সেক্সপ্লোশন
লেখক: Stanislaw Lem; অনুবাদ: কামিল শেৎচিন্সকি
শিল্পী: দীপ ঘোষ
স্তানিসোয়াভ লেমের একবিংশ শতাব্দীর পুস্তকমালা (১৯৮৬) থেকে:
সিমন মেরিল – সেক্সপ্লোশন
(ওয়াকের এন্ড কোম্পানি – নিউ ইয়র্ক)
আমরা যদি কল্পবিজ্ঞানের লেখকদের সম্পূর্ণ বিশ্বাস করে থাকি – এবং বর্তমানে তাঁদের উপর ভরসা রাখার যে আহ্বান বারবার শোনা যায় – তাহলে সম্প্রতি যে যৌনসংস্কৃতির আবির্ভাব দেখা দিয়েছে, তা আটের দশকের মধ্যে ভুবনপ্লাবী হয়ে যাবে। তবে “সেক্সপ্লোশন” উপন্যাসের সূচনা তার থেকে আরো বিশ বছর এগিয়ে, কঠোর শীতের তুষারাবৃত নিউ ইয়র্কে। একজন অজ্ঞাতনামা বৃদ্ধ বরফরাশির উপর দিয়ে ডিঙিয়ে, হিমধরা গাড়িসারির মধ্যে ঠোকা খেতে খেতে একটা প্রাণহীন বহুতলা ইমারতের সামনে পৌঁছোন। তারপর উনি কোটের পকেট থেকে চাবি বার করে ইমারতের লোহার ফটক খুলে ভূগর্ভস্থ ঘরে পাড়ি দেন। ওঁরএই পাতালবিহার এবং তার সাথে জড়িত বিচিত্র স্মৃতিচারণ এই উপন্যাসের মূল উপপাদ্য।
বৃদ্ধের কাঁপা হাতে টর্চের আলোয় খেলানো এই নিস্তব্ধ পাতাল হলটা জাদুঘর আর কোন মস্ত বানিকসঙ্ঘের অভিযাত্রীদের (বরং অভিগমনকারীদের) প্রদর্শনীর সংমিশ্রণের মতো লাগে।এ যেন যে সময় আমেরিকা পুনরায় ইউরোপের উপর আগ্রাসন শুরু করল, সেই সময়ে বানানো। মারকিনি ব্যাপক স্বয়ংক্রিয় উৎপাদন-ব্যবস্থার নির্দয় চলনের সাথে পাল্লায় পিছিয়ে পড়ল ইউরোপীয়দের আধা কারিগরি কারখানা এবং ক্রমশ এই বিজ্ঞান-প্রযুক্তিসম্মত উত্তর-শিল্পায়ন যুগেরদানবের কাছে হার মানতে বাধ্য হল। রণক্ষেত্রে মাত্র তিনটে বানিকসভা বাকি রইল – জেনেরল সেক্সোটিক্স, সাইবোরডেলিক্স এবং লাভ ইনকর্পোরেটেড । যখন এই মহাকায়দের উৎপাদন তুঙ্গে উঠেছিল, তখন সেক্স ব্যক্তিগত বিনোদন, গণক্রীড়া, সৌখিন আর অপটু চর্চাকারীদের জায়গা ছেড়ে একটা সভ্যতাব্যাপী দর্শনে পরিণত হল। ম্যাক-ল্যাহান যিনি বৃদ্ধ হলেও তখনো কর্মঠ ছিলেন, তিনি তাঁর “কামতন্ত্রে” প্রমাণ করে দেখিয়েছিলেন, যে যবে থেকে মানুষ প্রযুক্তির পথে অবতীর্ণ হয়েছে তবে থেকেই এই পরিণাম তার কপালে আঁকা ছিল। তিনি দেখালেন যে দাঁড়ে বাঁধা প্রাচীন কালের নাবিকেরা, সুদূর উত্তরের সেই করাত-ধরা কাঠুরেরা, স্টিভেনসনের সেই বাষ্পচালিত কল, তার বেলন ও চাপদণ্ড সমেত –এদের চলনের ছন্দ, রূপ আর ভঙ্গির অর্থই যুগ যুগ ধরে মনুষ্য সংগমকে অস্তিত্বের অন্যতম কারণরূপে প্রতিষ্ঠা দিয়ে এসেছে। মার্কিন মুলুকের নৈর্ব্যক্তিক শিল্পোৎপাদান প্রাচ্য ও পাশ্চাত্ত্যের বুদ্ধি-বিদ্যে গোগ্রাস করার পর, মধ্যযুগীয় সংরক্ষণ থেকে অ-সতীত্বের বন্ধন তৈরি করেছে, শিল্পকলাকে মৈথুক, কামুকা, লিঙ্গদোর, যোনিভর, জঠরানি, পানুকিদের নির্মাণের কাজে নিযুক্ত করেছে, বিশাল বিশাল সৃষ্টিহারা কনভয়ারে উৎপন্ন হতে লেগেছে সংগো গাড়ি, ধর্ষযান, ঘরোয়া ধর্ষকল আর সর্বজনীন কামালয়। এছাড়া এমন গবেষণাকেন্দ্র তৈরি হল, যেগুলো প্রজননের দায়িত্ব থেকে মুক্ত সমাজের নির্মাণে প্রবৃত্ত হল।
সেক্স আর কোন ফ্যাশন নয়, এখন এটা একটা ধর্ম, যৌনতৃপ্তি মানে নিত্যকর্ম, লাল তীরমুখওয়ালা যৌনতৃপ্তিমাপন মিটারগুলো সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ল, টেলিফোন ঘরের জায়গা কেড়ে নিয়ে। কিন্তু সেই পাতালহলের বিহারকারী বৃদ্ধটি তাহলে কে? ‘জেনেরল সেক্সোটিক্সে’র মুখ্য উকিল? তাই বুঝি উনি স্মরণ করছেন হাইকোর্ট ছোঁয়া সেই নামি-দামি মোকদ্দমা, ম্যানেকিন দিয়ে প্রসিদ্ধ ব্যক্তিদের রূপচেহারা নকল করানোর সেই অধিকার-আন্দোলন ( মারকিনি রাষ্ট্রপতির পত্নী ছিলেন যার প্রথম শিকার !)। প্রসঙ্গত, ১২ মিলিয়ন ডলারের খরচে ‘জেনরল সেক্সোটিক্স’ জিতেওছিল। এখন টর্চের ভোলা আলোতে ধুলো-পড়া অগুনতি প্ল্যাস্টিক ঝুড়িতে হলিউডের তারকা ও উচ্চমহলের নায়িকাদের, ভূষিত রানি ও সজ্জিত রাজকুমারীদের চিরসুন্দর চেহারা দেখা যায় – কোর্টের রায় অনুসারে বাহ্যিক যথাশ্লীলতা বজায় রেখেতাঁদের প্রদর্শন করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল।
মাত্র এক দশকের মধ্যে সিনথেটিক সেক্স প্রথমে ফুঁতে-ফোলানো ও স্প্রিং লাগানোমডেল থেকে স্বয়ংক্রিয় শীততাপনিয়ন্ত্রিত ও তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়াসম্পন্ন প্রোটোটাইপে পৌঁছে গেল । তাদের আসল শরীর অনেক দিন আগে হয় মরে গেছে, নয় বুড়ো হয়ে গেছে, কিন্তু টেফ্লোন, নাইলোন, ড্রালোন আর সেক্সোফিক্স কালপ্রবাহকে জিইয়ে রাখল। মোমপুতুলের জাদুঘরের মতো টর্চের আলোয় আভিজাত মহিলারা পথভোলা বুড়োর দিকে অনড় হাসি হাসতে থাকে। প্রত্যেকেরই হাতে রাখা একটা টেপরেকর্ড, যার মধ্যে মুদ্রিত হয়েছে তাদের মনমোহিনী গান (হাইকোর্টের আদেশে টেপ-বসানো ম্যানেকিন বেচার উপর মানা ছিল, তবে খদ্দের তার পছন্দমতো ব্যক্তিগতভাবে রেকর্ডিং পুরতে পারত)।
নিঃসঙ্গ বৃদ্ধের ধীর পদচারনায় উঠতে লাগল ধুলোপর্দা। তার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছিল সমবেত মৈথুনের গোলাপি দৃশ্যরাশি, কোনো কোনো ক্ষেত্রে এমনকি তিরিশজন পর্যন্ত অংশগ্রহণকারী, যেন বিশাল ছানার জিলিপি বা আদরের সঙ্গে পেঁচানো অমৃতির মতো শুয়ে ছিল। হয়তবা জেনরল সেক্সোটিক্সের স্বয়ং অধিকর্তা কামালয় আর আরামদায়ক ধর্ষকলের মধ্যে পায়চারি করছেন? নতুবা কোম্পানির সেই প্রধান ডিজাইনার, যিনি আমেরিকা আর তার পরে সারা দুনিয়াকে যৌনাঙ্গের ছাঁচে ফেলে দিলেন? এই যে সেই দূরনিয়ান্ত্রক পরিচালিত দৃশ্যাবলী আর অনুষ্ঠান, সীলমোহর দিয়ে সেন্সর করা, যে সেন্সরের জন্যে ছয়টি বিরাট মামলা লড়া হয়েছিল। এই যে ভিনদেশে পাঠানোর জন্য তৈরি করে রাখা রকমারি বয়াম – জাপানি বল, ডিলডো, পূর্বরাগের মলম জাতীয় হাজারো পণ্যতে ভরাট। প্রত্যেকটিতে নির্দেশাবলীর ফর্দ এবং হেল্পবুক সংযুক্ত।
সেটা শেষাবধি বিধ্বস্ত গণতন্ত্রের দিনকাল ছিল: সবাই সবকিছু করতে পারত – সবার সাথে। বনিকসঙ্ঘগুলো তাদের নিজের পোষা ভবিষ্যৎবিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী, একচেটিয়া-বিরোধী আইন টপকে, চুপিচুপি করে বিশ্বের বাজার ভাগ করে নিল। এখন তিনটে কোম্পানি এক একটা বিশেষ ক্ষেত্রের উপর থাবা বসাল। জেনেরল সেক্সোটিক্স যৌনবিকারের মুক্তি-আন্দোলন চালাচ্ছিল, যখন বাকি দুটো কোম্পানি যৌনতার স্বয়ংক্রিয়করণের পিছনে ফলাও করে টাকা ঢালছিল। মর্ষকামের ধারালো চাবুক, শৃঙ্খলও অন্যান্য ব্যবহারিক দ্রব্যেরপ্রোটোটাইপ জনগনকে দেখিয়ে বোঝানো হল এই সবে শুরু, কেননা বিশাল ইন্ডাস্ট্রি হতে গেলে শুধু চাহিদা মেটালে চলবে না, চাহিদা সৃষ্টিও করতে হয়! ঘরোয়া যৌনতা আর লালসার সাবেকি যত যন্ত্রপাতি, সেগুলি চকমকি-পাথর আর নিয়াণ্ডাথালের গদার পাশেই জমা দেওয়া উচিত এখন। পণ্ডিতমণ্ডলী ছ’-আট বছরের কোর্স এবং তুলনামূলক রমণরীতির উচ্চবিদ্যালয়ের পাঠক্রম তৈরি করে ফেললেন, উভয় লিঙ্গেরই জন্যে। বাজারে এলোস্নায়ু-উদ্দীপক যৌনযন্ত্র, তারপরে বিশেষ গলবন্ধ, শব্দ অপরিবাহী বস্ত্রাদি,বিশেষ ধরণের শব্দদমনকারী সিমেন্ট, যাতেপাড়া-পড়শিরা উদ্দাম যৌন শীৎকারের উদ্ভ্রান্ত চেঁচামিচিতে একে অপরের শান্তিহানি না করে।
তবুও এগিয়েই চলতেই হল এই দুঃসাহসী অবিরাম দৌড়ে, কারণ স্থবিরতা মানেই উৎপাদনের মরণ। ব্যক্তিগত উপভোগের জন্য দেবলোক পরিকল্পিত হচ্ছিল। সাইবরডেলিক্সের ঝলসানো বিজ্ঞাপনে দেখাচ্ছিল ঝকঝকে প্লাস্টিকের প্রথম গ্রীক দেবদেবীদের ঐশ্বর্যময় যন্ত্রমানবগুলো। ফেরেশতা-দেবদূতদের নিয়ে কথাও উঠেছিল – এমনকি গির্জার সঙ্গে মামলা করার জন্য বিশেষ আমানত বরাদ্দ করা হয়েছিল; যদিও কিছু প্রযুক্তিগতবিষয় এখনও মীমাংসা পায়নি: ডানাগুলি কিসের হলে ভালো হত? আসল পালক তো কারো নাকে চুলকোতে পারে? আবার বেশি নড়াচড়া করলে কি এতে যৌনক্রীড়ার লীলায় অসুবিধে হতে পারে? মাথার উপর দেবজ্যোতিটা নিয়ে কি হবে? তাকে চালু আর বন্ধ করার ব্যবস্থা কোথায় থাকবে? ইত্যাদি ইত্যাদি। ঐ সময় বিপর্যয় নেমে এলো।
একটি রসায়নিক পদার্থ (বোধ হয় সত্তর দশকে) আবিষ্কৃত হয়েছিল, যার সাংকেতিক নাম ‘কামনাশক’। তার অস্তিত্ব সম্বন্ধে শুধুমাত্র মুষ্টিমেয় ধুরন্ধর বিশেষজ্ঞই জানতেন। এই পদার্থটি একটা গুপ্তঅস্ত্র বলে পরিচিত ছিল এবং তার তৈয়ারি একটি ছোট পেন্টাগন-সংশ্লিষ্ট কোম্পানির কীর্তি। বাস্তবপক্ষে, গ্যাসীয় অবস্থায় ‘কামনাশক’ যে-কোন দেশের জনসংখ্যার বৃদ্ধি শূন্যের ঘরে নামাতে পারে, কেননা এই বাতাসের সাহায্যে ছড়িয়ে পড়া গ্যাসটি যৌনক্রিয়ার যাবতীয় অনুভূতি নিমেষের মধ্যে নিঃশেষ করতে পারে। কার্যত, সংগম তখনও সম্ভব হলেও তা কোন শ্রমসাধ্যকাজের মতো ক্লান্তিকর হয়, যেমন কাপড় কাচা, নিংড়ানো, ইস্তিরি করা বা মাটি খোঁড়া। কামনাশক দিয়ে তৃতীয় বিশ্বের জনবিস্ফোরণ রুদ্ধ করার প্রস্তাবও এসেছিল, কিন্তু তাকে বাতিল করতে হল অতিরিক্ত বিপদজনক বলে।
দুনিয়াব্যাপী এই সর্বনাশ কি করে হল, তা ঠিক জানা নেই। সত্যি কি কামনাশক গুদামগুলো ফেটে উড়ে গেছিল কোন বৈদ্যুতিক গোলমালে আর ইথারের ট্যাঙ্কে আগুন লেগে যাওয়ার ফলে? এতে কি একচেটিয়া তিনটে কোম্পানির কোন শত্রুর হাত ছিল? নাকি এটা কোন উগ্রপন্থী, রক্ষণশীল বা ধর্মীয় দলের ষড়যন্ত্র? এই প্রশ্নটি নিরুত্তরই থেকে যাবে।
ভূগর্ভের গোলকধাঁধায় পথ হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত বৃদ্ধ প্লাস্টিকের ক্লিওপেট্রার মসৃণ কোলে বসে (আগেই যন্ত্রটিকে বন্ধ করে নিয়েছিলেন) স্মৃতিসাগরে পাড়ি দিলেন ১৯৯৮ সালের বিপুল আর্থিক ও সামাজিক সঙ্কটের সময়ের দিকে। রাতারাতি সব লোক বাজার-ঠাসা যৌনক্রিড়ার মালপত্র ঘৃণার সঙ্গে পরিত্যাগ করেছিল। গতকাল যা যা রিরিংসা জাগাত, আজ সেসব যেন শ্রান্ত কাঠুরের কুড়াল, অথবা ধোবীর জন্য ভাটির মত ঠেকে। প্রকৃতি মানবজাতিকে এদ্দিন যাবত যে চিরন্তন মোহে, জাদুর কব্জায় রেখেছিল, তা কোনও চিহ্ন না রেখে মুছে গেল। এখন থেকে স্তন দেখে খালি এই কথা মনে পড়ে যে মানুষ স্তনপায়ী, পা – দ্বিপদচারী, পাছা – বসার বালিশ। আর কিছু না, তার বাইরে আর কিছুই না! ম্যাক-ল্যাহান যে এই দুঃসময় অবধি বাঁচেননি, তাঁর ভাগ্য ভালো। পুরোনো দূর্গ আর মহাকাশযান, জেট-ইঞ্জিন, ট্যারবাইন, বায়ুকল, নুনদানি, টুপি, আপেক্ষিকতাতত্ব, অঙ্কের বন্ধনী, শূন্য ও বিস্ময়ক চিহ্ন, এই সব কিছুকেই তিনি অস্তিত্বের একমাত্র চরম সত্যের প্রতিনিধি ও প্রতীক হিসেবে ব্যখ্যা করেছিলেন। ।
তাঁর যুক্তিপরম্পরা অর্থহীন হয়ে গেছিল সামান্য কয়েক ঘন্টার মধ্যে। যখন মানবজাতি নিঃসন্তান হয়ে সম্পূর্ণ বিলোপের সম্ভাবনার সামনে দাঁড়িয়েছে। দুনিয়াব্যাপী আর্থিক সঙ্কট দিয়ে তার শুরু হল, যার তুলনায় ১৯২৯ সালের মন্দা যেন শিশুদের পুতুলখেলাই। প্রথমেই “প্লেবয়”-এর সম্পাদকমণ্ডলী সমেত গোটা প্রকাশনাটাই হাওয়া হয়ে গেল; অনাহারে বা বহুতলের জানলা দিয়ে লাফিয়ে মরে গেল স্ট্রিপ-ক্লাবের কর্মীরা; দেউলে হয়ে পড়ল সচিত্র বড়দের পত্রিকাগুলি, সিনেমার কোম্পানি, বিজ্ঞাপনের অফিস, রূপচর্চাকেন্দ্র, তলিয়ে গেল সৌন্দর্য-সৌগন্ধরে কারবার, তারপর অন্তর্বাসের ব্যবসা – ১৯৯৯ সালে আমেরিকার বেকারত্বের সংখ্যা দাঁড়াল প্রায় সাড়ে তিন কোটি।
এবার কোম্পানিগুলি জনগনের মন ভোলাবে কি দিয়ে? তলপেটে পড়ার বেল্ট, পিঠের নকল কুঁজ, পাকা পরচুলা, বিকলাঙ্গের হুইলচেয়ারে বসা কাঁপো কাঁপো চেহারা – অন্তত যেগুলো দেখে যৌনকার্যের শ্রমের উৎপীড়ন, সেই অপ্রাকৃতিক নির্যাতন ভোলা সম্ভব। শুধু এই ধরণের জিনিসপত্রই কামোত্তেজনা থেকে নিরাপত্ততা বজায় রাখতে পারে, আর তার অর্থ বিশ্রাম ও শান্তি। সব দেশের সরকার বিপদের গুরুত্ব বুঝে মানবজাতীর সংরক্ষণ করার উদ্দেশ্যে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করেবসল। খবরের কাগজের পাতায় পাতায় বিবেক ও দায়িত্ববোধের জন্য ঘোষণা পড়া শুরু হল, টিভিতে সব ধর্মের প্রচারকেরা উচ্চতম বাক্কৌশল খাটিয়ে আধ্যাত্মিক মুক্তির জন্যে প্রজননক্রীয়ার কাছে আত্মসমর্পণ করার জন্য আহ্বান দিল। তবে এই বরেণ্যদের সমবেত গান জনসাধারণের কাছে পৌঁছল না। অনিহা কাটানোর জন্য যাবতীয় ডাকাডাকি ও সম্প্রচার ব্যর্থ হল। ফল এতে খুব একটা ফলেনি: শুধুমাত্র বিশেষ দায়িত্ববোধের অধিকারী জাপানি জাতি দাঁত চেপে আদেশ অনুসরণ করে চলেছে। ঐ সময় বিশেষ আর্থিক সুবিধে, সম্মানপত্র, পারিতোষিক, সংবর্ধনা, মর্যাদাদান, স্বর্ণপদক, পুরস্কার ট্রফি আর উপগমের প্রতিযোগিতা শুরু হল প্রজনন পারদর্শীদের জন্যে। যখন এই খেলাটিও ফুরাল, তখন জোরজবরদস্তির পালা নামল। তবুও সমস্ত অঞ্চলেরই মানুষ প্রজননের দায়িত্বে ফাঁকি দিতে শুরু করল। কম বয়সী ছেলেমেয়েরা বনেজঙ্গলে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে রইল, বয়স্ক পুরুষ মহিলারা যৌন অক্ষমতার নকল সারটিফিকেট বের করে ফেলল। সামাজিক নিয়ন্ত্রনের সভাসিমিতির প্রাচিরে ফাটল ধরল ঘুষে, পাড়ায় মহল্লায় নজরদারি শুরু হল, নিজেকে যৌনক্রিয়া থেকে বাঁচানোর দায়ে পড়শিদের ফাঁকিবাজি নির্দেশ করার চল শুরু হল।
এখন ক্লিওপেট্রার কোলে বসা সেই বুড়োর কাছে এই দুর্বিপাকের সময় নেহাৎই স্মৃতি। মানবজাতি মরে যায়নি; বর্তমানে নিষিক্তকরণ একটা স্যানিটরি হাইজেনিক পদ্ধতিতে করানো হয়, খানিকটা টিকা নেওয়ার মতো। সেই কষ্টকর চরম পরীক্ষার দুর্ধর্ষ উদ্যোগপর্ব চুকিয়ে মানবসভ্যতার মোটামুটি একটা স্থিতিশীল অবস্থা ফিরেছে।
তবুও সংস্কৃতির কোন রকম ফাঁক সয় না; যৌনতার অন্তঃস্ফুরণের পর থেকে যে দুঃসহ্য অভাব খাঁ খাঁ করতে লাগল, তার শূন্যস্থানে পদোন্নতি পেল রন্ধনশিল্প। রান্নাবান্না এবার রসালো ও অতিরসালো ভাগ করা হল; ভোজকামিতা, রেস্তরাঁর ফুডপর্নের এ্যালবাম আর কোন কোন খাদ্যবস্তু সবিশেষ ভঙ্গিতে ভক্ষণ করলে অকথ্য অশ্লীল বলে মনে করা হয় তা সমাজে প্রতিষ্ঠা পেল। যেমন হাঁটু পেতে ফল খাওয়াটা চরম নিষিদ্ধ (আবার এইটুকু স্বাধীনতার জন্য হাঁটু-পাতা-পার্টি লড়াই করে), পা উঁচিয়ে শীর্ষাসন করে শাক বা ডিমের ভুজিয়া খাওয়াও নিষিদ্ধ। তাও আছে – থাকাই স্বাভাবিক! – কিছু গোপন হোটেল, যেখানে রসিক ও বিশেষজ্ঞদের জন্য নোংরামির মেলা পাতা আছে; সবার সামনে সুদক্ষ রেকর্ডমারি পেটুকেরা এমন গিলেঠুসে খায় যে দর্শকদের মুখ থেকে লালা পড়ে। ডেনমার্ক থেকে ফুডপর্নের নীলবইয়ের পাচার হয়, যেগুলির মধ্যে বিকৃতির একশেষ- একজন নাকি স্ট্র দিয়ে ডিমের ভিতরটা শুষে খায়, যখন আর একজন টেবিলের উপর শুয়ে, গায়ে টেবিল ক্লথ মুড়ে, ঝাল-রসুন দেওয়া পুঁইশাকে আঙুল ডুবিয়ে কেপ্সিমাখা পর্ক-ইস্টুর ঘ্রাণ আস্বাদন করে নিতে থাকে আর তার দু’পা দড়ি দিয়ে কফি মেকার বাঁধা, যা এই বেলেল্লাপনার দৃশ্যে ঝাড়বাতির বদলে ব্যবহার করা হয়েছে। এই বছরের যে উপন্যাস ফেমিনা পুরস্কার পেয়েছে তার প্রধান নায়ক ট্রুফলের লেই দিয়ে তার মেঝেটা মাখিয়ে চেটে চেটে উপভোগ করে, পূর্বে আকণ্ঠ স্পাগেত্তির মধ্যে লুটোপুটি খেয়ে। রূপচেহারার আদর্শও পাল্টে গেছে: এখন ১৩০ কেজির স্থূল শরীর রাখা কাম্য, এতে প্রমাণ পায় পাকস্থলির মজবুতি। ফ্যাশন-কায়দার ক্ষেত্রে অদলবদল এল: পোশাকআশাক দেখে স্ত্রী না পুরুষ চেনা ভার। মুষ্টিমেয় অগ্রগন্যদেশের সরকারে এই আলোচনা চলছে, স্কুলে বাচ্চাদের পাকতন্ত্রের নিগূঢ় তত্ব শেখানোর আদৌ কি কোন সম্ভাবনা আছে? এযাবৎ এই প্রসঙ্গটি অশ্লীল বলে বিবেচিত হয়ে এসেছে।
শেষমেশ জীববিজ্ঞান লিঙ্গভেদ পুরোপুরি মুছে ফেলার পথে অতীর্ণ হয়েছে – অন্ধকার যুগের প্রাগৈতিহাসিক অবশেষ। ভ্রূণ এখন থেকে কৃত্রিম পদ্ধতিতে জন্ম দেওয়া হবে এবং জৈবিক প্রকৌশলে বড় করা হবে। কাজেই মানুষ থাকবে সম্পূর্ণ লিঙ্গরহিত। এতেই যৌনতানাশের বিভীষিকাময় দুঃস্বপ্ন থেকে রেহাই পাবে মানবজাতি। সমুজ্জ্বল পরীক্ষাগারে, সেই প্রগতির দেবালয়ে, সৃষ্ট হবে অর্ধনারীশ্বর, অথবা বলা উচিৎ নরনারীত্বহীন নতুন মানুষ, এবং অন্তিমে মানবজাতি সাবেকি কালিমা থেকে মুক্ত হয়ে সেই নিষিদ্ধ ফলের স্বাদ নিতে পারবে – অবশ্যই এখানে রন্ধনরীতি সংক্রান্ত নিষিদ্ধই বোঝানো হচ্ছে।
সম্পাদনাঃ দীপ ঘোষ
Tags: kalpabiswa y7n1, Stanislaw Lem, কামিল শেৎচিন্সকি, দীপ ঘোষ, স্তানিসোয়াভ লেম