গুপ্ত ইরাবতী
লেখক: সর্বান বন্দ্যোপাধ্যায়
শিল্পী: দীপ ঘোষ
।১।
১৮/৮/২২৪৫
“রুনু, এই রুনু…”
ধড়মড় করে ঘুম থেকে উঠে বসলাম। দেয়ালের খুদে পর্দাটায় মায়ের ছবিটা ভাসছিল। ঘুরে তাকাতে হেসে বলে, “শিগগির ওঠ। দৌড়ে লাউঞ্জে যা। নইলে মিস করবি।”
তাড়াহুড়ো করে সাফসুতরো হয়ে লাউঞ্জে গিয়ে দেখি ততক্ষণে খুব ভিড় হয়ে গেছে সেখানে। মাইকে অ্যানাউন্স করছিল, “গোলন্দাজ টিম নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে গেছে। আর চার মিনিটের মাথায়…”
অমনি আমি ভিড় ঠেলেঠুলে একেবারে জায়েন্ট স্ক্রিনের সামনে। এখানটা ভিআইপিদের জায়গা। সিটগুলো তুলতুলে ভেলভেটে মোড়া। সামনে পর্দা জুড়ে ইরাবান নামের তারাটার হলদেটে শরীর জ্বলছে। ওটা মায়ের ভেলার ক্যামেরার ছবি। আমি জানি। স্ট্রাইকারদের দলটার একদম সামনে রয়েছে মায়ের ভেলা।
হঠাৎ পর্দা জুড়ে মায়ের মুখটা ভেসে উঠল, “আমরা প্রস্তুত।”
“নিশানা?” ভেলভেটে মোড়া সিটগুলোর একটা থেকে প্ল্যানেটিয়ার শিপ-এর ক্যাপ্টেন উমেদ সিং-এর ভারী গলাটা প্রশ্ন করল।
“নির্দিষ্ট আঘাত-বিন্দুতে নিশানা বাঁধা হয়েছে।”
“ট্র্যাক্টর টিম?”
“তৈরি।”
পর্দায় ইরাবানকে ঘিরে চল্লিশটা আলোর ফোঁটা জেগে উঠেছে। ওরা মায়ের টিম। চল্লিশটা ভেলা। তাদের থেকে এগিয়ে আসা চল্লিশটা আলোর দাগ ইরাবানের শরীর থেকে অনেকটা দূরে একটা দপদপে সবুজ বিন্দুতে এসে মিলে গিয়েছে।
“সাঙ্ঘাতিক সাহসী মহিলা! স্টার বম্বিং-এর মত বিপজ্জনক কাজে স্বেচ্ছায়…” ভেলভেটের চেয়ারগুলো থেকে আরেকটা গলা ভেসে এল। মিশন ডিরেক্টর সামিরা। কাজটার জন্য মায়ের ভিডিও ইনটারভিউ নিয়েছিলেন। বিধাননগর ‘গরিব আশ্রয়’-এর লঝঝড়ে কমিউনিকেশন সেট-এ ওঁর সম্ভ্রান্ত চেহারাটা দেখে, কথাবার্তা বলতে মা ভারি সঙ্কোচ করেছিল প্রথমে। সেটা অবশ্য স্বাভাবিক। কোথায় উনি, আর কোথায় মা! অ্যাস্টেরয়েড মাইনিং কোম্পানির সাধারণ গোলন্দাজ! মন্দার বাজারে সে-চাকরিটাও তখন গেছে। ‘গরিব আশ্রয়’-এর বিনিপয়সার ডর্মিটরিতে মা-মেয়েতে মাথা গুঁজে আছি। ইনটারভিউয়ের জন্য পাশের বাঙ্কের পলিমাসীর থেকে একটা ভালো জামা ধার করেছিল মা।
সামিরা বলেছিলেন, “লেজার কামান দিয়ে গ্রহাণু ভাঙা আর স্টার-বম্বিং এক কাজ নয়। এতটুকু ভুলচুক হলে পুড়ে ছাই হয়ে উড়ে যাবে। তোমার দক্ষতা আছে। কিন্তু সাহস আছে কি?”
মা মাথা নেড়ে শুধু বলেছিল, “আছে।”
সেদিন রাতে আমি মাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলাম, “তুমি কাজটা নিও না মা। যদি কিছু…”
মা হেসে বলেছিল, “কেন যাচ্ছি জানিস? ওখানে যে গ্রহটা তৈরি করা হবে, ফার্মের কর্মীদের জন্য সেখানে অনেক কম দামে ফ্ল্যাট দেবে বলে লিখেছে বিজ্ঞাপনে। আমরা আমাদের নিজের তৈরি গ্রহে থাকব। মাটির ওপরের বাড়িতে।”
“মাটির ওপরে? ধ্যাত! শহর তো সমুদ্রের নীচে হয়। যেমন আমাদের এই নিউ ক্যালকাটা।”
মা কথা না বলে ভিউস্ক্রিনে একটা পুরনো বই জুড়ে দিয়ে বলেছিল, “আমার ঠাকুরদার যিনি ঠাকুরদা, এটা তাঁর ডায়েরি। দ্যাখ। তিনশো বছর আগে এইটা আমাদের বাড়ি ছিল। মানুষ আসলে মাটির ওপরেই থাকত।”
পর্দায় ভেসে ওঠা ছবিগুলো দেখে কী ভালোই যে লেগেছিল! পাহাড়ের ঢালে পাইন বন। বনের ফাঁকে একটা ছোট্ট কটেজ… পখিদের ওড়াউড়ি…
“আমি মায়ের কাঁধে মুখটা লুকিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, “ঐ গ্রহটাতেও এইরকম অনেক গাছ থাকবে?”
“হুঁউ।”
“পাখি?”
“অনেক”
সেদিন অনেক রাত অবধি আমরা গল্প করেছিলাম। কাজটা মা পেয়ে গিয়েছে। পরদিন ‘গ্রহ-কারিগর’-এর অফিসে হাজিরা। সেখান থেকে বিশাল প্ল্যানেটিয়ার শিপ-এ ইরাবানের দিকে রওনা। আমাকেও নিয়ে যাবে।
আমি কখনো খোলা আকাশ দেখিনি। মহাকাশ তো দূরের কথা। তাই উত্তেজনায় আমার ঘুম চলে গিয়েছিল। আর মায়ের তো হাজারটা গোছগাছ।
***
মায়ের মুখটা ফের পর্দায় ফিরে এসেছে। ভেলার ফোর্স ফিল্ডের ঢাকনার বাইরে ইরাবানের লকলকে আগুন। মা শান্ত গলায় বলে যাচ্ছিল, “ট্র্যাক্টর এক…”
“…তৈরি…”
ট্র্যাক্টর দুই…”
“…তৈরি…”
হঠাৎ আমার এমন গর্ব হল কী বলব! সামনের লাল ভেলভেটের চেয়ারটার ওপর দিয়ে উঁকি মেরে বললাম, “ওটা আমার মা।”
অমনি চেয়ারটা থেকে একটা বুড়োমত লোক পাশে দাঁড়ানো সিকিউরিটির লোকটাকে ইশারা করল। লোকটা খুব মুশকো। আমার ঝুলিয়ে তুলে নিয়ে একেবারে পেছনে নামিয়ে দিয়ে বলে, “তুই ফোর্থ ডেক-এর মেয়ে না? ফের যদি ভিআইপি জোন-এ দেখেছি…”
আমি মুখ নিচু করলাম। “মাফ করবেন, স্যার, আর করবো না।” নাকে একটা ঘোঁৎ শব্দ করে সিকিউরিটি নিজের জায়গায় ফিরে গেল।
ডিঙি মেরে উঁচু হয়ে সামনের স্ক্রিন দেখার চেষ্টা করলাম। এতদূর থেকে মেরেকেটে উপরের আধখানা দেখা যাচ্ছে। তাই বা কম কী! আশেপাশে আমার বয়সী বেশ কিছু ছেলেমেয়ে তাদের বাবা মায়ের কোলে চড়ে হাঁ করে পর্দাটাকে যেন গিলতে চাইছে। আমাকে কেউ কোলে নিচ্ছে না; নেবেই বা কেন? সত্যিই তো, ফোর্থ ডেকের আর একজনও লাউঞ্জে আসেনি। আমাকে নেহাত তাড়িয়ে দেবে না হয়তো, কিন্তু এদিক সেদিক তাকাতে গিয়ে যতজনের সঙ্গে চোখাচোখি হল, বুঝলাম প্রত্যেকেই আমাকে দেখে খুব বিরক্ত হচ্ছে।
কী মুশকিল, কতজনের কাছে ক্ষমা চাইবো? এতজনের বিরক্তি মনের মধ্যে খোঁচাতে থাকলে ঐ আধখানা স্ক্রিনেরও কিছু আমি শান্তিতে দেখতে পারবো না। ওদিকে স্পিকারে মায়ের গলায় “ট্র্যাক্টর বাইশ”, “ট্র্যাক্টর তেইশ” শুনতে পাচ্ছি। মানে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ইরাবানের উপর হামলা আরম্ভ হবে। লাউঞ্জে জড়ো হওয়া ফার্স্ট, সেকেন্ড আর থার্ড ডেকের লোকজনের বিরক্তিতে দম বন্ধ হয়ে আসছিল আমার। কোনোমতে সবাইকার দিকে একটা ক্ষমা চাওয়ার সেলাম ছুঁড়ে দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগলাম।
নামার মুহূর্তেই টের পেলাম উপর থেকে কেউ কেউ আমাকে সন্দেহ করছে। ভয় পেয়ে গেলাম খুব। ঘোরানো সিঁড়ির মাঝের থামে ভর দিয়ে কিছুটা লাফিয়ে, কয়েকটা সিঁড়ি টপকে ফোর্থ ডেকে নামতে লাগলাম। এমন সময়ে উপরে হাঁকডাকের আওয়াজ পেলাম। পায়ের শব্দে বুঝলাম সিঁড়ি বেয়ে কেউ আমার পিছু নিলো। আমার পিছনে কাউকে পাঠানো হয়েছে। ব্যাপার গুরুতর।
ফোর্থ ডেকে নেমে দেখি এই জাহাজেরই ক্যামেরা ফিড স্ক্রিনের সামনে সবাই জটলা করে আছে। স্ক্রিনের বাঁ দিক ঘেঁষে ধকধক করছে ইরাবান। ডানদিকে একটা অদৃশ্য বৃত্তের চল্লিশটা বিন্দু থেকে চল্লিশটা আলোর সুতো এসে মিলেছে সবুজ আলোর এক গোলকে। জাহাজের গায়ে লাগোয়া এই ক্যামেরা, তাই ট্র্যাক্টরগুলোকে ঠাহর করা যাচ্ছে না। আমি জানি আমার মায়ের ভেলা রয়েছে ঐ বৃত্তের ঠিক মাঝখানে। এই ক্যামেরায় সেটাও অদৃশ্য।
শান্ত মহাকাশের একঘেয়েমির চেয়ে এই দৃশ্য অনেক বেশি রোমাঞ্চকর, তাই ডেকে নেমেই মন্ত্রমুগ্ধের মতো স্ক্রিনে আটকে গিয়েছিলাম। লুকিয়ে পড়ার তাগিদটাও ইরাবান আর ঐ সবুজ গোলক দেখে মাথা থেকে উবে গিয়েছিল। তাছাড়া এখানে কেউ আমাকে দেখে নাক সিঁটকোয় না। আমি এদের সঙ্গেই থাকি। সেই শান্তিটাও ছিল। তাই বুঝতে পারিনি আমাকে ধাওয়া করে আসা সিকিউরিটিবাবু কখন আমার ঠিক পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে।
মা স্ক্রিন থেকে “ট্র্যাক্টর আটত্রিশ” বলার সঙ্গে সঙ্গে একটা শক্ত হাত আমাকে কোলপাঁজা করে তুলে নিলো। আমি চিৎকার করলাম, কিন্তু মুখ দিয়ে একটা “আঁক” বেরোতে না বেরোতেই আরেকটা হাত আমার মুখ চেপে ধরল। সামনের জটলার মানুষেরা চমকে পিছন ফিরে তাকাল। ধৃতিমান, ওরিহারা, রামোনা, আর বাকিরা সবাই তাকিয়ে রইলো। কিন্তু কেউ আমাকে ছাড়িয়ে নিতে এলো না।
সিকিউরিটিবাবু এরকম আশা করেনি। তাই একটু যেন তটস্থ হয়ে গেল। ওর গায়ে কেউ হাত দিতে যাবে না বটে, কিন্তু কেউ কৈফিয়ত অবধি চাইছে না এটা একটু বেশি অস্বাভাবিক।
মুহূর্তের আড়ষ্টতা। তারপরেই চটকা ভেঙে আমাকে নিয়ে দুদ্দাড় করে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগলো। একই সঙ্গে উপর আর নিচের সবকটা ডেক ভেসে গেল তীব্র সবুজ আলোয়। বুঝলাম, স্টার বম্বিং আরম্ভ হয়েছে।
।২।
প্ল্যানেটিয়ার শিপে রওনা হওয়ার দিন আমার হাতে সকাল এগারোটা পর্যন্ত সময় ছিল। গরিব আশ্রয়ে মায়ের সহকর্মীদের দাতব্য স্কুলে তাদের ছেলেমেয়েদের সঙ্গেই আমি পড়তাম। তাদের মধ্যে মাত্র চার জন আমাদের সহযাত্রী হবে। মায়ের টিমের বাকি সদস্যরা আসবে দেশের অন্যান্য জায়গা থেকে, যদিও কাজের সূত্রে তারা প্রত্যেকেই মায়ের চেনা। আমি তাই দেখা করতে গিয়েছিলাম স্কুলের তিনজন বন্ধুর সঙ্গে, যারা আমাদের সঙ্গে আসতে চাইলেও তাদের বাবা-মায়েরা যথেষ্ট সাহস দেখাতে পারেনি। মা আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল, ওদের সঙ্গে হয়তো আর আমাদের সামনাসামনি দেখা হবে না। বা হলেও হবে অনেক, অনেক বছর পর।
এ’কথা গোলতু, মেহতাব, আর রামসাগরও বুঝতে পেরেছিল। গোলতু আর রামসাগর আমাকে জড়িয়ে ধরে অনেক কান্নাকাটি করলো। গোলতু দিলো একটা ছোট্ট ঝিনুকের প্রাসাদ, আর রামসাগর নিজের রামচরিতমানস রিডারটাই আমাকে দিয়ে দিলো। আমি জানি বই বলতে ওর নিজের আর কিছুই নেই; আমারও ওকে টাটা করে আসার সময় বেশ কান্না পাচ্ছিল।
মেহতাব অবশ্য দুঃখ করলো না; বরং বেশ খুশি । আমাকে বলল, “রুনু, নতুন গ্রহ বানালে তোদেরকে ওখানে ফ্ল্যাট দেবে দেখলাম। সেসব বিক্রি করে দিলে অনেক টাকা পাবি। তখন এখানে ফিরে আসিস। রঙ্গনা আন্টির টিমের আমরা সবাই বাঁকুড়া চলে যাবো।”
আমি বললাম, আমরা তো ওখানকার ফ্ল্যাটেই থেকে যাবো। মেহতাব বলল তোরা কি পাগল? তোদের ফ্ল্যাটগুলো অনেকদিন ঘুপচি কাঁচের বাক্সে থাকবে। টেরাফর্মিং করতে সময় লাগে। আমি বললাম, মা বলেছে ওখানে গাছপালা থাকবে, পাখি… মেহতাব বলল উফ, সেসব তো প্রথমে চিড়িয়াখানায় রাখবে। টেরাফর্মিং শেষ না হলে বাইরে ছাড়বে কি করে?
টেরাফর্মিং আমি ভালোই বুঝি। নিউ ক্যালকাটার গম্বুজ টেরাফর্মিং করেই আমাদেরকে বাঁচিয়ে রাখে। সমুদ্রের জল থেকে অক্সিজেন টানে, বাড়তি কার্বন ডাই-অক্সাইড সমুদ্রে ছেড়ে দেয়। গাছপালার দরকার হয় না, তবু চোখকে আরাম দিতে কয়েকটা কালচে সবুজ ঘাসের মাঠ আছে। জন্তুজানোয়ার, পাখিরও দরকার নেই। পোষা কুকুর বিড়াল রাখলে তাদের অক্সিজেনের খরচ দিতে হয়। খুব বড়লোক কেউ কেউ তাদের পোষে।
আমাদের মাথার অনেক উপরে, গম্বুজের বাইরে চক্কর কাটছিল ঝাঁকে ঝাঁকে মাছ। আমাদের চারপাশে সকালের ফ্যাকাশে নীল আলোয় ঢেউয়ের ছায়া আর মাছেদের ছায়া মিলেমিশে যাচ্ছিল। ভাবলাম, ইরাবানের নতুন গ্রহের ফ্ল্যাট থেকে পাখিও দেখতে পাবো না, মাছও না। সত্যিই তো, এখানেই বেশ ভালো আছি। মেহতাবের মতো বাঁকুড়া যাওয়ার ইচ্ছে অবশ্য আমার নেই। সেই কথা বললাম।
মেহতাব আমার কথা উড়িয়ে দিলো। “কি করে জানলি ডাঙায় খাবার নেই, জল নেই? নিজের ভিউস্ক্রিনে দেখেছিস তো? আমাদের স্ক্রিনে মিথ্যে দেখায়। আব্বুর স্ক্রিনে অনেক বেশি দেখায়। ডাঙায় এখন দারুণ ভালো অবস্থা। ওরা ভিড় বাড়তে দিতে চায় না তাই আমাদেরকে ভুলভাল দেখায়।”
“কিন্তু তোর আব্বু বা আমার মা তো এইসবই জানবে? ওদের স্ক্রিন তো বড়দের স্ক্রিন।” জিজ্ঞেস করলাম।
“হ্যাঁ, তাতে কি?”
“তাহলে ওরা কেন কখনো ডাঙায় যাওয়ার চেষ্টা করে না?”
মেহতাব হাসতে গিয়েও গম্ভীর হয়ে গেল।
আমি ডর্মিটরিতে ফেরার পরেই বাঁধাছাঁদা শেষ করে রওনা দেওয়ার পালা। সব জিনিস সঙ্গে নেওয়া যাবে না। জিনিস আমাদের খুবই অল্প, কিন্তু নিজেরই অবাক লাগলো যখন দেখলাম আমার ভাঙা রোবট, ছেঁড়া জামা এসব ফেলে যেতেও মন খারাপ করছে। পলিমাসীও কাঁদলো, অন্য রুমমেটরাও কমবেশি দুঃখ করলো। আমরা আমাদের বাসনকোসন অবধি নিলাম না। মা বলল, শিপে প্রচুর খাবারদাবার থাকবে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তাহলে হেলথ টনিকটাই বা নিচ্ছ কেন? মা বলল, জলের নিচে থাকলে হেলথ টনিক নাকি নিতেই হয়, আর, একবার অভ্যেস হয়ে গেলে আর নাকি ছাড়া যায় না। জিজ্ঞেস করলাম,
“ছাড়লে কি হয়?”
মা কিছু বলল না।
***
১৮/৮/২২৪৫
ভিআইপি লাউঞ্জ থেকে বেসমেন্ট পর্যন্ত একটা ফুটো করে বসিয়ে দেওয়া ঘোরানো সিঁড়ি। হুড়মুড় করে আমাকে পাকড়াও করা সিকিউরিটিবাবু লাউঞ্জে উঠে আসতে দেখলাম, চারদিকে লোকজন জড়ো হচ্ছে। তাদের সবার বিরক্তির ঢেউয়ে আবার আমার মাথা ঝিমঝিম করতে লাগলো, কিন্তু চোখ চলে গেল দূরে জায়ান্ট স্ক্রিনে। ইরাবানের বুকের মাঝে গিয়ে বিঁধেছে সবুজ, শান্ত আলোর একটা বল্লম। তারাটার সারা দেহ জুড়ে তোলপাড় চলছে, গেলাসের জলে চামচ দিয়ে নাড়া দিলে যেমন হয়। নিটোল গোল আকারটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মাঝখান থেকে একটা বেল্টের মতো একটু একটু করে ফুলে উঠছে ইরাবানের শরীর।
“এ তো আমাদের হেড স্ট্রাইকারের মেয়ে!” সামিরার গম্ভীর গলায় বিস্ময়ের ছাপ। আমি প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগলাম শুধু ওঁর দিকে মন দিতে। এখানে একমাত্র উনি আমাকে অপছন্দ করেন না।
“ওর হাত দেখুন! আমি নিশ্চিত দেখেছি…” পাশ থেকে একটা লোক ব্যগ্রভাবে বলল। আমি তার দিকে তাকালাম না। কিন্তু সিকিউরিটিবাবু যখন আমার হাতটা টেনে সবার সামনে খুলে ধরল, তখন নিজের হাতের দিকে তাকালাম।
হাতের চেটো বেগুনি হয়ে গেছে। মাঝখানে রংটা এখনো তেমন গাঢ় নয়; কিন্তু আঙুলের ডগাগুলো আমার দেখা রংচঙে কিছু মাছের গায়ের রঙের মতো বেগুনি হয়ে গেছে। কিংবা…
“ডঃ দাসকে ডাকো! আর ওকে নিচে মেডিক্যালে নিয়ে চলো।” সামিরা কাউকে আদেশ দিয়ে আমার সামনে হাঁটু মুড়ে বসলেন। “তোমার কোনও অস্বস্তি হচ্ছে?” আমাকে নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেছেন। কেন জানি আমার ভীষণ লজ্জা হল।
এদিকে আমার যম সেই সিকিউরিটিবাবু কিছু দেখে অবাক গলায় বলল, “ক্যাপ্টেন কি করছেন?” আমি তাকিয়ে দেখলাম, ক্যাপ্টেন উমেদ সামনের সারিতে নিজের ছোট হলোগ্রাফিক স্ক্রিনের সামনে বসে কী-বোর্ডে বোতাম টিপে চলেছেন। স্ক্রিনে নানা রকম জ্যামিতিক নকশার খেলা। কিছু বুঝলাম না; ওখানেই উনি বেশিরভাগ সময়ে বসে থাকেন।
কিন্তু টের পেলাম, অনেকেই বিপদের আঁচ পেয়েছে। আমার মাথায় চেপে বসা ঘৃণার তরঙ্গগুলো রাতারাতি ভয়ের তরঙ্গে বদলে গেল। স্বয়ং সামিরা ক্যাপ্টেনের স্ক্রিনের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন, “উমেদ, থামো! সিকিউরিটি!”
আমার চেনা সিকিউরিটিবাবু এবং আরও তিনজন লাউঞ্জের নানা দিক থেকে দৌড়ে গেল। একজন চিৎকার করলো। সিঁড়ির কাছে জড়ো হওয়া কেউ কেউ মনে হয় কিছু বুঝতে পারছিল না। খালি সামিরা বিহ্বল গলায় বললেন, “আমাদের ফোর্স ফিল্ড! অত লম্বা স্ক্রিনিং, একটা উন্মাদকে উন্মাদ বলে চিনতে পারলো না?”
মায়ের গলা পর্দা থেকে গমগম করে উঠলো, “মিশন ডিরেক্টর, আমি আপনাকে বাঁচাতে চেয়েছিলাম, আপনি না বুঝে সেই সুযোগ হাতছাড়া করেছেন। আপনাকে বাঁচাতে অপারগ হওয়ার গ্লানি কখনো আমার মন থেকে ঘুচবে না।”
।৩।
প্ল্যানেটিয়ার শিপের যাত্রাপথ ছিল মঙ্গলের কক্ষপথে, মঙ্গল গ্রহের অবস্থানের বিপরীতে একটা ওয়র্মহোল তৈরি করে তার মধ্যে দিয়ে ইরাবানের কাছাকাছি হাইপার জাম্প। ওয়র্মহোল বানাবার জন্য নির্দিষ্ট স্থান পর্যন্ত পৌঁছতে আমাদের তিন মাস সময় লেগেছিল।
মায়ের অনেক দিনের চেনা রাস্তা। মা আর ধৃতিমান মাঝে মাঝেই একমনে ডেকের ক্যামেরা ফিড স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকতো। দু’জনেই গ্রহাণু ভাঙতে বহুবার এই পথে যাতায়াত করেছে। আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে হোভারক্রাফটে চড়ে শিপ পর্যন্ত আসার সময়ে শুধু আন্দামানে দু-এক ঘণ্টার জন্য খোলা আকাশ দেখতে পেয়েছিলাম। তাতে আমার আশ মেটেনি। কিন্তু শিপ মহাকাশে পৌঁছে যাওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই কালো আকাশে তারার কুচি দেখে দেখে আমার একঘেয়ে লাগতে শুরু করেছিল। তাই ওরা অত মন দিয়ে কি দেখছে আমি বুঝতে পারতাম না।
এক মা ছাড়া আমাদের ডেকের আর কেউ শিপের উপরতলায় যেত না। কিন্তু ডিরেক্টর সামিরা, ক্যাপ্টেন উমেদ সিং এবং আরও কোনও কোনও অফিসার নিয়মিত নিচে এসে দেখা করতেন। ডিরেক্টর ও ক্যাপ্টেনের সঙ্গে মায়ের ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। আর আমার বন্ধুত্ব হয়েছিল নয়া মুম্বাইয়ের রামোনা আর দিল্লির ওরিহারার সঙ্গে। সাত জনের দল বানিয়ে আমরা নিজেদের মতো খেলতাম।
শিপের খাবারদাবার নিউ ক্যালকাটার গরিব আশ্রয়ের চেয়ে অনেক ভালো ছিল সন্দেহ নেই, কিন্তু মায়ের আনা হেলথ টনিকে চুমুক দিলে আমার বাড়ির কথা সবচেয়ে বেশি মনে পড়তো। আমার মনে হয় প্রত্যেকেরই তাই হতো। এই হেলথ টনিক সারা দেশেই চলে। বিদেশেও চলে। টিমের অনেকেই নিয়ে এসেছিল। যারা আনেনি, তারা চেয়ে খেত। মনে মনে অনেকবার টনিকটা নিয়ে আসার জন্য মা-কে ধন্যবাদ দিয়েছি। মাস খানেকের মধ্যে এক ডজন জাম্বো সাইজের বোতল খালি হয়ে যায়।
একবার সমবেত হেলথ টনিক সেবনের মাঝে ক্যাপ্টেন উমেদ সিং এবং ডিরেক্টর সামিরা এসে উপস্থিত হলেন। মা বলল, “এসে যখন পড়েছেন, একটু টেস্ট করে দেখুন!”
উমেদ সিং হাসিমুখে এক কাপ তুলে নিলেন, কিন্তু সামিরা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন। আমতা আমতা করে “এগুলো আমার পোষায় না, বুঝলে…” বলে উঠে পড়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। মা অনেক সাধাসাধি করলো। এইভাবে সাধাসাধি করতে মা-কে কখনো দেখিনি। কিন্তু অনেক করেও সামিরা হেলথ টনিক মুখে তুললেন না। দুই অফিসার উপরতলায় ফিরে যাওয়ার পর ধৃতিমান বাঁকা হাসল। “সবার কি সবকিছু পোষায়? কেন অত জোর করতে গেলে, বস?”
মা দাঁত দিয়ে কিছুক্ষণ নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে রইল। তারপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে ব্যাপারটাকে ঝেড়ে ফেলে দিলো।
এর পর থেকে ক্যাপ্টেন উমেদ সিং হেলথ টনিক সেবনে আমাদের নিত্যসঙ্গী হয়ে ওঠেন। আমি বুঝতাম, আমাদের অর্থাৎ স্ট্রাইকারদের সঙ্গে খোলাখুলিভাবে মিশতে সামিরা সঙ্কোচ করেন, কিন্তু উমেদ সিং-এর সেসবের বালাই নেই। উপরতলায় মায়ের যাতায়াতও বেড়ে যায়। অবশ্য মিশন যত কাছে আসবে, টিমের ব্যস্ততা তত বেড়ে ওঠাই স্বাভাবিক।
***
১৮/৮/২২৪৫
ক্যাপ্টেন উমেদ সিং বিশেষ জোর দিয়ে কী-বোর্ডের একটা বোতাম চেপে ধরলেন। অমনি আমার কানে তালা লেগে রী-রী শব্দ হতে লাগলো। যে তিনজন সিকিউরিটি তাঁকে ধরতে ছুটে গিয়েছিল, তাদের একজন তৎক্ষণাৎ দু’হাতে মাথা চেপে ধরে বসে পড়লো। অন্য দু’জন হুমড়ি খেয়ে পড়ে গিয়ে বমি করতে লাগলো। লাউঞ্জের আলোগুলো দপদপ করতে করতে একটু পরেই নিভে গেল; তবু অন্ধকার নামলো না। স্ক্রিনে দৃশ্যমান ইরাবানের আলোয় শিপের ভিতরে এক ভয়ঙ্কর আলো-ছায়ার পরিবেশ তৈরি হল।
আমার মন থেকে এক ধাক্কায় ভয়ের তরঙ্গগুলো তীব্র আতঙ্কে বদলে গিয়ে আমাকে প্রায় অবশ করে ফেলল। কিন্তু একটু পরেই মনে হল, সেই ভার আপনা আপনি হালকা হয়ে যাচ্ছে। চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম, মানুষ আর লাউঞ্জের দেওয়াল— দুই-ই যেন প্রচণ্ড গরমে পুড়ে যাচ্ছে। শিপের ফোর্স ফিল্ড নিষ্ক্রিয় হয়ে যাওয়ার ফলে বাইরে মেরেকেটে এক কোটি কিলোমিটার দূরে থাকা ইরাবানের তীব্র তেজস্ক্রিয় বিকিরণ শিপের ভিতরকার সবকিছু তছনছ করে দিচ্ছে। ক্যাপ্টেন উমেদ সিং ছাড়া প্রত্যেকেই ধরাশায়ী; আমার পাশে বীভৎস অর্ধদগ্ধ দেহে পড়ে রয়েছেন মৃত্যুপথযাত্রী সামিরা। সিঁড়ি বেয়ে অনেকের উপরে উঠে আসার আওয়াজ পেলাম। আধো অন্ধকারে দেখলাম, উমেদ সিং তাঁর স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে কিছুর জন্য অপেক্ষা করছেন। তারপর আরেকটা বোতাম টিপলেন। আমার কানের রী-রী শব্দটা থেমে গেল। মানে ফোর্স ফিল্ড আবার সক্রিয় হয়েছে। শিপের ভিতর কোথাও থেকে একটা গোঁ গোঁ আওয়াজ আসতে লাগলো; জেনারেটর চালু হয়েছে। কয়েক মুহূর্ত পর লাউঞ্জের আলো আবার জ্বলে উঠলো।
অতগুলো মানুষের আতঙ্কের ভারের স্মৃতি, আর চোখের সামনে তাদের মৃতদেহ লাউঞ্জের চারদিকে ছড়ানো– আমার গা গুলিয়ে উঠলো। সেই সঙ্গে হাঁটু দুটো হঠাৎ নরম হয়ে আমি মাটিতে পড়ে গেলাম। এক মুহূর্তের জন্য সিঁড়ির দিকে চোখ পড়লো। ওরা সবাই লাউঞ্জে উঠে এসেছে। ধৃতিমান, ওরিহারা, রামোনা… আর সবার গায়ের রং বেগুনি। ঠিক আমাদের প্রিয় হেলথ টনিকের মতো গাঢ় বেগুনি।
অজ্ঞান হওয়ার আগেই আমি নিশ্চিত ছিলাম যে, আমার গায়ের রংও ঠিক ঐ রকম হয়ে গেছে।
।৪।
আমার জ্ঞান ফিরতে কয়েক ঘণ্টা লেগেছিল। তার পর কয়েকদিন হাসপাতালে ছিলাম। তাই ইরাবতী গ্রহের জন্মলগ্নের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সুন্দর সময়টাকেই আমি মিস করি। হেভি ডিউটি স্টার বম্বিং লেজার ইরাবানের পেট ফাটিয়ে — বা বলা ভালো ইরাবানের পেট থেকে কিছুটা মেদ ঝরিয়ে পনেরো থেকে ষোলো কোটি কিলোমিটার দূরত্বে ছিটিয়ে দেয়। আমার মায়ের টিমের কাজে এক বিন্দু ভুলচুক হয়নি। ঠিক যতখানি উপাদানের দরকার ছিল, ততটুকুই আলাদা করে তারা থেমে যায়। এরপর মহাশূন্যে ভাসমান ঐ গ্যাস আর খনিজের বলয় প্রাকৃতিক নিয়মে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে জমাট বেঁধে গ্রহ তৈরি করতে পারতো। কিন্তু মানুষের অতদিন ধৈর্য ধরে থাকার উপায় নেই। তাই ভাঙার পালা শেষ হলে ক্যাপ্টেন উমেদ সিং-এর পরবর্তী কাজ ছিল গড়া।
“সেদিন রাতে কয়েকটা কথা তোকে একটু বানিয়ে বলতে হয়েছিল। রাগ করিস না, বিটিয়া,” বলে মা আমার কপালে একটা চুমু খেলো। জ্ঞান ফেরার পরে তখন কয়েক দিন কেটেছে। স্টার বম্বার টিম প্ল্যানেটিয়ার শিপে ফিরে এসেছে। ইরাবানের তেজস্ক্রিয় বিকিরণের কয়েক সেকেন্ডের আঘাতেই শিপের কোনও কোনও অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বেশিরভাগ স্টাফ বেশিরভাগ সময়ে মেরামতির কাজে আসছে যাচ্ছে। আমরা রওনা দিয়েছি ইরাবানের পাঁচ কোটি কিলোমিটার দূরের ইরাবান ‘ক’ গ্রহে। মায়ের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা। ধৃতিমান পাশ থেকে বলল, “তোমার বিটিয়া তোমার কাজ দেখে দারুণ ইম্প্রেসড, বস। ও তোমাকে মাফ করে দিয়েছে।”
আমি হাসলাম। বেগুনি চামড়ায় মা-কে অন্যরকম দেখাচ্ছিল, কিন্তু ততদিনে বেগুনি মানুষ দেখে দেখে অভ্যস্ত হয়ে গেছি বলে আলাদা করে আর চমক লাগেনি। বললাম, “নিজেদের তৈরি গ্রহেই তো আমরা থাকবো। তুমি আর ভুল কী বললে।”
মা আমার চুলে বিলি কেটে দিয়ে বলল, “ওদের দেওয়া ফ্ল্যাটে থাকার কথাটা যেমন গুল। ওরাই তো আর রইলো না।” বলে ঠোঁট টিপে হাসল। তারপর একটু গম্ভীর হয়ে ঘাড় কাত করে জিজ্ঞেস করলো, “ডেডবডিগুলো নিয়ে স্বপ্নটপ্ন দেখছিস নাকি? সেদিনের কথা ভেবে খারাপ লাগছে?”
আমি দু’পাশে মাথা নাড়লাম। মা-ও জানে না, নিউ ক্যালকাটার রাস্তাঘাটে আমি কতবার উঁচু বাড়ির বারান্দা, দামি গাড়ি, আর সবচেয়ে বেশি করে শৌখিন টুরিস্টদের দিক থেকে ঘেন্নার ধাক্কা খেয়েছি। আমার খারাপ তো লাগছিল খালি সামিরার জন্য। কিন্তু মা তাঁকে বাঁচানোর চেষ্টা করেনি এমন নয়, আর আমাকে অপছন্দ না করলেও হেলথ টনিক মুখে তুলতে ওঁর যে আপত্তি ছিল, সেটা ঐ টুরিস্টদের ঘেন্নার চেয়ে খুব আলাদা কিছুও নয়।
আর আমার খারাপ লাগছিল মেহতাবের জন্য। হয়তো আর কোনোদিন ওর সঙ্গে দেখা হবে না। পৃথিবীতে কখনো ফিরতে পারবো না। ক্যাপ্টেন পৃথিবীর সঙ্গে সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেছেন। নাহলে শিপের হাজার রকম যোগাযোগের যন্ত্রের কোনও কোনটা থেকে সন্দেহজনক ফিড ঠিক ফাঁস হয়ে যেত। তার চেয়ে স্টার বম্বিং বিফল হয়ে আমরা সবাই ইরাবানের আগুনে ছাই হয়ে গেছি 一 ওদেরকে এটাই ভাবতে দেওয়া ভালো।
***
১১/১০/২২৪৫
স্ট্রাইকার আর মাইনাররা টপ ডেকের ভালো ভালো কেবিনগুলোর দখল নিয়েছে। সেগুলোর মধ্যে বেড়াতে বেড়াতে দেখলাম, ধৃতিমান খুব মন দিয়ে নিজের ভিউস্ক্রিনে কিছু একটা খুঁটিয়ে দেখছে। আড়চোখে আমার আগ্রহ দেখে আমার সঙ্গে শেয়ার করলো। দেখলাম, একটা পেল্লায় লেজার স্যাটেলাইটের নকশা। শুধলাম, “এটা কি?”
“পৃথিবীর চোখে ধুলো দেওয়ার কল।”
আমি বললাম, “পৃথিবীর চোখে তো আমরা ধুলো দিয়েই দিয়েছি। ক্যাপ্টেন সব কানেকশন কেটে দিয়েছেন তো!”
ধৃতিমান ভুরু নাচিয়ে বলল, “কোনও তারার কাছে গ্রহ আছে কি না কীভাবে দেখতে হয়?”
এটা আমি জানি। “তারার সামনে দিয়ে গ্রহ পাস করলে তারার আলো একটু ম্লান হয়ে যায়। সেটা পৃথিবীতে বসে দেখা যায়।”
ধৃতিমান বলল, “গুড। এবার আমাদের ইরাবতী যখন চলার পথে পৃথিবী আর ইরাবানের মাঝখানে আসবে, তখন পৃথিবী থেকে ইরাবানের দিকে তাক করা টেলিস্কোপ গুলোয় সেটা ধরা পড়বে কি না?”
আমার বুকের ধুকপুক হঠাৎ বেড়ে গেল। তাই তো! তাহলে কি হবে?”
ধৃতিমান হেসে বলল, “এই যে স্যাটেলাইট দেখছিস, এরকম কয়েকটা বানিয়ে আমরা ইরাবতীর চারদিকে ঝুলিয়ে দেবো। পৃথিবী থেকে দেখা যাওয়ার সময়ে ইরাবানের তেজ ঠিক যতখানি কম দেখানোর কথা, ততটুকুই তীব্র লেজার জ্বেলে আমরা পৃথিবীর দিকে তাক করবো। ইরাবানের আলোয় কিছু কমতি ওরা বুঝতে পারবে না।”
আমি বললাম, “অনেক এনার্জি লাগবে।”
“বছরে কয়েক ঘণ্টার তো ব্যাপার। চাপ নেই।”
আমার মনে আরেকটা খটকা লাগছিলো। সেটা হল এই যে, যে হেলথ টনিক আমাদেরকে ফোর্স ফিল্ডের অবর্তমানে ইরাবানের বিকিরণের হাত থেকে বাঁচিয়েছে, আর বরাবরের মতো আমাদের শরীরে কিছু বদল ঘটিয়ে দিয়েছে, সেই জিনিস পৃথিবী জুড়ে সস্তায় বিক্রি হয়! এতদিন ধরে এই তাজ্জব ব্যাপার চলছে কীভাবে?
ধৃতিমানকে জিজ্ঞেস করলাম। ও বলল, “এই বদলগুলো হেলথ টনিক কোম্পানির জানা নেই। এগুলো টনিকের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া।” একটু থেমে যোগ করলো, “এমনিতে সৌরজগতের বাইরে না এলে বোঝা যাওয়ার কথা নয়।”
আমি অবাক হয়ে শুধলাম, “তাহলে আমাদের এত বড় পরিকল্পনাটা কীভাবে করা হল?”
“তোর বন্ধু কিমিকোর বাবা গবেষণা করে দেখেছে।”
“ওরিহারার বাবা! কোম্পানিকে না জানিয়ে মা-কে বলল কেন?”
“ও-ও পালাতে চেয়েছিল। ও আর তোর মা এই দু’জনের বুদ্ধি। ষড়যন্ত্রও বলতে প্যারিস।”
“যদি আবার কেউ গবেষণা করে?”
“যারা জানতে পারলে ব্যাপারটাকে আটকাতে চাইবে, তারা সবাই সামিরার মতো। যে খাবার মুখে তুলতে বাধে, সেই খাবার নিয়ে কি তুই গবেষণা করার কথা ভাববি?”
নিশ্চিন্ত হয়ে বাইরে লাগানো ক্যামেরার চোখে চোখ লাগালাম। আমরা ইরাবান ‘ক’ গ্রহের সূর্যোদয়ের অঞ্চলে স্থির কক্ষপথে ঝুলে রয়েছি। শিপ থেকে ছাড়া হয়েছে শ’য়ে শ’য়ে ড্রোন, যারা ইরাবান ‘ক’-এর খনিজ-সমৃদ্ধ শিলাস্তর থেকে নিজেদের বিপুল সংখ্যক অনুকৃতি তৈরি করবে। তারপর একটা টিম তাদের নিয়ে চলে যাবে ইরাবতী বলয়ের কাছে। সেখানে গিয়ে হিসেব মতো ঠাণ্ডা আর গরম কামান দেগে, ইরাবানের নিজস্ব গ্রহাণুপুঞ্জ থেকে নির্দিষ্ট সংখ্যায় বরফের চাঙড় নতুন গ্রহের বুকে আছড়ে ফেলে লক্ষ বছরের কাজ দশ বছরে করবে। বায়ুমণ্ডল ও মহাসাগর সমন্বিত ইরাবতী গ্রহ তৈরি করবে।
ইরাবতী হবে ‘গ্রহ-কারিগরের’ (যদিও বিশ্বাসঘাতক) কর্মীদের বানানো প্রথম স্বাধীন গ্রহ।
Tags: kalpabiswa y7n1, science fiction, কল্পবিজ্ঞান গল্প, দীপ ঘোষ, সর্বান বন্দ্যোপাধ্যায়
সাবাশ
ধন্যবাদ!
দারুন লাগল ।
ধন্যবাদ!
খুব সুন্দর কল্পবিজ্ঞানজীবী কাহিনী
ধন্যবাদ!