ঘূর্নিপাকের হাল হকিকত
লেখক: Stanislaw Lem; অনুবাদ: সুপ্রিয় দাস
শিল্পী: দীপ ঘোষ
মূল গল্প: “The Seventh Voyage”, যা “The Star Diaries” গ্রন্থের অন্তর্গত।
সোমবার, ২রা এপ্রিল, আমার মহাকাশ যান বিটলজুস নক্ষত্রের পার্শবর্তী অঞ্চলে ভেসে চলেছে। এমন সময়ে একটা সিমবিচির কাছাকাছি আকৃতির আকাশপ্রস্তর আমার রকেটের খোলে এসে ধাক্কা মারল ও আমার চলন নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা তো বিগড়ে গেলই, উপরন্তু আমার রকেটের দিক নিয়ন্ত্রণকারি হালটাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ল। ফলে আমার রকেটের দিক ও গতি পরিবর্তনের কোনও উপায়ই আর রইলো না। অগত্যা আমি স্পেসস্যুট গায়ে চাপিয়ে রকেটের বাইরে বেরিয়ে বিকল যন্ত্রগুলোকে মেরামত করবার উদ্যোগ নিলাম। অতিরিক্ত একটা হাল আমার রকেটে ছিলো; ওটা সঙ্গে না নিয়ে নক্ষত্রযাত্রা করবার মত বুরবক আমি নই। কিন্তু ওটা রকেটের গায়ে ফিট করা যে আমার একার পক্ষে সম্ভব নয় তা এতক্ষণেবুঝলাম। আমাদের বুদ্ধিমান মহাকাশ ইঞ্জিনিয়ররা ওটা এমন কায়দায় বানিয়েছে যে একজন পেঁচকল দিয়ে বল্টুর মাথাটা চেপে ধরে না রাখলে ও অন্য আর একজন সেই বল্টুতে নাট বসিয়ে কষে টাইট না দিলে হালটা রকেটে ফিট করা অসম্ভব। অবশ্য আমি যে শুরুতেই এটা বুঝতে পেরে গেছিলাম তা নয়। বেশ কয়েক ঘণ্টা ধরে আমি কোনওরকমে পা দিয়ে পেঁচকলটা চেপে ধরে , বল্টুর অন্য প্রান্তে হাত দিয়ে নাটটা টাইট দিতে চেষ্টা চালিয়ে গেছি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটা পণ্ডশ্রম হয়েছে। মাঝখান থেকে আমার দুপুরের খাওয়াটি মাটি হয়েছে। অনেক চেষ্টার পরে যখন মনে হচ্ছিলো নাট-বল্টু বাবাজীকে প্রায় কাবু করে এনেছি, এমন সময়ে আমার পায়ের তলা থেকে পেঁচকল মহাশয় পিছলে বেরিয়ে মহাশুন্যে পিঠটান দিলেন। সুতরাং শেষ পর্যন্ত লাভের ভাঁড়ার রইল শুন্য, উল্টে ব্যাজার মুখ করে অত্যাবশ্যক যন্ত্রটিকে তারা ভরা মহাকাশে বিলীন হয়ে যেতে দেখা ছাড়া আমার আর কিছুই করার রইল না।
কিছুক্ষন পড়ে অবশ্য পেঁচকল বাবাজি ফিরে এলেন, একটা লম্বাটে ডিম্বাকৃতি পথ ধরে। আমার হাতের নাগালের অনেক দূরে পাক খেতে খেতে, রকেটের একটি উপগ্রহ হিসেবে নিজের একটা পাকাপাকি বন্দোবস্ত ততক্ষণে তিনি করে নিয়েছেন। আমিও রণে ভঙ্গ দিয়ে রকেটের ভিতরে ফিরে এসে রাতের বরাদ্দ খাবার নিয়ে বসে, গালে হাত দিয়ে এই উদ্ভট পরিস্থিতি থেকে নিজেকে উদ্ধার করবার উপায় ভাবতে লাগলাম। এদিকে নচ্ছার ঐ আকাশ-নুড়ির আঘাতে অকেজো গতি ও দিক নিয়ন্ত্রক বিহীন আমার মহাকাশযানের গতি বেড়েই চলল আর সেই বেড়ে চলা গতিতে সে কোনও দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে সটান এগিয়ে চলল। ভাগ্যিস সামনের দিকে কাছাকাছি কোনো গ্রহ-নক্ষত্রের অস্তিত্ব নেই। সুতরাং আমার রকেটের সঙ্গে কারও সংঘর্ষের সম্ভাবনাও নেই। তাই বলে এইরকম একরোখা অনির্দিষ্ট যাত্রা তো অনন্তকাল ধরে চলতে দেওয়া যায় না। পরিস্থিতির কথা চিন্তা করে নিজের অদৃষ্টের ওপর বেশ রাগ হয়েছিল বটে কিন্তু সেটাকে এতক্ষণ বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছিলাম না। কিন্তু খাওয়ার পরে রান্নাঘরে বাসন ধুতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম যে গতি বৃদ্ধির ফলে পারমানবিক ইঞ্জিনের অতিরিক্ত শক্তি উৎপাদনের ঠেলায় আমার ফ্রিজটি অকেজো হয়ে রবিবারের প্রাতরাশের জন্য অনেক যত্নে জমিয়ে রাখা সরেস গরুর দাবনার মাংসের টুকরোটা বরবাদ হয়েছে। তখন আমার ঋষিতুল্য ঠাণ্ডা মগজটিও নিমেষে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল। গলা ফুলিয়ে অশ্রাব্য কিছু শব্দ উচ্চারণ করে বেশ কয়েকটা পোর্সেলিনের প্লেট রান্নাঘরের মেঝেতে আছড়ে ভেঙ্গে অবশেষে কিছুটা শান্ত হলাম। তবে সারা ঘরে ভাঙা প্লেটের টুকরো ছড়িয়ে দেওয়াটা মোটেও বুদ্ধিমানের কাজ হল না। উপরন্তু ওই নষ্ট মাংসের টুকরোটা, যেটা রাগের মাথায় মহাকাশযানের বাইরে ছুঁড়ে মেরেছিলাম, সেটাও মহাশূন্যে বিদায় নেওয়ার বদলে পেঁচকলটারই মত আমার রকেটের দ্বিতীয় উপগ্রহ হয়ে পাক খেতে লাগল ও প্রত্যেক এগারো মিনিট ও চার সেকেন্ডে বিটলজুস নক্ষত্রের সটান সামনে এসে তার খন্ডগ্রাস গ্রহণ সৃষ্টি করে নিজের অস্তিত্ব সগর্বে ঘোষণা করে আমার কাটা ঘায়ে নুন ছিটিয়ে দিয়ে যেতে লাগল। হতাশ হয়ে মাথা ঠাণ্ডা করতে সন্ধ্যে পর্যন্ত বসে বসে হিসেব কষলাম। এই সিদ্ধান্তে পৌঁছনো গেল যে আজ থেকে ঠিক ষাট লক্ষ বছর পরে আমার মাংস-চন্দ্র আমার পেঁচকল-চন্দ্রের আগে আগে আমার মহাকাশযানকে প্রদক্ষিণ করে পেছন থেকে এসে তাকে আবার অতিক্রম করবে। অবশেষে এতক্ষণের জটিল হিসেবের ফলে ক্লান্ত হয়ে ঘুমোতে গেলাম। মাঝরাতে ঘুমের মধ্যে মনে হল কে যেন আমার কাঁধ ধরে জোর ঝাঁকুনি দিচ্ছে। চোখ খুলে দেখলাম একটা লোক। আমার বিছানার ওপর ঝুঁকে পড়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে; মুখটা দেখে খুব চেনা চেনা মনে হলেও কিছুতেই চিনতে পারলাম না লোকটাকে। সে বলল,
-“ওঠ, এখুনি ওঠ, সাঁড়াশি গুলো নিয়ে বাইরে চল। হালের নাট-বল্টুর প্যাঁচ কষতে হবে, চল শিগগির…”
-“প্রথমত তোমার আচরণ ভদ্রজনোচিত নয়। চেনা নেই জানা নেই, নিজের পরিচয় না দিয়ে অচেনা লোককে হুকুম দেওয়াটা কোন দেশী ভদ্রতা? তা ছাড়া আমি নিশ্চিত জানি যে বাস্তবে তোমার কোনো অস্তিত্ব নেই। এই যানে আমি সম্পুর্ণ একা। দুবছর আগে পৃথিবী থেকে রওনা হয়ে রামাবতার নক্ষত্রমণ্ডলের উদ্দেশ্যে আমি একাই এগিয়ে চলেছি। সুতরাং তুমি আমার ঘুমন্ত মস্তিষ্কের স্বপ্ন-ভ্রম ছাড়া আর কিছুই নও।“ বললাম আমি।
কিন্তু লোকটা আমার কোনও কথাই কানে তুলল না। উল্টে ক্রমাগত আমার কাঁধ খামচে ধরে ঝাঁকিয়ে যেতে লাগল আর বার বার আমাকে যন্ত্রপাতি নিয়ে অবিলম্বে যানের বাইরে মেরামত অভিযানে ওকে সঙ্গত করতে পীড়াপীড়ি করে যেতে থাকল। অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বললাম,
-“এ কী আহাম্মকি!” আমার বিরক্তি ক্রমে বেড়ে চলেছিল। স্বপ্নের মধ্যে এই বাকবিতন্ডা যে কোনও সময় আমার ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিতে পারে আর আমার অভিজ্ঞতা হল যে একবার ঘুম ভাঙলে মহাশূন্যে আবার ঘুম আসা খুবই কঠিন। শেষে ঐ বিটকেল লোকটাকে বললাম,
-“দেখ, এই বিছানা ছেড়ে তোমার সঙ্গে আমি কোত্থাও যাচ্ছি না, যাওয়াটা চরম মূর্খামি। স্বপ্নের মধ্যে নাটবল্টু টাইট দিলেও তাতে বাস্তবে কাল সকালে ঘুম ভাঙলে কিচ্ছু পাল্টাবে না। কাজেই আমাকে বিরক্ত না করে গায়েব হও বা অন্য যে কোনো ভাবে কেটে পড়, নয়ত এবার সত্যিই আমার ঘুম ভেঙ্গে যাবে।“ বললাম আমি।
-“তুমি কিন্তু জেগেই আছ; সত্যি বলছি! আমাকে ভালো করে দেখ। চিনতে পারছ না?” এই বলে আমার সেই স্বপ্ন-কায়া তার বাঁ গালে তর্জনি নির্দেশ করে এক জোড়া স্ট্রবেরির মত লাল জড়ুলের দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষন করল।
আমার অজান্তেই কখন যেন আমার ডান হাতটা আমার বাঁ গালে গিয়ে ঠেকল আর সঙ্গে সঙ্গে খেয়াল হল একদম একই জায়গায় ঠিক একই রকম এক-জোড়া জড়ুল তো আমার নিজেরও রয়েছে। এতক্ষনে আমার সন্দেহের অবসান হল, বুঝলাম যে এই উটকো লোকটাকে কেন আমার এত চেনা চেনা লাগছে। আমার বিছানার পাশে যে লোকটা দাঁড়িয়ে সে হুবহু আমারই প্রতিমূর্তি।
-“দোহাই তোমার, আমাকে আর জ্বালিও না। কেটে পড় এবার। যদি তুমি আর আমি একই লোক হই, তাহলে আর তোমার সঙ্গে কোনোরকম অহেতুক ভদ্রতা করার মানে হয় না। আর এতে আরো বেশী করে প্রমাণ হয় যে তুমি বাস্তব নও, তুমি নিছকই আমার স্বপ্ন। “ জোর গলায় অন্য আমাকে এই কথা বলে প্রাণপণে চোখ বন্ধ করে পাশ ফিরে কম্বলটা টেনে মাথার ওপর চাপিয়ে, জোর করে ঘুমোনোর চেষ্টা করলাম। আমার প্রতিমূর্তির তরফ থেকে একটা অস্ফুট বাক্য কানে এলো আমার গোঁয়ার্তুমি সম্পর্কে।
-“এর জন্য তোমাকে পস্তাতে হবে বুঝলে মূর্খ! খুব শিগগির বুঝবে যে এটা কোনও স্বপ্ন ছিল না। কিন্তু ততক্ষণেও অনেক দেরী হয়ে যাবে।“ আমার কাছ থেকে কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে এই বলে বিড়বিড় করতে করতে সে বিদেয় হল মনে হয়। আমি একই ভাবে মটকা মেরে পড়ে রইলাম এবং কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম কে জানে।
সকাল হতে ঘুম ভেঙে রাত্রের ওই অদ্ভুত স্বপ্নটার কথা মনে পড়ল। বিছানায় বসেই অবাক লাগল যে মানুষের মন করতকম বিচিত্র খেলাই না দেখায়। আমি বেশ জানি যে এই মহাকাশ যানে আমি ছাড়া অন্য কোনও প্রানী নেই। অথচ এক অভূতপূর্ব সংকটের মুখোমুখি হয়ে আমি মনে মনে নিজেকে ভেঙে আমার এক দোসর তৈরি করে নিয়েছি আধা সজাগ ও আধা স্বপ্ন দেখা অবস্থার মধ্যে। কারণ এই এই রকেটে অন্য আর একজন সহকারীর উপস্থিতিই বর্তমান সংকট থেকে মুক্ত হওয়ার একমাত্র উপায়।
ব্রেকফাস্টের পরে হিসেব করে দেখলাম যে সারা রাতে আমার রকেটের গতি বেশ খানিকটা বৃদ্ধি পেয়েছে। মহাকাশযানের লাইব্রেরিতে গিয়ে বেশ কিছুক্ষণ নানা রকম কাগজপত্র ও জার্নাল ঘাঁটাঘাঁটি করলাম যদি সেখানে এই বিপত্তি থেকে উদ্ধার পাওয়ার কোনও উপায় পাওয়া যায়। কিন্তু কোনও লাভ হল না। অবশেষে ছায়াপথের এই অংশের ম্যাপটা টেবিলে বিছিয়ে বসে বাইরের মাংসের টুকরোর পূর্ণগ্রাসে নিয়মিত আড়ালে চলে যাওয়া বিটলজুস নক্ষত্রের আলোয় সেটাকে ভালো করে দেখতে লাগলাম; দেখছিলাম যদি ভাগ্যক্রমে কাছাকাছি কোনও মহাজাগতিক সভ্যতার অস্তিত্ব থাকে ও তাঁদের থেকে সাহায্য পাওয়ার চেষ্টা করা যায়। কিন্তু সেরকম কিছুই আশেপাশে নেই। নক্ষত্রপুঞ্জের এই অংশটাকে একরকম মহাজাগতিক মরুপ্রান্তর বলা চলে। সব মহাকাশযানই এই অঞ্চলটা এড়িয়ে চলে। ম্যাপ বলছে এই অঞ্চলে প্রচুর মহাকর্ষীয় ঘূর্ণির অস্তিত্ব রয়েছে যার ফলে এই যায়গাটা অত্যন্ত বিপজ্জনক। মোট একশ সাতচল্লিশটা এরকম ঘূর্ণির অস্তিত্ব ম্যাপে দেখাচ্ছে। ওগুলো যেমন আকারে অতিকায় তেমনই অত্যন্ত রহস্যময়। বিভিন্ন বইপত্রে এইসমস্ত মহাকর্ষীয় ঘূর্ণির অস্তিত্বের কারণ হিসেবে ছ-রকম বৈজ্ঞানিক তত্ত্বর উল্লেখ পেলাম, কিন্তু সেগুলো সব কটাই একে অপরের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা কারণ ব্যাখ্যা করেছে।
মহাকাশযাত্রাপঞ্জিতে এই সমস্ত ঘূর্নিগুলো সম্পর্কে বিশেষ করে সতর্কবানী লেখা রয়েছে। এর খপ্পরে কোনো মহাকাশযান পড়লে, বিশেষত অস্বাভাবিক গতিতে এগুলোর মধ্যে দিয়ে যাওয়া আসা করলে, এর আপেক্ষিক প্রভাব কি হতে পারে তা মানুষের ধারণার বাইরে বলে লিখেছে ওই বইয়ে।
তবে বর্তমানে আমার হাত পা বাঁধা। আমার হিসেব অনুযায়ী আমার বর্তমান যাত্রাপথে আসন্ন প্রথম ঘূর্ণির সীমানা আমার রকেট অতিক্রম করবে বেলা প্রায় এগারোটা নাগাদ। সুতরাং তাড়াতাড়ি দুপুরের খাবার রান্না করতে লেগে পড়লাম। খালি পেটে অচেনা বিপত্তির মুখোমুখি হওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। খাওয়া হয়ে গেলে এঁটো বাসনগুলো ধুয়ে যখন শেষ ডিশটা মুছছি, এমন সময় মহাকাশযানে একটা প্রলয় বেঁধে গেল। রকেটটা হঠাতই প্রচণ্ড বেগে দুলতে ও সাঁই সাঁই করে পাক খেতে শুরু করল। তার ধাক্কায় আমি ছিটকে মেঝেতে পড়তেই হঠাৎ পাক খাওয়ার দিক পরিবর্তন হয়ে যানে যা কিছু না বাঁধা অবস্থায় আলগা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল, সবই পাগলা শিলাবৃষ্টির মত চার দিকে ছিটকে দেয়ালে, মেঝেতে আর সিলিংএ ধাক্কা খেয়ে আবার বিপরীত দিকে চলে যেতে লাগল। আমি কোনওরকমে মাথা বাঁচিয়ে মেঝেতে শরীর ঘষ্টে ঘষ্টে যান চালকের জন্য নির্দিষ্ট চেয়ার অবধি পৌঁছে, সিট-বেল্ট দিয়ে নিজেকে চেয়ারের সঙ্গে বেঁধে ফেললাম। রকেটটা তখনো প্রবল বেগে পাগলা-পাক খেয়ে চলেছে, এরই মধ্যে হঠাত চোখে পড়ল রকেটের কেবিনের অন্য প্রান্তে একটা ঝাপসা বেগুনী রঙের ধোঁয়াশা জমাট বাঁধছে। আর সেই ধোঁয়াশার মাঝখানে, ঠিক আমার রান্নাঘরের স্টোভ আর বাসন ধোয়ার সিঙ্কের মাঝে ফুটে উঠেছে কিছুটা ঝাপসা একটা মনুষ্যমূর্তি। তার পরনে একটা রান্নার এপ্রন আর সে বেশ মনোযোগ দিয়ে ফেটানো ডিম গরম চাটুতে ঢেলে ওমলেট বানানোর তোড়জোড় করছে। ডিম ঢেলে লোকটা মুখ তুলে আমার দিকে একবার চাইলো। তবে খুব একটা অবাক হল বলে মনে হল না। তার পরেই হঠাত শান্ত জলে পাথর ছুড়লে যেরকম ঢেউ খেলে জলে পড়া স্থির বস্তুর ছায়া ভেঙে তালগোল পাকিয়ে মিলিয়ে যায়, ঠিক সেইরকম ভাবেই লোকটা ঐ বেগুনী ধোঁয়াশা সমেত হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। আশে পাশে চোখ বুলিয়ে আমি নিশ্চিত হলাম যে এই আকাশযানে আমি ছাড়া আর কোনও প্রাণের অস্তিত্ব নেই। কাজেই ওই দৃশ্যটাকে আবার গত রাতের মত আর একটা মানসিক বিভ্রম মনে করে উড়িয়ে দিলাম।
রকেটের দুলুনি কমবার অপেক্ষায় চেয়ারে বসে বসে হঠাত একটা কথা আমার মনে হল। লাইব্রেরি থেকে বার করে আনা এক ভল্যুম জাবদা ‘জেনারেল থিওরি অফ রিলেটিভিটি’ আমার কানের পাশ দিয়ে সাঁই করে উড়ে গিয়ে দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে আবার আমার দিকেই ফিরে আসছিল। আমার হাতের নাগালের সামান্য বাইরে দিয়ে আবার গিয়ে অন্যদিকের দেওয়ালে ধাক্কা খেল। অনেক কসরত করে বার চারেকের চেষ্টায় ওটাকে হস্তগত করে খুলে বসলাম। রকেটের ঐ মাতাল ঝাঁকুনি ও পাগলা পাকের মধ্যে ঐ ভারী বইয়ের পাতা ওল্টানোও এক দুঃসাধ্য কাজ। অনেক চেষ্টায় অবশেষে সঠিক চ্যাপ্টারে এসে পৌঁছলাম। এই চ্যাপ্টারে টাইম-লুপ বা অতিরিক্ত মার্ধ্যাকর্ষণ বলের প্রভাবে সময়ের অভিমুখ বেঁকে যাওয়া নিয়ে লেখা রয়েছে। কখনো কখনো অত্যন্ত প্রবল মার্ধ্যাকর্ষণের ফলে সময়প্রবাহের মুখ সম্পূর্ণ বিপরীত দিকেও ঘুরে যেতে পারে ও তার ফলে একই জায়গায় একাধিক বর্তমান কালের সৃষ্টি হতে পারে। যে মহাকর্ষ ঘূর্ণিটার মধ্যে দিয়ে আমি এখন চলেছি, ম্যাপ অনুযায়ী সেটা এমন কিছু শক্তিশালী নয়। তবে যদি আমি কোনওরকমে এই যানের মুখ ছায়াপথের কেন্দ্রের দিকে সামান্যও ঘোরাতে পারি, তাহলে আমি সটান যে ঘূর্ণিতে গিয়ে পড়ব তা আর সব ঘূর্নির পালের গোদা। ওতে নাকি বর্তমানের দু-তিনটে প্রতিরূপ এক সঙ্গে অনুভব করা খুবই সম্ভব।
যদিও জানি যে আমার রকেটের দিকনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ অকেজো, তবুও ইঞ্জিন রুমে গিয়ে যানের যন্ত্রপাতি নিয়ে খুট-খাট করতে শুরু করলাম। এই করতে করতে কতক্ষণ যে কেটে গেছে তার কোনও হদিশ ছিল না। যখন হুশ হল, আবিষ্কার করলাম যে এর মধ্যে বেশ কয়েক ঘণ্টা কেটে গেছে আর আর আমি অপ্রত্যাশিত ভাবে আমার আকাশযানের মুখ কোনওভাবে নক্ষত্রপুঞ্জের ঠিক কেন্দ্রবিন্দুর দিকে ঘুরিয়ে ফেলেছি।
আমার আকাশযান যখন সেই মহাকর্ষীয় মহাঘূর্ণির একেবারে মর্মস্থলে গিয়ে উপস্থিত হল, তখন প্রায় মাঝরাত। যানের সমস্ত কাঠামোটা অকল্পনীয় মহাকর্ষের আকর্ষনে গোঁ গোঁ শব্দে কাতর আর্তনাদ করে উঠল আর সঙ্গে সঙ্গে শুরু হল সেই রাম কাঁপুনি। মনে হল বিশালকায় একদল অদৃশ্য দৈত্য চতুর্দিক থেকে আমার রকেটের খোলনলচে ধরে মরণপণ দড়িটানাটানিতে মত্ত হয়ে উঠেছে আর যে কোনো মুহুর্তে সেই টানের চোটে রকেটটা শত শত টুকরোতে ভেঙেচুরে মহাকাশে বিলীন হবে। কিন্তু একসময়ে ঐ চরম টানাটানিও শিথিল হল। মহাজাগতিক নৈঃশব্দের প্রাণহীন আলিঙ্গন আবার আমার রকেটকে অনির্দেশের পথে চালিয়ে নিয়ে চলল। আমিও ক্লান্ত শরীরে ইঞ্জিন রুম থেকে বেরিয়ে এলাম আর এসেই আমার বিছানায় নিশ্চিন্ত ঘুমে যাকে আবিষ্কার করলাম সে আর কেউ নয়, স্বয়ং আমিই। মুহূর্তে গত রাতের কথা মনে পড়ে গেল আর বুঝলাম ঐ আমি গত রাত অর্থাৎ সোমবার রাত্রে আকাশযান মেরামতে ব্যর্থ হয়ে ঘুমিয়ে পড়া আমি ছাড়া আর কেউ হতেই পারে না। স্বয়ং নিজের সঙ্গে আমার মোলাকাত নিয়ে মনে কিছু দার্শনিক চিন্তার উদ্রেক হয়েছিল বটে কিন্তু তাদের আমল না দিয়ে সটান বিছানার দিকে ছুটে গিয়ে ঘুমন্তের কাঁধ খামচে ধরে ঝাঁকিয়ে তার নিদ্রাভঙ্গের আয়োজন করলাম। জানি না কতক্ষণ ‘আমার সোমবার’ আমার মঙ্গলবারে নিজের অস্তিত্ব টিঁকিয়ে রাখবে। কিন্তু সোমবার বিদায় নেবার আগেই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মঙ্গলবারে এই দুই আমাতে মিলে যানের বাইরে গিয়ে হালের হাল ফেরাতেই হবে।
কিন্তু আমার প্রবল ঝাঁকুনিতেো কোনওরকমে এক চোখ খুলে ওই ঘুমন্ত আমি বিরক্ত স্বরে বলল যে আমি শুধু অভদ্রই নই, আমি ওই ঘুমন্ত আমার নিশিস্বপ্নের কল্পনা ছাড়া আর কিছু হতেই পারি না। অনেকক্ষণ ডাকাডাকি করে ফল না হওয়ায় আমি ধৈর্য হারিয়ে টেনে হিঁচড়ে ওকে বিছানাচ্যূত করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু ও গোঁয়ারের মত বলেই চলল যে আমি নাকি শুধু ওর ঘুমের মধ্যে একটা স্বপ্ন; মেজাজ হারিয়ে গালাগালও দিলাম, কিন্তু তাতে ও যুক্তি দেখালো যে স্বপ্নের মধ্যে যতই নাটবল্টু কষা হোক, তাতে ঘুম ভাঙলে বাস্তবে পরিস্থিতির কোনও উন্নতিই হবে না। আমি দিব্যি করে বললাম যে আমি স্বপ্ন নই, অনুরোধ উপরোধ গালমন্দ সবই করলাম- এমন কি আমার গালের আঁচিলটার দিকেও ওর দৃষ্টি আকর্ষন করলাম, কিন্তু কিছুতেই কিছু ফল হল না। ও আমার দিকে পিছন ফিরে নির্বিকার ভাবে নাক ডাকিয়ে ঘুম দিলো।
ইঞ্জিন রুমে ফিরে এসে গালে হাত দিয়ে বসে আমার অবস্থার কথা ভাবতে লাগলাম। গত কিছুক্ষণের পরিস্থিতিটার মধ্যে দিয়ে আমি দুবার গিয়েছি, একবার ঘুমন্ত সোমবারের আমি আর অন্যবার ঐ আমিকে ঘুম থেকে জাগাতে ব্যর্থ এই মঙ্গলবারের আমি। সোমবারের আমি সময় প্রবাহের প্রতিলিপি-প্রপঞ্চের অস্তিত্বে বিশ্বাসী নয় কিন্তু মঙ্গলবারের এই আমার এর বাস্তবতা নিয়ে কোনও সন্দেহই নেই। ব্যাপারটা নিতান্তই সহজ সরল একটা সময় বৃত্ত। কিন্তু এখন এই রকেটের হালটা মেরামত করবার কি ব্যবস্থা করা যায়? আমি জানি যে সোমবারের আমি সেদিন বাকি রাতটা নিরুপদ্রবেই ঘুমিয়েছি। সুতরাং মঙ্গলবারে বসে আমি নিশ্চিত যে ঐ আমাকে আর জাগাতে চেষ্টা করা বৃথা। তবে আমার রকেট যে পথে ছুটে চলেছে, সেই পথে বেশ অনেকগুলো মহাকর্ষ ঘূর্নি আমার জন্য অপেক্ষা করে রয়েছে; সুতরাং কয়েকদিনের মধ্যেই আবার অন্য কোনও সময়ের এক বা তারও বেশি আমার সঙ্গে আমার সাক্ষাত হতে চলেছে। আমার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল, ভাবলাম একটা চিঠি লিখে সমস্তটা ব্যাখ্যা করে ঐ আমার বালিশের তলায় গুঁজে দিই যাতে সকালে জেগে উঠে ও বুঝতে পারে যে রাতের ঘটনাটা একেবারেই স্বপ্ন ছিলো না।
কিন্তু কাগজ কলম নিয়ে টেবিলে বসতে না বসতেই ইঞ্জিন রুম থেকে একটা ঝনঝন শব্দ কানে এলো। তাড়াতাড়ি ছুটে গিয়ে দেখি রকেটের অনিয়ন্ত্রিত গতির ঠেলায় ইঞ্জিন আগুনের মত গরম হয়ে প্রায় ফেটে পড়বার জোগাড় হয়েছে। প্রাণপণে ইঞ্জিনে জল ঢালতে লাগলাম। বেশ অনেকক্ষণ জল ঢালবার ফলে অবশেষে ইঞ্জিনটা ঠান্ডা হয়ে শান্ত হল। এই পুরো সময়টাই আমার সোমবারের জোড়াটি ঘুমিয়ে কাদা হয়ে কাটালেন, আর ঘুমের মধ্যেই তার সশব্দ নাসিকাগর্জন শুনে আর অবিস্রান্তবার ওর জিভ বার করে ঠোঁট চাটা দেখে আমার পিত্তি জ্বলে গেল। সারা রাত জেগে থাকার ফলে চোখ জ্বালা করছিল, প্রচণ্ড খিদেও পেয়েছিল, তাই সোজা ব্রেকফাস্ট বানাতে শুরু করলাম। খাওয়া শেষ হতে প্লেট টা ধুয়ে সবে শুকনো কাপড় দিয়ে মুছছি এমন সময়ে আমার আকাশযান সটান পরবর্তী মহাকর্ষীয় ঘূর্নির কবলে গিয়ে পড়ল। আমার চোখের সামনে দেখলাম সোমবারের আমি ইঞ্জিন রুমের চেয়ারে আষ্টেপৃষ্টে সিট-বেল্ট বেঁধে বসে আমার দিকে অবাক চোখে চেয়ে রয়েছে, আর মঙ্গলবারের আমি স্টোভের সামনে দাঁড়িয়ে মনযোগ দিয়ে ওমলেট ভাজছি। এমন সময়ে রকেটটা একটা প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে আমাকে মুখ থুবড়ে ফেলে দিলো আর পড়ামাত্র মেঝের সঙ্গে সংঘর্ষে আমি সংজ্ঞা হারালাম। জ্ঞান হতে দেখি চতুর্দিকে ভাঙ্গা পোর্সেলিন ডিশের টুকরো ছড়ানো আর তার মাঝে আমি হাত পা ছড়িয়ে উপুড় হয়ে পড়ে আছি। আমার মুখের ঠিক সামনে এক জোড়া জুতো পড়া পা ছড়িয়ে কেউ একজন দাঁড়িয়ে রয়েছে।
-“উঠে পড়ো, তুমি ঠিকই আছো। শুধু একটু অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলে। খুব বেশি চোট লাগে নি তো?” এই বলে সে হাত ধরে টেনে আমাকে উঠে বসতে সাহায্য করল।
-“মনে তো হচ্ছে আমি অক্ষতই আছি। তা তুমি কোন বারের?” উঠে দু হাতে ভর দিয়ে বসে আমি প্রশ্ন করলাম। আমার মাথা তখনও ঝিমঝিম করছে।
-“আমি বুধবার। চল এইবার সময় সুযোগ থাকতে ঝটপট রকেটের হালটা সারিয়ে ফেলা যাক।“ বলল সে।
-“ কিন্তু সোমবারের সে কোথায়?” জিজ্ঞেস করলাম আমি।
-“সে নেই। আর তার মানে তুমিই সে।“
-“কি ভাবে?”
-“ভেবে দেখ, সোমবারের আমি সোমবার মাঝরাত পেরোতেই, মঙ্গলবার সকালে হয়ে গেল মঙ্গলবারের আমি, অর্থাৎ তুমি।“
-“কিন্তু সোমবার আর মঙ্গলবারের দুজন আলাদা সময়ের আমি মিলে একজন হয়ে গেলাম কি করে সেটা আমার মাথায় ঢুকল না।”
-“ওসব ছাড় এখন। আস্তে আস্তে ব্যাপারটা তোমার গা সওয়া হয়ে যাবে ও মাথায়ও ঢুকে যাবে। কিন্তু এখন জলদি চল, আমাদের হাতে নষ্ট করবার মত সময় একেবারে নেই!“
-“এক মিনিট, আমি যদি মঙ্গলবারের আমি হই আর তুমি যদি বুধবারের আমি হও, আর যদি বুধবার ঐ সময় অবধি হালটা মেরামত না হয়ে থাকে, তার মানে কোনও না কোনও কারণে আমরা হালটা মেরামত করতে ব্যর্থ হব, তা না হলে তুমি বুধবারে দাঁড়িয়ে মঙ্গলবারে এই সময়ে আমার কাছে হালটা মেরামত করতে সাহায্য চাইতে না। সুতরাং তোমার কি মনে হয় না যে আমাদের রকেটের বাইরে গিয়ে নিজেদের জীবন বিপন্ন না করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে?”
-“আবোল তাবোল ভাবা বন্ধ কর! আমি হলাম বুধবারের আমি আর তুমি হলে মঙ্গলবারের আমি আর এই রকেটের অস্তিত্ব, আমার অনুমান, মহাজাগতিক ঘূর্নির খপ্পরে পড়ে বিভিন্ন দিনে বিক্ষিপ্ত। রকেটের কিছু অংশ রয়েছে মঙ্গলবারে, কিছুটা রয়েছে বুধবারে আর কে জানে কিছু সামান্য অংশে হয়ত এখন বৃহস্পতিবার। মোদ্দা কথা হল ঘূর্নির প্রভাবে সমস্ত রকেটের সময়-মাত্রা ঘেঁটে তালগোল পাকিয়ে রয়েছে, কিন্তু তাতে আমাদের কি? এই মুহূর্তে এইখানে আমারা দুজন একসঙ্গে রয়েছি, সুতরাং আমাদের কাছে হাল মেরামত করবার সুযোগ রয়েছে তাই নয় কি?!“
-“না, ভুল করছ! ভেবে দেখ, তুমি তো সমস্ত মঙ্গলবার অতিক্রম করেই বুধবারে পৌঁছেছ, সুতরাং মঙ্গলবার তোমার অতীত, আর তোমার সেই অতীতে যদি রকেটের হাল মেরামত না হয়ে থাকে তবে সেটার একটাই মানে হয় যে মঙ্গলবারে হাল মেরামত হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই আর যেহেতু আমার কাছে সময়টা এখনো মঙ্গলবার, তাহলে যদি আমরা এই মুহূর্তে হাল মেরামত করতে যাই এই মূহুর্তটাও তোমার কাছে অতীত ও আমরা সফল হলে তোমার বর্তমানে কোনও কিছু মেরামতের আর প্রয়োজন হওয়ারই কথা নয়, অর্থাৎ……”
-“অর্থাৎ তুই একটা গণ্ডারের মতই গোঁয়ারগোবিন্দ! এর জন্য তোকে প্রচুর আফসোস করতে হবে। তবে একটাই সান্ত্বনা যে তুইও নিজের গোঁয়ার্তুমিতে এইভাবেই অগ্নিশর্মা হবি যেরকম এখন আমি হচ্ছি তোর ওপর- শুধু মাত্র একটা রাত কাটতে দে আর তোর বুধবার আসতে দে!” গজরাতে গজরাতে বলল বুধবারের আমি।
-“দাড়াও, এক মিনিট, বলছ যে বুধবারে আমি মঙ্গলবারের আমাকে হাল সারাতে যেতে পীড়াপীড়ি করব, ঠিক যেমন তুমি করছ তবে একমাত্র তফাত হবে যে কাল তোমার যায়গায় আমি থাকব? কিন্তু…তাই তো! সময় ডিগবাজি খেলে তো একেবারে তাইই হওয়ার কথা! সব বুঝতে পেরেছি এবার, দাঁড়াও আমি আসছি, তোমার সঙ্গে যাবো হাল মেরামত করতে… “
কিন্তু এই বলে আমি যেই না মেঝে ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে যাব, আকাশযান তখনি আর একটা নতুন ঘূর্নীতে প্রবেশ করল আর আমরা ছিটকে যানের সিলিঙের সঙ্গে গিয়ে সেঁটে গেলাম। মহাকর্ষের প্রবল টানে যানের গোঙানি ও ঝাঁকুনি মঙ্গলবার রাত কাবার করে একেবারে বুধবার সকাল পর্যন্ত চলল। আর ওই অবস্থার একটু উন্নতি হতেই যেই না সিলিং ছেড়ে দেয়াল বেয়ে একটু একটু করে নিচে নামতে শুরু করেছি, জেনারেল থিওরি অফ রিলেটিভিটির গোদা বইটা সটান ছুটে এসে আমার কপালে এমন জোর ধাক্কা মারল যে আমি চোখে সর্ষেফুল দেখে আবার জ্ঞান হারালাম। চোখ খুলতেই আমি দেখলাম মেঝেতে ছড়ানো ডিশের ভাঙা টুকরোর মধ্যে উপুর হয়ে শুয়ে একটা লোক কাতরাচ্ছে। গা ঝাড়া দিয়ে লাফিয়ে উঠে ওর হাত ধরে মৃদু টান দিয়ে বললাম,
-“উঠে পড়ো, তুমি ঠিকই আছো। খুব বেশি চোট লাগে নি তো?”
-“মনে হচ্ছে আমি অক্ষতই আছি। তা তুমি কোন বারের?” দুহাতে ভর দিয়ে উঠে বসে, চোখ পিটপিট করতে করতে প্রশ্ন করল ঐ আমি।
-“আমি বুধবার। চল এবার সময় সুযোগ থাকতে ঝটপট রকেটের হালটা সারিয়ে ফেলা যাক।“
-“কিন্তু সোমবারের সে কোথায়?” হাতে ভর দিয়ে কিছুটা উঠে বসে জিজ্ঞেস করল সে। লক্ষ্য করলাম ওর একটা চোখে কালশিটে।
-“সে নেই। আর তার মানে তুমিই সে।“
-“কি ভাবে?”
-“ভেবে দেখ, সোমবারের আমি সোমবার মাঝরাত পেরোতেই, মঙ্গলবার সকালে হয়ে গেল মঙ্গলবারের আমি, অর্থাৎ তুমি।“
-“কিন্তু সোমবার আর মঙ্গলবারের দুজন আলাদা সময়ের আমি মিলে একজন হয়ে গেলাম কি করে সেটা আমার মাথায় ঢুকল না”
-“ওসব ছাড় এখন। আস্তে আস্তে ব্যাপারটা তোমার গা সওয়া হয়ে যাবে ও মাথায়ও ঢুকে যাবে। কিন্তু এখন জলদি চল, আমাদের হাতে নষ্ট করবার মত সময় একেবারে নেই!“
এই বলে আমি মেরামতের যন্ত্রপাতি গোছাতে শুরু করলাম।
-“এক মিনিট, আমি যদি মঙ্গলবারের আমি হই আর তুমি যদি বুধবারের আমি হও, আর যদি বুধবার ঐ সময় অবধি হালটা মেরামত না হয়ে থাকে, তার মানে কোনও না কোনও কারণে আমরা হালটা মেরামত করতে ব্যর্থ হব, তা না হলে তুমি বুধবারে দাঁড়িয়ে মঙ্গলবারে এই সময়ে আমার কাছে হালটা মেরামত করতে সাহায্য চেয়ে বেড়াতে না। সুতরাং তোমার কি মনে হয় না যে আমাদের রকেটের বাইরে গিয়ে নিজেদের জীবন বিপন্ন না করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে?”
-“আবোলতাবোল ভাবা বন্ধ কর! আমি হলাম বুধবারের আমি আর তুমি হলে মঙ্গলবারের আমি………
আর এইভাবেই আমরা বচসা চালিয়ে গেলাম, কিন্তু গতরাতের উল্টো ভুমিকায় অবতীর্ণ হয়ে। ঝগড়া যত চলতে লাগল আমার মাথাও ততই গরম হতে থাকল, ও কিছুতেই আমাকে হাল মেরামতে সাহায্য করতে যেতে রাজি হল না আর আমিও রেগে উঠে ওকে গোঁয়ার-গণ্ডার বলে গাল পাড়তে থাকলাম। অবশেষে যখন ও আমার সঙ্গে রকেটের বাইরে যেতে রাজি হল, ঠিক তখনই রকেটটা গিয়ে আর একটা মহাকর্ষীয় ঘূর্ণিতে ঝাঁপ মারল। আমার শরীরে একটা ঠান্ডা স্রোত খেলে গেল, মনে হল যে এই সময়ের গোলোকধাঁধায় অনন্তকাল ঘরে একই চক্রে ঘুরে যাব নাকি আমি ও আমার এই দুই নম্বর সংস্করণ? কিন্তু ভাগ্যক্রমে তা ঘটল না। যানের ওপর মহাকর্ষীয় বল কম হয়ে আমি আবার নিজের পায়ে উঠে দাঁড়িয়ে আবিষ্কার করলাম যে রকেটের কেবিনে আমি আবার একা। মঙ্গলবারের সময়সুত্র যা এতক্ষণ আমার রান্নাঘরের সিঙ্কের সামনের অংশ দখল করে ছিল, এখন ছিন্ন হয়েছে; সম্ভবত চিরকালের জন্য আমার ঐ অতীত অবশেষে আমার নাগালের বাইরে চলে গেছে। ছুটে গিয়ে আবার ম্যাপের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে খুঁজতে শুরু করলাম যে কাছাকাছি আর কোনও ঘূর্নি আছে কি না, যার কাছে কোনোরকমে পৌঁছে আবার সময়কে পাক খাইয়ে নিজের কোনও জোড়ার থেকে হাল মেরামতে কোনও সাহায্য পাওয়ার চেষ্টা করা যায় যদি।
ম্যাপে সেরকম একটা পেয়েও গেলাম, আর অনেক পরিশ্রমে বহু ঘণ্টার চেষ্টায় আকাশযানের মুখ কোনও রকমে ঘোরাতে সফল হলাম যাতে একেবারে ঐ ঘূর্নির মর্মস্থল ভেদ করে যায়। লক্ষ্য করলাম যে ম্যাপ অনুযায়ী এই ঘূর্নিটার আকার অন্যগুলোর থেকে কিছুটা আলাদা। এটায় পাশাপাশি দুটো কেন্দ্রবিন্দু ম্যাপে আঁকা রয়েছে। ব্যাপারটাকে খুব একটা আমল দিলাম না। বহু ঘণ্টা ইঞ্জিন রুমে মেহেনত করার ফলে আমার আমার হাত মুখ কালিঝুলি মেখে ময়লা হয়ে পড়েছিল, কাজেই ঘূর্নিতে পৌঁছতে এখনো দেরি আছে দেখে হাতমুখ ধোওয়ার জন্য বাথরুমের দিকে এগোলাম, কিন্তু বাথরুমের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। ভিতর থেকে জল দিয়ে কুলকুচো করার মত একটা শব্দ কানে এল।
-“ভেতরে কে?!” হতবাক কন্ঠে প্রশ্ন করলাম।
-“আমি” ভেতর থেকে সাড়া এল।
-“কোন আমি?”
-“ইজ্ন টিচি।“
-“কোন বারের?”
-“শুক্রবারের। কি চাই তোমার?”
-“হাত ধুতে চাই…।“ নিজের অজান্তেই মুখে এই জবাব এসে পড়ল। তবে মনে তখন অনেক ভাবনার ভিড়। আমার কাছে এখন বুধবার সন্ধ্যে, আর ভেতরের আমি শুক্রবারের, সুতরাং যে ঘুর্নি তাক করে রকেট এগিয়ে চলেছে তার প্রভাবে সময় শুক্রবার থেকে পাক খেয়ে বুধবারে এসে পড়েছে, কিন্তু পড়বার পরে কি হবে তা আন্দাজ করার কোনও উপায় নেই। আর সব চেয়ে বড় প্রশ্ন হল তাহলে বৃহস্পতিবারে কি ঘটল? আমার শুক্রবারের জোড়া তখনো বাথরুমের দরজা খোলে নি। আমি অনবরত দরজায় ধাক্কা দিচ্ছি কিন্তু সে ভেতরে নিজের ইচ্ছেমত কুলকুচো করে চলেছে। আমার আর ধৈর্য্যে কুলালো না। চেঁচিয়ে বললাম-
-“তোমার ঐ কুলকুচো থামাও! প্রতিটা মুহূর্ত এখন দামি; কাজেই এখুনি বাইরে এস। আমাদের রকেটের হাল মেরমত করতেই হবে।“
দরজার ওপাশ থেকে ঘড়ঘড়ে গলায় উত্তর এলো।
-“হাল সারাতে আমাকে কি প্রয়োজন? একটু খুঁজলেই বৃহস্পতিবারের আমাকে পেয়ে যাবে। ওকে নিয়ে যাও…”
-“বৃহস্পতিবারের?! তা কি করে সম্ভব?…”
-“ সম্ভব কি না আমার চেয়ে ভালো কে জানবে? ভুলে যেও না যে তোমার বুধবার আর ওর বৃহস্পতিবার কাটিয়েই আমি শুক্রবারে এসে পৌঁছেছি।“
আমার মনে আবার সব কিছু তালগোল পাকিয়ে গেল। কিন্তু কেবিনে একটা শব্দ শুনে সেখানে ছুটে গিয়ে দেখি একটা লোক কেবিনে দাঁড়িয়ে খাটের তলা থেকে যন্ত্রপাতির ব্যাগটা টেনে বার করছে।
তার দিকে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
-“তুমি কি বৃহস্পতিবারের?”
-“ঠিক ধরেছ। এবার আমার সঙ্গে এসে হাত লাগাও…”
এগিয়ে গিয়ে খাটের নিচের ব্যাগটা ধরে টানাটানি করতে করতে জিজ্ঞেস করলাম,
-“আমরা কি এবার হালটা সারাতে সফল হব?”
-“তা আমি জানি না। বৃহস্পতিবারে ওটা মেরামত হয় নি, শুক্রবারের আমাকে জিজ্ঞেস কর গিয়ে…”
এটা আমার মাথায় আসে নি। ছুটে বাথরুমের দরজার সামনে পৌঁছে গেলাম।
-“এই যে শুক্রবারের জন! হালটা কি তোমার বারে সারাই হয়েছে?”
-“শুক্রবার অব্ধি ত হয় নি।“ বলল সে।
-“হয় নি কেন?”
“এই জন্যে,” দরজা খুলে এবার বেরিয়ে এল সে। দেখলাম তার মাথায় একটা তোয়ালে জড়ানো আর হাতে একটা চ্যাপ্টা ছুরি যার সমতল দিকটা দিয়ে সে তার কপালে গজানো ডিমের আকারের একটা আবের ফোলা কমানোর চেষ্টা করছে।
বৃহস্পতিবারের আমি এর মধ্যে যন্ত্রপাতি হাতে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে ও কপালে আব গজানো আমি-কে চুপচাপ পর্যবেক্ষণ করে চলেছে আর সেই আমি তখন হাত বাড়িয়ে একটা সেলজার সাইফন* বাথরুমের তাকে তুলে রাখছে। এতক্ষনে বুঝলাম যে যাকে আমি কুল্কুচোর শব্দ বলে ভেবে আসছিলাম তা আসলে এই সাইফনের শব্দ।
শুক্রবারের ঐ দূর্দশা দেখে আমার একটু মায়া হোল। ওকে জিজ্ঞেস করলাম,
-“ তোমার এই দশা হল কি ভাবে?”
-“কিভাবে নয়, বরং বল কার হাতে। এ রবিবারের আমার কীর্তি।“
-“রবিবারের আমি? এ যে অবিশ্বস্য! কিন্তু কেন?…”
-“সে অনেক কথা…”
-“বাদ দাও ওসব! যদি হালটা মেরামঅত করতে চাও ত আমার সঙ্গে এস। এখনি!” বৃহস্পতিবার তাড়া দিল পেছন থেকে।
-“কিন্তু রকেটটা যে কোনও মুহূর্তে ঘূর্নির মধ্যে গিয়ে পড়বে। আমরা তখন রকেটের বাইরে থাকলে আমরা মহাশূন্যে ছিটকে যাব আর আমাদের লীলা ওখানেই শেষ হবে…” বললাম আমি।
-“মাথা খাটাও বুরবক! শুক্রবারের আমি জলজ্যান্ত তোমার সামনে দাঁড়িয়ে। সুতরাং আজ অর্থাৎ বৃহস্পতিবার আমাদের কোনও ক্ষতি হতে পারে না।“ বলল বৃহস্পতিবার।
-“কিন্তু আজ ত বুধবার।“ আপত্তি জানিয়ে বললাম আমি।
-“তাতে কি? বুধ হোক বা বৃহস্পতি, আমরা দুজনেই শুক্রবারের মুখ দেখব।“
-“হ্যাঁ, কিন্তু আসলে আমরা দুজন নই, এটা সময়ের ডিগবাজির সৃষ্ট একটা অসংগতি। আসলে আমরা একই মানুষ শুধু সপ্তাহের আলাদা দুটো দিনের…” বৃহস্পতির ভুল ধরিয়ে দিলাম আমি।
-“আচ্ছা বাবা ঠিক আছে। এবার আকাশযানের দরজাটা খোলো চুপচাপ…।“
কিন্তু এইবার একটা সমস্যা দেখা দিলো। আমাদের খেয়াল হল যে আকাশযানে ত একটাই মাত্র স্পেস স্যুট রয়েছে। সুতরাং আমার আর বৃহস্পতিবারের এক সঙ্গে রকেটের বাইরে যাওয়ার কোনও উপায় নেই। কাজেই হাল সারাই করবার সমস্ত পরিকল্পনা শিকেয় উঠল। রেগেমেগে নিষ্ফল আস্ফালন করতে লাগলাম-
-“জাহান্নামে যাক সব! আগাগোড়া স্পেস স্যুটটা পড়ে থাকা উচিত ছিল আমার। এতক্ষণ একথা খেয়ালই হয় নি। কিন্তু তুমি ত বৃহস্পতিবারের। অর্থাৎ তোমার বুধবারেই এই ব্যাপারটা তোমার মাথায় এসে থাকবে। তোমার তো মনে করে স্যুটটা পড়ে নেওয়া উচিত ছিল! ”
-“স্পেস স্যুট আমি পড়ছিলাম, কিন্তু শুক্রবারের আমি ওটা কেড়ে নিয়েছে”, বৃহস্পতিবার বলল।
-“কখন? কেন?”
-“এহ, ওসব গল্প আর শুনে কি করবে? নিজেই তো সময়মত সব জানতে পারবে।” এই বলে হাল ছেড়ে কাঁধ ঝাকিয়ে সে কেবিনের দিকে চলে গেল।
লক্ষ্য করলাম শুক্রবারের আমাকেও আর দেখা যাচ্ছে না। বাথরুমের দরজা খুলে দেখলাম সেখানে কেউ নেই। কেবিনে ফিরে দেখি বৃহস্পতিবার খুব মনযোগ সহকারে ছুরির ভোঁতা অংশটা দিয়ে একটা ডিম ফাটিয়ে ভেতরের তরলটা গরম তাওয়ায় ধোঁয়া ওঠা গরম মাখনে ঢালছে।
-“শুক্রবার কোথায়?”
-“শনিবারের কাছাকাছি কোথাও থাকবে নিশ্চই।“ তাওয়ায় ঢালা ডিম খুন্তি দিয়ে নাড়তে নাড়তে শুকনো গলায় জবাব দিল সে।
-“আর এটা কি হচ্ছে? তোমার ত এতক্ষণে বুধবারের খাওয়া হয়ে যাওয়া উচিত। তহলে কার অনুমতিতে তুমি বুধবারে আবার খাওয়ার আয়োজন করছো?”
আমার প্রতিবাদে তার কোনও প্রতিক্রিয়া হল না। তাওয়ায় লেগে যাওয়া বাদামি ডিমের পড়ত ছুরি দিয়ে চাঁছতে চাঁছতে সে আগের মতই শান্ত স্বরে বলল,
-“এই যানের র্যাশনে আমারও তোমার সমান অধিকার আছে ভুলে যেও না। আর একটু আগেই তো বলছিলে যে আমি আর তুমি আদতে এক। তাহলে আমার খাওয়া আর তোমার খাওয়া একই ব্যাপার নয় কি?”
-“কি যুক্তি! দাঁড়াও, অতটা মাখন নিলে! পাগল নাকি? আমার ভাঁড়ারে এত বাড়তি লোকের খাবার নেই!”
আমার কথা শেষ হতেই ওর হাত থেকে তাওয়াটা ছিটকে গিয়ে রকেটের দেয়ালে আছড়ে পড়ল; অর্থাৎ আমরা আবার এক ঘূর্নির মধ্যে প্রবেশ করলাম। আকাশযান হেঁপো জ্বরের রুগির মত কাঁপতে ও কোঁকাতে শুরু করল। এদিকে আমি তখন বাইরে করিডরে পৌঁছে স্পেস স্যুটটা গায়ে চাপাতে বদ্ধপরিকর। আমি বুধবার ছেড়ে বৃহস্পতিবারে পৌঁছলে যাতে আমার গায়ে স্পেস স্যুটটা চাপানোই থাকে; আর একবার ওটা পড়তে পারলে আমি শুক্রবারের আগে কোনও ভাবেই ওটা গা থেকে খুলব না। অতএব বৃহস্পতির আমার আর শুক্রবারের আমার যখন দেখা হবে তখন আমাদের দুজনের গায়েই স্পেস স্যুট চাপানো থাকবে আর আমরা অবশেষে ওই অলুক্ষুনে হালটা মেরামত করতে পারব। কিন্তু মহাকর্ষের প্রবল চাপ পড়তেও আমি মাথা ঘুরে চোখে অন্ধকার দেখে পড়ে গেলাম আর যখন জ্ঞান ফিরল, দেখলাম আমি আমার আগের অবস্থান অর্থাৎ বৃহস্পতিবারের ডান দিকের বদলে বাঁ দিকে মেঝেতে পড়ে রয়েছি। মনে মনে যতই দৃঢ় সংকল্প হই না কেন, কাজে স্পেস স্যুটটা পড়া যে প্রায় অসম্ভব তা এইবার টের পেলাম। মহাকর্ষের প্রচণ্ড টান কাটিয়ে নড়াচড়া করাই আমার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়েছে। ঘূর্নির টান কিছুটা কম হতে আমি এক এক ইঞ্চি করে শরীর ঘষ্টে ঘষ্টে করিডোরের দরজার দিকে নিজেকে টেনে নিয়ে চললাম। এরই মধ্যে লক্ষ করলাম যে বৃহস্পতিবারও আমার মতই বুকে হেঁটে ঐ দরজাটার দিকে এগিয়ে চলেছে। এইভাবে প্রায় এক ঘণ্টার চেষ্টায় ঠিক যখন আকাশযান ঘূর্নির গভীরতম অংশ দিয়ে চলছে, আমরা দুজনেই দরজার চৌকাঠে এসে একত্র হলাম। ঘূর্নির চাপে মেঝের সঙ্গে সেঁটে থাকতে থাকতে ভাবলাম দরজার হাতলটা অব্ধি পৌঁছতে আমার পরিশ্রম করবার কোন অর্থ আছে? বৃহস্পতিবারই ঐ মেহেনতটা করুক গে। কিন্তু তখনই গত কিছুক্ষণের ঘটনাপরম্পরা মনে করতেই বুঝলাম যে এই মুহূর্তে আমিই বৃহস্পতিবার, অপর জন নয়।
-‘তুমি কোন দিনের?” নিশ্চিত হতে ওকে জিজ্ঞেস করলাম। মহাকর্ষের চাপে আমার মেঝেতে পিষে যাওয়া মাথা একটু ফিরিয়ে ওর চোখে চোখ রাখলাম। অনেক কষ্টে ওর মুখে থেকে একটা গোঙানির মত শব্দ বের হল,
-“বৃ-হ-স্প-তি”,
এটা একেবারেই প্রত্যাশিত ছিল না। এও কি সম্ভব যে ঘূর্নির ঘটানো সময়ের ওলট-সত্ত্বেও আমি এখনো বুধবারেই রয়ে গেছি? গত কিছুক্ষনের ঘটনা গুলো মনে করবার চেষ্টা করলাম। না, এ হতে পারে না। সুতরাং ঐটা নিশ্চিত শুক্রবারের আমি। ঘূর্নিতে পড়বার আগে যদি ও আমার থেকে একদিন এগিয়ে থেকে থাকে তবে এখনো তাইই আছে। আমি শুয়ে শুয়ে ওর হাতল ঘুড়িয়ে দরজা খোলার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিন্তু মনে হল সে ও একই প্রত্যাশায় স্থির হয়ে উল্টে পড়ে আছে। এরই মধ্যে মহাকর্ষের টান অনেকটাই কমে গেছে, সুতরাং আমি গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দরজা খুলে করিডরে ছুটলাম। করিডরে স্পেস স্যুটটা প্রায় বগলদাবা করে এনেছি এমন সময়ে কে যেন আমাকে একটা বিষম ল্যাং মারল আর স্পেস স্যুটটা আমার হাত থেকে কেড়ে নিল। ল্যাং খেয়ে মুখ থুবড়ে করিডরের মেঝেতে পরে আমি গড়াগড়ি গেলাম।
-“হতচ্ছাড়া কুকুর! শেষে নিজেই নিজেকে ল্যাং মারলি-এতটা নীচে নামলি কি করে!”
কিন্তু আমার কথায় কর্নপাত না করে ও শান্তভাবে স্পেস স্যুটে পা গলিয়ে ওটা পড়তে উদ্যত হল। ওর নির্লজ্জ আচরণে প্রচণ্ড রাগে কান গরম হয়ে উঠল আমার। তখনই স্পেসস্যুটের ভেতর থেকে কোনও এক অদৃশ্য শক্তি ওকে ধাক্কা মেরে ছিটকে ফেলে দিল। প্রথমে হকচকিয়ে গেলেও বুঝতে পারলাম যে স্পেস স্যুটের ভেতরে ইতিমধ্যেই কেউ ঢুকে বসে আছে। কিছুক্ষনের জন্য আবার কে যে কোন দিনের আমি, তা গুলিয়ে মাথা ভোঁ ভোঁ করতে লাগল।
-“এই বুধবার! ওই বৃহস্পতিকে থামাও, আমাকে সাহায্য কর।“ স্পেসস্যুটের ভেতরের জনের চিৎকারে আমার হুশ ফিরল। দেখলাম বৃহস্পতি সত্যিই ওর গা থেকে স্পেস স্যুটটা প্রায় ছিঁড়ে উপড়ে নেওয়ার জন্যে বেদম টানাটানি লাগিয়েছে।
-“দে, আমাকে স্পেস স্যুটটা দে বলছি!” অন্য আমার সঙ্গে মল্লযুদ্ধর মাঝেই হুঙ্কার ছাড়ল বৃহস্পতি।
-“ ছাড়ো আমাকে! কি করছো? কেন বুঝতে চাইছো না যে এই স্পেসস্যুটটা আমার গায়েই থাকা উচিত, তোমার নয়!?” বৃহস্পতির আক্রমণের থেকে আত্মরক্ষা করতে করতে কঁকিয়ে উঠল অন্য জন।
-“তাই নাকি? সে কোন যুক্তিতে?”
-“কারন আমি তোমার চেয়ে শনিবারের কাছাকাছি রয়েছি আর স্যুটটা আমার কাছে থাকলে শনিবার এলে তখন দুজন স্যুটপড়া আমি থাকব। বুঝলে গর্ধভ!”
এবারে আমি আর চুপ থাকতে না পেরে তর্কে যোগ দিয়ে বললাম,
-“বোকার মত কথা বলো না, শনিবারে বড় জোর স্যুটসহ একজন তুমিই থাকবে, সুতরাং সঙ্গীর অভাবে ঠুঁটো হয়ে বসে থাকা ছাড়া তুমি শনিবার আর কিছুই করতে পারবে না। স্যুটটা তোমাদের আমাকে দেওয়া উচিত। আমি যদি এখন স্যুটটা পড়ে নিই, তাহলে শুক্রবার তুমিও ওটা পড়ে থাকবে আর আমিও শনিবার ওটা পড়ে থাকব। ফলে শনিবার আমরা দুজন স্যুটধারি মিলে হালটা নিশ্চিত সারিয়ে ফেলতে পারব। কাজেই এস, বৃহস্পতি, আমাকে স্যুটটা ওর থেকে নিতে সাহায্য কর।“
এই বলে শুক্রবারের আমার শরীরের থেকে স্যুটটা খুলে নিতে ওর ওপর হামলে পড়ে স্যুটের পিঠের দিকের ফিতে ধরে টানাটানি শুরু করলাম। আমাকে কাঁধের এক ঝটকার পিঠ থেকে সরিয়ে দিয়ে আঙ্গুল তুলে শাসিয়ে ও বলল,
-“দাঁড়াও, এক পাও এগোবে না। প্রথমত মাঝরাত পার হয়ে গেছে সুতরাং তুমি বৃহস্পতিবার ডাকছ কাকে? তুমি নিজেই ত এখন বৃহস্পতিবার। দ্বিতীয়ত, স্পেসস্যুট আমার গায়ে থাকলেই সবার পক্ষে মঙ্গল। তোমরা স্পেস-স্যুট পড়লে কোনও কাজ হবে না।“
-“কেন হবে না? যদি আমি আজ এটা পড়ে নিই, আজ গিয়ে কাল এলেও আমি এটা পড়েই থাকব। সহজ হিসেব।“
-“সে তুমি দেখতেই পাবে। ভুলে যাচ্ছ যে আমিই বৃহস্পতিবারে তুমি ছিলাম আর বৃহস্পতি কাটিয়েই আমি শুক্রবারে এসে পৌঁছেছি, সুতরাং আমিই সবার চেয়ে ভালো জানি তাই না?”
-“অনেক বকেছ। এবার আমাকে ওটা দাও বলছি!” এই বলে একটা লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। কিন্তু ও আমার হাত এড়িয়ে ছুটে পালালো আর আমিও ওর পেছনে ধাওয়া করলাম। প্রথমে ইঞ্জিন রুম, সেখান থেকে কেবিন, ওর পেছনে ছুটতে ছুটতে লক্ষ্য করলাম যে এই মুহূর্তে রকেটে শুধু আমরা দুজনেই রয়েছি। আর সঙ্গে সঙ্গে এটাও স্পষ্ট হল যে রকেটের দরজার সামনে যন্ত্রপাতির বাক্স হাতে দাঁড়ানো বৃহস্পতিবার কেন বলেছিল যে ওর স্পেস স্যুটটা শুক্রবার ছিনতাই করেছে; আমিই ত রাত পেরিয়ে এখন বৃহস্পতিবার! আর শুক্রবার আমার স্পেস স্যুটটা নিয়ে পালাচ্ছে! কিন্তু পালাতে অত সহজে ও পারবে না। দেখাচ্ছি ওকে মজা! এই ভেবে করিডর পেরিয়ে ইঞ্জিন রুমে পৌঁছে গেলাম। ওর পেছনে ধাওয়া করবার মধ্যেই যেটা লক্ষ্য করেছিলাম- এবার সেটা হস্তগত করলাম; জিনিসটা ইঞ্জিন ঠান্ডা রাখবার জলবাহি ভারি পাইপের একটা বাড়তি টুকরো। ইঞ্জিন রুমের মেঝে থেকে ওটা হাতে তুলে নিয়ে সশস্ত্র হয়ে সোজা কেবিনের দিকে দৌড়লাম। ওখানেই ওকে পেয়ে গেলাম। দেখলাম গোটা স্পেস স্যুটটাই ও পড়ে ফেলেছে, একমাত্র মাথায় হেলমেটটা এখনো গলায় নি। পাইপটা বাগিয়ে ধরে মাথার ওপর তুলে ওকে হুমকি দিলাম,
-“এখুনি স্পেস স্যুটটা থেকে বেরিয়ে আয় !”
-“কিছুতেই বেরোব না!”
-“বেরো বলছি!”
একমুহূর্ত ভাবলাম ওকে আঘাত করা উচিত হবে কি না। কিন্তু বাথরুমে দেখা শুক্রবারের সঙ্গে এখন আমার সামনে দাঁড়ানো শুক্রবার মিলছে না কারন ওর মাথায় আব বা চোখে কালশিটে কিছুই নেই। তাহলে নিশ্চই এই শুক্রবারের আমারও ঐ দশাই হবে শেষ পর্যন্ত। ঐ শুক্রবার তো এতক্ষনে নিশ্চিত শনিবারে গিয়ে পৌঁছেছে; হয়ত বা রবিবারের দোরগোড়ায়। আর স্পেস স্যুটের ভিতরের শুক্রবার তো এই কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত বৃহস্পতিবার ছিল, যেই বৃহস্পতিবার এই মুহূর্তে আমি নিজে। সুতরাং সময়ের ঢাল বেয়ে আমি আর ও ক্রমশ সেই মুহূর্তের দিকে অগ্রসর হচ্ছি যে মুহুর্তে ও অক্ষত শুক্রবার থেকে আহত শুক্রবারে পরিণত হবে। কিন্তু শুক্রবার যে আমাকে বলেছিল যে ওকে আহত রবিবারের আমি করেছে। সেই রবিবারের আমার তো এখনও কোনও চিহ্ণ নেই। আরও কিছুক্ষণ কেটে গেল, আমরা একই ভাবে পরস্পরের সামনাসামনি কেবিনে দাঁড়িয়ে রইলাম কিন্তু রবিবারের এখনো কোনও পাত্তা নেই। হঠাত আমার মাথায় একটা মতলব খেলে গেল।
-“স্পেস স্যুট থেকে বেরোবি কি না!” গর্জে উঠলাম ওর উদ্দেশ্যে।
-“দূর হ হতচ্ছাড়া বৃহস্পতি!” পালটা চিৎকার করে বলল সে।
-“ আমি বৃহস্পতি নই, আমি রবিবারে রয়েছি!”, গলার শিরা ফুলিয়ে জবাব দিয়ে আমি ওর দিকে কয়েক পা এগিয়ে গেলাম। ও পা তুলে আমাকে লক্ষ্য করে একটা লাথি ছুঁড়লো। কিন্তু স্পেস স্যুটের বুট গুলো খুব ভারি হওয়ায় ওর পা খুব বেশি উঠল না। ইতিমধ্যে আমি ওর মাথায় পাইপ দিয়ে এক ঘা বসিয়ে দিলাম। খুব একটা জোরে নয় যদিও, কারন ইতিমধ্যে আমি এই সময়ের পাক খাওয়ার নিয়ম কানুন গুলো অনেকটাই বুঝে ফেলেছি । আমি জানি যে বৃহস্পতি গিয়ে শুক্রবারে পৌঁছলে ওর যায়গায় আমি নিজে থাকব আর ওই পাইপের আঘাত আমার নিজের মাথায়ই পড়বে। সুতরাং নিজে নিজের খুলি ফাটিয়ে দেওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। মাথায় আঘাতের জায়গাটা চেপে ধরে একটা চাপা গোঙানির মত শব্দ করে ও মেঝেতে পরে গেল। আমিও ঝাঁপিতে পড়ে স্পেস স্যুটটা প্রায় ছিঁড়ে ছড়িয়ে নিলাম ওর শরীর থেকে।
-“তুলো কোথায়…, সেল্টজারটা গেল কৈ…,” ইত্যাদি বিড়বিড় করতে করতে টলতে টলতে ও বাথরুমের দিকে চলে গেল।
আমি তড়িঘড়ি এত কষ্ট করে ফিরে পাওয়া স্পেস স্যুটটা পড়ে ফেলতে মনোনিবেশ করলাম। স্যুট পড়বার মাঝেই হঠাত চোখে পড়ল আমার খাটের তলা থেকে একটা মানুষের পা বের হয়ে রয়েছে । খাটের দিকে এগিয়ে গিয়ে হাঁটু মুড়ে বসলাম ব্যাপারটা ভালো করে বুঝতে। আমার খাটের তলায় একটা লোক; গপ গপ করে বিশেষ কোনও দিনের জন্য জমিয়ে রাখা আমার অন্তিম মিল্ক চকোলেটের বারটি উদরস্থ করছে আর একটা কাপড় দিয়ে মুখ ঢেকে চকোলেট চিবোনোর শব্দটা গোপন করবার চেষ্টা করছে। ব্যাটা চকোলেট খেতে এতই ব্যাস্ত যে মনে হচ্ছে বেশ কয়েকবার চকোলেটের রাংতা সমেতই ওটা কামড়েছে, রাংতার কিছু টুকরো ওর ঠোঁটের আশপাশে আটকে চিকচিক করছে। ওর পা ধরে এক টান দিয়ে বললাম,
-“আমার চকোলেটটা ছাড়! কে তুই? তুই কি বৃহস্পতিবার?”
শেষ প্রশ্নটা একটু চাপা গলায় করলাম। মনে মনে একটা আশঙ্কা হচ্ছিল যে যদি আমি ইতিমধ্যে শুক্রবার হয়ে গিয়ে থাকি তাহলে যে কোনও মুহূর্তে মাথায় পাইপের আঘাত গ্রহণ করে নিজের বৃহস্পতিবারের কৃতকর্মের ফল কড়ায় গণ্ডায় ফেরত নিতে হবে।
-“আমি রবিবারের”, ওর মুখভর্তি চকোলেটের ফাঁক দিয়ে কোনক্রমে বেরিয়ে এল উত্তরটা।
উত্তর শুনে আমার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। ওর কথা যদি মিথ্যে হয়, তাহলে আমার দুশ্চিন্তার কোনও কারণ নেই। কিন্তু যদি ও সত্যিই রবিবারের আমি হইয়ে থাকে তাহলে হলে আমার কপালে দূর্ভোগ ঘনিয়ে এসেছে কারণ শুক্রবারের আমাকে তো রবিবারই ঠ্যাঙাবে, অন্তত বাথরুমে দেখা হওয়া শুক্রবার আমাকে তাইই বলেছিল, পরে যদিও আমিই রবিবার সেজে শুক্রবারের মাথায় পাইপের ঘা বসিয়েছি। অন্যদিকে আবার মনে হল যে যদি ও রবিবারের আমি না-ও হয়, তাহলেও সম্ভবত ও আমার পরের কোনও সংস্করণ, আর ও যদি সময়ের হিসেবে আমার পরের কোনও সংস্করণ হয়ে থাকে, ও নিশ্চই জানে যে আমি শুক্রবারকে মিথ্যে বলে বোকা বানিয়েছি। তাহলে ও নিজেও যে আমাকে মিথ্যে বলছে না তার কোনও প্রমাণ নেই। আমি ওই মূহুর্তের রিফ্লেক্সে যে মিথ্যে বলেছিলাম, ওর কাছে এখন সেটা একটা সাধারণ অতীতের স্মৃতি, নিজের সময় সম্পর্কে ওই মিথ্যে বলার কৌশল নেওয়াটা ওর পক্ষে একেবারেই স্বাভাবিক। যখন আমি এই সব আকাশপাতাল ভাবছি এরই মধ্যে দেখলাম খাটের তলার বাবুটি নির্বিঘ্নে গোটা চকলেটটি পেটে চালান করে দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে এলেন।
-“যদি তুমি রবিবারই হবে ত তোমার স্পেসস্যুট কোথায়?” ওকে এবার সম্পূর্ণ চোখের সামনে দেখে প্রশ্নটা বেরিয়ে এল আমার মুখ দিয়ে ।
-“এখুনি ওটা আমার হাতে এসে যাবে।“ ঠাণ্ডা গলায় ওর উত্তরটা কানে এসে পৌঁছনোর সঙ্গে সঙ্গে ওর হাতে ধরা পাইপের টুকরোটা আমার চোখে পড়ল। এর পরে শুধু চোখের সামনে একটা আলোর ঝলকানি মনে আছে, যেন এক সঙ্গে কয়েক ডজন সুপারনোভা বিস্ফোরণ ঘটে গেল চোখের সামনে তার পরে সব অন্ধকার। জ্ঞান হতে দেখলাম আমি বাথরুমের মেঝেতে বসে আছি; কেউ একটা জোরে বাথরুমের দরজায় আঘাত করছে। আমি আহত কপালের শুশ্রূষা শুরু করলাম, আর বাইরে থেকে দরজায় করাঘাত চলতে থাকল; বাইরের লোকটা বলল ও নাকি বুধবারের আমি। আমি বাইরে বেরিয়ে বুধবারকে আমার ফুলে ওঠা কপাল দেখালাম ও তার পরে ও বৃহস্পতির পিছনে পিছনে যন্ত্রপাতি হাতে নিয়ে রওনা দিল। এর পড়ে দুজনের মধ্যে স্পেস স্যুট নিয়ে অনেক কাড়াকাড়ি ও ছুটোছুটি চলল। কোনও রকমে আমি ওই পাগলামির থেকে নিরাপদ দুরত্বে রইলাম ও শনিবার সকাল হতে হামাগুড়ি দিয়ে খাটের তলায় ঢুকে বাঁচিয়ে রাখা একটুকরো চকোলেটের সন্ধানে আমার স্যুটকেস ঘাঁটতে শুরু করলাম। স্যুটকেসে খুঁজে পাওয়া আমার শেষ চকোলেট বারটা প্রায় শেষ করে এনেছি অমন সময় কে যেন আমার পা ধরে টানাটানি শুরু করল; বুঝলাম না ওটা কোন আমি, কিন্তু হাতের কাছে পড়ে থাকা একটা পাইপের টুকরোর ঘায়ে ওটাকে কুপোকাত করে ওর গা থেকে স্পেস স্যুটটা ছাড়িয়ে নিয়ে যেই নিজে পড়তে যাবো অমন সময়ে রকেটটা পরবর্তী ঘূর্ণির মধ্যে গিয়ে পড়ল আর আমি আবার চোখে অন্ধকার দেখলাম।
জ্ঞান হতে দেখি কেবিনে বহু লোকের ভিড়। ভিড়ের চোটে প্রায় ধাক্কাধাক্কি হওয়ার যোগাড়। সকলেই আসলে আমিই। বিভিন্ন দিন, সপ্তাহ, মাসের ত বটেই, এমনকি একজন দাবী করল যে সে নাকি আগামি বছরের। এদের অনেকেরই কপালে আঘাত, চোখে কালশিটে, আর এদের মধ্যে পাঁচ জনের পরনে স্পেস স্যুট। কিন্তু রকেটের বাইরে বেরিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হালটা মেরামত করার বদলে সকলে পরস্পরের সঙ্গে ঝগড়া, তর্ক, তরজা আর গালাগালিতে ব্যস্ত। এসবের বিষয় একটাই, কে কখন কার মাথায় পাইপের আঘাত করেছে আর কে কার থেকে স্পেস স্যুট কেড়ে নিয়ে পরেছে। এর মধ্যে যখন একই দিনে সকাল, দুপুর বিকেল থেকে আমি এসে ভিড় আরও বাড়িয়ে তুলল, পরস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠল। ভয় হল যে এই রকম চলতে থাকলে কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়ত মিনিট সেকেন্ডের ফারাকের আমি এসে উদয় হবে। এদিকে যারা এর মধ্যেই এসে ভিড় করেছে, তাদের অধিকাংশই পাগলের মত মিথ্যে কথা বলতে শুরু করেছে।
আজ অবধি আমি নিশ্চিত হতে পারিনি যে কে কে আমাকে মেরেছিল আর আমিই বা কার কার মাথায় পাইপের ছাপ বসিয়ে দিয়েছিলাম। শুধু এইটুকু বুঝেছিলাম যে মারমারিটা এক একটা ত্রিভুজ গোষ্ঠির মধ্যে হয়েছিল যার তিন সহস্য ছিল বিভিন্ন বুধ, বৃহস্পতি ও শুক্রের আমি ও তারা প্রত্যেকেই ছিল আমারই কোনও না কোনও অতীত সংস্করণ। মনে হয় নিজেকে শুক্রবারের আমার কাছে রবিবারের আমি বলে মিথ্যে পরিচয় দেওয়াটাই যত নষ্টের গোড়া। এরই ফলে আমার ক্যালেন্ডার অনুসারে যতবার মাথায় পাইপের ঘা খাওয়া উচিত ছিল, তার চেয়ে একবার অতিরিক্ত আমাকে খেতে হয়েছে। কিন্তু ওসব কথা আপনাদের বেশি না জানানোই ভালো। ঘটনাগুলো আমিও যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ভুলে যেতেই চাই। সারা সপ্তাহ জুড়ে যে আমি নিজের মাথায় পাইপের ঘা বসানো ছাড়া আর কোনও কাজের কাজ করে উঠতে পারি নি, সেটা তো লোকজনের কাছে বড়াই করে বলে বেড়ানোর মত বিষয় নয়।
তবে সমবেত বচসা চলতে থাকল। কোনও কাজের কাজ না করে মূল্যবান সময় শুধু একে অপরকে দোষারোপ করে অপচয় করার মোচ্ছব যত চোখের সামনে দেখছিলাম, ততই মনে মনে দমে যাচ্ছিলাম। এদিকে রকেট আপন খেয়ালে এক ঘূর্নি থেকে আর এক ঘূর্নিতে ঝাঁপিয়ে বেড়াচ্ছিল। এদিকে ক্রমশ স্যুট পরে থাকা আমিদের সঙ্গে স্যুট বিহীন আমিদের একটা গোষ্ঠিদ্বন্দের সূত্রপাত হতে দেখলাম। আমি এই বিবাদ থামিয়ে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। অবশেষে আমার আমানুষিক পরিশ্রমের পরে সকলে একটা মিটিং-এ বসে ভদ্রভাবে পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে রাজি হল। মিটিঙে আগামী বছরের আমাকে প্রবীণ ও বেশি অভিজ্ঞ বলে সভাপতি নির্বাচিত করা হল।
একটি নির্বাচন কমিটি ও একটি মনোনয়ন কমিটি গঠন করা হল যারা কোনও রকম সম্ভাব্য সমস্যার মোকাবিলা করতে আর একটি কমিটি গঠন করল আর সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ন, আমাদের পরস্পর ঠ্যাঙানি প্রতিরোধ করতে আগামি চার মাসের আমাকে নিয়ে একটি গনসুরক্ষা বাহিনীও গঠন করা হল। তবে এই সবের মধ্যেই আবার পরবর্তী ঘূর্নির উদয় হল আর আমাদের সংখ্যা এক ধাক্কায় অর্ধেকে নেমে এল; ফলে প্রথম নির্বাচনে আমরা কোরামের জন্য নির্দিষ্ট সংখ্যার সদস্য উপস্থিত করাতে পারলাম না। সুতরাং আমাদের হাল কারা সারাবে তা নিয়ে ভোটদানের উপায় বার করতে বাই-ল সংশোধন করতে হল। এদিকে ম্যাপ অনুযায়ী অন্যান্য ঘূর্নির আবির্ভাবের কোনও বিরাম ছিল না আর প্রতিবার তা আমাদের সমস্ত পরিকল্পনা ভেস্তে দিয়ে যাচ্ছিল; প্রথমে যারা হাল মেরামতের জন্য নির্বাচিত হল তারা সকলেই এক ঘুর্নির প্রকোপে অন্তর্হিত হল; এর পরবর্তি ঘূর্নিতে মঙ্গলবারের সঙ্গে মাথায় তোয়ালে জড়ানো শুক্রবারের এক লজ্জাজনক অধ্যায়ের প্রত্যক্ষদর্শী হতে হল আমাদের। এর পরে একটা অত্যন্ত শক্তিশালী ঘূর্নির প্রভাবে রকেটে তীব্র স্থানাভাব সৃষ্টি হল। কেবিন, ইঞ্জিন রুম, করিডোর সর্বত্র ঠাসাঠাসি, আমাদের সংখ্যা বেড়ে যানে স্বাভাবিক ভাবে দাঁড়ানোর অবধি জায়গা রইল না। তবে সব চেয়ে সমস্যার বিষয় হল যে সময়ের এই ঘুর্নিপাকের পরিধি ক্রমেই বেড়ে চলেছিল। প্রথমে কয়েকজন পাকামাথা ও তার অনতিবিলম্বে কিছু ঘাড়ছাঁটা চুলের খুদে নাবালককে ভীড়ের মধ্যে মিশে থাকতে দেখলাম। বলাই বাহুল্য যে ওরা সকলেই আমারই ছেলেবেলার সংস্করণ।
এই ডামাডোলে আমার সমস্ত সময়ের হিসেব গুলিয়ে গেছিল। আমি রবিবারে রয়েছি না ইতিমধ্যে সোমবারে পদার্পণ করেছি বুঝতে পারছিলাম না। বাচ্চাগুলো ভীড়ের চাপে বাবা-গো মা-গো বলে কান্নাকাটি জুড়ল; আমাদের সভাপতি অর্থাৎ পরের বছরের আমি ভীড়ের চাপে খাটের তলায় ঢোকা বুধবারের হাতের আঙ্গুল মাড়িয়ে দিল আর তার প্রতিক্রিয়ায় বুধবার তার পায়ে একটা মোক্ষম কামড় বসিয়ে তার মুখ থেকে বেশ কিছু বাছাই করা শব্দ উৎপন্ন করল। এর মধ্যে কিছু পাকা দাড়িরও আবির্ভাব হল আর আমাদের পরিণতি নিয়ে দুশ্চিন্তা আরও বাড়িয়ে তুলল। ১৪২ আর ১৪৩ তম ঘূর্নির মাঝে আমি একটা উপস্থিতিপত্রে সবাইকে নিজের নিজের বিবরণ কাল উল্লেখ করে সই করতে বললাম। কিন্তু তা আমার হাতে ফিরে এলে বুঝলাম অনেকেই তাতে মিথ্যে কথা লিখেছে, বিশেষতঃ নিজের নিজের বয়স, কোমরের মাপ আর ওজন সংক্রান্ত উত্তর গুলোতে। এর পেছনে কোনও যুক্তি খুঁজে পেলাম না, হয়ত পরিস্থিতির চাপে স্বাভাবিক বুদ্ধি বিবেচনা সকলে হারিয়ে ফেলেছিল। ভিড়ের শব্দ ব্রহ্ম এমন উচ্চগ্রামে উঠল যে ফুস্ফুসের চরমসীমায় উঠে চিৎকার না করলে আমার কথা কারও কানে পৌঁছচ্ছিল না। এই সময়ে আমাদের সভাপতি একটি চমৎকার বুদ্ধি বাতলালো; ও প্রস্তাব দিল যে আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বৃদ্ধ আমিটিকে সবার মাঝে বসিয়ে নিজের সারা জীবনের ঘটনা পরপর বলে যেতে বলা হোক। সব চেয়ে বুড়ো আমার জীবনে নিশ্চই বাকি সকলের জীবনের ঘটনা ইতিমধ্যে ঘটে গেছে। সতরাং সকলে মিলে আমাদের মধ্যে সমস্ত চুলদাড়ি সাদা হয়ে যাওয়া আমিটিকে ধরে এনে সবার মাঝে বসানো হল। সে এতক্ষণ কেবিনের এক কোনায় চুপটি করে দাঁড়িয়ে ছিল। বয়সের ভারে ঈষৎ কাঁপা কাঁপা পদক্ষেপে এগিয়ে এসে সে আমাদের মধ্যমনি হয়ে বসল। কিন্তু তাকে প্রশ্ন করতেই সে তার সন্তান সন্তদি নাতি পুতিদের বিবরণ, তার এই নব্বই উর্ধ জীবনে কত অসংখ্য মহাকাশ যাত্রা সে পার করেছে ইত্যাদি নিয়ে লম্বা গৌরচন্দ্রিকা শুরু করে দিল। আমরা বার বার তাকে এই মুহূর্তে যে যাত্রাটি চলছে তার সম্পর্কে প্রশ্ন করছিলাম, কিন্তু মনে হল তার এই যাত্রাটি নিয়ে বিশেষ কিছুই মনে ছিল না, সামান্য যাও বা স্মৃতিতে ছিল, ওই মুহূর্তে সকলের সামনে বসে বর্ণনা দেওয়ার উত্তেজনায় সে সেসব তালগোল পাকিয়ে ফেলছে। কিন্তু বুড়ো অবসরপ্রাপ্ত মহাকাশ্চারির স্বাভাবিক অহংবোধ-এর প্রভাবে সে কিছুতেই আমাদের সামনে সত্যিটা স্বীকার করছে না। অহংকারের বশে , বিস্মৃতি গোপন করতে সে বার বার ঘুরে ফিরে একই কথা বলে যেতে লাগল। উঁচু মহলে তার বিশেষ প্রতিপত্তি, মহাকাশ্চারি হিসেবে জীবনে সে কত সম্মান ও পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছে, তার কজন নাতি-নাতনি রয়েছে আর তারা সকলে কি কি করে এই সব শুনে শুনে অধৈর্য হয়ে শেষে সকলে গলা ফুলিয়ে চেঁচিয়ে তাকে চুপ করালো। এরই মধ্যে আমরা আরো দুটি ঘূর্নি পার হয়ে এসেছি ও তারা অধিকাংশ আমাকেই নির্মম ভাবে গায়েব করে দিয়েছে। এর পরের ঘূর্নি পার হতেই শুধু যে রকেট প্রায় ফাঁকা হয়ে গেল তা নয়, স্পেস-স্যুট পড়া সব কটা আমি গায়েব হয়ে গিয়ে আমরা আবার ফ্যাসাদে পড়লাম। আমাদের কাছে একটাই মাত্র ফাঁকা স্পেস স্যুট পড়ে ছিল। ওটার অধিকার নিয়ে মারদাঙ্গা এড়াতে ভোটাভুটি করে ওটাকে করিডোরের দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখবার সিদ্ধান্ত হল। এর পরবর্তী কি কর্ত্ব্য তা নিয়ে আবার আলোচনা শুরু হল।
আলোচনা ভেস্তে গিয়ে স্পেস স্যুট নিয়ে আর এক প্রস্থ কাড়াকাড়ি মারামারির মধ্যেই আবার একটা ঘূর্নি এসে পুরো রকেটটাই ফাঁকা করে দিল। পরিস্থিতিটা ভালো করে বুঝতে চেষ্টা করলাম। কেবিনের মাঝখানে মেঝেতে কিল-চড়-ঘুঁষির প্রভাবে ফুলে ওঠা চোখমুখ নিয়ে,- চার দিকে ছড়িয়ে থাকা ভাঙা আসবাব, ছেঁড়া জামাকাপড়, ভোটের ব্যালট-পত্র ও উপড়ান জেনারেল থিওরি অফ রিলেটিভিটির বইয়ের পাতার স্তুপের মাঝে হাত পা ছড়িয়ে বসে হঠাৎ কেবিন-টা অস্বাভাবিক রকমের বিশাল মনে হল। এই জঞ্জালের স্তুপের থেকে কোনো রকমে ম্যাপটা খুঁজে বার করে বুঝলাম যে আমি মহাকর্ষীয় ঘূর্ণি অধ্যুষিত এলাকাটা সম্পূর্নভাবে পার হয়ে এসেছি। সুতরাং সময়ের পাক খাওয়া ও আমার অন্য সময়ের সংস্করণের থেকে হাল মেরামতে কোনো রকমের সাহায্য পাওয়ার আর সম্ভাবনা নেই। এই সত্যিটা উপলব্ধি করতেই প্রচন্ড হতাশা এসে আমাকে গ্রাস করল। কেবিনের মেঝেতে হাত পা ছড়িয়ে অনেকক্ষণ শুয়ে রইলাম। কিছুই আর ভালো লাগছিল না। বেশ বুঝতে পারছিলাম যে আমার উদ্ধার পাওয়ার কোনও সম্ভাবনাই প্রায় আর নেই। এইভাবে প্রায় ঘন্টাখানেক কেটে গেল। কোনওরকমে শারীরিক ও মানসিক শক্তি সঞ্চয় করে নিজেকে টেনে তুললাম। টলতে টলতে করিডোরে পৌঁছতেই অবাক হয়ে দেখলাম যে স্পেস স্যুটটা ওখানে আর নেই। অনেক চেষ্টার পরে আবছা মনে পড়ল শেষ ঘূর্ণিটার ঠিক আগে আমার দুজন খুদে সংস্করণকে সবার অলক্ষ্যে যেন দরজা গলে করিডোরে যেতে দেখেছিলাম। কিন্তু ওদের যা হাইট তাতে কি স্পেসস্যুট গায়ে চাপানো সম্ভব? এক যদি না ওরা দুজনে এক সঙ্গে স্পেস স্যুটে ঢুকে থাকে। এও কি সম্ভব?! এক ছুটে ইঞ্জিন রুমে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ প্যানেলের ওপর হামলে পড়ে বোতাম, লিভার ঘাঁটাঘাঁটি করতে লাগলাম। রকেটের হাল সম্পূর্ণ স্বাভাবিকভাবে কাজ করছে! তাহলে যখন আমরা ধেড়েগুলো গাধার মত নিজেদের মধ্যে বচসা করে মরেছি তখন ঐ দুটো খুদে শয়তান মিলে হালটা সারিয়ে ফেলেছিল। আমি আন্দাজ করলাম নিশ্চই ঐ দুজনের একজন স্পেস স্যুটের হাতায় নিজের হাত দুটো ঢুকিয়েছিল আর অন্য জন স্যুটের পায়ে। ফলে ওদের একই সঙ্গে পেঁচকল দিয়ে হালের বল্টু চেপে ধরতে ও নাটে টাইট দিতে কোনও অসুবিধেই হয় নি। একটু খুঁজতেই স্পেস স্যুটটা খুঁজে পেলাম। ওটা রকেটের দরজায় পৌঁছনোর বায়ুরোধক চেম্বারে পড়ে রয়েছে। ওর ভেতরে এখন কেউই নেই। কোনও পবিত্র উপহারের মত যত্নে ওটাকে রকেটের ভেতরে এনে সাজিয়ে রাখলাম। দুই সুদূর ছেলেবেলায় ফেলে আসা আমার দুই অমূল্য বালক সংস্করণের প্রতি অপরিসীম কৃতজ্ঞতায় আমার মন ভরে উঠল। ওই দুজনের উপস্থিত বুদ্ধির জোরে আমার বাকি পথটা নির্বিঘ্নেই কাটলো ও আমি নিরাপদে আমার গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম।
এর পরে অবশ্য শুনলাম যে সমস্ত ঘটনাটাই নাকি আমার কল্পনা প্রসূত। যারা একটু বেশীই আমার প্রতি বিরূপ তারা তো এও বলতে ছাড়ল না যে আমার কোনো কড়া মাদকে আসক্তি রয়েছে ; পৃথিবীর পরিবেশে আমি হয়ত আমি কিছুটা সংযত থাকি কিন্তু দীর্ঘ নিঃসঙ্গ মহাকাশ যাত্রায় আমার সংযমের বাঁধ ভেঙে পড়ে। এ ছাড়াও যে আমাকে নিয়ে সে সময়ে যে কত রকমের মুখরোচক গুজব চারদিকে ছড়িয়েছিল তা ঈশ্বরই জানেন। বাস্তবে আমাদের মানবসমাজটাই এইরকম; অত্যন্ত আজগুবি আবোলতাবোলও মানুষ বিশ্বাস করে থাকে অথচ এতক্ষণ ধরে যে বাস্তব বর্ণনা করলাম তা কেউ সত্যি বলে মানতে চায় না।
Tags: kalpabiswa y7n1, science fiction, কল্পবিজ্ঞান গল্প, দীপ ঘোষ, সুপ্রিয় দাস, স্তানিসোয়াভ লেম
আমাদেরও মাথায় ঘূর্ণিপাক। চমৎকার গল্প।