প্রহরী
লেখক: কার্লোস সুচলওস্কি কন, অনুবাদ: সৌরভ ঘোষ
শিল্পী: প্রমিত নন্দী
কিছুটা সময়ের জন্য খুদে যন্ত্রটা থমকে দাঁড়াল রাস্তার মাঝখানে। দিনের পর দিন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা নিয়ম মেনে এতকাল সে যে রাস্তায় অন্যান্য যন্ত্রদের মতো টহলদারি করে এসেছে ঠিক সেখানে। রোগ সংক্রমণের বিভিন্ন পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে ওরই মতো আরও খুদে খুদে যন্ত্র তৈরি করা হয়েছিল যাতে তারা সংক্রমণের হার নির্ণয় করতে পারে। তাদের যদিও সেই সমস্ত পরিস্থিতির সামনাসামনি ইদানিং খুব একটা হতে হয়নি। বিশেষ করে সংক্রমিতদের ভিড়ে এই ছোট্ট যন্ত্রটাকেও খুব একটা দেখা যায়নি। তা সত্ত্বেও এখনও অবধি রাস্তায় সে যাদের সম্মুখীন হয়েছে তাদের অনেকের মধ্যেই রোগ সংক্রমণের চিহ্ন সে লক্ষ করেছে। আর ঠিক সেই কারণে তার শরীর সংলগ্ন লাল আলো জ্বালিয়ে সে বারবার “পিক-পিক” শব্দ করেছে এবং একইসঙ্গে যেটা করেছে… সেটা আরও ভয়ঙ্কর…।
সবুজ আলোর অর্থ হল সংক্রমণের হার শূন্য। আর তার লক্ষ্যবস্তুতে যদি সংক্রমণের কোনওরকম চিহ্ন থাকে, তাহলে সে একইভাবে তার শরীর সংলগ্ন লাল আলো জ্বালিয়ে ‘পিক-পিক’ শব্দ করে থাকে। লাল আলোটা তার শরীরে সবুজ আলোটার ঠিক বিপরীত দিকে অবস্থান করছে। ছোট্ট এই যন্ত্রটার মতোই আরও বহু খুদে যন্ত্র বিভিন্ন সময়ে পর্যায়ক্রমে টহলদারি করে চলেছে অন্যান্য রাস্তায়, শহরের সরু সরু অলিগলিগুলোর মধ্যেও।
পৃথিবী অসুস্থ এক বেয়াদব রোগে। এই প্রহরী যন্ত্রগুলো রোগ সংক্রমণের লক্ষণ জানলেও, সংক্রমণের কারণ জানে না। রাস্তায় টহলদারি করার সময় তাদের একটাই মাত্র কাজ— ‘রোগ সংক্রমণের হার নির্ধারণ’। অনেক সময়ে তাদের এমন পরিস্থিতিরও সম্মুখীন হতে হয়েছে যেখানে সবুজ আলোর জৌলুস ক্রমশ কমে এসে লাল আলোর জৌলুস বেড়েছে। অর্থাৎ তারা তাদের লক্ষ্যবস্তুকে প্রথমদিকে সুস্থ মনে করলেও পরে তাদের মধ্যে অসুস্থতার ভাব ফুটে উঠেছে। সেই সমস্ত ক্ষেত্রে শেষ অবধি তারা লক্ষ্যবস্তুকে সংক্রমিত হিসেবেই ধরে নিয়েছে। কারণ এই যন্ত্রদের একটা নির্দিষ্ট কলনসূত্রের (অ্যালগোরিদম) মাধ্যমে চালনা করা হচ্ছে। যে মুহূর্তে এই যন্ত্রগুলো তার চলার পথে কোনও ব্যক্তি বা বস্তুর সম্মুখীন হচ্ছে, অ্যালগোরিদমের যান্ত্রিক পরিভাষা মেনে তৎক্ষণাৎ সক্রিয় হয়ে উঠছে তাদের যান্ত্রিক ইন্দ্রিয়। যন্ত্রে সঞ্চিত পরিভাষার আদেশে তারা যাচাই করে নিচ্ছে যে তাদের লক্ষ্যবস্তুতে কোনওরকম সংক্রমণের লক্ষণ রয়েছে কিনা। ‘অসুস্থ’ লক্ষ্যবস্তুকে চিহ্নিত করার পর সেই বস্তু সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্য তারা তুলে রাখছে তাদের যান্ত্রিক স্মৃতিকোষে। আর সেই তথ্য অচিরেই পৌঁছে যাচ্ছে তাদের নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার কাছে। সময় বুঝে তারা যাতে সংক্রমণের বিরুদ্ধে সঠিক পদক্ষেপ নিতে পারে।
কিন্তু যান্ত্রিক পরিভাষার কঠোর আদেশ মেনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা এই খুদে যন্ত্রটির সে বিষয়ে কোনও মাথা ব্যাথা নেই। স্বাভাবিক, অস্বাভাবিক কোনওরকম ফলাফলই তাকে বিচলিত করে না। সে অবশ্য কোনওকিছুরই প্রত্যাশী নয়। এমনকি এই বিরাট কর্মকাণ্ডে কোনওমতে টিকে থাকা তার ছোট্ট ধাতব কাঠামোর অস্তিত্বটুকু নিয়েও বিন্দুমাত্র চিন্তা করতে সে অপারগ। সে যেন মুক্তধারা। বলতে গেলে এই চরাচরে ঘটে চলা কোনও ঘটনাই এই ক্ষুদ্র যন্ত্রের চেতনায় ধরা দেয় না। তাই সে খানিক দাঁড়িয়ে থেকে আবার চলতে আরম্ভ করল। বিগত চব্বিশ ঘণ্টা ধরে যে পথপরিক্রমা সে করে চলেছে সেই একই পথ ধরে আরও খানিকটা এগিয়ে গেল। শরীরে সৌরশক্তি চালিত ব্যাটারি থাকায় এই দীর্ঘ পথশ্রমে তার খুব একটা অসুবিধে হয়নি। ব্যাটারিটি যে স্বয়ংক্রিয় তা বলা বাহুল্য। সেটা নিজের শক্তির চাহিদা নিজেই পূরণ করতে সক্ষম। যুগের পর যুগ পেরিয়ে এই পৃথিবী যতদিন সূর্যালোকে স্নাত হবে, ততকাল এই ব্যাটারির কোনও ক্ষয় নেই। সেই কথা ভেবেই সেটা তৈরি করা হয়েছে। অর্থাৎ যতদিন না শ্বেতবামনের আকার নিয়ে সূর্যের মৃত্যু ঘটছে অথবা কোনও দানবিক উল্কা পৃথিবীপৃষ্ঠে আছড়ে পড়ে মহাপ্রলয়ের আভাস দিচ্ছে, ততদিন এই যান্ত্রিক মিছিল অব্যাহত থাকবে। তারই সঙ্গে এই সভ্যতার নিত্য সঙ্গী হয়ে উঠবে সুনসান সড়কপথে টহলদারি করা যান্ত্রিক প্রহরীরা।
কিন্তু সেই খুদে যন্ত্র? সে কি সত্যিই জানত যে একদিন ধ্বংস অবশ্যম্ভাবী? এমন কোনও লক্ষ্যবস্তুর কথা সে কি কখনও কল্পনা করেছিল যা ‘সুস্থ’ অবস্থা থেকে নিমেষে হয়ে উঠতে পারে ‘সংক্রমিত’… যা এই ক্ষুদ্র যন্ত্রের জন্য ক্ষতিকারক!
‘ধ্বংসের’ কথা যখন উঠলই তখন এই খুদে যন্ত্রটার বিশেষত্ব আরেকটু খুঁটিয়ে বলা দরকার। লক্ষ্যবস্তুকে পর্যবেক্ষণ করতে যন্ত্রগুলো প্রথমে তাদের স্মৃতিকোষে দেওয়া তালিকার সঙ্গে লক্ষ্যবস্তুর হাব-ভাব মিলিয়ে নেয়। তাদের স্মৃতিকোষের তালিকায় রয়েছে সংক্রমিতের সম্ভাব্য বৈশিষ্ট্য। সংক্রমণের কোনও লক্ষণ ধরা পড়লেই অন্য যন্ত্ররা যেমন লাল আলো জ্বালায় এই যন্ত্র তার থেকে একটু ভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করে। সে প্রথমে লাল আলো জ্বালায় বটে। তারপর “পিক-পিক” শব্দের সঙ্গে সে শুরু করে সাইরেন বাজার মতো তীব্র যান্ত্রিক আর্তনাদ, যেন ব্যস্ত কোনও অ্যাম্বুলেন্স চিৎকার করছে। এক নিমেষে যন্ত্রটার সমস্ত শরীর কয়েকবার ঝঙ্কার দিয়ে ওঠে। সেই সঙ্গে তার মধ্যে অবিরত চলতে থাকে কোনও ভীষণরকমের জারণ-বিজারণ প্রক্রিয়া। ঠিক এইরকম পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যন্ত্রটা যা করে সেটা আরও অস্বাভাবিক। এক প্রকার ক্ষিপ্র, আগ্নেয় রশ্মি নির্গত হতে থাকে সেই যন্ত্র থেকে যা চোখের পলকে ভস্ম করে ফেলতে পারে ইহজাগতিক যা কিছু। যেন স্বয়ং রুদ্র তাঁর তৃতীয় নয়ন বিস্ফারিত করে জেগে উঠেছেন। বলা বাহুল্য সেই তেজস্ক্রিয় রশ্মিতে লক্ষ্যবস্তুর পরিণতি হয় বড়ই মর্মান্তিক। সেটা অবশেষে ছাই হয়ে মাটিতে মিশে যায়। খুদে সেই যন্ত্র থেকে তেজস্ক্রিয় রশ্মি ততক্ষণ নির্গত হতে থাকে যতক্ষণ না তার সামনে কোনও উষ্ণশোণিত প্রাণী অথবা পরবর্তী লক্ষ্যবস্তু এসে পড়ছে। পড়ে থাকা ছাইয়ের স্তূপ মিশে যায় শহরের বড় বড় রাজপথে, মিশে যায় ছোট ছোট অলিগলির আনাচেকানাচে। অন্যান্য যন্ত্র প্রহরীরা সেসব টেরও পায় না। সেটা অবশ্য তাদের কাজও নয়। পরবর্তী সময়ে তাদেরই মধ্যে হয়তো কেউ কেউ সেই ছাই মেশা ধুলো উড়িয়ে নিজের অজান্তেই হুবহু এক রাস্তা ধরে টহলদারি করতে থাকবে। তারা যে সকলেই যন্ত্র, যন্ত্রপ্রহরী। পরিবর্তন তারা বোঝে না। তারা নিয়মের দাস।
সবকিছু একরকম স্বাভাবিকই চলছিল। কিন্তু বিশেষ সেই দিনের ঘটনার পর থেকে খুদে যন্ত্রটা কেমন যেন স্তব্ধ হয়ে গেল। যন্ত্রটার মধ্যে দেখা দিল অদ্ভুত এক নিরবতা। সেই নিরবতা যে আসলে এক গভীর চক্রান্ত তা কেউ ভাবতেও পারেনি।
এই প্রহরী যন্ত্রগুলো যে দায়ভার গ্রহণ করেছে সেই তালিকা থেকে মানুষও বাদ যায়নি। সেটা বলতে গেলে সমাজ সচেতনতার খাতিরে। বহু সময় ধরে যান্ত্রিক পরিভাষার একই পদ্ধতি মেনে তারা মানুষেরও গড় আয়ু নির্ধারণ করে চলেছে। অর্থাৎ যন্ত্রদের লক্ষ্যবস্তু হিসেবে তাদের সামনে হেঁটে চলা বা দাঁড়িয়ে থাকা মানুষেরা ঠিক কতটা সংক্রমিত সেটা দেখার কাজও এই খুদে খুদে ধাতব গোলকগুলোর ওপরেই রয়েছে। কত শতাংশ মানুষ ঠিক কতটা রোগাক্রান্ত বা তারা আদৌ দীর্ঘায়ু কিনা সেটাও যন্ত্ররাই নির্ধারণ করে থাকে। এই কাজ সম্পন্ন করতে লক্ষ্যবস্তু হিসেবে মানুষ এবং যন্ত্রের মধ্যে কমপক্ষে দু-গজের দূরত্ব থাকা দরকার। কিন্তু মানুষ? তারা চিরকালের মতোই এ ব্যাপারেও চরম আত্মবিশ্বাসী। দূরত্ব বজায় রাখা অনেক দূরের ব্যাপার বরং এই যন্ত্রপ্রহরীদের সামনে তাদের হেঁটে বেড়াতে একটুও বুক কাঁপে না। যদিও তারা জানে সংক্রমণ আগুনের ফুলকির মতো ছড়িয়ে পড়ছে তাদের চারপাশে, কিন্তু তাদের দৃঢ় বিশ্বাস সেই সংক্রমণ তাদের ছুঁতেও পারবে না। তারা নিজেদের কাছে যথেষ্ট সুস্থ এবং সচেতন। তারাও যেন অনেকটা সেই খুদে যন্ত্রটার মতো। কোন কিছুরই তারা তোয়াক্কা করে না। এদের মধ্যে খুব কম সংখ্যকই সমস্ত বাধানিষেধ মেনে চলার চেষ্টা করে। কিন্তু বেশির ভাগই ব্যতিক্রমী। ব্যতিক্রমীরা মনে মনে আসলে ভিতু। তারা নিজেদের সমাজের থেকে, এই সভ্যতার থেকে নিজেদের লুকিয়ে রাখতে স্বাছন্দ্য বোধ করে। তাদের ভয়টা শুধুমাত্র সংক্রমণ নিয়ে নয়। তারা ভেতর ভেতর মনে করে তাদের মধ্যে একবার সংক্রমণ ধরা পড়লে শাস্তি হিসেবে তাদের সঙ্গে এমন বিশ্রী কিছু করা হবে যা তারা দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারে না। এসবের বাইরে আবার বেশ কিছু মানুষ আছে যাদের ধারণা তারা সংক্রমিত হয়েও নিজেদের লুকিয়ে রেখে সুস্থভাবে জীবনযাপন করতে পারে।
শেষে বর্ণিত এই বিশেষ শ্রেণির মানুষদের মধ্যে জয়ন্ত একজন। তার রোগ সংক্রমণের ব্যাপারে অবশ্য কেউই ঠিক জানে না। জয়ন্ত যদিও নিজেই সে ব্যাপারে কাউকে জানতে দেয়নি। সে যেভাবে নিজের যত্ন নিজেই নিয়ে থাকে তাতে তাকে দেখেও বিশ্বাস করা কঠিন যে সে সংক্রমিত। এমনকি অন্যান্যদের মতো সে নিজেও জানে না ভেতর-ভেতর সে আসলে অসুস্থ কি না। শুধু এইটুকুই সে বুঝতে পারে, তার মধ্যে একটা পরিবর্তন আসছে। একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছে সে। খুদে যন্ত্রপ্রহরীদের বহু সময় ধরে সে লক্ষ করেছে। তাদের গতিবিধি নিয়েও সে অনুসন্ধান করেছে অনেক এবং শেষ পর্যন্ত একটাই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে— প্রহরী যন্ত্রদের রোগ নির্ধারণ পদ্ধতি একেবারেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। এই পুরো যান্ত্রিক পদ্ধতির মধ্যে গোপনে লুকিয়ে আছে ভয়ানক কোনও চক্রান্ত।
জয়ন্তের দৃঢ় বিশ্বাস এই খুদে যন্ত্রগুলো এই মুহূর্তে শুধুমাত্র এই শহরেই নয় তারা ছড়িয়ে পড়েছে সারা পৃথিবী জুড়ে। লোকচক্ষুর আড়ালে তারা আসলে প্রতিনিয়ত ভয়ানক কোনও চক্রান্ত করে চলেছে। হয়তো সেই চক্রান্তেরই কোনও এক নির্দেশ তারা এই মুহূর্তে পালন করে চলেছে নিয়মানুবর্তিতার মুখোশ এঁটে! শহরে অকারণে আতঙ্ক সৃষ্টি করার ভান করে তারা হয়তো একটু একটু করে গ্রাস করে চলেছে এই মানবসভ্যতাকে। প্রশ্ন জাগে জয়ন্তের মনে, “যন্ত্রগুলোর যখন স্বাস্থ্য নিরপত্তা নিয়ে এতই চিন্তা তাহলে শহরে চলতে থাকা ফাঁকা বাসগুলোর ড্রাইভারদের সে পরীক্ষা করে না কেন? কিংবা পাড়ায় কোনওরকমে টিমটিমে আলো জ্বলতে থাকা মুদির দোকানের মালিকগুলোকে দেখে যন্ত্রগুলো এড়িয়ে যায় কেন? তবে কী… তবে কী তারা এখন আর কেউ মানুষ নয়…? তাদের রক্তশূন্য ফ্যাকশে মুখগুলো কিসের পরিচয় বহন করে?” ভাবতে ভাবতে কপালে ভাঁজ খেলে যায় জয়ন্তর। বেশ কিছুদিন ধরে শহরের রাস্তাঘাটে মানুষের সংখ্যা আস্তে আস্তে কেমন যেন কমে আসছে। ব্যাপারটা জয়ন্তর চোখ এড়ায়নি। কোথায় যাচ্ছে তারা? পরিবার বলতে তার মা, ভাইও যে নিখোঁজ আজ বহুদিন ধরে। জয়ন্ত একা এবং অসহায়। দিনের পর দিন শহরের রাস্তায় ধুলো আর ছাইয়ের পরিমাণও যেন অদ্ভুতভাবে বেড়ে চলেছে। এই সবকিছুর জন্যে কি তবে এই প্রহরীরাই দায়ী…?
হঠাৎ একটা খুট শব্দে তার চিন্তার জাল শতছিন্ন হয়। জয়ন্ত সতর্ক হয়ে ওঠে। অবশ্য পাড়ায় টহলদারি করতে থাকা যন্ত্রের হাত থেকে নিজেকে সবসময় বাঁচাতে সতর্ক তাকে থাকতেই হয়। বহুদিন হল সে তার নিজের বাড়ি ছেড়ে গা ঢাকা দিয়েছে গোপন এক আস্তানায়। একটা পোড়ো লাইব্রেরির পেছনে বেড়া দেওয়া ছোট্ট একটা ঝুপড়ি ঘরে নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছে সে। এটা অবশ্য ওই প্রহরীদের হাত থেকে বাঁচার এক ক্ষণস্থায়ী এবং মোক্ষম পরিকল্পনা। জয়ন্তর ধারণা বর্তমানের পরিস্থিতি ক্রমশ গুরুতর হয়ে উঠছে। তার ফলে মানুষের মধ্যে সংক্রমণ নির্ধারণ করতে রাস্তায় টহলদারি করতে থাকা যন্ত্রগুলো একদিন রাস্তা ছেড়ে মানুষের বাসস্থান ওই আবাসনগুলোয় অনুপ্রবেশ করবে এবং সেই পরিবর্তন আসতে আর বেশি সময় বাকি নেই।
এই ঝুপড়ির ঘরে সূর্যের আলো প্রায় ঢোকে না। মাঝে মাঝে একেবারে মন বসাতে পারে না জয়ন্ত। মন চায় একটু রাস্তায় নেমে চারপাশটা ঘুরে দেখতে। সে যে ঝুপড়ির বাইরে একদম বের হয় না তা নয়। বাইরে বেরনো বলতে লুকিয়ে চুরিয়ে লাইব্রেরির ভেতরে ভাঙা দুটো ঘরের মধ্যে পায়চারি করা ছাড়া আর কি-ই বা করতে পারে সে। সেটাও খুব সন্তর্পণেই করতে হয় জয়ন্তকে। পাছে প্রহরীদের হাতে ধরা পড়ে যায় সেই ভয়ে। তার মধ্যেকার আত্মবিশ্বাস কানে কানে ফিসফিসিয়ে বলে যায়, “কোনওরকম রোগ তার মধ্যে দানা বাঁধেনি… বাঁধতে পারে না।” অন্তত সেরকম কোনও লক্ষন এখনও প্রকাশ পায়নি। এক যদি না কোনও দৈববলে সে আক্রান্ত হয়ে থাকে। সেটা ছাড়া সংক্রমণের কোনও সম্ভাবনাই তার নেই।
শব্দটা যে দিক থেকে এসেছিল এবার সেইদিকে খুব সন্তর্পণে তাকাল জয়ন্ত। জায়গাটা তার ঝুপড়ির উলটো দিকের রাস্তায়। একটা নোনা ধরা, চুন খসা দেওয়াল। ওই জায়গায় আগে ছোটখাটো একটা খাবারের দোকান ছিল বটে, কিন্তু এখন আর সেসব কিছুই নেই। তবে ওখানে বেশ কিছু খাবারের প্যাকেট পড়ে রয়েছে। সেখান থেকে খুব কম লোকই এখন খাবার নেয়। শহরের জনসংখ্যা ক্রমশ হ্রাস পাওয়ায় সময়ের সঙ্গে তাই খাবারের প্যাকেটগুলো স্তূপীকৃত হচ্ছে সেই একই জায়গায়। প্রতি রাতে খাবার বোঝাই একটা ট্রাক এসে সেখানে টাটকা খাবার রেখে যায় আর আগের দিনের বাসি খাবার ফেরত নিয়ে যায়। দিনের পর দিন নিয়মিতভাবে এরকমই হয়ে চলেছে। ট্রাকটা ঠিক কোথা থেকে আসে জয়ন্তর জানা নেই। ট্রাকটা আসার আওয়াজেই তখন সতর্ক হয়ে উঠেছিল সে।
বলা যায় না ওই প্রহরীদের সঙ্গে হয়তো এই খাদ্য সরবরাহকারী ট্রাকটারও কোনও বিশেষ যোগাযোগ রয়েছে। এই সবই হয়তো একটা চক্রান্ত…! একমনে আবার ভাবতে থাকে জয়ন্ত।
ট্রাকটাকে লক্ষ করতে করতে কখন সে রাস্তায় নেমে পড়েছে এতক্ষণ খেয়ালই করেনি। কাজ সেরে ট্রাকটা ফেরার জন্য মুখ ঘোরাতেই হুঁশ ফিরল তার। গা বাঁচাতে তাই তাড়াহুড়ো করে রাস্তার পাশেই অন্য একটা অন্ধকার বাড়িতে লুকিয়ে পড়ল সে। দামড়া ট্রাকটা ওখান থেকে যতক্ষণ না সরছে ততক্ষণ নিজের ঝুপড়িতে ফেরা জয়ন্তর পক্ষে হয়তো নিরাপদ হবে না। এই বাড়িটা ফাঁকা, জনমানবশূন্য। হয়তো এই অঞ্চলে সংক্রমণের হার খুব বেশি হওয়ায় বাড়ির লোকজন অন্য কোথাও আশ্রয় নিয়েছে। নাহ এরকম ফাঁকা জায়গায় আর ভয় লাগে না জয়ন্তর। “একাকীত্ব” এখন আর তাকে একটুও বিচলিত করে না। মা আর ভাইয়ের নিরুদ্দেশের কথাটা মনে পড়তেই তার মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল। তার চেনা পরিচিত সবাই যেন এইভাবে হারিয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে। দাঁতে দাঁত চেপে ফাঁকা ঘরটার মাঝখানে লুটিয়ে পড়ে জয়ন্ত। তারপর আস্ফালন করে ওঠে, “এইভাবে আর কত…?” মাঝে মাঝে সে অসহায় বোধ করে। আর সেই অসহায়তা তাকে মরিয়া করে তলে প্রতিবাদের জন্য… প্রতিশোধের জন্য।
গভীর ভাবনায় বুঁদ হয়েও এসব নিয়ে চিন্তা করতে কখনও কখনও বড় অস্বস্তি হয় জয়ন্তর। তার মনে হয় এই বিশ্বচরাচরে সে যেন একাই এবিষয়ে বোকার মতো ভেবে চলেছে। যা তার ভাগ্যে আছে তাই হবে। এসব ব্যাপারে বেশি ভেবে লাভ নেই। নিজের মনকে শক্ত করে সে। নিজেই নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, “দেখাই যাক না শেষ অবধি এই সভ্যতার জন্য কী অপেক্ষা করে আছে…!”
আসলে জয়ন্তর জীবন এই মুহূর্তে এক চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে দিয়ে চলছে। এই শহরের নিয়মকানুন, আইনরক্ষক, বড় বড় আমলা, মন্ত্রী সবার ওপর থেকে সে আস্থা হারিয়েছে। এইতো… এইতো সেদিন যখন জয়ন্ত জানলা থেকে বাইরে উঁকি দিচ্ছিল এক অদ্ভুত দৃশ্যে তার চোখ আটকে গেল। সে দেখল তার বহুকালের চেনা পরিচিত প্রতিবেশী এক বৃদ্ধকে দুটো মুশকো লোক টেনেহিঁচড়ে একটা গাড়িতে তুলছে। আর তাদের পেছনে রয়েছে কয়েকটা খুদে খুদে যন্ত্র প্রহরী। বুড়োর সাতকুলে কেউ ছিল না। একটা গোটা বাড়িতে সে একাই থাকত। বড় ভালো লোক ছিল। ছোটবেলায় জয়ন্ত প্রায়ই যেত ওর কাছে। সে-ই তো জয়ন্তকে বলেছিল স্কাইনেট ল্যাবের গল্পটা। গল্পের ফাঁকে সেই বিখ্যাত সিনেমাটাও দেখিয়েছিল সে জয়ন্তকে— “টারমিনেটর”। টারমিনেটরের গল্পটা ভীষণ প্রভাবিত করেছিল জয়ন্তকে। হঠাৎ সেই বৃদ্ধর কী যে হল কে জানে…! অসহায় বৃদ্ধকে কেউ একটিবারের জন্যেও সাহায্য করতে আসেনি সেদিন। যে আইন অসহায়ের পাশে দাঁড়ায় না… যে আইন নিপীড়িতকে মুক্ত করতে পারে না… সেই আইনের ওপর কি ভরসা রাখা যায়? এই ছোট্ট শহরে যদি যন্ত্রপ্রহরীরা এতটাই আতঙ্ক সৃষ্টি করতে পারে, তবে সারা বিশ্বের এখন ঠিক কী পরিস্থিতি? কথাটা ভাবতেই যেন আঁতকে ওঠে জয়ন্ত। সারা বিশ্বে ঠিক কত সংখ্যক যন্ত্রপ্রহরী ছড়িয়ে পড়েছে তা তার কল্পনার বাইরে। কিন্তু এই শহরে যন্ত্রপ্রহরীর সংখ্যা কত আর এদের থেকে বাঁচার কি উপায় তা তাকে খুঁজে বার করতেই হবে।
কিন্তু এ ব্যাপারে কে তাকে সাহায্য করবে? তার পাড়ার পুলিশ স্টেশন নাকি এই শহরের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎশক্তি সরবরাহ কেন্দ্র… ঠিক কোথায় গেলে কেউ তাকে শিখিয়ে দেবে এই অতন্দ্র প্রহরীদের শায়েস্তা করার উপায়? দুশ্চিন্তার কালো মেঘ ক্রমশ ঘনিয়ে আসে জয়ন্তর মনে।
হঠাৎ একটা বিদঘুটে আর ভয়ানক চিন্তায় পেয়ে বসে তাকে। যদিও সেই পরিকল্পনায় তার জীবনের ঝুঁকি প্রবল তবুও জয়ন্ত সেসবে বিশেষ গুরুত্ব দেয় না। প্রথমেই সে পরিকল্পনা করে টহলদারি করতে থাকা কোনও এক যন্ত্রপ্রহরীকে সন্তর্পণে আক্রমণ করে অকেজো করে ফেলতে হবে এবং সেটা করতে হবে যন্ত্রটার পর্যবেক্ষণ করার আগেই। যন্ত্রটা হঠাৎ অকেজো হয়ে পড়লে সেই খবরটা নিশ্চয়ই পৌঁছে যাবে নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার কাছে। যন্ত্রটা একবার অকেজো হলে সেটা নিশ্চয়ই জয়ন্তকে শনাক্ত করার অবস্থায় থাকবে না। সেইদিক দিয়ে জয়ন্ত নিশ্চিন্ত। তবে এই পরিস্থিতির পর দুটো সম্ভাবনা থেকেই যায়।
এক, অকেজো যন্ত্রটা সেই মুহূর্তে ঠিক করতে তার গঠনত্রুটি, অথবা তার দেহ মধ্যস্ত বৈদ্যুতিন কলকবজা পরীক্ষা করার প্রয়োজনে নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা থেকে কেউ সেখানে আসতে পারে।
কিংবা দুই, অকেজো যন্ত্রের পরিবর্তে একই ধাঁচের নতুন যন্ত্র প্রহরী সেই জায়গায় আনা হবে এবং পুরোনো, আঘাতপ্রাপ্ত যন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা তাদের গবেষণাগারে ফেরত নিয়ে যাবে।
জয়ন্ত এই দ্বিতীয় সম্ভাবনাতেই প্রচণ্ড আশাবাদী। এর আগেও সে দেখেছে কোনও যন্ত্র বিকল হলে নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা ঠিক এই পদক্ষেপই নিয়েছে। আর ঠিক এই সুযোগের অপেক্ষাতেই রয়েছে জয়ন্ত। সমস্ত পরিকল্পনা ঠিকঠাক এগোলে সেই বিকল যন্ত্রের সঙ্গে লুকিয়ে জয়ন্তও পৌঁছে যাবে নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার মুখ্য গবেষণাগারে। তারপরে সে ঠিক একটা উপায় বার করে ফেলবে। তার হাতেই রয়েছে এই শহরবাসীর নিয়তি। তবে যন্ত্র বিকল হওয়ার জন্য অপরাধীকে ধরতে নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা চুলচেরা অনুসন্ধান চালাবে ঠিকই। জয়ন্ত সেসবে এখন আর ভয় পায় না। এতদিনে সে আত্মরক্ষার কৌশল শিখে গেছে।
অনুসন্ধান পর্বে আর যাই হোক নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার কাছে এইটুকু পরিষ্কার হয়ে যাবে, যন্ত্র অকস্মাৎ বিকল হয়নি। সেটাকে আসলে বিকল করে দেওয়া হয়েছে। আর সেটা বিকল করেছে অন্য কেউ নয় জয়ন্ত নিজে। তার মতো একজন সাহসী, প্রতিবাদীর কথা আইনরক্ষকরা মনে রাখুক বা নাই রাখুক মানবজাতির ইতিহাসে চিরকালের জন্য তার নাম গ্রন্থিত থাকবে।
অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে সে কোনওরকমে রান্নাঘর অবধি পৌঁছল। তারপর সবজি কাটার লম্বা ছুরিটা শক্ত হাতে তুলে নিয়ে রাস্তার দিকের দরজার কাছে এসে ঘাপটি মেরে দাঁড়াল। উত্তেজনার ঢেউ খেলছে জয়ন্তর স্নায়ুতন্ত্র জুড়ে। ভেতরে ভেতরে আরও একবার পরিকল্পনা করে নেয় সে। রাস্তায় টহলদারি করতে থাকা কোনও খুদে যন্ত্র এই বাড়ির দরজার কাছে এলেই সে প্রথমে যন্ত্রটার পেছনদিক থেকে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। তারপর হাতের ছুরিটা চেপে বিঁধিয়ে দেবে তার গোলাকৃতি ধাতব মস্তিস্কে। যদি তাতেও কিছু না হয় তারপর সে সেই ছুরিটা দিয়ে যন্ত্রটার শরীরে থাকা সমস্ত যান্ত্রিক ইন্দ্রিয়গুলোকে খুঁচিয়ে নষ্ট করে দেবে। আর সবশেষে ছুরি দিয়ে সেটার কাঠামো চিরে বের করে আনবে ধাতব পাত আর বৈদ্যুতিক তারে জড়ানো যান্ত্রিক অন্ত্র। ব্যাস! এইটুকুই যথেষ্ট ওই খুদে যন্ত্রটাকে শেষ করে দিতে।
আত্মবিশ্বাসে ভর দিয়ে দরজার পাশে অন্ধকারে মিশে যায় জয়ন্ত। তারপর অপেক্ষা করতে থাকে।
বেশ খানিকটা সময় পর একটা ঘড়ঘড় শব্দে জয়ন্ত সজাগ হয়ে উঠল। “ঘড়ঘড়” এই শব্দ তার চেনা। এর অর্থ একটাই কোনও এক যন্ত্রপ্রহরী এই রাস্তায় তার পরিক্রমা সম্পূর্ণ করছে। জয়ন্ত খানিকটা এগিয়ে এসে দরজার পাল্লাগুলো কিছুটা ফাঁক করে যন্ত্রটার গতিবিধি লক্ষ করতে লাগল। যন্ত্রটা যেন অন্যদের তুলনায় একটু বেশিই ছোট, অন্যদের থেকে একটু আলাদা। প্রচণ্ড ধীর গতিতে সেটা এগিয়ে আসছে বাড়ির দিকে। রাস্তায় মাঝে মাঝে একটু থেমে যাচ্ছে সেটা তারপর আবার চলছে। যন্ত্রটা ঠিক বাড়ির দরজার কাছে এসে পড়তেই আর একটুও সময় নষ্ট না করে পরিকল্পনা মাফিক জয়ন্ত পেছন দিক থেকে দুর্দম গতিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল সেটার ওপরে। কিন্তু সে ঠিক সুবিধে করে উঠতে পারল না। কারণ যন্ত্রটার ওপরের অংশটায় একটা শক্ত প্লাস্টিক জাতীয় পদার্থের আবরণ রয়েছে। যন্ত্রটার দেহটা আধখানা ডিমের মতো। হঠাৎ সেটাকে দেখলে অ্যালিসের রূপকথায় হাম্পটি ডাম্পটির কথা মনে পড়ে যায়। যদিও হাবেভাবে এই বস্তুটি হাম্পটি ডাম্পটির ব্যক্তিত্ব থেকে অনেকটাই আলাদা। এর পিক পিক শব্দের যান্ত্রিক আর্তনাদই হল তার প্রমাণ।
জয়ন্তর শরীরের চাপে সেই ডিম্বাকৃতি যন্ত্রটা অক্ষচ্যুত হয়ে গড়িয়ে পড়ল সামনের দিকে। আর সঙ্গে সঙ্গে তার মাথার কাছের লেন্সটা ঘুরে গেল সেই মুহূর্তে তার একমাত্র লক্ষ্যবস্তু জয়ন্তর দিকে। পিক পিক শব্দটা যেন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠল। তার শরীরের সবুজ আলোটা বিক্ষিপ্তভাবে দপদপিয়ে উঠল। জয়ন্ত প্রথমেই ভয় কেমন সিটিয়ে গেছিল। আতঙ্কের একটা ঠান্ডা স্রোত যেন নেমে গেল তার শিরদাঁড়া বেয়ে। এতকিছুর পর ‘সে সুস্থ’ এইটুকু বিশ্বাস করতে বড্ড কষ্ট হচ্ছিল তার । অবাক কাণ্ড!
যাইহোক জীবনের কঠিন পরীক্ষায় সে উত্তীর্ণ হতে পেরেছে। সেই ভেবে মনে মনে একটু স্বস্তি হলেও এখনই সে ঠিক নিশ্চিন্ত হতে পারল না। তার মনে হল হয়তো প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়ে যন্ত্রটা ত্রুটিপূর্ণ ফলাফল দেখাচ্ছে। সেটা যে সম্পূর্ণরূপে অসম্ভব তাও নয়। কারণ এই রকম আঘাত যন্ত্রটা তার চকচকে, মসৃণ ধাতব শরীরে আগে কখনও পেয়েছে বলে মনে হয় না। যন্ত্রটা তখনও উলটে পড়ে আছে তার সামনে, নিশ্চল। জয়ন্ত যন্ত্রটার চারপাশটা একবার ঘুরে দেখেল সত্যিই সেটা কাবু হয়েছে কি না। একবার হাত দিয়ে, একবার পা দিয়ে সে ঝাঁকিয়ে দিল যন্ত্রের নিথর শরীরটা। কিন্তু তাতে খুব একটা লাভ হল না। খুদে যন্ত্রটা নিরুত্তর। জয়ন্ত কী যেন ভাবল খানিকক্ষণ। তারপর দরজা খুলে ধীরে ধীরে পায়ে করে যন্ত্রটাকে ঢুকিয়ে দিল বাড়ির ভেতরে। সে নিজেও ঢুকল একইসঙ্গে। ঢুকেই সে প্রথমে যন্ত্রটাকে গড়িয়ে দিল ঘরের আরও ভেতর দিকে। যাতে সেটা চট করে বাড়ির বাইরে বেরতে না পারে। গড়াতে গড়াতে সেটা আবারও উন্মাদের মতো পিক পিক শব্দে আর্তনাদ করে উঠল বটে তবে সেটা খুব আস্তে আস্তে। কিছুক্ষণ পরে সামনের একটা দেওয়ালে ধাক্কা খেতেই শব্দটা থেমে গেল। সবকিছু আগের মতোই শান্ত। জয়ন্ত দরজার ফাঁক দিয়ে বাইরে একবার উঁকি দিয়ে দেখে নিল কোনও প্রতিবেশী তার ওপর নজর রাখছে কি না। তারপর নিশ্চিন্তে আবার ঘরে এসে ঢুকল। রাস্তাঘাট আগের মতোই জনশূন্য। নাহ তার ভয় পাবার কোনও কারণ নেই। সবকিছু তার পরিকল্পনা মতোই এগোচ্ছে। তার মন বলছে যন্ত্রটা এবারে বিকল হয়েছে। পুরোপুরি বিকল না হলেও অসুবিধে নেই। যা আঘাত পেয়েছে তাতে ঘরের ভেতর থেকে বেরনো সেটার পক্ষে মুশকিল। সুতরাং নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার থেকে যারা সেটাকে নিতে আসবে তাদের বাড়ির বেশ খানিকটা ভেতরে আসতে হবে। আর তারা যখন যন্ত্রটাকে উদ্ধারে ব্যস্ত থাকবে ঠিক সেই সময়ে পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে জয়ন্ত তাদের গাড়িতে চড়ে বসবে এবং লুকানোর মতো একটা যুতসই জায়গা খুঁজে নেবে। এই মুহূর্তে এটাই তার একমাত্র পরিকল্পনা, তার একমাত্র লক্ষ্য।
প্রায় আধঘণ্টা পরে একটা লাল রঙের গাড়ি এসে থামল বাড়িটার সামনে। দরজার ফাঁক থেকে জয়ন্ত দেখল গাড়িটার গায়ে অদ্ভুত সব চিহ্ন আঁকা। এরকম গাড়ি আগে কখনও দেখেনি জয়ন্ত। সেটা থেকে ষণ্ডামার্কা দুটো লোক বেরিয়ে এল। দূর থেকে ঝাপসাভাবে তাদের মানুষ বলেই মনে হল কিন্তু মুখটা ঠিক ভালোভাবে বোঝা গেল না। তাদের শরীর যেন রক্তশূন্য। একটা বড় মাপের ডিম্বাকৃতি জালের দু-পাশের দুটো রডকে পাল্কির মতো তারা শক্ত করে ধরে এগিয়ে আসছে। তাদের মধ্যে একজনের হাতে ধরা আছে একটা লম্বা চোঙাকৃতি বাক্স। বোঝাই যাচ্ছে সেই বাক্সের মধ্যে রয়েছে এই ডিম্বাকৃতির যন্ত্র সদৃশ আরেকটা নতুন যন্ত্র। যে এই বিকল যন্ত্রের পরিবর্তে প্রহরী হয়ে টহলদারি করবে। যে রাস্তা এই বিকল যন্ত্র সম্পূর্ণ করতে পারেনি বাকি সেই রাস্তাটুকু সম্পূর্ণ করবে এই নবাগত প্রহরী। লোকদুটোর মধ্যে একজন বোধহয় কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে প্রাপ্ত বিকল যন্ত্রের অবস্থান দেখে অন্যজনকে বাড়ির ভেতর নির্দেশ করল। তারপর তারা দুজনেই বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করল। বাড়ির ভেতরে লোকদুটো কী করছে সে ব্যাপারে জয়ন্ত একটুও আগ্রহ দেখাল না। বরং সে অযথা সময় নষ্ট না করে সুযোগ বুঝে লাল গাড়িটার পেছনে চেপে বসল। গাড়ির পেছন দিকটা প্রায় উন্মুক্ত। তাই সে যতটা পারল হাত-পা মুড়ে নিজের অস্তিত্ব গোপন করবার চেষ্টা করল।
জয়ন্ত এখন আরও বেশি উত্তেজিত। সে ঠিক যেমনটা চেয়েছিল তার পরিকল্পনা অনুযায়ী তেমনটাই ঘটে চলেছে। তাও শেষ অবধি যতটা সতর্কতা নেওয়া যায় ততই ভালো। গাড়ির পেছনে অন্য একটা চোঙাকৃতি বাক্সের পেছনে সে নিজেকে লুকিয়ে রাখল। একটা খসখস শব্দে বোঝা গেল লোকদুটো বিকল যন্ত্রটাকে একটা বাক্সে পুরছে। ঠিক যে বাক্স থেকে সেটাকে প্রথমে আনা হয়েছিল এটা মনে হয় সেই একই বাক্স। লোকদুটোর কথা শুনে জয়ন্তর অন্তত তাই মনে হল। সব কিছুই জয়ন্ত বেশ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিল। শব্দ শুনে সে বুঝল তার ঠিক দুটো বাক্স আগে ওই বিকল যন্ত্রটাকে রাখা হয়েছে। এরপর গাড়ির পেছনের দরজা বন্ধ করে লোক দুটোর গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার আওয়াজ পেতেই জয়ন্ত স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। কিন্তু সামনের দুটো বাক্স পেরিয়ে বিকল যন্ত্রটাকে দেখার কৌতূহল সে কিছুতেই দমিয়ে রাখতে পারল না। খুব সন্তর্পণে সে সামনে বাক্স দুটো সরিয়ে বিকল যন্ত্রটার বাক্সের দিকে এগিয়ে গেল।
যন্ত্রটা তখনও একইভাবে নির্বিকার হয়ে পড়ে আছে বাক্সের মধ্যে। তার নিথর ধাতব কাঠামোটা যত্ন করে শোয়ানো আছে বাক্সের মধ্যে। কিন্তু হঠাৎ… হঠাৎ এ কী হল! যন্ত্রটার শরীরটা হঠাৎ তীব্র ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল সঙ্গে উন্মাদের মতো পিকপিক শব্দে প্রচণ্ড আর্তনাদ। এক নিমেষে হতচকিত হয়ে পড়ল জয়ন্ত। তাকে কেমন দিশেহারা লাগছে। সে দেখল যন্ত্রের মাথার কাছে লাগানো লেন্সটা আগের মতোই একটু একটু করে ঘুরে যাচ্ছে তার দিকে। লাল আলোর একটা ঝলকানিও খেলে যাচ্ছে জয়ন্তর মুখের সামনে। তার মানে… তার মানে কি সে সংক্রমিত…? এইবার ধীরে ধীরে যন্ত্র থেকে বেরিয়ে এল সেই প্রচণ্ড রশ্মি। প্রথমে জয়ন্তর ত্বক, তারপর অস্থি, তারপর মজ্জা, রক্ত, রক্ত কণিকা একটু একটু করে যেন গ্রাস করতে থাকল সেটা। জয়ন্তর শরীরের ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র দেহাণু যেন বাষ্প হয়ে মিলিয়ে যেতে থাকল বায়ুমণ্ডলে। এ এক অদ্ভুত অনুভূতি জয়ন্তর কাছে। তার মস্তিষ্ক আর হৃদয় সেই নির্মম পার্থক্যটুকু বুঝতে পারল না। শুধু সে এক অপার্থিব তৃপ্তি অনুভব করল। এই দূষিত নীল গ্রহটার থেকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার তৃপ্তি। খুব হালকা লাগছে নিজেকে জয়ন্তর। কারণ আসল সত্যিটা সে উপলব্ধি করে ফেলেছে এতক্ষণে। সংক্রমণ বলে সত্যিই কিছু নেই। জয়ন্তর পরেও হয়তো তারই মতো অনেকে মুক্তির জন্য ঠিক একই রাস্তায় এগবে। একইভাবে হয়তো প্রতিবাদের ভাষা খুঁজে পাবে। কিন্তু পুরোটাই যে একটা গভীর চক্রান্ত সেটা তারা ধরতে পারবে না। শেষ অবধি তারা এই রহস্যের সমাধান করতে পারলেও বড্ড দেরি হয়ে যাবে। আক্ষেপ একটাই সে হয়তো আগামীর সভ্যতাকে দেখে যেতে পারবে না।
কিন্তু তার এই দেহকণা যা ছাই হয়ে মিশে গেছে রাজপথে, শহরের ছোট ছোট অলিগলিতে। সেই ধুলো মেখেই একদিন বড় হয়ে উঠবে আগামীর হাজার হাজার জয়ন্তরা যারা এই প্রহরীদের সামনে দাঁড়িয়ে বুক চিতিয়ে বলবে, “নাহ। যন্ত্র সভ্যতাই এই ছোট্ট গ্রহটার শেষ কথা নয়…” ততদিনে হয়তো এই শক্তিশালী রশ্মিও ফিকে হয়ে যাবে। যান্ত্রিকতা নয় শুধু মনুষ্যত্বই হবে তাদের প্রতিবাদের স্ফুলিঙ্গ, তাদের সভ্যতার একমাত্র প্রহরী।
মূল স্প্যানিশ গল্প: “বিপ বিপ” (২০২০)
Tags: অনুবাদ গল্প, কার্লোস সুচলওস্কি কন, প্রমিত নন্দী, ষষ্ঠ বর্ষ প্রথম সংখ্যা, সৌরভ ঘোষ, স্প্যানিশ অনুবাদ
ভাল গল্প। অসামান্য অনুবাদ।
অনুবাদটা ভালো হয়েছে। গল্পটা আমার অসাধারণ লাগে নি তবে পাঠযোগ্য।