নিত্যতা সূত্র
লেখক: শ্রেয়া ঘোষ
শিল্পী: প্রমিত নন্দী
এই ছোঁয়াচে অসুখে জর্জর, আতঙ্কগ্রস্ত শহরের আকাশেও শেষ বিকেলে রামধনুটা শুহার মন ভালো করে দিল। এমনকি এখনও। একান্ত সাময়িক যদিও। সাবান কাচার পর ডেটলে চুবিয়ে রোদে মেলা কাপড়গুলো তুলতে এসেছিল ছাদে। একতলার ঘুপচি থেকে, অন্ধকার ইট বেরোন এবড়োখেবড়ো সিঁড়ি পেরিয়ে ছাদের আকাশটাই একমাত্র সান্ত্বনা শুহার দুর্বিষহ শ্বশুরঘরে। কাপড়গুলো তুলে ওপরে চোখ তুলেই এ মাথা থেকে ওমাথা অব্দি টানা রঙিন বৃত্তাংশটা আচমকা সবকিছু পালটে দিল। বরাবরের মতো সাতটা রং খুঁজতে চেয়ে বড়জোর চারটে প্রথমেই। তারপর খুঁজতে খুঁজতে লুকিয়ে থাকা আরও অজস্র রং। তাদের নামও অজানা। অপূর্ব সব রং নিজস্ব তরঙ্গদৈর্ঘে পৌঁছে যায় ওর সাদামাটা জীবনে। বরাবরের মতো ভালোলাগার অভিঘাতে চোখে জল। একটা বিশ্বাস বদ্ধমূল হয়েছে এসব রং শুধু ওর জন্যে। পি.এইচ.ডি. মাঝপথে বন্ধ করে বিপুলকে বিয়ে করে ঘেঁটে যাওয়া একটা অতিবাহনে এটুকুই ওর সম্বল। একান্ত। ডানহাতটা কপালে ঠেকাতেই সূর্য সরকারদের তেতলার পেছনে টুপ করে ডুব দিল। সব হারিয়ে নিমেষে ভয়ঙ্কর নৈরাশ্যের ছাই রং দখল করে নিল আকাশের, মনের।
কাশতে কাশতে সিঁড়ি দিয়ে ততক্ষণে উঠে এসেছে বিপুল। মাস্কটা দাড়ি না কামানো অপরিচ্ছন্ন গাল থেকে ঝুলে আছে চোয়ালে। এক ঝটকায় সেই নোংরা ন্যাকরাটা খুলে শুহার নাকে চেপে ধরতে স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ায় কাপড়গুলোকে বাঁ হাতে নিয়ে ডান হাতে একটা ঝটকা দিতেই উলটে পড়ল বিপুল। হামাগুড়ি দিয়ে শুহাকে তাড়া করতেই দৌড়ে এসে ছাদের দরজটা টেনে শিকল তুলে শান্ত পায়ে নীচে। শুহা পাঁচফুট আধ ইঞ্চি। ক্ষয়াটে রোগা। গায়ের রং তামাটে। বিপুলকে এক ধাক্কায় উলটে ফেলা ওর পক্ষে অসম্ভব। কিন্তু এখন আর নিজেও অবাক হয় না শুহা।
কৃস্টালে আটকে পড়ছে বিস্তৃত এক তড়িচ্চুম্বক ক্ষেত্র। তার সবটুকু শক্তি শুহার দখলে। পোষা কুকুরের মতো বশ্যতা মেনেছে। নির্দিষ্ট টার্গেটের দিকে ছুড়ে দিচ্ছে পছন্দের তরঙ্গদৈর্ঘ্য। পুড়িয়ে দিচ্ছে, বিষিয়ে দিচ্ছে নিজের খেয়ালে। বাইরে থেকে বুঝবে না। ভিতরে চুরচুর ঝুরো বালির মতো ঝরে যাচ্ছে। তখন ক্যরামের ঘুঁটিতে টোকা দেওয়ার মতো হালকা একটা টুস্কিতে উলটে পড়ছে বিপুলের আশি কেজি পেটানো শরীরটা। বিপুলের মা দিনে দিনে একটা জড়পিণ্ড। শুধু সঠিক ওয়েভলেংথটা স্থির করা। রাত জেগে পাতার পর পাতা জুড়ে জটিল সমাধান।
নীচতলাটা ঘুপচি, স্যাঁতসেঁতে। জ্বর, কাশি, কফের কটু গন্ধে আবিল। দরজা জানলা বন্ধ সেই কবে থেকে। একফোঁটা আলো, হাওয়া ঢোকে না। ওদের সদর আটকানো বাইরে থেকে। দরজার ওপর কর্পোরেশনের নোটিশ। ওদের বাহিরে বেরোন মানা। ভিতরে তিন জন জীবাণু আক্রান্ত আর শুহা। রোগের বীজ ওর শরীরে আস্তানা গাড়েনি। ও লুকিয়ে কৃস্টালের বুক চিরে আসা সূর্যরশ্মি গিলে খায়। বুকের কাপড় সরিয়ে তাপটুকু শুষে নেয়। আর লোকদেখানি হোমিয়োপ্যাথি খায়। ভিটামিনের বড়ি। পুলিশ না পৌরসভা কারা যেন প্যাকেটে প্যাকেটে ওষুধ দিয়ে গেছে। সেগুলো বিপুল খায়। ওর মা আর ন্যালাখ্যাপা ভাইকে দেয়। শুহাকে দেয় না।
শুহাও শোধ নেয়। ফ্রিজ থেকে বের করে চিকেন রান্না করে। ডিম, মাছ, পনির, ডাল। গোটা বাড়ি রান্নার সুঘ্রাণে মাতাল করে দেয়। তারপর খেতে বসে আর কেউ খেতে পারে না। নুন দিতে ভোলে কোনওদিন। কোনওদিন পোড়া লাগায়। নীচে এসে ভাত ডাল নামিয়ে মাংস কাটার বড় ছুরিটা হাতে নিয়ে ছাদে গিয়ে দরজাটা খুলে দেয়। বিপুল তেড়ে এসে ছুরি দেখে পিছিয়ে যায়। বিপুলের প্রতি উদগ্র ঘৃণায় ফের তেড়ে যায় শুহা ছুরিটা বাগিয়ে ওর দিকে। পায়ে পায়ে ওর ন্যালাখ্যাপা দেওরটা কখন পিছনে পিছনে উঠে এসেছে খেয়ালই করেনি। হঠাৎ ওকে চমকে দিয়ে হাততালি বাজিয়ে জড়িয়ে জড়িয়ে বলে ও মা দেখে যাও দাদা ভয়ের চোটে পাজামায় হিসি করে ফেলেছে। বিয়ের পাঁচ বছরে এই প্রথম বোধহয় শুহা ওর দিকে তাকিয়ে দেখল। অদ্ভুত রূপবান এ কিশোর কি করে বিপুলের মতো একটা শয়তানের ভাই হতে পারে। ওকে ডাকতে গিয়ে খেয়াল করল শুহা নামটাই জানে না। আলতো হাতে ওর জট পড়া লালচে চুলগুলো ঘেঁটে দিয়ে নেমে এল। ওর ওড়নাটা আঙুলে পাকাতে পাকাতে ছোট।
(২)
বিপুলের সঙ্গে শুহার বিয়েটাকে প্রফেসর সেনচৌধুরি বলেছিলেন শতাব্দীর দশটি উল্লেখযোগ্য দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার অন্যতম। শুহাকে পরে পৃথা, অরুণ ওরা বলেছিল। এই সব ধারণা যে একদিন ভুল প্রমাণিত হবে নিশ্চিত ছিল শুহা। বিপুল ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্টের চাকরিটা ছেড়েছিল বিয়ের আগেই। অন্য চাকরির চেষ্টাও আর করেনি। ওর ফেলোশিপের টাকা গুনে গুনে তুলে দিতে হত বিপুলের মায়ের হাতে। পেটে বাচ্চা আসার পর হিমোগ্লোবিন সাড়ে পাঁচ হতে সন্তোষপুরে ফিরে এসেছিল। বাবা বলেছিল পাঁচ হাজার টাকা বিপুলের থেকে আনতে হবে মাস গেলে। বিপুল রাজি হয়নি। বাবা অসম্ভব বিরক্ত মুখে বলেছিল, বেশ ডেলিভারি অব্দি থেকে যাও। কিন্তু তারও পর ওরা দায়িত্ব না নেয় যদি, তাহলে সম্পর্কটা ছেঁটে ফেলতে হবে। মাঝের এই ক-টা দিনের ভুল ইরেজ করে দিতে হবে। জীবন থেকে বরাবরের মতো। জন্মের আগেই সব দায়িত্ব থেকে মুক্তি দিয়েছিল শুহাকে ওর অনাগত সন্তান। মাঝ রাতে ছাদে উঠেছিল শুহা। আলসের পাশে দাঁড়িয়ে চরম কোনও সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছিল। এমাথা থেকে ওমাথা জুড়ে সাদা রামধনু উঠেছিল। পূর্ণিমা ছিল। সাদা আলোর বৃত্তটার আরেকটু কাছে পৌঁছতে গিয়ে সহস্র বেলির টবে হোঁচট খেল।
নার্সিং হোমের খরচ বাবা মিটিয়েছিল। সেই শেষ দেখা বাবার সঙ্গে। ট্যাক্সি নিয়ে বিপুলদের ঘুপচি একতলাতেই ফিরেছিল। শর্ত বিপুলও দিয়েছিল। রিসার্চ ছাড়তে হবে। বিকল্প উপার্জনের রাস্তাও বলে দিয়েছিল। দু-একটা কোচিং সেন্টারের খবর এনে দিয়েছিল। সেখান থেকে বাড়ি গিয়ে পড়ানোর আরও কিছু সন্ধান। তবে ততদিনে নিজের কাজ স্থির হয়ে গেছে ওর।
পড়াতে পড়াতে খোলা জানলা দিয়ে দেখেছে উলটো ফুটপাথে চায়ের ভাঁড় হাতে নিয়ে বিপুল। কোচিং সেন্টারে ঢুকতে গিয়ে মুখোমুখি হয়তো। বাবার শর্তটা মেনে নেওয়াই স্থির করার মুহূর্তে বিপুলের পেছনে ঝাঁকড়া নিম গাছের আড়াল থেকে একটু একটু করে স্পষ্ট হয়েছে রামধনুটা। বিপুলের কাছে এসে জিজ্ঞেস করেছে বৃষ্টি হল বুঝি এক পশলা? তারপর হেসে হাতটা তুলে রামধনুটা দেখিয়েছে। বিপুল বিরক্ত হয়ে বলেছে আবার সেই ন্যাকামি। এবার ঘরের সিলিং-এও রামধনু দেখবে তুমি। শুহা হালকা হেসে বলেছে, তোমাকেও দেখাবো। রাতে।
– বলা হয়নি। কানু রেলে চাকরি পেয়ে গেছে। বাজারের কাজটা ছেড়ে দিচ্ছে, আমি ধরে নিলাম। আজ থেকেই। ভাত টাত খেয়ে রাতে সাড়ে দশটা এগারোটা নাগাদ বেরোব। সব ট্রাক ঢুকবে। সব্জী,মাছ, ফল। ব্যাপারীদের ভাগ বাঁটোয়ারা সেরে, হিসেব জমা দিয়ে ফিরতে ভোর হয়ে যাবে।
শুহার মুখে টক জল উঠে এসেছে। বলেছে ফের তো সকাল থেকে আমার পেছনে স্পাইগিরি।
(৩)
বিশ্বকর্মা পুজোর আগের দিন স্কুলের ফিজিক্স ল্যাব ঝাড়াঝুড়িতে হাত লাগিয়েছিল শুহা, নীতা, দু -একজন বিশুদার সঙ্গে। পুরোনো আলমারির পেছনের ঝুল, মাকড়সার জাল সরাতে গিয়ে পেয়েছিল বলটা। হাতে ধরতেই ঝিঁ ঝিঁ ধরে গিয়েছিল আঙুলে। আঙুল বেয়ে পুরো হাতে। অবশ হয়ে যাচ্ছিল যেন হাতটা। কাচের বলটা ঠেলে আরও ভেতর দিকে ঢুকিয়ে তখনকার মতো বেরিয়ে এসেছিল। ছুটির পর, ক্যালকুলেটর ফেলে এসেছি বোধহয় ল্যাবে বলেই ফের দৌড় সায়েন্স ব্লকে। বিশুদাকে দিয়ে তালা খুলিয়ে সাবধানে কাচের বলটা ব্যাগে পুরে হাঁপাতে হাঁপাতে স্কুল বাস কোনওরকমে।
কাচের গোলকটা ফাইল দিয়ে ঘষার খেলাটা শুরুটা হয়তো অকারণ। আচমকাই। তারপর ক্রমশ নেশার মতো।এদিক ওদিক ঘুরে সামান্য কয়েকটা যন্ত্র। আন্দাজেই মোটামুটি। মাঝে মাঝে কোণাগুলো মেপে নেওয়া। স্কুলের শেষ দিক থেকে শুরু। কলেজ, ইউনিভার্সিটি। থেকে গেল সঙ্গে। নিপুণ থেকে নিপুণতর হয়েছে আকৃতি। সূক্ষ্মতর কৌণিক বিন্দুগুলি, আলো পিছলোনো অজস্র তল। ক্রমশ রঙের খেলা, রামধনুর ম্যাজিক। আলো, অপটিক্স, শক্তির রূপান্তর একদিকে তত দিনে গিলে নিচ্ছে শুহাকে আর একদিকে অন্ধ একটা বিশ্বাসের কাছে স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ সম্পূর্ণ হচ্ছে। নিজেকে সর্বশক্তিমান ভাবাটা অভ্যেসে পরিণত ক্রমশ। রাতে ঘুম ভেঙে উঠে টেবল ল্যাম্প জ্বালিয়ে গোলকটায় চোখ রাখলে ভিতরে অজস্র কারিকুরি। একশোটা, দুশোটা আশ্চর্য সব রঙের সুতো। নিজেদের মধ্যে জট পাকাতে পাকাতে আবছা অবয়ব। বামনাকৃতি শুরুতে। ঘুরছে ফিরছে তারা আর বড় হচ্ছে। পাঁচ সেন্টিমিটার ব্যাসের গোলকের ভিতর পূর্ণাবয়ব আকৃতি সব। কারা এরা? খবরের কাগজের ছবিতে দেখা কাউকে, পুরোনো অ্যালবামে। আরও যারা, কোনওদিন দেখেনি, কিন্তু পরে দেখা হবে। এভাবেই একদিন কাচের বলের মধ্যে বিপুলের সঙ্গে নিজেকে দেখেছিল শুহা। সেকেন্ড ইয়ারে কলেজের ফিজিক্স ল্যাবে দেখা হওয়ার বছর তিনেক আগেই।
(৪)
বিকেলে আসতে বলেছিল বিপুলকে বাড়িতেই। সন্তোষপুরে। ইতস্তত করছিল ও। শেষ অব্দি শুহার জেদের কাছে হেরে গেল। শেষ বিকেলে সূর্যটাকে পিছনে রেখে বাগানের জল দেওয়ার মোটা পাইপ থেকে ফোয়ারার মতো জল ছেড়েছিল। লালচে আগুনের বিন্দুগুলো ভেঙে যাচ্ছিল জলের তোড়ে। আর কুয়াশার মতো জলধারার বুকে তৈরি হচ্ছিল রামধনু। হেসে গড়িয়ে পড়ছিল শুহা বিপুলের গায়ে। হাসির চোটে বিষম লেগে কাশছিল। কাশির দমকে চোখে জল এসে গিয়েছিল। মুখটা লাল হয়ে গিয়েছিল। বিপুল একটা পাথরের স্ট্যাচু যেন ওই বিশাল বাগানে। ওর খুব কাছে এসে শুহা ফিসফিস করে বলেছিল, এই সূর্য সাক্ষী রইল, এই রামধনু সাক্ষী রইল। আজ থেকে তুমি আমার বর। বিপুল ভয় পেয়েছিল। পালিয়ে গিয়েছিল। পালানোর সব পথ বন্ধ বুঝতে সময় লেগেছিল। শুহার নির্ভুল গণনায় পেয়ে যাওয়া অভ্রান্ত কৌণিক রেখায় আনত প্রতিসরিত অদৃশ্য রশ্মি বিপুলের শরীরে ঢুকে ক্রমাগত প্রতিফলিত হতে হতে ওকে বেঁধে ফেলেছে তক্ষণে আষ্টেপৃষ্ঠে। সবুজ, হলুদ আর কমলার গড় একটা কম্পাঙ্কের রশ্মি রামধনুর রং থেকে সোজা ঢুকেছে অঙ্ক করে নির্ণিত কোণে বিপুলের মেডুলায়। স্পষ্ট দেখেছে শুহা লোভ আর ধূর্তামিতে চকচক করে উঠেছে বিপুলের কুৎকুতে চোখদুটো। ওদের সন্তোষপুরের বড় তিনতলা বড়িটা, বাগানটা লোলুপ করেছে বিপুলকে। সে লোভের সংক্রমণ ছড়িয়ে দিয়েছে নিজের মা’র মনেও।রেজিস্ট্রি হয়ে গেছে নির্বিঘ্নে এর পর। লম্বা ছুটির দরখাস্ত জমা করে এসেছে প্রফেসর সেনচৌধুরির কাছে। বলেছে, শতাব্দীর মস্ত দুর্ঘটনাটা ঘটেই গেল স্যার।
ফিরে এসেছে ঘুপচি ঘরে। জানলার তাকে ওর জল খাওয়ার কাচের গ্লাসে জলের ভিতর ডুবে অদৃশ্য হয়ে লুকোন কৃস্টালটাকে হাতে তুলে নিয়ে মুঠোয় চেপে ধরেছে। চোখ থেকে গড়িয়ে এসেছে নোনা জল। ওর গলা বুক বেয়ে জমা হয়েছে কাচের মসৃণ তলে। একটু সরিয়ে ধরতেই রাস্তার ঝাঁকড়া অমলতাসের গাছের পাতা গলে আসা ছোট ছোট সূর্য বলের মতো লাফালাফি শুরে করেছে। এক সময়ে স্থির হয়ে সেই সহস্র সূর্য মিলে গিয়ে এক হয়ে ঢুকে পড়েছে গোলকের মসৃণ তল ফুঁড়ে। তীব্র উত্তাপে অদ্ভুত দপদপানি শুরু হয়ে গেছে বলের অন্তঃস্থলে। সাবধানে দেওয়ালের তাকে স্থাপন করে এক দৃষ্টে মনঃসংযোগ করেছে শুহা। রঙিন সুতোগুলো প্রথমে জট পাকিয়ে তারপর জট খুলে ধীরে ধীরে রামধনুর মতো বিস্তৃত। একটার পর একটা, আরও একটা। শুহার চোখের নোনা জল ম্যাজিক করল যেন। অসংখ্য রামধনুর মাঝে নিরালা নির্জন আলেকজাণ্ডার ব্যাণ্ডে চুপ করে হাঁটু ভাঁজ করে কে ও?
(৫)
ছোট ওর চোখের সামনেই আজ পাঁচ বছর। তবু চোখ মেলে দেখতে দেরি হয়ে গেল। এবারের গণনাটা অন্যরকম। নির্মাণের জন্যে যা কিছু তা সময়সাপেক্ষ জানে শুহা। বিপুলের রাতের ওই বাজারের কাজটা বিঘ্নহীন মনোযোগের সুযোগ এনে দিল।
-তোর বউ ডাইনি খোকা। কতবার বলেছি। রাতে ঘুমায় না। সমস্ত রাত দরজার নীচ দিয়ে আলো আসে। দিনেও ঘুম নেই। রান্না করে যখন আমি লুকিয়ে চোখ রাখি কিছু মেশাচ্ছে কিনা। আজকাল দেখি ছোটর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। ছোটকে কেমন বশ করেছে দেখেছিস?
রাতে কাজের সময়ে বন্ধ ঘর থেকেই কৃস্টালের নির্গত আলোর সুতো বেঁকে চুরে দরজার তলা দিয়ে বেরিয়ে দালান ঘুরে ফিরে আসে শুহার কাছে। বিপুলের মা একটা চুবড়ি থেকে ধুলো ধুলো কী সব ছড়িয়ে দেয় ঘরের কোণায়। ছোট ঘুমিয়ে থাকে যে চৌকিতে তার চার দিকে। বিপুলের কুঁজো হওয়া মা, তার হাতের চুবড়ির ধুলো প্রতিপক্ষ হয়ে শুহার সামনে দাঁড়ায়। ওর জেদ বাড়িয়ে দেয়। কৃস্টালের তলগুলো আরও মসৃণ করে। নিজের মস্তিষ্ক আরও ধারালো। আরও কঠিন গণনা। নিজের সঙ্গে নিজের তর্ক। তর্ক থেকে সিদ্ধান্ত। সঠিক তরঙ্গ দৈর্ঘ খুঁজে পেতে ধৈর্য লাগে অসীম।
বিপুল বলে, তোমার ওই তান্ত্রিকের ধুলো পড়া কাজ দিচ্ছে মা। ছোটর মুখ দিয়ে লাল পড়া কমেছে দেখেছ? হাত থেকে জিনিস পড়ে না আর তত। কথাগুলো ও তো বেশ স্পষ্ট। শুহা ভাবে দৃশ্যমান লাল আলো আর অদৃশ্য ইনফ্রা রশ্মির ম্যাজিক সফল হবেই এই বিশ্বাসটা ধরে রাখা শেষ অব্দি সহজ ছিল না।
(৬)
– চিনতে পারছেন স্যার? হ্যাঁ আমি শুহা। তাকিয়ে দেখুন। হয়তো শেষবারের মতো। যেমন করে এক একটা অঙ্গ, উপাঙ্গ অকেজো হয়ে যাচ্ছে সেভাবেই এবার একটা একটা করে পাঁচটা ইন্দ্রিয়।
– পাঁচ ফুট আধ ইঞ্চি বড়জোর। রোগা, ক্ষয়াটে, তামাটে গায়ের রং। মাঝে কতগুলো বছর কেটে গেল। তবু বদলাইনি একটুও। হয়তো এই স্ট্যাটিসটিক্সই বাঁচিয়ে দিয়েছে আমাকে আপনার থাবা থেকে। পৃথা পুড়ে গেল আপনার কামনার আঁচে।
– হ্যাঁ সেই কৃস্টালটা। এখনও নখ দাঁত বার করেনি। খেলনার মতো, তাই না? সঠিক বিন্দুতে স্থাপন করলেই শুরু হবে খেলা। খেলাটা আপনার জানা, তাই না স্যার। পুরোনো খেলা।
– আমার বিয়েটা নাকি শতাব্দীর সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার একটা ছিল? আপনার মতে। শিক্ষক আপনি, বিজ্ঞানের। আপনার ভণ্ডামি সেদিনই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। দুর্ভাগ্যকে সুবিধায় বদলে দেবার চ্যালেঞ্জটা কিন্তু নিলাম আমি।
– আপনার দর্শন, শ্রবণ আদি ইন্দ্রিয়গুলো এখনও জ্বালে যায়নি শুধু এই কথাগুলো শুনতে হবে বলে। আর একবার আমার সঙ্গে দেখা হওয়া বাকি ছিল বলে।
– আলো নিয়েই কাজ ছিল আমার কিন্তু শুরুতে আলোর দাহিকাশক্তিকেই ব্যবহার করে গেছি আমি। সংশোধনের সেটাও একটা পথ। বিপুলের লোভ, বিপুলের মায়ের শঠতা, আপনার …, আপনার কথায় পরে আসছি। অসীম বিস্তারযুক্ত বর্ণালি থেকে বেছে নিয়েছি সেই রশ্মিগুলো বারুদের মতো পুড়িয়ে, গলিয়ে দেবে যা মস্তিষ্কের যত নোংরামি। তখনও পৃথার কথা জানতামনা। তাই আপনি আমার সাবজেক্ট ছিলেন না প্রাথমিক পর্যায়ে।
– হাতে সময় বেশি নেই স্যার আপনার। আমারও বহু কাজ এখনও বাকি।পৃথা এসেছিল আমার কাছে। পুরোন বন্ধুত্বের দাবী নিয়ে। বাচ্চাটাকে আপনি দেখেননি একবারও। আপনার ষাট বছর বয়সের বৃদ্ধ বীজ পৃথার গর্ভে রোপণ করে যে বিকলাঙ্গ সন্তান সৃষ্টি করেছেন তাকে অস্বীকার করা ছাড়া পিতৃত্বের আর কোন দায়িত্ব নেন নি।
– পৃথার সন্তানকে সুস্থ করার পাশাপাশি আর একটা কাজের প্রস্তুতিও শুরু করে দিয়েছি স্যার। অদৃশ্য বর্ণালির চরম রশ্মিগুলোর নিয়ন্ত্রণও আমার হাতের মুঠোয় এখন। নিত্যতা সূত্র অভ্রান্ত হলে, এক একজন বিকলাঙ্গ শিশুকে সুস্থ করতে গেলেএক এক করে আপনাদের মতো জঞ্জাল সরাতেই হবে।
– সময় ফুরলো। এবার আপনি আসুন স্যার।
Tags: গল্প, প্রমিত নন্দী, শ্রেয়া ঘোষ, ষষ্ঠ বর্ষ প্রথম সংখ্যা