হেমেন্দ্রকুমার রায় ও বাংলা কল্পবিজ্ঞান
লেখক: প্রদোষ ভট্টাচার্য্য
শিল্পী: প্রমিত নন্দী
কল্পবিজ্ঞানের জন্মদাতা
বাংলা সাহিত্যে এই ‘জঁর’-এর পথিকৃৎ কে?
অধ্যাপক অনীশ দেব, তাঁর সম্পাদিত সেরা কল্পবিজ্ঞান সঙ্কলনের মুখবন্ধে বলেছেন:
… বাংলাভাষায় কল্পবিজ্ঞানের সূচনা ১৮৯৬ সালে, আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর কলমে। কুন্তলীন পুরস্কার প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করে তাঁর ‘নিরুদ্দেশের কাহিনী’ গল্পটি। এর পঁচিশ বছর পরে ‘অব্যক্ত’ গ্রন্থ প্রকাশের সময়ে জগদীশচন্দ্র গল্পটিকে পরিমার্জনা করেন। নাম দেন ‘পলাতক তুফান’ … বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র এই গল্পে কল্পবিজ্ঞানের নিয়ম মেনে ‘সারফেস টেনশান’ বা ‘পৃষ্ঠটান’ তত্ত্বের প্রয়োগ করেছিলেন।[1]
কিন্তু দীপ ঘোষ ও সন্তু বাগ কল্পবিশ্ব পত্রিকায় তাঁদের ‘প্রথম বাংলা তথা ভারতীয় কল্পবিজ্ঞানের সন্ধানে’ প্রবন্ধে জগদানন্দ রায়ের ‘শুক্র-ভ্রমণ’ গল্পটির প্রকাশকাল ‘১৮৯৫ সালের ‘ভারতী’ পত্রিকার ১৯তম বর্ষতে’ প্রমাণ করায় পথিকৃতের অভিধা যে জগদানন্দ রায়েরই প্রাপ্য, তাতে আর সন্দেহ থাকে না।[2]
বর্তমান প্রবন্ধে কল্পবিজ্ঞানকে বাংলা সাহিত্যে জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে, এই জঁর-এর পথিকৃৎ হিসেবে জগদীশচন্দ্রকে নিয়ে যেরকম ভ্রান্ত ধারণা চালু ছিল, ঠিক সেইরকমই আরেকটি ভুল কথার সংশোধন করার প্রয়াস করছি।
প্রচলিত ধারণা
অধ্যাপক দেবের সঙ্কলনে ১৯২১ সালের ‘পলাতক তুফান’-এর পরেই এসেছে ১৯৬৫ সালে প্রকাশিত প্রেমেন্দ্র মিত্রের গল্প ‘মামাবাবুর নিদ্রাভঙ্গ।’[3] এই দৃষ্টিভঙ্গির পুনরুক্তি দেখি প্রেমেন্দ্র মিত্রের কল্পবিজ্ঞান সমগ্র সঙ্কলনের সম্পাদকীয়তে:
বাংলা কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের পথিকৃৎ প্রেমেন্দ্র মিত্র …প্রেমেন্দ্র মিত্রের বিজ্ঞানভিত্তিক সাহিত্য রচনা শুরু হয় ১৯৩০ সালে … এরকম সময় ছোটদের ‘রামধনু’ পত্রিকার সম্পাদক ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য তাঁকে ছোটদের জন্য কিছু লেখার অনুরোধ করেন … সম্পাদকের ফরমাশের জবাবে প্রেমেন্দ্র ‘রামধনু’র পাতায় লিখে ফেললেন ‘সেকালের কথা’ নামে একটি লেখা … লেখাটি যখন পুস্তিকা আকারে ডি. এম. লাইব্রেরি থেকে বের হল তখন তার নাম পালটে রাখলেন ‘পিঁপড়ে পুরাণ।’ এটাই ছোটদের জন্য প্রেমেন্দ্র মিত্রের প্রথম লেখা, এবং এটাই বাংলা কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের প্রথম রচনা।[4]
বিপ্রতীপ তথ্য
কিন্তু, আশা গঙ্গোপাধ্যায় রচিত বাংলা শিশুসাহিত্যের ক্রমবিকাশ, ১৮০০-১৯০০-তে আমরা পাই অন্যরকম তথ্য।[5] ১৩৩০ বঙ্গাব্দে (১৯২৩-২৪ খৃ:) ‘মৌচাক’ পত্রিকায় ‘সম্পূর্ণ মৌলিক রোমাঞ্চকর উপন্যাস’ যকের ধন-এর লেখক হেমেন্দ্রকুমার রায়ের কলম ‘ইহার পরে অনুসরণ করিল পরবর্তী বৈজ্ঞানিক ফ্যান্টাসিয়া’ যার ফসল মেঘদূতের মর্তে আগমন (বঙ্গাব্দ ১৩৩২, অর্থাৎ ১৯২৫-২৬ খৃ:) ও ময়নামতীর মায়াকানন (বঙ্গাব্দ ১৩৩৩, অর্থাৎ ১৯২৬-২৭ খৃ:)।
বিতর্ক
কল্পবিজ্ঞান-নামক রসগোল্লার আবিষ্কর্তা তাহলে জগদানন্দ রায়। কিন্তু এটিকে জনপ্রিয় করে তোলার ব্যাপারে পথিকৃৎ বাংলায় কে? মিষ্টান্নটির ক্ষেত্রে ওড়িষা-পন্থীদের মতো প্রেমেন্দ্র-ভক্তরা আমার মতো হেমেন্দ্র-অনুরাগীদের ঘাড় চেপে ধরে প্রশ্ন করবেন, “বাপু, ঠিক এর পরেই আশা গঙ্গোপাধ্যায় কি বলেছেন?” অনস্বীকার্য যে তিনি বলেছেন যে ‘ভাষার সাহিত্যিক সৌন্দর্য্যে এবং গল্প [জমিয়ে তোলবার] কুশলতায়’ হেমেন্দ্রকুমার বাংলা শিশু-সাহিত্যে এইচ. জি. ওয়েলস এবং স্যার আর্থার কন্যান ডয়ালের দ্বৈত ভূমিকা গ্রহণ করলেন।[6] এবার ওড়িষা বাংলাকে বলবে, “তোমাদের হেমেন রায় তো সারাজীবন বিদেশি লেখা থেকে টুকলি করেই চালিয়ে দিয়েছে! মেঘদূতের মর্তে আগমন তো আসলে এইচ. জি. ওয়েলসের The War of the Worlds (১৮৯৭-৯৮), আর ময়নামতীর মায়াকানন হ’লো স্যার আর্থার কন্যান ডয়ালের The Lost World (১৯১২)। অতএব মৌলিক কাহিনির রচয়িতা হিসেবে, প্রেমেন্দ্র মিত্রই পথিকৃতের অভিধা পাবার যোগ্য।”
প্রত্যুত্তর
প্রত্যুত্তরে ওড়িষাকে বাংলার পক্ষ থেকে স্মরণ করাবো যে ‘পিঁপড়ে পুরাণ’-এর অনুপ্রেরণাও সেই ওয়েলস সাহেবের ১৯০৫ সালে প্রকাশিত ছোট গল্প ‘The Empire of the Ants’!
আর, সত্যিই কি হেমেন্দ্রকুমারের উপন্যাস দুটি আদৌ ‘টুকলি’?[7] একেবারেই নয়, ঠিক যেমন মিত্রমশাইয়ের উপন্যাসটি ওয়েলসের গল্প থেকে নিয়েছে ঠিক দুটি জিনিস: দক্ষিণ আমেরিকার পটভূমি আর সেখানে মানুষদের ওপর পিঁপড়েদের মারণ-আক্রমণ। প্রেমেনবাবুর পিঁপড়েরা দানবাকৃতি এবং প্রযুক্তির ব্যবহার-জানা। উপন্যাসের ঘটনাগুলি ঘটছে এক ডিস্টোপিয়ান ভবিষ্যতে, ৭৮৯৯ সালের পর, যেখানে ওয়েলস বলছেন যে পিঁপড়েদের— যেগুলি সাধারণ পিঁপড়ের চেয়ে বড় হলেও দানবাকৃতি নয়— সাম্রাজ্যের কথা তিনি শুনেছেন মাত্র সপ্তাহ-তিনেক আগে।
মাঙ্গলিকদের পৃথিবী-আক্রমণ ও গ্রহান্তর যাত্রা
The War of the Worlds উপন্যাসে মঙ্গল গ্রহের প্রাণীরা পৃথিবীকে তাদের উপনিবেশ বানাতে চেয়েছিল। ভিনগ্রহের আক্রমণ নিয়ে এটিই সম্ভবত বিশ্বসাহিত্যে প্রথম কাহিনি। ওয়েলস সাহেব তাঁর উপন্যাসের নামে যে war-এর কথা বলেছেন, সেটির ক্ষেত্র সম্পূর্ণভাবে আমাদের পৃথিবী। মাঙ্গলিকেরা যেভাবে অবলীলায় ইংল্যান্ডের Woking গ্রাম থেকে শুরু করে সেসময়ে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ শহর বলে খ্যাত লন্ডনকে ছারখার করেছে, তার মধ্য দিয়ে লেখক পাঠকদের স্মরণ করিয়েছেন যে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের মাধ্যমে তথাকথিত ‘সভ্য’ মানুষও নিজেদের মধ্যে যেসব জাতিদের হীনতর মনে করেছে, তাদের অনেক ক্ষেত্রে নিশ্চিহ্ন করেছে:
The Tasmanians, in spite of their human likeness, were entirely swept out of existence in a war of extermination waged by European immigrants, in the space of fifty years. Are we such apostles of mercy as to complain if the Martians warred in the same spirit?[8]
হেমেন্দ্রকুমারের কাহিনিতে কিন্তু মাঙ্গলিকেরা পৃথিবীর প্রাণী ও অন্যান্য বস্তু তাদের নিজের গ্রহে নিয়ে যেতে সচেষ্ট। হেমেন্দ্রকুমারের উপন্যাস ওয়েলসের মতো মঙ্গল গ্রহের বাসিন্দাদের দ্বারা পৃথিবী আক্রমণ দিয়ে শুরু হলেও মোট ২৪ পরিচ্ছেদের মধ্যে অষ্টম পরিচ্ছেদের শেষেই কাহিনির মূল মানুষ-চরিত্রদের অপহরণ করে, নবম পরিচ্ছেদে, বিনয়বাবুর ভাষায়, তাদের নিজেদের “ছোটখাট শহরের মতো বড়” মহাকাশ-যানের মধ্যে বন্দি করে ফেলছে মঙ্গল গ্রহের বাসিন্দারা।[9] পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ অবধি সমস্ত ঘটনা ঘটছে এই মহাকাশ-যানের মধ্যে। ষষ্ঠদশ পরিচ্ছেদে পাঠকদের নিয়ে লেখক, তাঁর কথক বিনয়বাবুর ডায়েরির মাধ্যমে— যে উত্তম পুরুষে কথনের শুরু এই ১৫শ পরিচ্ছেদ থেকে, যেখানে ওয়েলসের কাহিনি শুরু থেকেই উত্তম পুরুষে কথিত— নামিয়ে আনছেন মঙ্গল গ্রহের বুকে। এরপর মঙ্গলের জোড়া চাঁদ, ‘ডিমোস’ ও ‘ফোবোস’, এবং তার উদ্ভিদ ও প্রাণীজগৎকে বিনয়বাবুর মাধ্যমে আমরা চাক্ষুষ করছি, যার মধ্যে আছে মঙ্গল গ্রহের গরু বা ঘোড়া, যাদের আকৃতি উটের মতো হলেও, তাদের একটি করে শিং আছে, তাদের গায়ের রং মিশমিশে কালো, এবং যারা আকারে উটের চেয়ে ছোট। আর আছে হনুমানের মতো ল্যাজবিশিষ্ট চতুস্পদ পাখী![10] ২৩শ পরিচ্ছেদে, বিনয়বাবু, বিমল-কুমার ও অন্যান্যরা মঙ্গল গ্রহের কিছু বাসিন্দাসহ একটি মহাকাশ-যান কৌশলে কবজা করে মঙ্গল থেকে পৃথিবীর দিকে রওনা দিচ্ছে।
কল্পবিজ্ঞানের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে অনীশ দেব বলেছেন:
কল্পবিজ্ঞান কাহিনিতে বিজ্ঞানের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ বিশেষ নিয়ন্ত্রণী ভূমিকা থাকবে। থাকবে অজানা সম্ভাব্য জগতের কথা, প্রাণীর কথা, আর আগামী দিনের কথা। [11]
মেঘদূতের মর্তে আগমন-এ বিজ্ঞানের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণী ভূমিকা দেখা গেছে দুটি ক্ষেত্রে, যেখানে হেমেন্দ্রকুমার গ্রহান্তরে-যাত্রা-আখ্যানে তাঁর দুই পূর্বসূরি জুল ভের্ন ও ওয়েলসের তুলনায় আরও যুক্তিগ্রাহ্য যন্ত্রের উপস্থাপনা করেছেন। ভের্নের উপন্যাসে মানুষ পৃথিবী থেকে চাঁদে গেছে এক প্রকাণ্ড কামানের মাধ্যমে তাদের মহাকাশযান উৎক্ষেপিত করে। ওয়েলসের মাঙ্গলিকেরা ঠিক একই উপায়ে তাদের নলাকৃতি যানগুলি মঙ্গল থেকে পৃথিবীর দিকে ছুড়েছে। বিনয়বাবু বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে বসে এনেছেন রকেটের প্রসঙ্গ, যদিও তাঁর শ্রোতারা, কুমার বিশেষ করে, এতে বিস্ময় প্রকাশ করেছে। এ ছাড়া, মাঙ্গলিকেরা যে উপায়ে পৃথিবীর প্রাণী এবং প্রাকৃতিক বস্তু (বটগাছ, এক-পুকুর জল, তার মধ্যের মাছগুলিও) নিজেদের মহাকাশযানে টেনে নিচ্ছে, তার ব্যাখ্যায় বিনয়বাবু বলেছেন এক বিশাল vacuum-যন্ত্রের কথা, যা শুনে কুমার শিয়ালদহ স্টেশনে দেখা vacuum cleaner-এর কথা মনে করেছে। অজানা সম্ভাব্য জগৎ ও প্রাণী আমরা পেয়েছি প্রথমে মহাকাশযানের মধ্যে মাঙ্গলিক বামনদের দেখা পেয়ে এবং তার পরে মঙ্গল গ্রহে পৃথিবীর মানুষ ও জীবজন্তুদের নিয়ে মহাকাশযান অবতরণের পর উক্ত গ্রহের বিচিত্র জীবদের বর্ণনায়।
তদুপরি, ষোড়শ পরিচ্ছেদের (‘জোড়া চাঁদের মুল্লুকে’) শেষে একটি পাদটীকায় হেমেন্দ্রকুমার মঙ্গল গ্রহ সম্বন্ধে যে সব তথ্য এখন অবধি পরিবেশিত হয়েছে, তার উৎস হিসেবে বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে যেসব বৈজ্ঞানিকদের কথা অনেকে মানত তাঁদের নামোল্লেখ করেছেন, যেমন ইটালির Giovanni Schiaparelli (১৮৩৫-১৯১০), আমেরিকার Percival Lowell (১৮৫৫-১৯১৬), ইংল্যান্ডের Arthur Stanley Williams (১৮৬১-১৯৩৮) ফ্রান্সের Nicolas Camille Flammarion (১৮৪২-১৯২৫, বইতে নামটি ভুল ছাপা হয়েছে ‘শ্লামেরিয়ন’) প্রমুখ।
ডাইনোসরের দেশে
মঙ্গল গ্রহ থেকে পৃথিবীর দিকে রওনা দিয়ে উপন্যাসের শেষে মহাকাশযান এসে পড়ছে প্রাগৈতিহাসিক জীব-অধ্যুষিত এক দ্বীপে। কেউ “কিং কং” বলে লাফিয়ে ওঠার আগেই মনে করিয়ে দিই যে ময়নামতীর মায়াকানন ধারাবাহিকভাবে মৌচাকে প্রকাশিত হয়েছে ১৯২৬ সাল থেকে, আর কিং কং ছবিটি আত্মপ্রকাশ করে ১৯৩৩-এ, এবং হেমেন্দ্রকুমার এই ছবির উপন্যাসায়ণও তার পরেই করেন। বরং হেমেন্দ্রকুমারের দ্বীপের অনুপ্রেরণা, আগেই বলেছি, কন্যান ডয়ালের ১৯১২ সালের উপন্যাস The Lost World।
আর, ঠিক মেঘদূতের মর্তে আগমনে ওয়েলসের থেকে মাঙ্গলিকদের পৃথিবী-আক্রমণের trope-টুকুই যেমন হেমেন্দ্রকুমার গ্রহণ করেছিলেন, কয়েক বছর পরে প্রেমেন্দ্র মিত্রও যেভাবে সেই ওয়েলসের থেকে পিঁপড়েদের মানুষদের ওপর চড়াও হওয়ার কল্পনাটুকু নিয়েছিলেন, ময়নামতীর মায়াকাননে-ও একই ব্যাপার ঘটেছে। প্রাগৈতিহাসিক জীবজন্তু-অধ্যুষিত এক অজানা দ্বীপে— দক্ষিণ আমেরিকার আমাজনের জঙ্গলে কোন মালভূমিতে নয়— এসে পড়েছে কাহিনির মূল পাঁচ চরিত্র। লস্ট ওয়ার্ল্ডে মুখ্য অভিযানকারীদের সংখ্যা চার।
কন্যান ডয়ালের উপন্যাসে প্রাগৈতিহাসিক প্রজাতি হিসেবে আমরা পেয়েছি টেরোড্যাক্টিল, ইগুয়ানোডন এবং সবচেয়ে ভয়ঙ্কর, মাংশাসী অ্যালোসরাস বা মেগালোসরাস। সবার শেষে আসছে বনমানুষ আর মানুষের মধ্যেকার missing link যারা আক্রমণ করছে ওই মালভূমির আদিবাসীদের মানুষ এবং চার অভিযানকারীদের। ময়নামতীর মায়াকানন-এ আমরা প্রথম স্পষ্ট দেখছি প্রকাণ্ড ফড়িং, তারপর সমুদ্রের তলা থেকে উঠে আসছে ডিপ্লোডোকাস, এর পর আসছে মাংশাসী দু-পেয়ে ডাইনোসরের আক্রমণ। ইগুয়ানোডনদের বিচরণ কন্যান ডয়ালে আছে, আর আছে তাদের ছিন্নভিন্ন দেহের বিবরণ, এবং তার আগের রাত্রে তাদের ওপর মাংশাসী ডাইনোসরের চড়াও হবার কথা। হেমেন্দ্রকুমার এই চড়াও হওয়া প্রত্যক্ষভাবে দেখিয়েছেন। টেরোডাক্টিলদের আক্রমণ দুটি উপন্যাসেই আছে, আর আছে missing link-দের অভিযানকারীদের ওপর আক্রমণ, যদিও এই আক্রমণ-দুটির গতিপ্রকৃতি দুটি বইতে একেবারে ভিন্ন।। এ ছাড়া ময়নামতীর মায়াকাননে খাঁড়া-দেঁতো বাঘ শিকার করে হাতীর মতো বড় ষাঁড়কে, আছে ডানাবিহীন হাঁস ও অতিকায় স্লথ। সবশেষে আমাদের অভিযানকারীদের ‘আটলান্টিক মহাসাগরের এই অজানা দ্বীপ’[12] থেকে উদ্ধার করতে আসে এক ইউরোপীয় জাহাজ, যার যাত্রীরা প্রত্যক্ষ করে ট্রাইসেরাটপস এবং তারপর, রামহরির ভাষায় দুটি ‘গরুড় পাখী’, অর্থাৎ টেরোডাক্টিলদের মধ্যে যুদ্ধ। কন্যান ডয়ালের উপন্যাসে অভিযানকারীরা মালভূমির এক সুড়ঙ্গ দিয়ে আবার পরিচিত পৃথিবীতে পদব্রজে ফেরে। কাজেই, ময়নামতীর মায়াকানন একেবারেই লস্ট ওয়ার্ল্ড-এর সরাসরি অনুসরণ নয়; আবার বলি, হেমেন্দ্রকুমার কন্যান ডয়ালের থেকে নিয়েছেন শুধু কয়েকটি trope।
প্রেমেন্দ্র মিত্রের গ্রহান্তর ও ডাইনোসর-সমীপে যাত্রা
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন ‘দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের বেশ কয়েক বছর আগে কল্পিত ও ‘পৃথিবী ছাড়িয়ে’ নামে প্রকাশিত’ প্রেমেন্দ্র মিত্রের উপন্যাসখানির, যার সম্বন্ধে বলা হয়েছে, ‘হাউই-বারুদই যে ভাবীকালের মহাকাশ-বিজয় সম্ভব করে তুলবে, এই নির্ভুল দূরদৃষ্টির কৃতিত্বটুকু বাংলা ভাষার গ্রহান্তর যাত্রা সম্বন্ধে প্রথম মৌলিক ও বিজ্ঞানভিত্তিক এই উপন্যাসটি দাবি করতে পারে।’[13] ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত পৃথিবী ছাড়িয়ে-র পরিমার্জিত রূপান্তর শুক্রে যারা গিয়েছিল-র ‘প্রকাশকের নিবেদন’-এ উল্লেখিত এই দাবিটি প্রেমেনবাবুর কল্পবিজ্ঞান সমগ্রে-র সম্পাদক ‘শব্দের সম্ভার, বাক্যের বিন্যাস ও লেখার শৈলী’-র ভিত্তিতে লেখকের নিজের উক্তি বলেই চিহ্নিত করেছেন।[14] ১৯৬৪-র এই নিবেদনটিতে এর আগে বলা হয়েছে:
যে হাউই-বারুদকে কাজে লাগিয়ে গত কয়েক বছরে মানুষ মহাকাশে প্রথম পাড়ি দেওয়া শুরু করেছে, গত দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগে তা ব্যবহারের কথা দু-একজন খেয়ালি বৈজ্ঞানিক ছাড়া কেউ ভাবেননি বললেই হয়। জার্মানরা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ভি টু ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করার সময় থেকেই হাউই-বারুদ সম্বন্ধে গবেষণার জোয়ার আসে বলা যায়।[15]
প্রেমেন্দ্র মিত্র আর হেমেন্দ্রকুমার একে অপরকে যে শুধু চিনতেন তা নয়, তাঁদের পরস্পরের প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধা ছিল।[16] উদ্ধৃত কথাগুলি যদি প্রেমেনবাবুর নিজের হয়, তাহলে প্রশ্ন ওঠে যে তিনি ১৯২৫ সাল থেকে মৌচাকে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত মেঘদূতের মর্তে আগমন-এ রকেটে করে গ্রহান্তরে যাবার যে উল্লেখ আছে[17] সে কথা কি ভুলে গিয়েছিলেন?
পৃথিবী ছাড়িয়ে-র আখ্যানে রকেটে করে গ্রহান্তর যাত্রার সঙ্গে আরও একটি trope ব্যবহার করেছেন প্রেমেনবাবু। পৃথিবী থেকে বুধগ্রহে পৌঁছে সমর, অজয়, আর দুই জার্মান প্রত্যক্ষ করছে ডা. ব্রুলের ভাষায়, “দশ কোটি বছর আগেকার পৃথিবীর সেই … সেলজেহক যুগের … সরীসৃপের একাধিপত্যের” সময়![18] সমর প্রথম প্রায়-আক্রান্ত হচ্ছে উড়ন্ত সরীসৃপ-দ্বারা, তারপর তার বৈদ্যুতিক পিস্তলের আওয়াজে ভয় পেয়ে, স্তন্যপায়ী গণ্ডারের ডিম্বজাত পূর্বপুরুষ মনোফ্লোনিয়াসকে পেটস্থ করার আগেই পালাচ্ছে টিরানোসরাস জাতীয় কোনও মাংসাশী ডাইনোসর। অর্থাৎ, একই উপন্যাসে মিলে গেছে মেঘদূতের মর্তে আগমন-এর গ্রহান্তর যাত্রা আর ময়নামতীর মায়াকানন-এর প্রাগৈতিহাসিক জীবেরা!
অতএব, ‘দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের বেশ কয়েক বছর আগে কল্পিত ও ‘পৃথিবী ছাড়িয়ে’ নামে প্রকাশিত’ প্রেমেন্দ্র মিত্রের আখ্যানের পূর্বসূরি সেই হেমেন্দ্রকুমার, যিনি প্রথম মহাযুদ্ধ শেষ হবার বছর সাতেকের মধ্যে প্রেমেনবাবুর পরে-প্রকাশিত উপন্যাসের দু’টি trope-ই ব্যবহার করে ‘বাংলা ভাষার গ্রহান্তর যাত্রা সম্বন্ধে প্রথম মৌলিক ও বিজ্ঞান-ভিত্তিক’ উপন্যাস রচনা করে ফেলেছিলেন, এবং তার পরেই লিখেছিলেন আধুনিক মানুষের সঙ্গে প্রাগৈতিহাসিক জীবদের সাক্ষাতের গল্প![19]
বিজ্ঞানভিত্তিক অপরাধ–কাহিনি
হেমেন্দ্রকুমার শুধু গ্রহান্তর যাত্রা আর প্রাগৈতিহাসিক জীবদের আধুনিক সময়েও বেঁচে থাকার কথা লিখে ক্ষান্ত থাকেননি। বিমল-কুমারের পরই হেমেন্দ্র-ভক্তরা যে জুটির কথা ভাবেন, সেই জয়ন্ত-মাণিকের প্রথম কাহিনি, জয়ন্তের কীর্তি হল, লেখকের ভাষায়, ‘আধুনিক বৈজ্ঞানিকের অপরাধের কাহিনি, এবং বাংলা ভাষায় সম্পূর্ণ- রূপে নতুন।’ এর পরের বাক্যেই, অধ্যাপক অনীশ দেবের সংজ্ঞা অনুযায়ী, কল্পবিজ্ঞান কাহিনিতে বিজ্ঞানের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ বিশেষ নিয়ন্ত্রণী ভূমিকার আবশ্যিকতার ব্যাপারে হেমেন্দ্রকুমার বলেছেন, ‘কতকগুলি সত্য তথ্য ও বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের উপর নির্ভর করেই [উপন্যাসের আখ্যান] কল্পনা করা হয়েছে। ভবিষ্যতে মানুষের দেহকে জিইয়ে রেখে তাকে যে মৃত্যু ও বার্ধক্যের কবল থেকে রক্ষা করা যেতে পারে … বহু পরীক্ষার পর আধুনিক পাশ্চাত্ত্য বৈজ্ঞানিকরা ঐ অভাবনীয় … সিদ্ধান্তে উপস্থিত হয়েছেন। অবশ্য, কি ওদেশে ও কি পাশ্চাত্ত্য দেশে, ঐ বিচিত্র তথ্য বা আবিষ্কার নিয়ে আজ পর্যন্ত উপন্যাস লেখবার কল্পনা আর কোন লেখক ক’রেছেন বলে জানি না।’[20]
যাঁরা এর উত্তরে পৃথিবী ছাড়িয়ে নিয়ে প্রকাশকের (কারো-কারোর মতে লেখকের) মহাকাশযান নিয়ে এই জাতীয় দাবীর কথা বলবেন, তাঁদের মনে করাব যে ওই প্রতিবেদনে পৃথিবী ছাড়িয়ে-র প্রকাশকালকে স্পষ্টভাবে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কয়েক বছর আগে বলে উল্লেখ করা হয়েছে, যা হেমেন্দ্রকুমারের দুটি উপন্যাসের— মেঘদূতের মর্তে আগমন ও ময়নামতীর মায়াকানন— মোটামুটি এক দশক পরে। জয়ন্তের কীর্তি-র সঠিক প্রকাশের বছর বর্তমান প্রবন্ধকারের জানা নেই, কিন্তু জয়ন্ত-মাণিক যে ১৯২০-র ‘নন-কো-অপারেশন’ আন্দোলনের ফলে কলেজের পড়াশুনো ত্যাগ করেছিল,[21] এই তথ্যের ভিত্তিতে জয়ন্ত-মাণিক জুটির এই প্রথম অভিযান ১৯২০-র দশকে প্রকাশিত হয়েছিল মনে করা যেতেই পারে, যেখানে বিমল-কুমারকে নিয়ে হেমেন্দ্রকুমারের প্রথম শিশু-কিশোরদের জন্য রচনা তিনটি মৌচাকে ধারাবাহিকভাবে আত্মপ্রকাশ করেছে ১৯২৩ থেকে ১৯২৬-এর মধ্যে।[22]
পুনরুজ্জীবন নিয়ে হেমেন্দ্রকুমার স্বাধীনতা-উত্তর কালে আরেকটি কাহিনি রচনা করেছিলেন, সেখানেও আছে জয়ন্ত-মাণিক-সুন্দরবাবুর ত্রয়ী: ‘কাঁচের কফিন।’[23]
মানব এবং পশুশরীর নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষার আরেক দিক হেমেন্দ্রকুমার দেখিয়েছেন বিমল-কুমারকে নিয়ে অসম্ভবের দেশে উপন্যাসে।[24] এটিতে বিশ্বে নিজের আধিপত্য কায়েম করার উদ্দেশ্যে উন্মাদ বৈজ্ঞানিক ধরণী মানুষ ও পশুর গ্রন্থি বা gland-এর রস-উৎপাদনের ক্ষমতা ‘কল্পনাতীতরূপে বাড়িয়ে’ তুলে মানব-দানব এবং দানবাকৃতি পশু সৃষ্টিতে ব্যস্ত। ঠিক এই তত্ত্ব ব্যবহার করে প্রেমেন্দ্র মিত্র লিখেছেন ‘অবিশ্বাস্য’ নামে ছোটগল্প।[25] তা ছাড়াও ধরণী এক কীর্তি করেছে যা আমাদের, আক্ষরিকভাবে একেবারেই নয়, কিন্তু লেখকের মনোভাবের দিক দিয়ে ১৯২৩ সালে প্রকাশিত সুকুমার রায়ের ‘প্যারডি’ ‘হেঁশোরাম হুঁশিয়ারের ডায়েরি’ কে মনে করাবে। ধরণী দুই বাঙালি মাসিকপত্রের কবিকে – যারা মনুষ্যসমাজে থেকে অদম্যভাবে অপাঠ্য কবিতা রচনা করে যাচ্ছিল – ধরে এনে এক কুমির ও এক হনুমানের শরীরে তাদের মস্তিষ্কদ্বয় প্রতিস্থাপন করেছে। এর ফলে জলে এবং স্থলের গাছ থেকে শোনা যায় কবিতার প্রবাহ, ওই দুটি পশুদেহী-মনুষ্যমস্তিষ্ক প্রসূত! এবং পাদটিকায় হেমেন্দ্রকুমার ‘এই অদ্ভুত কল্পনার জন্য … এক বিলাতি লেখকের কাছে’ তাঁর ঋণ স্বীকার করেছেন।[26]
আরও দুটি কাহিনিতে হেমেন্দ্রকুমারের সৃষ্টির অভিনবত্ব আছে বলে মনে করি:
প্রথম হল নবযুগের মহাদানব উপন্যাস, যাতে যন্ত্রমানব বা ‘রোবটে’র মাধ্যমে অপরাধ সংঘটিত হতে দেখি, যে রহস্যের সমাধান করে জয়ন্ত।[27]
দ্বিতীয় কাহিনি সত্যজিৎ রায়-রচিত ‘সেপ্টোপাসের ক্ষিদে’-র পূর্বসূরি ছোটগল্প ‘পিশাচ’, যাতে বিমল-কুমার এক মাংসাশী উদ্ভিদের সম্মুখীন হয়।[28]
উপসংহার
অতএব, বাংলায় জগদানন্দ রায় কল্পবিজ্ঞান কাহিনির সৃষ্টি করার পর, সেই জাতীয় কাহিনির স্রোতকে এগিয়ে নিয়ে যান সর্বপ্রথম হেমেন্দ্রকুমার রায় এবং তারপর এই ধারাকে পরিপুষ্ট করেন প্রেমেন্দ্র মিত্র, ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য, অদ্রীশ বর্ধন প্রমুখ। হেমেন্দ্রকুমারের কলমেই আসে প্রথম বাংলা গ্রহান্তর যাত্রার বিজ্ঞানসম্মত আখ্যান, প্রথম প্রাগৈতিহাসিক জীব-অধ্যুষিত অঞ্চলে আধুনিক মানুষের অভিযান,[29] প্রথম মূলত রসায়নবিদ্যার প্রয়োগে মানবদেহের পুনরুজ্জীবনের কথা, মানুষ ও পশুর গ্রন্থির রসোৎপাদন বৃদ্ধি করে দানব সৃষ্টির কথা, পশুদেহে মানব-মস্তিষ্কের প্রতিস্থাপন (এটি অবশ্য ‘প্যারডি’ই হয়েছে), যন্ত্রমানবের উদ্ভাবন, ও মাংশাসী উদ্ভিদের গল্প।
একমাত্র মেঘদূতের মর্তে আগমন ও ময়নামতীর মায়াকানন ছাড়া বাকি উপন্যাস ও গল্পগুলির প্রকাশকাল বর্তমান প্রবন্ধকারের অজানা। কেউ যদি তথ্য দিয়ে দেখান যে এগুলির আগেই বাংলা কল্পবিজ্ঞান-কাহিনিতে এইসব অভিনবত্ব দেখা গেছে, আমি তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ থাকব। এই কথা আমার এই সমগ্র প্রতিবেদনের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
গ্রন্থপঞ্জী:
প্রাথমিক পাঠ্য:
হেমেন্দ্রকুমার রায় রচনাবলী, ১ থেকে ৩২ খণ্ড, সম্পাদনা গীতা দত্ত, এবং কিছু খণ্ডে সুখময় মুখোপাধ্যায় (এশিয়া পাবলিশিং কোম্পানী, কলকাতাঃ ১৯৭৪-২০১৯)
হেমেন্দ্রকুমার রায়, ছোটদের অমনিবাস (এশিয়া পাবলশিং কোং, কলকাতাঃ ১৯৯৭, পুনর্মুদ্রণ ২০০০)
সেরা কল্পবিজ্ঞান, সম্পাদনা অনীশ দেব (আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতাঃ ১৯৯১, ৯ম মুদ্রণ ২০১৬)
প্রেমেন্দ্র মিত্র, কল্পবিজ্ঞান সমগ্র, সম্পাদনা সুরজিৎ দাশগুপ্ত (দে’জ পাবলিশিং, কলকাতাঃ ২০১০, ২য় সংস্করণ ২০১৩)
অ্যাডভেঞ্চারের গল্প, সম্পাদনা অশোক সেন (শিশু সাহিত্য সংসদ, কলকাতাঃ ২০০০, ৮ম মুদ্রণ ২০১৮)
গৌণ পাঠ্য:
আশা গঙ্গোপাধ্যায়, বাংলা শিশু-সাহিত্যের ক্রমবিকাশ (১৮০০-১৯০০) (ডি. এম. লাইব্রেরী, কলকাতাঃ ১৩৬৬ (১৯৫৯-৬০])
[1] সেরা কল্পবিজ্ঞান, সম্পাদনা অনীশ দেব (আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতাঃ ১৯৯১, ৯ম মুদ্রণ ২০১৬) ‘কল্পবিজ্ঞান প্রসঙ্গে’, পৃঃ ৬।
[2] আজ, ২ ফেব্রুয়ারি ২০২১-এর ভোর-রাত্রে, স্বয়ং দীপ ঘোষ ই-মেলে আমাকে তাঁর ও সন্তুবাবুর লেখাটির লিঙ্ক পাঠান। তার আলোয় এই অনুচ্ছেদে আমার পূর্ব-বক্তব্য সংশোধন করলাম। লেখকদ্বয়কে আমার অকুণ্ঠ কৃতজ্ঞতা জানাই।
[3] যদিও পরে প্রেমেন্দ্রবাবুর চেয়ে বয়ঃকনিষ্ঠ দুই লেখকের দু’টি গল্প, দু’টিই ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত, সঙ্কলনে স্থান পেয়েছেঃ দিলীপ রায়চৌধুরী, ‘শিলাকান্থ’, বিশু দাস, ‘ড. হাইসেনবার্গ আর ফেরেননি’।
[4] ‘সম্পাদকীয়’, প্রেমেন্দ্র মিত্র, কল্পবিজ্ঞান সমগ্র, সম্পাদনা সুরজিৎ দাশগুপ্ত (দে’জ পাবলিশিং, কলকাতাঃ ২০১০, ২য় সংস্করণ ২০১৩), পৃঃ ৮-৯।
[5] আশা গঙ্গোপাধ্যায়, বাংলা শিশু-সাহিত্যের ক্রমবিকাশ (১৮০০-১৯০০) (ডি. এম. লাইব্রেরী, কলকাতাঃ ১৩৬৬ (১৯৫৯-৬০]), ২৮১। জোর বর্তমান প্রবন্ধকারের।
[6] সেই স্থানে, অর্থাৎ, পৃঃ ২৮১।
[7] ওয়েলসের The Invisible Man-এর হেমেন্দ্রকুমার-কৃত স্বীকৃত রূপান্তর অদৃশ্য মানুষ এশিয়া-প্রকাশিত রচনাবলী-র ২য় খণ্ডে আছে। ২৩শ খণ্ডে আছে স্টিভেনসনের ‘Dr Jekyll and Mr Hyde’ আধারিত মানব-দানব। ২৪শ খণ্ডে পাওয়া যাবে মেরী শেলীর Frankenstein– এর রূপান্তর মানুষের গড়া দৈত্য। কোনটিই সরাসরি ‘অনুবাদ’ নয়, সবগুলিকেই ভারতীয় প্রেক্ষাপটে স্থাপন করা হয়েছে। মূল চরিত্রগুলিও বাঙালী। দ্বিতীয় ও তৃতীয় রূপান্তর-দু’টির উৎস-কাহিনিদ্বয়কে অনেকেই horror বলে থাকেন বটে, কিন্তু দু’টিতেই, অনীশ দেবের ভাষায়, ‘বিজ্ঞানের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ বিশেষ নিয়ন্ত্রণী ভূমিকা’ আছে।
[8] H. G. Wells, The War of the Worlds (1898, http://www.planetpublish.com/wp-content/uploads/2011/11/The_War_of_the_Worlds_NT.pdf 10 December 2020) p. 7 of 293.
[9] মেঘদূতের মর্তে আগমন, পৃঃ ২৮৪-৩৬৯, হেমেন্দ্রকুমার রায় রচনাবলী, প্রথম খণ্ড, সম্পাদনা গীতা দত্ত, (এশিয়া পাবলিশিং কোংঃ কলকাতা, ১৯৭৪, ৫ম মুদ্রণ ১৯৮৪) পৃঃ ৩১৮।
[10] এখানে যাঁরা ওয়েলসের The First Men in the Moon-এর (১৯০০-১৯০১) তুলনা টানবেন তাঁদের ওয়েলসের উপন্যাসের ১১শ পরিচ্ছেদে mooncalf-এর বর্ণনা পড়ে দেখতে অনুরোধ করব। আর টার্জান-স্রষ্টা এডগার রাইস বারোসের ১৯১২ সালের উপন্যাস A Princess of Mars-ও ঘাঁটা যেতে পারে!
[11] সেরা কল্পবিজ্ঞান, ৬।
[12] ময়নামতীর মায়াকানন, ছোটদের অমনিবাস (এশিয়া পাবলশিং কোং, কলকাতাঃ ১৯৯৭, পুনর্মুদ্রণ ২০০০) পৃঃ ১৭২, ১৫৩।
[13] ‘সম্পাদকীয়’, প্রেমেন্দ্র মিত্র, কল্পবিজ্ঞান সমগ্র, ১০।
[14] ওই, ৯।
[15] ওই, ১০।
[16] হেমেন্দ্রকুমার প্রেমেনবাবুকে নিয়ে লিখেছেন এখন যাঁদের দেখছি-তে (রচনাবলী, ৪র্থ খণ্ড, এশিয়া, কলকাতাঃ ১৯৮০) ৩৯৮-৪০১, আর তাঁর সঙ্কলন রাত্রে যারা ভয় দেখায় (দি নিউ বুক স্টল, কলকাতা) উৎসর্গ করেছেন ‘প্রেমাস্পদ’ প্রেমেনবাবুকে। এশিয়া-প্রকাশিত রচনাবলীর তৃতীয় খণ্ডের ভূমিকা লিখেছেন প্রেমেন্দ্র মিত্র (কলকাতাঃ ৩য় প্রকাশ ১৯৮৩) ৩-৬, আর প্রেমেনবাবুর ছোট গল্প ‘গল্পের স্বর্গে’ সগৌরব উপস্থিতি দেখি হেমেন্দ্রকুমার-সৃষ্ট বিমল-কুমারের (প্রেমেন্দ্র মিত্রের ছোটদের শ্রেষ্ঠ গল্প, অভ্যুদয় প্রকাশ মন্দির, কলকাতাঃ ১৯৫৭, ৩য় মুদ্রণ ১৯৬২, ৯৪-১০২)।
[17] রচনাবলী ১ম খণ্ড, ৩০১
[18] প্রেমেন্দ্র মিত্র, পৃথিবী ছাড়িয়ে, অ্যাডভেঞ্চারের গল্প, সম্পাদনা অশোক সেন (শিশু সাহিত্য সংসদ, কলকাতাঃ ২০০০, ৮ম মুদ্রণ ২০১৮) ৪১-১০৭। উদ্ধৃত বাক্যটি ৯৩-তে আছে। ১৯৬৪-তে এই চরিত্ররা বুধের বদলে শুক্রে অবতরণ করে, এবং উপন্যাসটিও নাম বদলে হয় শুক্রে যারা গিয়েছিল, যা প্রেমেনবাবুর কল্পবিজ্ঞান সমগ্রে-র ৩১৭-৪০৬-তে আছে। সেখানে সেলজেহক যুগের বদলে শোনা গেছে মেসোজোইক যুগের কথা, আর মনোফ্লোনিয়াস হয়ে গেছে ট্রাইসেরাটপস।
[19] সুকুমার রায়ের হেঁশোরাম হুঁশিয়ার সন্দেশে আত্মপ্রকাশ করেন ১৩৩০ বঙ্গাব্দের বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠতে (১৯২৩ খৃঃ)। কিন্তু তাঁর ডায়েরি লস্ট ওয়ার্ল্ডের রূপান্তর নয়, ‘প্যারডি’। এ ব্যাপারে আলোকপাত করেছেন সুদীপ দেব, স্বমহিমায় শঙ্কু-র ‘কৈফিয়ত’-এ (কল্পবিশ্ব পাবলিকেশনস, কলকাতাঃ ২০১৯, ২য় মুদ্রণ ২০২০) ৭-৮। হেঁশোরামের কথা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য বন্ধুপ্রতীম ছাত্র অভিরূপ মাশ্চরককে ধন্যবাদ। হেঁশোরামের প্রকাশের বছর জানতে পেরেছি ফেসবুকে ‘বইয়ের হাট’ গ্রুপের সুমন বিশ্বাসের সৌজন্যে।
[20] রচনাবলী, ১০ম খণ্ড, সম্পাদনা গীতা দত্ত ও সুখময় মুখোপাধ্যায় (এশিয়া পাবলিশিং কোম্পানি, কলকাতাঃ ১৯৮৭) ৯১।
[21] ওই, পৃঃ ১৩
[22] আশা গঙ্গোপাধ্যায়, ২৮১।
[23] রচনাবলী, ২৪শ, সম্পাদনা গীতা দত্ত (এশিয়া পাবলিশিং কোম্পানি, কলকাতাঃ ২০০৯) ১৬১-১৮২।
[24] রচনাবলী, ২২শ, সম্পাদনা গীতা দত্ত (এশিয়া পাবলিশিং কোম্পানি, কলকাতাঃ ২০০৭) ৫-৬২।
[25] প্রেমেন্দ্র মিত্র, কল্পবিজ্ঞান সমগ্র, ৯০-৯৯। সম্পাদক বলেছেন (১২) যে এই গল্পটি ‘ভয়ংকর’ নামেও প্রকাশিত হয়েছে। প্রেমেনবাবুর গল্প না হেমেন্দ্রকুমারের উপন্যাস, কোনটি আগে বেরিয়েছিল, এ ব্যাপারে কেউ তথ্য দিতে সাহায্য করলে কৃতজ্ঞ থাকব।
[26] ওই, পৃঃ ৫১।
[27] রচনাবলী, ৫ম, সম্পাদনা গীতা দত্ত ও সুখময় মুখোপাধ্যায় (এশিয়া, কলকাতাঃ ১৯৮৩, ৭ম মুদ্রণ ২০১৩) ২০৯-২৭৪।
[28] রচনাবলী, ১৪শ, সম্পাদনা গীতা দত্ত ও সুখময় মুখোপাধ্যায় (এশিয়া, কলকাতাঃ ১৯৯৬) ১০৫-১১০। গল্পটি ছায়াকায়ার মায়াপুরে নামক সঙ্কলনের অন্তর্গত।
[29] আগেই বলা হয়েছে যে ১৯২৩ সালের হেঁশোরাম হুঁশিয়ার ছিল প্রফেসর চ্যালেঞ্জারের ‘প্যারডি’, ময়নামতীর মায়াকানন (১৯২৬-২৭) একেবারেই তা নয়।
Tags: প্রদোষ ভট্টাচার্য্য, প্রবন্ধ, প্রমিত নন্দী, ষষ্ঠ বর্ষ প্রথম সংখ্যা, হেমেন্দ্রকুমার রায়
এরপর হেমেন্দ্রকুমারের এক অসাধারণ কল্পবৈজ্ঞানিক কীর্তি নিয়ে লেখার ইচ্ছে রইল। ১৮৯৬ সালে ওয়েলস লিখলেন The Island of Dr Moreau। কোন এক সময় হেমেন্দ্রকুমার লিখলেন তার এক অনবদ্য sequel: ‘প্রশান্তের আগ্নেয় দ্বীপ’। মরোর দ্বীপ থেকে এক অর্ধ-ব্যাঘ্র অর্ধ-মানুষ জীব হানা দেয় সুন্দরবনে, আর তার সূত্র ধরে বিমল-কুমার-জয়ন্ত-মাণিক-সুন্দরবাবু-রামহরি-বাঘা পাড়ি দেয় মরোর দ্বীপে! জানি নয়া কল্পবিশ্ব আম্মায় সে সুযোগ দেবে কিনা!
৯ নং পাদটিকায় ‘হেমেন্দ্রকুমার রায় রচনাবলী’-র খণ্ড-সংখ্যা উল্লেখ করতে ভুলে গেছি। ‘মেঘদূতের মর্তে আগমন’ আছে প্রথম খণ্ডেই।