মেরুজ্যোতি
লেখক: সৌম্য সুন্দর মুখোপাধ্যায়
শিল্পী: প্রমিত নন্দী
মিসেস উইলসনের বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ যখন ডোরবেল টিপছি, আকাশটা তখন জ্বলজ্বলে নীল-সবুজে মেশামিশি মেরুপ্রভায় যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই আমি খেয়াল করলাম, ওই উজ্জ্বল আলোর মধ্যে একটুখানি গোলাপির আভাও যেন দেখা যাচ্ছে।
বহু পুরোনো রোবট চাকরটা নড়ে নড়ে এসে যতক্ষণে দরজা খুলল, ততক্ষণে দরজার বাইরে অরোরা দেখে দেখে আমার প্রায় আড়াই মিনিট কেটে গেছে।
এ তল্লাটে অরোরা আগে কখনও দেখাই যেত না। ব্যাপারটা শুরু হয়েছে এই অল্প ক-দিন হল। ঝড়টার জন্যই এ বিরল ঘটনা ইউরোপের এই অঞ্চলে ঘটতে শুরু করেছে, জানি। কিন্তু জিনিসটা স্বচক্ষে দেখার পর বলতেই হচ্ছে, এ সৌন্দর্যের তুলনা হয় না।
জরাজীর্ণ রোবটটা দরজা খুলে খনখনে, যান্ত্রিক গলায় বলল, “উইলসন ভিলায় আপনাকে স্বাগত, স্যার।”
হাউস রোবট সিরিজের বহু পুরোনো মডেল এই নমুনাটা— অফিসে আমরা এই মান্ধাতার আমলের রোবটগুলোকে মজা করে “টিনের কৌটো” নামে ডাকি। এদের ইন্টেলিজেন্স খুবই লো-লেভেলের। সদ্য সদ্য যে ভয়ংকর ঝড়টা গেল, তার হাত থেকে যে ইনি বেঁচে গেছেন, তার একটাই কারণ— খারাপ হওয়ার মতো অতি আধুনিক ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি এর মধ্যে বিশেষ কিছু ছিলই না।
তাতে অবশ্য এর এবং এর বুড়ি মালকিনের মঙ্গলই হয়েছে, বলতে হবে।
বাড়ির মধ্যে ঢুকলাম আমি; রোবটটা আমার পেছনে দরজা বন্ধ করে দিল। স্বর্গত মিস্টার উইলসনের ফ্রেমে বাঁধানো ছবি ঝুলছে দেওয়ালে। নাকে আসছে রুম ফ্রেশনারের হালকা লেবু-লেবু গন্ধ।
বৃদ্ধা মিসেস উইলসনের কণ্ঠস্বর শোনা গেল পাশের একটা ঘর থেকে। “এদিকে আসুন, মিস্টার ডান।”
বুড়ো টিনের কৌটো রোবটটা পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল আমাকে। ঘরের মধ্যে ঢুকে দেখলাম, তিনি বসে আছেন তাঁর গদি-আঁটা হুইলচেয়ারে। হাতে তাঁর ধরা আছে একখানা কম-অল; সেটাকে নিয়েই খুটুর-খাটুর করছেন ভদ্রমহিলা।
ভালো করে দেখলাম আমার ক্লায়েন্টকে। রোগাটে গড়নের বৃদ্ধার বয়স অনেক হবে— আশি যদি নাও হয়, পঁচাত্তর ছুঁইছুঁই তো বটেই। ফ্যাকাশে চামড়া কুঁচকে গেছে ওয়েস্টপেপার বাস্কেটে ফেলে দেওয়া মোচড়ানো কাগজের মতো। কুঁচকেছে দু-চোখের কোণগুলোও, কিন্তু তাঁর মুখে লেগে থাকা হাসিটি ভারী সুন্দর। জানালার পাল্লা বন্ধ, কিন্তু পর্দা যেহেতু সরানো আছে, তাই অরোরার চলন্ত, বহুবর্ণের আলো এসে পড়েছে তাঁর চশমার মোটা কাচে, আর তাতেই তাঁর বলিরেখাকীর্ণ, সরল মুখটিকে যেন অপার্থিব সুন্দর লাগছে।
বৃদ্ধা স্বস্তির শ্বাস ফেলে বললেন, “থ্যাংক গড, আপনি এসে পড়েছেন। বসুন, মিস্টার ডান।”
সোফায় বসে ঘরটার চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম। পুরোনো টেলিভিশন সেট একটা আছে, কিন্তু সেটা প্রত্যাশামতোই বন্ধ পড়ে আছে। রোবট রাঁধুনিটা সংলগ্ন মিনি-কিচেনে একটু ঝুঁকে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে— তার দৃষ্টি আটকে আছে একগোছা কাঁটা-চামচ আর প্লেটের দিকে।
ঝড়ের আঘাতটা ওকে ওই সময়েই লেগেছে, বোঝা যাচ্ছে।
মিসের উইলসন বললেন, “যখন দেখলাম অবশেষে গতকাল থেকে আপনাদের এমার্জেন্সি কাস্টমার কেয়ার নম্বরটা কাজ করছে, তখন একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। এই যা দেখছেন, এ অবস্থা হয়েছে দিন সাতেক আগে। ওরা যতজন আছে, সবাই একসঙ্গে হঠাৎ কাজ করা বন্ধ করে দিল। শুধু আমার এই বুড়ো ডমিনিক ছাড়া।” এই বলে প্রশংসার চোখে একবার টিনের কৌটোটার দিকে তাকিয়ে নিলেন তিনি।
আমি বললাম, “খুব শক্তিশালী সৌরঝড় এলে এমনটা হয়। এইসব সূক্ষ্ম ইলেকট্রনিক যন্ত্র এখনও এত ভয়ানক আঘাত সহ্য করতে পারে না। গত সপ্তাহে যে ঝড়টা পৃথিবীতে আছড়ে পড়েছে, সেটাকে এই শতাব্দীর সবচেয়ে শক্তিশালী সোলার ফ্লেয়ার বলতে পারেন। যাইহোক, মিসেস উইলসন, আপনার সব ক-টা গ্যাজেটকেই সারিয়ে তুলতে পারব, আশা করছি। আমাদের কাস্টমার সার্ভিসও তো ডাউন ছিল এই ক-দিন— সদ্য তাকে অনলাইনে ফেরাতে পেরেছি আমরা। সেও কি কম ঝক্কি গেছে? যাই হোক, আপনি আপনার ছেলের ব্যাপারে ফোনে কিছু একটা বলেছিলেন মনে হচ্ছে?”
দেখলাম, বৃদ্ধার চোখের কোণদুটি এই প্রথমবারের জন্য একটু ভেজা-ভেজা লাগছে। তাঁর কম-অল যন্ত্রটা আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন তিনি। “আমার জনির সঙ্গে এক সপ্তাহ কোনও যোগাযোগ করতেই পারিনি, মিস্টার ডান।”
ডিভাইসটা হাতে নিয়ে একটু পরীক্ষা করে দেখে বললাম, “এটা তো ঠিকই আছে দেখছি। এই নতুন কম-অল মেশিনগুলো আমরা এমনভাবে বানাই যাতে সোলার ফ্লেয়ার এগুলোর খুব একটা ক্ষতি করতে পারে না। আপনারটার মতো নতুন সব ক-টা মডেলেই এই ফিচার আছে।”
তিনি বললেন, “সেই কথাই তো বলছি। নিয়ম করে রোজ রাতে আমার সঙ্গে একবার অন্তত কথা বলতে জনির ভুল হয় না। সপ্তাহখানেক আগে একদিন রাতে যখন ওর কল এল না, আমি ভাবলাম, ঠিক আছে, হতেই পারে। এমন আগেও দু-একবার ঘটেনি, তা নয়। অফিসের জরুরি কোনও কাজে আটকা পড়ে গিয়ে মাঝে মধ্যে এক-আধবার কল করতে পারেনি, এমন হয়েছে। কিন্তু দিনের পর দিন কেটে যেতে লাগল, আর এই কম-অলটা চুপ করে বসে রইল। আমি ভাবলাম, বোধহয় ওর কমিউনিকেটিং ডিভাইসটাতেই কোনও গণ্ডগোল হয়েছে, নেপলসে হয়তো কম-অলের সার্ভিস সেন্টার নেই, তাই আমি অপেক্ষা করে রইলাম। কিন্তু জনি সেই থেকে হঠাৎ একদম চুপ করে গেছে কেন, বুঝতেই পারছিলাম না। তারপর মনে হল, গণ্ডগোলটা হয়তো আমার ডিভাইসটাতেই হয়েছে। হয়তো ও ভিডিয়ো কল করার চেষ্টাও করেছিল, কিন্তু আমার যন্ত্রটা বিগড়েছে বলে করতে পারেনি।”
আমি সান্ত্বনার সুরে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করলাম। “দেখুন মিসেস উইলসন, ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এইরকম বিশাল মাপের সৌরঝড় রোজ হয় না ঠিকই, কিন্তু যখন হয়, পৃথিবীতে তার ঝাপটা এসে পড়েই। তখন সারা পৃথিবীরই বেশির ভাগ গ্যাজেট সাময়িকভাবে কোমায় চলে যাওয়ার চান্স থাকে, কিন্তু এ সমস্যা থেকে উদ্ধার পাওয়া খুব কঠিন নয় এখন। একদম হাল আমলের যেসব আর্টিফিশিয়ালি ইন্টেলিজেন্ট রোবট তৈরি হচ্ছে, তারা তো একটা টাইম গ্যাপের পর নিজেরাই নিজেদেরকে এই কোমাটোস স্টেট থেকে জাগিয়ে তুলতে পারে। কিন্তু যেগুলোর বুদ্ধিবৃত্তি একটু কম, যেমন আপনার এই রাঁধুনি রোবটটার মতো মডেলগুলো, সেগুলোকে সারাতে টেকনিশিয়ানের সাহায্য লাগে। চিন্তা করবেন না, এটা ঠিক করে দিচ্ছি এখুনি। আর আপনার ছেলের ব্যাপারটা নিয়েও ভাববেন না। হয়তো ওঁর কম-অলটা এমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যে আর সারাই করা যাবেই না। সেটা হতেই পারে; কারণ সৌরঝড়টার পর থেকে গোটা পৃথিবীরই কমিউনিকেশন সিস্টেম বেশ সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।”
টিনের কৌটো আমাদের জন্য কফি নিয়ে এল ট্রে-তে সাজিয়ে। একটা কাপ তুলে নিয়ে আমি বললাম, “থ্যাংক ইউ, ডমিনিক।”
সেই চেনা খনখনে গলায় সে উত্তর দিল, “ইউ আর ওয়েলকাম, স্যার।”
মিসেস উইলসনের দিকে তাকিয়ে আমি বললাম, “ঘরে এই পুরোনো মডেলগুলো থাকার এই একটা উপকারিতা। এগুলোর ওইসব সৌরঝড়-টড়ে বিশেষ কোনও ক্ষতি হয় না। নতুনগুলোর মতো এদের এত বুদ্ধি নেই, এত নিখুঁতভাবে মানুষের মতো দেখতেও নয়, কিন্তু আপনার ক্ষেত্রে বুড়ো ডমিনিক যে সার্ভিসটা দিচ্ছে, নতুন ফ্যান্সি মডেলগুলো সেটা দিতে পারত না।”
মিসেস উইলসন হাসলেন। “আমার জনি ওকে উপহার দিয়েছিল আমার বাষট্টি বছরের জন্মদিনে। এখন আমার কত বলুন তো? চুয়াত্তর। ডমিনিকেরও বয়স বেড়েছে, পুরোনো হয়ে গেছে। আপনি দেখছেন তো মিস্টার ডান, আমি এখন হুইলচেয়ারে জীবন কাটাচ্ছি। এই ডমিনিককে ছাড়া বেঁচে থাকাই আমার পক্ষে কষ্টকর— বাথরুমটাও ও আমাকে ধরে ধরে নিয়ে যায়। হ্যাঁ, একটু ধীরে চলে ও, বুঝতে পারি। কিন্তু কচ্ছপ আমাদের কী শিখিয়েছে মনে আছে তো? স্লো বাট স্টেডি উইনস দ্য রেস।”
নিজের কথায় নিজেই হাসতে লাগলেন তিনি। ভদ্রতার খাতিরে আমিও তাঁর সঙ্গে একটু হাসলাম। জানালার বাইরে যেন ভৌতিক আলোর খেলা খেলছে অরোরা।
কম-অলটা হাতে নিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম আবার। নাঃ, কোনও সমস্যা তো ওতে নেই। ওটা থেকে আমার নিজের ডিভাইসটায় একটা ভিডিয়ো কল করে দেখলাম। দিব্যি করা গেল।
বৃদ্ধাকে মুখের উপর বলতে সংকোচ হচ্ছিল যে জনির তাঁকে কল না করার কারণটা খুব সম্ভবত উপেক্ষা ছাড়া আর কিছু নয়। মা যতটা ভালোবাসে, প্রবাসী ছেলের বোধহয় বুড়ি মায়ের উপর সেই টানটা আর নেই। রোজ রাতে মায়ের সঙ্গে কথা বলাটাকে সে সম্ভবত আর খুব একটা জরুরি মনে করছে না।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম আমি। এসব কথা ওঁকে বলা ঠিক নয়। কী দরকার লোকের ব্যাপারে নাক গলিয়ে?
টুলবক্স খুলে রাঁধুনি রোবটটাকে সারাই করার কাজে মন দিলাম। ডমিনিক সব কাজের মতো টুকটাক রান্নাও পারে বটে, কিন্তু রাঁধুনিটার মতো এত ভালো পারে না।
ওটাকে ঠিক করতে আমার প্রায় এক ঘণ্টার কাছাকাছি সময় লেগে গেল। ডমিনিক হাতে হাতে যন্ত্রপাতিগুলো এগিয়ে দিয়ে আমাকে সাহায্য করছিল। মনে মনে আমি স্বীকার করতে বাধ্য হলাম, ব্যাটাকে দেখতে যতই টিনের কৌটোর মতো হোক, সব রকমের কাজেই সে ভীষণ দড়।
রাঁধুনিটাকে সারাই করে কম-অলটা আরেকবার হাতে নিলাম আমি। মিসেস উইলসন বললেন, “মিস্টার ডান, এটা থেকে জনিকে একবার ভিডিয়ো কল করবেন?”
আমি বললাম, “করতে তো কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু ও ধরবে কিনা বলতে পারছি না।”
“দেখুন না একবার চেষ্টা করে।”
অগত্যা তাই করলাম। ওদিক থেকে কোনও উত্তর এলো না। আসবে না, আমি জানতাম।
“আপনার ডিভাইসে তো কোনও সমস্যা নেই, মিসেস উইলসন। হয়তো আপনার ছেলেই…”
যন্ত্রটা আমার হাতের মধ্যে হঠাৎ কাঁপতে শুরু করল।
জনি উইলসনের মুখটা ভেসে উঠেছে স্ক্রিনে।
“এই তো! এই তো কল করছে আমার জনি!” চিৎকার করে মিসেস উইলসন কম-অলটা আমার হাত থেকে প্রায় ছিনিয়েই নিলেন।
কলটা উনি রিসিভ করতেই স্ক্রিনের উপর জনিকে দেখা গেল। একগাল হেসে সে বলল, “মা, খুব দুশ্চিন্তা করছিলে নাকি? ভেবো না একদম, ঠিক আছি আমি।”
উত্তেজনায়, খুশিতে মিসেস উইলসনের মুখটা জ্বলজ্বল করছে। “ছিলি কোথায় এতদিন, বাঁদর? জানিস, এই একটা সপ্তাহ আমার কত টেনশনে কেটেছে? তুই কি কোনওদিন বড় হবি না রে?”
বাঁদর জনি যে যথেষ্ট বড় হয়ে গেছে, তার প্রমাণ তার নাকের তলায় মোটা গোঁফজোড়াতেই পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু মায়ের কাছে ছেলেরা আর কবে বড় হয়?
মিচকে একটা হাসি হেসে সে বলল, “সরি, মা। কিন্তু মনে হচ্ছে তুমি শোনোনি একটা বিরাট সৌরঝড়ের ঝাপট পৃথিবীর উপর দিয়ে গেছে। তাতেই আমার কম-অলটার বারোটা বেজে গিয়েছিল। যা হোক, কেউ একজন আছেন মনে হচ্ছে তোমার কাছে?”
বুঝলাম, আমাকে সে দেখেছে ক্যামেরা দিয়ে। মিসেস উইলসন বললেন, “হ্যাঁ রে। এই যে, মিস্টার ডানের সঙ্গে আলাপ কর। মিস্টার ডান, আর একটু সরে আসুন এইদিকে। এই যে আমার ছেলে জনি। আর জনি, ইনি মিস্টার ডান— ইউনিভার্সাল আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস সেন্টার থেকে আসছেন। উনি যে আমার কী উপকার আজ করেছেন, সে আর কী বলব তোকে!” একবার মিনি কিচেনে রাঁধুনি রোবটটার দিকে সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিয়ে আমার দিকে কম-অলের ফেসক্যামেরাটা ঘুরিয়ে দিলেন তিনি।
জনি যে ভীষণভাবে চমকে উঠল, সেটা আমার নজর এড়াল না। কয়েক মুহূর্তের জন্য প্রচণ্ড আতংকের একটা ছাপ ফুটে উঠল তার মুখে, যেন সে ভূত দেখেছে। তারপর জোর করে মুখে একটা হাসি টেনে এনে শুকনোভাবে বলল, “ও, আচ্ছা। ইউ.এ.আই.এস.সি.র লোক আপনি? তা, সব ভালো তো?”
আমিও কটকটে ভাবে বললাম, “হুঁ, ভালো। আপনার সব ভালো তো?”
ওদিক থেকে একটা মাথানাড়া আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করে একটু সরে গেলাম।
একটা কিছু গড়বড় এখানে আছে, স্পষ্ট আঁচ পাচ্ছি।
সেটা যে ঠিক কী, আমি বুঝতে পারছি না। কিন্তু যে ছেলেটা কম-অলে মিসেস উইলসনের সঙ্গে কথা বলছে, তার মধ্যে কিছু একটা অদ্ভুত ব্যাপার আছে, এটা নিশ্চিত।
আস্তে আস্তে গিয়ে আমি বৃদ্ধার পেছনে দাঁড়ালাম, উঁকি মেরে দেখতে লাগলাম স্ক্রিনের ছবিটা। জনি তখন নেপলসের দারুণ সুন্দর রোদেভরা আবহাওয়া আর সেখানে তার সঙ্গে যেসব সুন্দরী মেয়ের আলাপ হয়েছে, তাদের গল্প শোনাচ্ছে তার মাকে। তিনিও মন্ত্রমুগ্ধের মতো ছেলের গপ্পো শুনছেন।
একমিনিট ধরে খুব খুঁটিয়ে জনির মুখটা দেখলাম আমি— বিশেষ করে চোখদুটো আর নিচের চোয়ালটা। একটা সন্দেহ আমার হচ্ছে, জনি উইলসন বোধহয়…
আরও দু-মিনিট নজর রেখে বুঝলাম, আমার অনুমানটাই ঠিক।
মিসেস উইলসনের খুশি খুশি মুখটা দেখতে দেখতে বুঝতে পারলাম, আমার ভেতরে জনির উপর একটা প্রচণ্ড ক্রোধ তৈরি হচ্ছে।
আলতো করে একটা হাত রাখলাম মহিলার কাঁধে। কথার মাঝে থেমে গিয়ে আমার দিকে তাকালেন তিনি। আমি বললাম, “জনির সঙ্গে কিছু কথা বলতে দেবেন আমাকে? তাহলে প্রাইভেটে একটু কথা বলতাম। নেপলসের ব্যাপারে কয়েকটা জিনিস জানবার আছে আমার।”
“নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই।” সঙ্গে সঙ্গে যন্ত্রটা আমার হাতে দিয়ে দিলেন তিনি।
ডিভাইসটা নিয়ে উইলসন ভিলার বাইরে এসে দরজা লাগিয়ে দাঁড়ালাম আমি। আমি চাই না উনি আমাদের কথাগুলো শুনতে পান।
রাতের আকাশটার গায়ে এখনও ঢেউয়ের মতো ভেসে বেড়াচ্ছে নীল, সবুজ আর গোলাপি আলো। কম-অলের স্ক্রিনে জনির মুখ পাথরের মতো শক্ত হয়ে উঠেছে।
আমি প্রশ্ন করলাম, “কে তুমি?”
জনি বলল, “এ আবার কেমনধারা প্রশ্ন? কী বলতে চান, স্পষ্ট করে বলুন।”
আমি চাপা গলায় গর্জন করে বললাম, “আমার কাছে চালাক সাজতে এসো না, খোকা। ইউনিভার্সাল আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস সেন্টারের সিনিয়রমোস্ট টেকনিশিয়ান আমি। তোমার নিচের চোয়াল খুব ভালোভাবে খেয়াল করে দেখেছি আমি। এক মিনিটে ক-বার তোমার চোখের পাতা পড়ে, গুনেছি সেটাও। তাই মিস্টার ঠকবাজ, পুরো ব্যাপারটার একটা ব্যাখ্যা তো আমার চাইই। নয়তো পুলিশকে ফোন করতে আর কত সময়ই বা লাগে?”
জনির ভোল বদলে গেল সঙ্গে সঙ্গে। কাতরস্বরে সে বলল, “ঠিক আছে, ঠিক আছে, আমি সব সত্যি কথা বলব। আপনি যা জানতে চান, সব বলব। শুধু একটা কথা আমাকে দিন আপনি।”
“কী?”
“আমি আপনাকে যা বলব, আপনি মিসেস উইলসনকে কিচ্ছু বলবেন না।”
আমি বললাম, “তোমাকে কোনও কথা আমি দেব না। এবার আমি প্রশ্ন করব, আর তুমি উত্তর দেবে। তুমি যে মানুষ নও, এ আমি আগেই বুঝেছি। তোমার নিচের চোয়ালের নড়াচড়া পার্ফেক্ট নয়— নতুন কম্প্যানিয়ন সিরিজের মডেলে এই সমস্যাটা দেখা দিয়েছে, জানি। ব্যাপারটা বোঝা যায় তোমার কথা বলার সময়। তা ছাড়া মিনিটে তোমার চোখে পলক পড়ে মাত্র দুই কী তিনবার— ব্লিঙ্ক রেট সাধারণ মানুষের তুলনায় অনেক কম। ওই নিখুঁতভাবে তৈরি মুখটি দেখিয়ে এক বুড়ো মানুষকে হয়তো ঠকাতে পারো তুমি, কিন্তু সিনিয়র একজন রোবট এক্সপার্টকে ঠকাবে কী করে?”
জনি মাথা নিচু করে রইল; উত্তর দিল না।
আমি বললাম, “ওই বৃদ্ধার সঙ্গে এরকম অসভ্যতা করার মানে কী, রাস্কেল? ওঁর ছেলে সেজে তুমি নাটক করছ কেন? আসল জনি কোথায়?”
“মারা গেছে।”
এক মুহূর্তের জন্য থমকে যেতে হল আমাকে। তারপর কড়া গলায় বললাম, “একদম মিথ্যে কথা বলবে না।”
“আমি সত্যি কথাই বলছি।”
“কীভাবে মারা গেছে জনি? কী হয়েছিল ওর?”
“ক্যান্সার। রোগটা ধরা যখন পড়েছে, তখন ট্রিটমেন্ট করার মতো আর খুব বেশি কিছু বাকি ছিল না। ডাক্তাররা বলে দিয়েছিল, আয়ু আর তিন মাস বড়জোর। ওই তিন মাসের মধ্যেই অসাধ্য সাধন করেছিল জনি। আপনাদের ইউ.এ.আই.এস.সি. থেকে আমাকে কেনার পর আমার মুখের উপর নিজের মুখের হুবহু গড়ন তৈরি করে বসিয়েছিল সে। জনি উইলসন জিনিয়াস ছিল, মিস্টার ডান; আর তার প্রমাণ আমি নিজে। আমাকে এখন দেখে যে কোনও সাধারণ মানুষ ভাববে, আমিই জনি উইলসন।”
আমি চুপ করে রইলাম কিছুক্ষণ। তারপর বললাম, “তুমি যে সত্যি কথা বলছ, তার প্রমাণ কী?”
রোবটটা ম্লান হাসল। “আমি কোথা থেকে কথা বলছি, জানেন?”
“নেপলস থেকে নয়, এটুকু আমিও বুঝতে পেরেছি। কোথা থেকে?”
“এই উইলসন ভিলারই চিলেকোঠা থেকে।”
“অ্যাঁ?”
অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম আমি। নকল জনি বলল, “মিসেস উইলসনের হুইলচেয়ার-বন্দি জীবন। উনি কোনওদিন চিলেকোঠায় উঠে আমাকে খুঁজে পাবেন না। জনি নিজেই একজন রোবট-সায়েন্টিস্ট ছিল; আমার ব্রেনসার্কিটে একটা বিহেভিয়ারাল মডিফিকেশন করে ওখানেই একটা ভারী বাক্সের মধ্যে আমাকে রেখে গিয়েছিল সে। ওখান থেকেই ওঁর সঙ্গে ‘জনি’ সেজে কথা বলি আমি। এখনও তাই বলছি। আমার ব্যাকগ্রাউন্ডে যেটুকু নেপলসের বাড়িঘরের বা জনির ড্রয়িংরুমের দৃশ্য দেখা যায়, ওটা একটা ফেক ইমেজ প্রোজেকশন। বিশ্বাস না হলে এসে দেখে যেতে পারেন চিলেকোঠায়, মিস্টার ডান। তবে সত্যিটা আবিষ্কার হওয়ার পর আর মা-কে বাঁচানো যাবে বলে মনে হয় না।”
মা-কে?
কী বলব বুঝতে না পেরে আমি চুপ করে রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলাম। মনে হল কোনও এক অদৃশ্য শিল্পী তুলি দিয়ে গোটা আকাশের গায়ে জীবন্ত রং বুলিয়ে দিচ্ছে। আমার পেছনে উইলসন ভিলা; চিলেকোঠার ঘরের জানালাটা আমি দেখতে পাচ্ছি এখান থেকে।
রোবট কথা বলল আবার— এবার তার কথায় অনুরোধের সুর। “মিসেস উইলসনের দিন শেষ হয়ে আসছে, মিস্টার ডান। জনি জানত তার মা তার মৃত্যুশোক সহ্য করতে পারবে না। তাই আমাকে তৈরি করেছিল ও একদম নিজের মতো করে। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স হিসেবে ‘ভালোবাসা’ ব্যাপারটা আমার এক্তিয়ারের বাইরে পড়ে; কিন্তু আমি ওঁকে খুশি দেখতে চাই। গত এক সপ্তাহ ধরে সৌরঝড়ের আঘাতে আমি কাবু হয়ে পড়েছিলাম; নড়াচড়ার ক্ষমতাও ছিল না। সেইজন্যই যে ওঁর সঙ্গে কন্ট্যাক্ট করতে পারিনি, সেকথা আপনি বুঝেছেন, জানি। আপনি ওঁকে যদি এখন সত্যি কথাটা বলে দেন, সে আঘাত উনি সহ্য করতে পারবেন বলে আমার মনে হয় না।”
আমি বলে উঠলাম, “একটা মিথ্যা আশা নিয়ে উনি জীবন কাটাচ্ছেন, এ কথা তুমি অস্বীকার করতে পারো?”
রোবটটা হাসল। “কিন্তু উনি ‘জীবন’ কাটাচ্ছেন, স্যার। উনি বেঁচে আছেন, আনন্দে আছেন। ক-দিনই বা আর বাঁচবেন? আমার মধ্যে যে ব্যাটারি আছে, তার আয়ু এখনও বাইশ বছর। মানে, আমি জনির প্ল্যান মতো তার মায়ের শেষ দিন পর্যন্ত তাঁকে সঙ্গ দিয়ে যেতে পারব। বলুন না আমাকে, ‘সত্য’ জিনিসটা কি ওঁর এই মুহূর্তে খুব দরকার?”
ভাবতে লাগলাম আমি, খুব করে ভাবতে লাগলাম। কী দরকার এই মুহূর্তে ওই বৃদ্ধা মহিলার?
আকাশের দিকে আবার তাকালাম আমি। তার সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে আছে বিচিত্রবর্ণ আনন্দ।
ধীরে ধীরে আবার ভিলার মধ্যে এসে ঘরে ঢুকে আমি দরজা লাগিয়ে দিলাম। মিসেস উইলসন যে ঘরে বসে আছেন, সেখানে গিয়ে কম-অলটা ফেরত দিলাম তাঁকে। খেয়াল করে দেখলাম, তাঁর চেয়ারের পেছনেই চিলেকোঠায় যাওয়ার ঘোরানো সিঁড়ি।
মহিলা জিজ্ঞাসা করলেন, “কী বলল জনি? নেপলসের ব্যাপারে কথা হল?”
“অনেক কথা হল। ও আরও একটা কথা বলল— আপনি হচ্ছেন পৃথিবীর সেরা মা।”
তাঁর দন্তহীন মুখে বুদ্ধের মতো প্রসন্ন একটি হাসি ফুটে উঠল— আমি সেইদিকে তাকিয়ে রইলাম। জানালা থেকে মেরুজ্যোতির বহুবর্ণ আলোর সমারোহ এসে পড়ছে তাঁর চোখে, চশমার কাচে; উজ্জ্বল আলোয় ভরে আছে তাঁর শিশুর মতো মুখ।
কেন জানি না, অদ্ভুত একটা প্রশান্তি পেয়ে বসছে আমাকেও। একবার তাকালাম কম-অলের দিকে; দেখলাম, জনি তাকিয়ে আছে কৃতজ্ঞতামাখা দৃষ্টিতে।
আমি আবার বললাম, “একটা কথা এখানে আমার না বললেই নয়, মিসেস উইলসন। এমন ছেলে পেয়েছেন, আপনারও কিন্তু অনেক সৌভাগ্য।”
তৃপ্তমুখে কম-অলের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, “আমি জানি তো।”
Tags: গল্প, ষষ্ঠ বর্ষ প্রথম সংখ্যা
বেশ ভালো গল্প।
বেশ ভাল লাগল
আহা! মনটা ভরে গেল এমন একখানা লেখা পড়ে।
bah…besh