কল্পবিজ্ঞান সাহিত্য পরিচয় ১: লাস্ট অ্যাকশন হিরো
লেখক: ঋজু গাঙ্গুলী
শিল্পী: ইন্টারনেট
এ এক সুদূর ভবিষ্যতের গল্প।
সেখানে প্রযুক্তি আছে বিস্তর। আছে জন্ম-মৃত্যু, আশা-নিরাশা। আছে স্বপ্ন আর ভবিষ্যতের ভাবনা। আছে টিন-এজারের মুড সুইং আর স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া।
ভাবছেন, তাহলে বর্তমানের সঙ্গে সেই সময়ের কী আর এমন পার্থক্য আছে?
প্রথমত, মানবতা ততদিনে ছড়িয়ে গেছে গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে— অন্য ছায়াপথে, নীহারিকারও সুদূর পারে। তার নানা কোণে সে খুঁজে পেয়েছে হারিয়ে যাওয়া ভিনগ্রহীদের ফেলে যাওয়া প্রযুক্তি আর নানা জিনিস। সব মিলিয়ে মানুষের ‘জগৎ’-টা অনেক-অনেক বড় হয়ে গেছে ততদিনে।
দ্বিতীয়ত, পৃথিবীর ছোট্ট গণ্ডির বাইরের সেই বি…শা…ল জগতে দুটো প্রধান অংশ আছে। তার মধ্যে একটা হল প্রিজার্ভেশন— যেখানে সভ্য জগতের নিয়ম, রেওয়াজ, শাসন… এ-সব টিকে আছে। আর তার বাইরে রয়েছে কর্পোরেশন রিম— যেখানে গ্রহ, উপগ্রহ, মায় সেখানকার বাসিন্দাদের ওপর রয়েছে নানা বহুজাতিক সংস্থার মালিকানা। এইসব সংস্থাকে আমরা সিদ্ধার্থ ঘোষের ডিস্টোপিক দুনিয়ায় পেয়েছি। এমন কোনও কাজ নেই যা এরা লাভের জন্য করতে আর করাতে পারে না।
আমাদের উপাখ্যান শুরু হচ্ছে কর্পোরেশন রিমের এক গ্রহ থেকে। একটি বিজ্ঞানী তথা অভিযাত্রী দল সেখানে গেছে অনুসন্ধান চালাতে। সেই গ্রহের বিপজ্জনক প্রাণীদের থেকে তাদের নিরাপদে রাখার জন্য গেছে একাধিক সিকিউরিটি ইউনিট। সেটাই দস্তুর।
এই সেক-ইউনিট আসলে সাইবর্গেরই মতো একটি জিনিস। তাদের দেহে বসানো আছে নানা যন্ত্রপাতি ও অস্ত্র। তাদের দেওয়া আছে নানা ক্ষমতা। তবে পুরোপুরি রোবট না বানিয়ে তাদের দেহে রেখে দেওয়া হয়েছে নানা মানবিক অংশ। কেন বলুন তো? যাতে তাদের তরফে আদেশ পালনে দেরি হলে বা তারা আপত্তি জানালে তাদের গভর্নর মডিউল তাদের ভয়াবহ যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি দিতে পারে। বুঝতে পারছেন তো ব্যাপারখানা?
এইরকম হয়েই থাকে। এমন দুর্গম গ্রহে অভিযাত্রী দলেরও নানা বিপদ-আপদ হতেই পারে। সবসময় যে সেক-ইউনিট তাদের বাঁচাতে পারবে, তারও কোনও মানে নেই। তবে এবার একটা পরিবর্তন হল।
ওই দলের সঙ্গে এল এমন একটি সেক-ইউনিট, যে নিজের মতো করে ভাবতে পারে! আসলে সে নিজের গভর্নর মডিউলকে হ্যাক করে ফেলেছিল। তার কারণ কী জানেন? যাতে সে ডিউটিতে থেকে বোর হওয়ার সময়টা নিজের পছন্দমতো সিরিয়াল… থুড়ি ‘হিউম্যান মিডিয়া’ দেখতে পারে!
অতীতে একটি ডিউটি করার সময় এই সেক-ইউনিট একটা মারাত্মক কাজ করেছিল। যে ক্লায়েন্টদের নিরাপদে রাখার জন্য তাকে নিয়োগ করা হয়েছিল, সে তাদেরই মেরে ফেলেছিল। তারপর তার স্মৃতি ধুয়ে-মুছে সাফ করে দেওয়া হয়। নতুন চেহারা, নতুন পরিচয় দিয়ে তাকে পাঠানো হয় সেই দূরের গ্রহে। সেক-ইউনিটটি কিছুতেই জানতে পারেনি সে কেন, কোথায়, কাদের সঙ্গে এই ভয়ংকর কাজটি করেছিল। তবে অনুশোচনা তাকে প্রতিনিয়ত শাস্তি দিয়ে চলে। সে কিছুতেই নিজেকে ক্ষমা করতে পারে না। কারও সঙ্গে মিশতে চায় না সে। দুনিয়াসুদ্ধ সবাই তার বিরক্তির পাত্র। সত্যি বলতে কি এক সশস্ত্র খুনি অন্যকে নিয়ে ভাববেই বা কেন?
নিজের চোখে সে একজন খুনি রোবট। তাই নিজেকে সে মার্ডারবট বলেই ভেবেছে আর ডেকেছে।
কিন্তু ওই গ্রহে ডিউটি করার সময় সে কিছুতেই নিজেকে সরিয়ে রাখতে পারল না। এক ভয়ানক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে যখন তার ক্লায়েন্টদের প্রাণ ও মান বিপন্ন হল, তখন সে নিজের সবকিছু দিয়ে তাদের বাঁচাল। সেটা করতে গিয়েই সে বুঝতে পারল।
অন্যের আজ্ঞাবহ সেক-ইউনিট সে নয়। হয়তো সে খুনি। কিন্তু তার পেছনে কোনও ইতিহাস আছে।
আর… অন্যদের সাহায্য করতে তার খারাপ লাগেনি। বরং মহা শক্তিধরের চক্রান্তে দুমড়ে যাওয়া কোনও দুর্বলের হয়ে লড়তে তার দারুণ লেগেছে!
তাহলে? সে কি চুপচাপ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে, কারও সঙ্গে কথা না বলে ডাউনলোড করা সিরিয়াল দেখেই অস্তিত্বের বাকি সময়টা কাটিয়ে দেবে?
নাকি সে জানবে নিজের অতীত?
সেই পথে চলতে গিয়ে যদি সে দেখে যে তার পছন্দের, অন্তত কম অপছন্দের মানুষগুলোর ক্ষতি করতে চাইছে কেউ, তাহলে সে কি তাদের ছেড়ে দেবে? খেপেছেন? এ কোনও আজ্ঞাবহ বন্ধু রোবট নয়।
আমরা যার কথা বলছি সে মার্ডারবট!
আর তারই আখ্যান লেখা হয়েছে এখনও অবধি চারটি বড়গল্প, একটি ছোটগল্প এবং একটি উপন্যাস জুড়ে। কালানুক্রমে সাজালে তারা হল:
- অল সিস্টেমস্ রেড: যে কাহিনি দিয়ে এই সিরিজ শুরু।
- আর্টিফিশিয়াল কন্ডিশন: মার্ডারবট নিজের অতীতের কথা জানতে পারে এবার। তার আলাপ হয় এক মহাশক্তিধর আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্সের সঙ্গে— যাকে সে নিজস্ব ভঙ্গিতে এ.আর.টি (অ্যাসহোল রিসার্চ ট্র্যান্সপোর্ট!) বলেই ডাকে।
- রোগ প্রোটোকল: প্রথম কাহিনিতে যে সংস্থা ভিলেইন বলে চিহ্নিত হয়, তার আরও কিছু গোলমেলে কাজের খবর পেয়ে তদন্তে নামে মার্ডারবট।
- এক্সিট স্ট্র্যাটেজি: সেই ভিলেইন সংস্থার সঙ্গে এবার একটা এসপার-ওসপার করতে নামে মার্ডারবট।
- হোম— হ্যাবিট্যাট, রেঞ্জ, নিশ, টেরিটরি: ছোট্ট এই গল্পটা এই সিরিজের প্রধান চরিত্রদের সঙ্গে আমাদের আলাপকে একবার ঝালিয়ে নেওয়ার সুযোগ দেয়। তবে এটাকে জলজিরা-র সঙ্গে তুলনা করাই ঠিক হবে, কারণ এর পরেই আসে মেইন কোর্স!
- নেটওয়ার্ক এফেক্ট: নিজের মতো করে একটা কাজে ডিউটি করে সবার সঙ্গে প্রিজার্ভেশনে ফিরছিল মার্ডারবট। হঠাৎ তাদের ওপর আক্রমণ চালাল একটি মহাকাশযান। অপহরণ করা হল তাদের। তারপর মার্ডারবট বুঝতে পারল, এই মহাকাশযানের চালকই ছিল তার একদা সঙ্গী এবং বন্ধু— এ.আর.টি! সে আর নেই। তার বদলে এসেছে অন্য কেউ, আর তার লক্ষ্য বড় ভয়ানক। কী করবে মার্ডারবট? পালাবে। না বদলা নেবে?
এখনও অবধি যা পড়েছেন তাতে তো বুঝতেই পারছেন কী করেছিল সে।
কর্পোরেশন আপনার বিরুদ্ধে? আইন নিজের মতো করে চলতে গিয়ে পথ হারিয়েছে কোনও অন্ধ গলিতে? কেউ নেই আপনার পাশে?
আছে। সে আমার-আপনার মতো মানুষ নয়। তার লিঙ্গবোধ নয়। সে মুখে কিছু না বললেও মনে-মনে প্রচুর গালাগাল দেয়। একেবারে অবাস্তব, অসম্ভব সব সিরিয়ালের ভক্ত সে।
কিন্তু সে আপনার পাশে আছে। থাকবেও।
মার্ডারবটের সাত নম্বর অ্যাডভেঞ্চার প্রকাশিত হয়েছে সাতাশে এপ্রিল। তার নাম ফিউজিটিভ টেলিমেট্রি। তার আগে, যদি পারেন, পড়ে ফেলুন এই লেখাগুলো। হিউগো, নেবুলা, এমন আরও বহু প্রাইজ জিতেছে মার্থা ওয়েলস্-এর এই সিরিজ। তবে আসল যে জিনিসটি সে জিতে একেবারে নিজের ড্রাইভে আপলোড করে ফেলেছে তা হল আমাদের হৃদয়।
মার্ডারবট ডায়েরিজ-কে উপেক্ষা করবেন না কিন্তু!
Tags: ঋজু গাঙ্গুলী, কল্পবিজ্ঞান সাহিত্য পরিচয়, গ্রন্থ পরিচিতি, ষষ্ঠ বর্ষ প্রথম সংখ্যা