এ তুমি কেমন তুমি
লেখক: ফিলিপ কে. ডিক, বাংলা অনুবাদ: রাকেশকুমার দাস
শিল্পী: সৌরভ ঘোষ
জিল হেরিকের সুন্দর নীল চোখদুটো জলে ভরে উঠল। অব্যক্ত এক যন্ত্রণায় নিজের স্বামীর দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলে উঠল, ‘জঘন্য মানুষ তুমি একটা।’
স্বামী লেস্টার হেরিক কিন্তু নিজের হাতের কাজ থামালো না। টেবিলের উপর কাগজের স্তূপ থেকে যতরকম নোট আর গ্রাফ ছিল সেগুলো বেছে বেছে সাজিয়ে রাখছিল।
‘জঘন্য কথাটা মূলত জাজমেন্টাল শব্দ একটা।’ লেস্টার ঠান্ডা গলায় বলল, ‘এর মধ্যে ফ্যাক্ট বা ইনফর্মেশন বলতে কিছু নেই।’ এই বলে সেন্টাউরি নক্ষত্রের বিভিন্ন গ্রহের পরজীবি প্রাণী সংক্রান্ত রিপোর্টের টেপটা কোথাও একটা পাঠাতে শুরু করল টেবিলে রাখা টেপ স্ক্যানারটা দিয়ে। ‘বলা যেতে পারে এটা জাস্ট তোমার একটা ওপিনিয়ন, তোমার মধ্যে একটা যে ইমোশন তৈরি হয়েছে তার বহিঃপ্রকাশ। এ ছাড়া আর কিছুই নয়।’
জিল চোখের জল মুছতে মুছতে রান্নাঘরের দিকে গেল। আনমনাভাবেই স্টোভের কাছে এসে হাত নাড়ল, তাতেই স্বয়ংক্রিয় স্টোভটা চালু হয়ে গেল। একটা কনভেয়র বেল্ট চলতে শুরু করে দিল, তাতে মাটির নিচের ভাঁড়ার ঘর থেকে আনাজপাতি মাংস ইত্যাদি রান্নাঘরে উঠে আসত লাগল। ডিনার রান্না শুরু হবে এবার।
জিল মরিয়া হয়ে শেষ বারের জন্য স্বামীর কাছে মিনতি করল, ‘অল্প কিছুক্ষণের জন্যেও নয়? মাসে একবার যদি ও…’
‘না, মাসে একবারের জন্যেও নয়। ও আসলে তুমি বলে দিও। তোমার যদি সাহসে না কুলায়, আমিও বলে দিতে পারি। একটা বাচ্ছা সারাক্ষণ বাড়িতে দৌড়াদৌড়ি হুলুস্থুল কাণ্ড করে যাবে এটা চলতে পারে না। আমার প্রচুর কাজ থাকে। এই দেখ, এই বিটেলজিউস ইলেভেন গ্রহের রিপোর্টটা অন্তত দশ দিন আগে আমার পাঠানোর কথা ছিল।’ লেস্টার ফোমালহটীয় ফসিলের রিপোর্টের আরেকটা টেপের রীল স্ক্যানারে বসাল। ‘তোমার দাদার কি হল? ফ্র্যাঙ্ক নিজের ছেলেকে সামলাতে পারছে না কেন?’
জিল চোখ থেকে জল মুছে বলল, ‘তুমি কি কিছুই বুঝতে পার না? গাসকে আমিই আমার কাছে রাখতে চাই। দাদাকে আমি হাজার বার বলে রাজি করিয়েছি যাতে গাসকে এখানে আসতে দেয়। আর তুমি এখন বলছ…’
‘আরেকটু বড় হলে যেদিন সরকারের হাতে ওর দায়িত্ব তুলে দেওয়া যাবে, সেদিন শান্তি পাব।’ বিরক্তিতে ভরে উঠল লেস্টারের রোগা মুখটা। ‘আহ জিল, কি হল? ডিনারটা এখনও হল না? দশ মিনিট তো হয়ে গেল! স্টোভটা কি বিগড়েছে না কি?’
‘হ্যাঁ, এই হয়ে এল বলে।’
স্টোভের গায়ে একটা লাল আলো জ্বলেছিল। একটা রোবট পরিচারক চুপচাপ দেওয়াল থেকে বেরিয়ে এল। খাবারটা রেডি হলেই স্টোভ থেকে বের করে নেবে বলে দাঁড়িয়ে রইল।
জিল বসে বসে ফুঁপিয়ে কেঁদে যাচ্ছিল বসার ঘরে। লেস্টার নির্বিকারভাবে তার কাজ করে যাচ্ছিল। দিনের পর দিন এভাবেই লেস্টার তার গবেষণার কাজ করে গেছে। লেস্টারের শীর্ণকায় শরীরটা যেন একটা পাকানো স্প্রিংয়ের মতো স্ক্যানারের উপর ঝুঁকে রয়েছে, হিমশীতল ধূসর চোখ দিয়ে যেন তথ্য গিলে চলছে একটা ঘোরের মধ্যে থেকে, তারই মধ্যে প্রতিটি তথ্যকে বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন করে চলছিল তার মস্তিষ্ক। তার চিন্তাশক্তি যেন তেল-মাখানো কলকবজার মতো একনাগাড়ে কাজ করে চলে অবিশ্রান্তভাবে।
এদিকে কষ্টে আর ক্ষোভে জিলের ঠোঁট কেঁপে কেঁপে উঠছিল। আহা রে, ছোট্ট গাসটা। কীভাবে একটা বাচ্চাকে বলা যায় যে তুই আর আসিস না। চোখ দিয়ে টস করে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে গেল জিলের। গাবলুটাকে আর কোনওদিন আদর করতে পারবে না! আর কোনওদিন হয়তো তাকে এ বাড়িতে দেখা যাবে না। এর কারণ কি? না তার খেলা আর হাসি না কি ওঁর বিরক্তির উদ্রেক করে! রিসার্চের কাজে না কি ব্যাঘাত ঘটে!
স্টোভের আলোটা হঠাৎ সবুজ হয়ে গেল। রান্না হওয়া খাবার ধীরে ধীরে ভেতর থেকে বেড়িয়ে রোবটের হাতে চলে এল। একটা মৃদু টুংটাং শব্দ করে জানান দিল যে ডিনার রেডি।
‘শুনতে পেয়েছি, বার বার বাজানোর দরকার নেই। স্টুপিড রোবট।’ খেঁকিয়ে উঠল লেস্টার। টকাস করে স্ক্যানারটা বন্ধ করে দাঁড়িয়ে পড়ল, ‘মনে হয় আমাদের ডিনার শেষ হওয়ার আগেই মহামান্য গাসবাবু এসে পড়বেন।’
‘আমি ফ্র্যাঙ্ককে ভিড করে বারণ করে…’
‘না না। ব্যাপারটা আজকেই মিটিয়ে ফেলা দরকার।’ বলে অধৈর্য হয়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রোবট পরিচারককে ধমক দিয়ে উঠল, ‘আরে রাখো না টেবিলে, দাঁড়িয়ে আছ কেন খাবার নিয়ে?’ সরু ঠোটদুটো যেন ক্রোধের চিহ্ন এঁকে দিচ্ছিল মুখের মধ্যে। ‘এত স্লো হলে চলে না। আমাকে এখনই কাজে বসতে হবে আবার!’
জিল আবার কান্নায় ভেঙে পড়েছে। ওদের খাওয়াদাওয়া মিটতে না মিটতেই গাস হাজির হল। জিল আনন্দে চিৎকার করে উঠল, ‘ওরে আমার গাসি রে’ বলে ছোঁ মেরে মেঝে থেকে কোলে তুলে নিল গাসকে। ‘তুই তো জানিস না, কত্তটা খুশি হই আমি তুই আসলে।’
‘আমার বাঘ দেখেছ? এই যে আমার বাঘ’ গাস ফিসফিস করে বলল। বলে হাতে করে একটা ছোট্ট বিড়ালবাচ্চা এনেছিল সেটা ধুপ করে ফেলে দিল মেঝেতে। সঙ্গে সঙ্গে বিড়ালটা গিয়ে সোফার তলায় ঢুকে গেল। গাস ফিসফিস করে বলল, ‘ও কিন্তু লুকিয়ে আছে।’
লেস্টার এসব শুনে চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে দেখল বাচ্চাটা যাকে বাঘ বলছে তার ধূসর রঙের লেজটা সোফার নিচ থেকে বেরিয়ে আছে।
লেস্টার বিরক্তি নিয়ে বলল গাসকে, ‘তুমি এটাকে বাঘ বলছ কেন? এটা তো একটা বিড়াল। রাস্তাঘাটে যেসব বিড়াল দেখা যায়।’
গাস কথাটা শুনে বেশ আঘাত পেল মনে হল। মুখ ভেঙিয়ে বলল, ‘উঁ… ওটা বাঘ। গায়ে ডোরাকাটা দাগ আছে।’
‘বাঘ তো হলুদ হয়, আর এর থেকে অনেক বড় হয়। তোমাকে তো জন্তুজানোয়ার এসবের নামগুলো ঠিক করে জানতে হবে আগে।’
‘লেস্টার, প্লিজ…,’ জিল অনুনয় করল।
‘আরে তুমি থামো।’ লেস্টার জিলকে থামিয়ে দিয়ে বলতে লাগল, ‘গাস আর ততটা বাচ্চা নেই, ওকে এইসব চাইল্ডিশ গালগপ্প ছাড়তে হবে। রিয়ালিটি ফেস করতে হবে। সাইকি-টেস্টাররা কি নাকে তেল দিয়ে ঘুমায়? এসব ননসেন্স মাথা থেকে বের করাতে পারে না?’
জিল জানে মনন-পরীক্ষকরা গাসের মধ্যে কোনও অস্বাভাবিকতা খুঁজে পাবে না।
গাস দৌড়ে গিয়ে বিড়ালটাকে তুলে নিল। ‘তুমি ওকে কিছু বলবে না কিন্তু।’
বিড়ালটার দিকে তাকিয়ে লেস্টার কী যেন ভাবল। তারপর একটা অদ্ভুত শীতল হাসি হেসে বলল, ‘ল্যাবে এসো একদিন, তোমাকে অনেক বিড়াল দেখাব। আমাদের কাজে লাগে তো এইসব। বিড়াল, গিনিপিগ, খরগোশ— সব রিসার্চের কাজে লাগে, বুঝলে?’
‘লেস্টার!’ জিল বাকরুদ্ধ হয়ে গেল এক মুহূর্তের জন্য। লেস্টার ল্যাবে যে সাঙ্ঘাতিক সব জিনিস নিয়ে গবেষণা করে সেটা কারও অজানা নয়। ‘কেমন মানুষ তুমি, এত নীচ হতে পারলে?’
লেস্টার মুচকি হাসল। হঠাৎ ওখান থেকে উঠে গিয়ে নিজের কাজের ডেস্কে গেল। ‘এবার এখান থেকে কেটে পড় জিল। এত এত সব রিপোর্ট, আজই পাঠাতে হবে। আর গাসকে কথাটা বলতে ভুলো না।’
গাস তো শুনেই নাচতে লাগল। ‘কী কথা আছে পিসি, কী কথা আমায় বলো না!’ ফর্সা গালটা রাঙা হয়ে উঠল, চোখটা ঝকমকিয়ে উঠল। ‘কী কথা গো পিসি? খুব সিক্রেট কথা?’
জিলের বুকটা ভারী হয়ে উঠল। গাসের কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘চল আমরা বাগানে গিয়ে গল্প করি, ওইখানেই সিক্রেট কথাটা বলব। কই তোর বাঘটা কই? ওকে নিয়ে আয়।’
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই এমার্জেন্সি ভিডসেন্ডার যন্ত্রটি একটা ক্লিকের মতো শব্দ করে আলোকিত হয়ে উঠল, জানান দিল জরুরি মেসেজ এসেছে। লেস্টার তড়াক করে লাফিয়ে উঠল, ‘এই সবাই চুপ কর এবার।’ এই বলে ভিডসেন্ডারের কাছে চলে গেল। বড় বড় নিশ্বাস ফেলা দেখে বোঝাই যাচ্ছে রীতিমতো ঘাবড়ে গেছে সে।
জিল এবং গাস দরজা দিয়ে বেরোতে গিয়েও থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। একটা সিল করা মেসেজ টুপ করে বেরিয়ে এল। সিল ভেঙে লেস্টার মেসেজটা দেখতে লাগল৷
‘কী ব্যাপার?’, খারাপ কিছু?’ জিল জিজ্ঞাসা করল।
‘খারাপ?’ লেস্টারের মুখটা চাপা উত্তেজনায় উদ্ভাসিত দেখাচ্ছিল, ‘না, খারাপ তো নয়ই, দেখা যাক, আমাকে হয়তো…’
‘কী তাহলে?’
‘আমাকে দু-তিন সপ্তাহের জন্য ট্যুরে যেতে হতে পারে। আর চার্টে যা দেখাচ্ছে তাতে রেক্সর ফোর গ্রহেও যেতে হবে মনে হচ্ছে!’
‘সত্যি? তুমি রেক্সর ফোরে যাচ্ছ?’ জিল আনন্দে দু-হাতের আঙুলগুলো একসঙ্গে মুঠো করে ব্যগ্র ভাবে বলল, ‘উফ আমার বহুদিনের শখ ছিল রেক্সর ফোর যাওয়ার। পুরোনো দিনের সব ব্যবস্থা, প্রাচীন ধ্বংসাবশে, পুরোনো শহর। লেস্টার, আমাকে নিয়ে চল না গো? তুমি আজ পর্যন্ত আমাকে কোথাও ছুটিতে নিয়ে যাওনি, সারাজীবন শুধু কথা দিয়ে গেছ নিয়ে যাব বলে…’
লেস্টার যেন কথাটা শুনে আমোদ পেল খুব। ‘তুমি যাবে? তুমি?’ বলেই খ্যাক খ্যাক করে একটু হেসে নিল। ‘আর না হাসিয়ে প্লিজ আমার জামাকাপড় প্যাক করে দাও। এই ট্যুরটার জন্য আমি অনেক ওয়েট করেছি।’ উত্তেজনায় আর পরিতৃপ্তিতে দুটো হাতের তালু ঘষতে লাগল লেস্টার, ‘শোন আমি না আসা অবধি তুমি বাচ্চাটাকে বাড়িতে নিয়ে আসতে পার। কিন্তু তারপর আর না। ওফ, রেক্সর ফোর। কই প্যাকিং করতে গেলে?’
(২)
‘তোকে তো একটু মানিয়ে নিতেই হবে,’ ফ্র্যাঙ্ক বলল, ‘আফটার অল ও একজন বিজ্ঞানী।’
‘বিজ্ঞানী হোক আর যাই হোক’ জিল বলল, ‘আমি আর ওর সঙ্গে ঘর করতে পারছি না রে দাদা। রেক্সর ফোর থেকে ফিরলেই আমি সব সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়ে চলে আসব। আর আর সহ্য করতে পারছি না।’
ফ্র্যাঙ্ক একদম চুপ মেরে গেল, চিন্তার গভীরে ডুবে রইল। বাগানের লনে বসে ছিল জিল আর তার দাদা ফ্র্যাঙ্ক। হঠাৎ ফ্র্যাঙ্ক পা-টা ছড়িয়ে বলে উঠল, ‘তুই যদি বিয়েটা ভেঙে দিস, তার মানে তুই আবার বিয়ে করতে পারিস। আচ্ছা একটা কথা আমাকে বল, তোর কোন সমস্যা নেই তো?’ ফ্র্যাঙ্ক একটু ইতস্তত করে বলেই ফেলল, ‘মানে… সেক্সুয়ালি তুই অ্যাক্টিভ তো?’
জিল নিশ্চিন্ত করল দাদাকে, ‘নিশ্চয়ই, সেক্স নিয়ে কোনও সমস্যা নেই। শুধু এমন লোক খুঁজতে হবে যে বাচ্চা পছন্দ করে।’
‘তুই সারাদিন বাচ্চা বাচ্চা করে যাস,’ ফ্র্যাঙ্ক যা বুঝেছে সেটাই বলল, ‘গাসও তোর বাড়ি যেতে ভালোবাসে। কিন্তু ও লেস্টারকে মোটেই পছন্দ করে না।’
‘জানি রে। এই এক সপ্তাহ ও নেই বাড়িতে, কি দারুণ যে কেটেছে।’ জিল নিজের মখমলের মতো কোমল ব্লন্ড চুল হাত দিয়ে নাড়িয়ে গাল লাল করে বলল, ‘মনে হচ্ছে আমি যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছি।’
‘কবে ফিরবে?’
‘যে কোনও দিন ফিরে আসতে পারে,’ হাতের মুঠোটা যেন একটু শক্ত হয়ে উঠল জিলের, ‘পাঁচ বছর হল আমাদের বিয়ে হয়েছে, আর ওর এই ব্যবহার দিন কে দিন খারাপ থেকে আরও খারাপ হচ্ছে। এক্কেবারে অমানুষ একটা। যেমন পাষাণ তেমনি নিষ্ঠুর। ও আর ওর কাজ। দিনরাত শুধু এই চলেছে।’
‘লেস্টার উচ্চাকাঙ্খী, ও ওর ফিল্ডে টপে যেতে চায়।’ ফ্র্যাঙ্ক একটা সিগারেট ধরালো অলসভাবে, ‘আর হয়তো ও সেটা করেও ফেলবে। কোন ফিল্ডে আছে যেন ও?
‘টক্সিকোলজি… বিষবিজ্ঞান… নিত্যনতুন নতুন বিষ আবিষ্কার করে চলেছে মিলিটারিদের জন্য। এই যে ক্যালিস্টোদের কপার সালফেট স্কিন-লাইম দিয়ে আক্রমণ করা হল, এটা ওরই বানানো।’
‘খুবই ছোট ফিল্ড। আমাকেই ধর না।’ ফ্র্যাঙ্ক দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসল, ‘শ’য়ে শ’য়ে উকিল কাজ করে এই আন্তঃগ্রহ ছাড়পত্র দপ্তরে, ছাড়পত্র বের করায়, নয়তো আটকায়। বছরের পর বছর কাজ করেও আমি কোনও মহান কিছু করে ফেলতে পারব না। সেটা আমি জানি। আমি এতেই সন্তুষ্ট। নিজের কাজ নিজে করে যাই। তাতেই আনন্দ।’
‘লেস্টার যদি কিছুটা তোর মতো ভাবত!’
‘বলা যায় না, মানুষের তো পরিবর্তন হয়।’
‘লেস্টারের পরিবর্তন হবে না।’ তিক্ততার সঙ্গে জিল বলে উঠল, ‘আমি এখন বুঝে গেছি। তাই আমি মনস্থির করে ফেলেছি, সংসার ছেড়ে আসা ছাড়া গতি নেই। ও চিরকাল একইরকম থেকে যাবে।’
(৩)
রেক্সর ফোর থেকে লেস্টার ফিরলো যেন সম্পূর্ণ আলাদা মানুষ হয়ে। যেন খুশিতে একেবারে ডগমগ করছে। অ্যান্টি-গ্র্যাভ সুটকেসটা পাশে দাঁড়ানো রোবট-পরিচারকের হাতে ধরিয়ে দিয়ে ‘থ্যাংক ইউ’ পর্যন্ত বলল।
বিস্ময়ে জিলের মুখ থেকে কোন কথা সরে না। ‘লেস্টার, কী ব্যাপার…’
লেস্টার টুপি খুলে মাথা নীচু করে অভিবাদন জানিয়ে বলল, ‘গুড ডে, মাই ফেয়ার লেডি! তোমাকে তো দারুণ লাগছে। তোমার আঁখি যেন নীল টলটলে স্বচ্ছ দীঘি, তার মাঝে যেন দারুচিনি দ্বীপ— কোনও এক দিগন্তের জলসিঁড়ি নদীর ধারে।’
লজ্জায় আরক্ত জিল একটা ঠেলা মেরে লেস্টারকে থামাল। লেস্টার যেন কীসের একটা গন্ধ শোঁকার ভান করল জিলের হাত থেকে, ‘কীসের ঘ্রাণ পাচ্ছি বলত? বাড়িতে কি আমার জন্য সব ভালো ভালো খাবার অপেক্ষা করে আছে? হুঁ হুঁ… আমিষ ও নিরামিষ, চর্ব্য ও চোষ্য— সবই জোগাড় আছে মনে হচ্ছে? হেঁ হেঁ।’
জিল নিজের চোখকে আর কানকে যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। চোখ পিটপিট করতে করতে বলল, ‘তোমার কী হয়েছে বলত? এরকম তো আগে কখনও করনি?’ জিলের বুকে একটা ক্ষীণ আশা জমাট বাঁধছিল। ‘একদম পালটে গেছ!’
‘তাই? আমি পালটে গেছি? হাঃ হাঃ’, এটা সেটায় হাত বোলাতে বোলাতে বাড়ির দিকে এগোতে লাগল। ‘আমার ছোট্ট মিষ্টি বাড়িটা। উফ এতদিন পর বাড়িতে নিজের বাড়িতে ফিরলে যে কি ভালো লাগে তুমি জান না, বিশ্বাস কর।’
‘বিশ্বাস করতে আমার ভয় করছে’, জিল বলল।
‘কী বিশ্বাস করতে ভয় করছে?’
‘যে এই সব কথা তুমি মন থেকে বলছ। তুমি আগে যেরকমটা ছিলে এখন তুমি সেরকমটা নও।’
‘আগে কেমন ছিলাম?’
‘নীচুমনের মানুষ ছিলে। আর নির্দয়।
‘আমি?’ লেস্টার ভুরু কুঁচকায়। ঠোটটা মুছে বলল, ‘তাই? তাহলে অদ্ভুত ব্যাপার বলতেই হয়। খুবই অদ্ভুত। হাঃ হাঃ।’ উদ্ভাসিত হয়ে বলল, ‘যাক গে, যা হয়ে গেছে তা এখন অতীত। রাতে কী খাওয়া হবে আজ? খিদেতে পেট চুঁইচুঁই করছে।’
জিল ঠিক নিশ্চিত হতে পারছিল না, লেস্টারকে চোখের আড়াল না করেই রান্নাঘরে যেতে উদ্যত হল, ‘তুমি যা বলবে লেস্টার, তুমি তো জানোই হেন খাবার নেই যা আমাদের স্টোভ করতে পারে না। সবচেয়ে বেশি খাবারের লিস্ট রয়েছে আমাদের মডেলটায়।’
‘হুমম, তাই তো!’ লেস্টার কাশতে লাগল, ‘তাহলে… উমম… আচ্ছা আজ সারলয়েন স্টিক (গরুর দাবনার মাংসের ফালি দিয়ে একটা রান্না) চলতে পারে? মাঝারি মাপের মাংসের টুকরো পিঁয়াজ দিয়ে মাখো মাখোমাখো করে একদম, বুঝলে কি না? সঙ্গে মাশরুম সস। হোয়াইট রোল (পাঁউরুটি জাতীয় খাবার) দিয়ে খাব। ঠিক আছে কি না? আর গরম কফি বলে দাও। শেষে ডেজার্টে আইসক্রিম আর অ্যাপেল পাই, ব্যাস। তোফা!’
‘তুমি আবার খাবারদাবার নিয়ে এত মাথা ঘামাচ্ছ কবে থেকে?’ জিল কিছু একটা ভাবতে ভাবতে বলল।’
‘হ্যাঁ? সেকি?’
‘তুমি তো বলতে, যাই খাই-না কেন সেটা থেকে যাতে খুব সহজে খাদ্যরস শোষণ করা যেতে পারে তার উপযোগী করে রান্না করা উচিৎ, হ্যান ত্যান আরও কত কী।’ জিল খুব ভালো করে লেস্টারকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল, ‘লেস্টার, ঠিক করে বলত কী ব্যাপার?’
‘ব্যাপার আবার কী? কিছুই না।’ বলে একটা পাইপ বের করে তাড়াহুড়ো করে ধরাতে গেল। জিলের কেমন যেন একটু বেমানান লাগল। পাইপ থেকে কিছুটা তামাক কার্পেটে পড়ে গেল। লেস্টারকে হঠাৎ একটু নার্ভাস মনে হল, কার্পেট থেকে তামাকের গুঁড়োগুলো তুলতে চেষ্টা করল। ‘আমার কথা বাদ দাও, তুমি তোমার কী কাজকর্ম আছে সেগুলো কর। চাইলে আমি তোমাকে সাহায্যও করতে পারি। কিছু করে দিতে হবে?’ লেস্টার বলল।
‘নাহ্, আমি নিজেই সব করে নিতে পারব’, জিল বলল। ‘তুমি তোমার কাজ শুরু দাও।’
‘কাজ বলতে?’
‘ওই তোমার রিসার্চ? বিষটিষ ছাইপাঁশ সব?’
‘বিষ?’ লেস্টার ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। ‘হায় ভগবান, বিষটিষ এসব অত্যন্ত খারাপ জিনিস, আমি এসবের মধ্যে নেই বাবা।’
‘কী বললে তুমি?’
‘অ্যাঁ… মানে… আসলে আমি খুবই ক্লান্ত এখন। পরে কাজকর্ম শুরু করব।’ বলে লেস্টার ঘরের মধ্যে পায়চারী করতে করতে বলল,’ বসে বসে বরং আমি বাড়ি ফেরত আসার আনন্দটাই উপভোগ করি। রেক্সর ফোরে যা দিন গেছে!’
‘কেন, ট্যুর খারাপ গেছে?’
‘উফ বীভৎস খারাপ।’ বিরক্তিতে যেন লেস্টারের মুখ বেঁকে গেল, ‘যেমন শুকনো জায়গা, মড়া গ্রহ একটা। রোদ আর শুষ্ক হাওয়াতে পুরো শুকিয়ে আম আঁটির ভেঁপু হয়ে গেছি একদম। এক্কেবারে ওঁচা জায়গা।’
‘আমারও খারাপ লাগছে শুনে। বহুদিনের ইচ্ছে ছিল ওখানে যাওয়ার।’
‘খবরদার আর না’, লেস্টার হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল। তারপর গলা খাদে নামিয়ে বলল, ‘এখান থেকে তুমি আর কোত্থাও যাবে না জিলসোনা, আমি আর তুমি দুজনে একসঙ্গে এখানেই থেকে যাব সারাজীবন।’ আর টেরাগ্রহ, আমাদের পৃথিবী… এরকম অপূর্ব গ্রহ আর কোথায় পাবে? হলুদ পাতা, শিশিরের পালক, কার্তিকের রাত…’ লেস্টার খুশিতে আবার ডগমগ করছিল, ‘যেমনটি প্রাণ চায়।’
জিল ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘কিন্তু আমার তো মাথায় কিছুই ঢুকছে না!’
(৪)
‘কী বললি আবার একবার বল’, ফ্র্যাঙ্ক বলল, ‘যা যা মনে পড়ছে। যা যা পরিবর্তন তুই দেখেছিস ওর মধ্যে। আমার সত্যি কৌতূহল হচ্ছে।’ ফ্র্যাঙ্কের রোবট-পেন্সিলটাও উদগ্রীব হয়ে রইল।
‘কেন?’
‘এমনিই। বল না। তুই বললি তুই প্রথমেই বুঝতে পেরেছিলিস কিছু গড়বড় আছে, তাই না?’
‘হ্যাঁ, ঠিকই। মুখের ভাবটাই অন্যরকম ছিল। সাধারণত যেমন থাকে— কঠিন নিরস ভাব, সেরকমটা ছিল না। ওর মুখে একটা উৎফুল্ল, নিরুদ্বেগ ভাব ছিল। বেশ ধৈর্যশীল লাগছিল। একটা শান্তভাব দেখেছিলাম যেটা আগে কখনও দেখিনি।’
‘হুমম, বুঝলাম’, ফ্র্যাঙ্ক বলল, ‘আর কিছু? ‘
জিল একটু নার্ভাস হয়ে পিছন ফিরে বাড়ির দিকটায় তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘কিছু শোনা যাবে না তো ভেতর থেকে?’
‘না না, লেস্টার তো বসার ঘরে গাসের সঙ্গে খেলছে। এখান থেকে আওয়াজ যাবে না। ওরা আজকে শুক্রগ্রহের ভোঁদরমানব সেজে খেলছে। লেস্টার মনে হয় ওর ল্যাবে একটা স্লিপ বানিয়েছে যেটা ওই ভোঁদরমানবরা ব্যবহার করে। দেখলাম ওটা প্যাকিং খুলে বার করছে ওরা।’
‘ওর কথাবার্তা।’
‘ওর কী?’
‘কথাবার্তা! যেভাবে কথা বলছে, যেসব শব্দ ব্যবহার করছে, আগে কোনওদিন করেনি। নতুন কী সব বুলি শিখেছে, উপমা দিয়ে কথা বলছে কবিতার মতো! পাঁচ বছরে একবারের জন্যেও এসব শোনার সৌভাগ্য হয়নি। বলত ওইসব কবিতা-ফবিতা কখনও নিঁখুত তথ্য দিতে পারে না। আর…’
‘আর কী?’ পেন্সিলটা তখনও পাতায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে নানারকম আঁকিবুকি কেটে যাচ্ছিল।
‘আর অদ্ভুত সব শব্দ ব্যবহার করছে। পুরোনো দিনের শব্দ, যেগুলো এখন কেউ আর ব্যবহার করে না।’
‘প্রাচীন রচনাশৈলীর ভাষা?’
‘হ্যাঁ রে,’ পকেটে হাত ঢুকিয়ে লনে পায়চারি করতে করতে বলল জিল, ‘একদম ফর্মাল কথা বলে, যেমন ধর…’
‘যেমন পুরোনো বইতে লেখা থাকে?’
‘একদম, তুইও খেয়াল করেছিস? ‘
‘হ্যাঁ, করেছি বটে’, ফ্র্যাঙ্কের মুখটা নিষ্প্রভ হয়ে গেল তৎক্ষণাৎ। ‘হুমম বলে যা।’
জিল থমকে গেল, ‘কী ভাবছিস বলত, কিছু মাথায় আসছে?’
‘আরও তথ্য জানতে হবে।’
‘কী তথ্য আবার। ও এখন খেলা করছে, গাসের সঙ্গে আবার, মজার মজার কথা বলছে, খাচ্ছে…’
‘খাচ্ছে মানে? আগে খেত না?’
‘না মানে আগে এরকমভাবে খেত না। এখন যাকে বলে ভোজনরসিক হয়ে উঠেছে। কিচেনে যায়, গিয়ে যতরকম সম্ভব সব খাবার বানায়, ওই অটোকুকিং স্টোভটা নিয়ে যতরকম কিম্ভূত সব দেশবিদেশের খাবার বানাতে থাকে।’
‘একটু মোটাও লাগছে সেই জন্য।’
‘হ্যাঁ তো, দশ পাউন্ড ওজন বেড়ে গেছে। খাচ্ছে দাচ্ছে, হাসিঠাট্টা করছে। আবার বিনয়ের অবতার হয়ে সারাক্ষণ কথা বলছে। আর তুই বিশ্বাস করবি না দাদা…’ জিল একটু লজ্জা পেয়ে চোখ সরিয়ে বলল, ‘এখন আবার বাবু রোমান্টিক হয়ে গেছেন। কী সব কবিতার লাইন আওড়ায় মাঝে মধ্যে। অথচ নিজেই বলত এসব অযৌক্তিক ব্যাপার সব। আর সব চেয়ে বড় ব্যাপার হল, ওর ওই বিষ-টিষ নিয়ে রিসার্চ? ওতেই আর একদম মন নেই ওর।’
‘বটে? আর কিছু?’
‘আরেকটা জিনিস নিয়ে আমিও চিন্তিত, আমি বেশ কয়েকবার খেয়াল করেছি।’
‘কী?’
‘ও কেমন যেন মাঝে মাঝে…’
হঠাৎ লেস্টারের হাসিতে সবাই চমকে উঠল। লেস্টার হ্যারিক, দৌড়াতে দৌড়াতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছে। আনন্দে যেন চোখ ঝকমক করছে। পেছনে পেছনে ছোট্ট গাসও তাড়া করে আসছে।
লেস্টার চেঁচিয়ে বলতে লাগল, ‘শুনুন শুনুন, একটা ঘোষণা আছে।’
গাস সেটাকেই অনুকরণ করে বলল, ‘ঘোছোনা আচে।’
ফ্র্যাঙ্ক দাঁড়িয়ে উঠে চট করে নোটবই আর পেন্সিল-রোবট কোটের পকেটে লুকিয়ে ফেলল। তারপর বলল, ‘কী ঘোষণা শুনি?’
‘তুমি বলো’ বলে গাসকে হাত ধরে সামনে এগিয়ে দিল লেস্টার। হাতে একটা লাঠি ধরিয়ে দিল নকল মাইক্রোফোন হিসেবে।
গাস ফোলা ফোলা মুখ নিয়ে চোখমুখ বন্ধ করে মনে করে নেওয়ার চেষ্টা করল কি বলতে হবে। তারপর লাঠিটা মুখের সামনে এনে চেঁচিয়ে বলল, ‘আমি কাল থেকে পিসির বাড়িতে থাকব!’ তারপর স্বাভাবিক স্বরে জিলের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘লেস্টার আংকল তো বলল আমি যেতে পারি। সত্যি গো পিসি?’ জিলের মুখ দেখে বোঝার চেষ্টা করল এটা সত্যি ঘটনা কি না।
জিলের মনটা অপরিসীম আনন্দে ভরে উঠল। গাস এর থেকে চোখ সরিয়ে লেস্টারের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘সত্যি বলছ? কী গো?’ আবেগের চোটে জিলের গলার স্বর প্রায় শোনাই যাচ্ছিল না।
লেস্টার হাত বাড়িয়ে জিলকে টেনে জড়িয়ে ধরল, ‘নিশ্চই, ও আমাদের সঙ্গেই থাকুক।’ তার চোখেও উষ্ণতা আর আশ্বাস ধরা পড়ল। ‘আর আমরা কেউ গাসবাবুকে একটুও উত্যক্ত করব না।’
‘ইয়েস, নো টিজিং, বুঝলে?’ গাস চিৎকার করে উঠল। লেস্টার আর জিল দুজনেই গাসকে টেনে নিল তাদের কাছে, ‘না না বাবু, একদম না।’
ফ্র্যাঙ্ক একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিল মুখ কালো করে। জিল সেটা খেয়াল করেই চট করে লেস্টার আর গাসকে ছেড়ে দিয়ে বলল, ‘কী হয়েছে রে দাদা? তুই ওরকম মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?’
‘তোমাদের হয়ে গেলে…’ লেস্টারের দিকে ঘুরে বলল ফ্র্যাঙ্ক, ‘লেস্টার আমার সঙ্গে একটু আসবে? কথা ছিল।’
জিলের বুকটা কেন যেন একটু ছ্যাঁৎ করে উঠল। ‘কেন কী হয়েছে? আমিও আসব?’
ফ্র্যাঙ্ক মাথা নেড়ে না জানিয়ে দিল। কেমন যেন ভয়ে পেয়েছে মনে হল ফ্র্যাঙ্ক। চাপা গলায় ফ্র্যাঙ্ক বলল, ‘চলো লেস্টার। আমরা দুজনে একটু ঘুরে আসি গাড়িটা নিয়ে।’
ফ্র্যাঙ্কের সারফেস ক্রুজারে দুজনে চেপে বসল।
(৫)
আন্তঃগ্রহ ছাড়পত্র দপ্তরের তিনজন প্রতিনিধির সামনে কয়েক ফুট দূরে বসেছিল লেস্টার হেরিক। তিনজনেই বেশ সতর্কভাবে লেস্টারকে নিরীক্ষণ করে চলেছে, হাতে ভাইব্রো-রে’র নল নিয়ে।
তিনজনের মধ্যে একজন ছিলেন ছাড়পত্র দপ্তরের অধিকর্তা মিস্টার ডগলাস। ডগলাস বেশ অনেকক্ষণ দেখার পর পাশে দাঁড়ান ফ্র্যাঙ্ককে বলল, ‘তুমি কি নিশ্চিত?’
‘একদম।’
‘রেক্সর ফোর থেকে কবে ফিরেছে এ?’
‘সপ্তাহখানেক আগে।’
‘পরিবর্তন কি তখনই দেখা গেছে?’
‘হ্যাঁ, রেক্সর ফোর থেকে ফেরামাত্রই ওর স্ত্রী টের পেয়েছে। পরিবর্তনটা যে রেক্সরেই হয়েছে সে নিয়ে কোনও সন্দেহই নেই।’ ফ্র্যাঙ্ক অর্থপূর্ণভাবে কিছুটা থেমে বলল, ‘তার মানে নিশ্চই বুঝতে পারছেন ব্যাপারটা?’
‘হুমম।’ বসে থাকা লেস্টারকে সমস্ত কোন থেকে ধীরে ধীরে নিরীক্ষণ করতে লাগল ডগলাস। লেস্টার শান্ত ও নির্বিকার ভাবেই বসে ছিল। কোট সুন্দর করে ভাঁজ করে রাখা হাঁটুর কাছে, হাত রাখা হাতির দাঁত বসানো বেতের ছড়ির হাতলে। ধূসর বর্ণের নরম কোট, তার ওপর একটা নেকটাই, ফ্রেঞ্চ কাফ আর চকচকে পালিশ করা কালো বুট। এভাবেই চুপচাপ বসে ছিল লেস্টার।
‘ওদের পদ্ধতি বেশ সহজ এবং নিখুঁত বুঝলে?’ ডগলাস খোলসা করে বোঝাচ্ছিল, ‘বাহকের নিজস্ব চেতনাবস্তুটিকে শুষে বাইরে বের করে ঝুলন্ত কোনও কিছুর মধ্যে রেখে দেয়। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পরিবর্ত চেতনাবস্তু ঢুকিয়ে দেয় ভেতরে। এই বাবুটি বোধহয় কোনরকম সুরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। কোনওরকম শিল্ড বা সুরক্ষা-আবরণ ছাড়াই রেক্সরের প্রাচীন ধ্বংসাবশেষের ভিতর এদিক ওদিক ঘুরে বেরাচ্ছিলেন হয়তো, ব্যাস আর পায় কে।’
বসে থাকা বাবুটি একটু ঘুরে বসল। ‘একটু জিলের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারলে ভালো হত হে,’ বিড়বিড় করে বলে উঠল, ‘নিশ্চয়ই খুব দুশ্চিন্তা করছে সে।’
ফ্র্যাঙ্ক ঘুরে তাকাল, মুখের ভাব আমুল বদলে গেছে। ‘মাইরি, এটা এখনও একই রকম অভিনয় করে যাচ্ছে!’
অধিকর্তা ডগলাস অনেক কষ্টে নিজের মেজাজ সামলে নিলেন। ‘যতই দেখছি ততই অবাক হচ্ছি। চেহারায় কোনও পার্থক্যই খুঁজে পাবে না।’ বসে থাকা মানুষটার কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল, ‘শোন, তোমরা নিজেদের কে কী নামে ডাকো তা আমি জানিনা। আমি যা বলছি সেটা বুঝতে পারছ?’
‘নিশ্চয়ই, কেন বুঝব না,’ লেস্টার হেরিক জানাল।
‘তুমি কি ভেবেছ এরকম অভিনয় করে তুমি পার পেয়ে যাবে? তোমার আগে যারা এসেছিল সব ক-টাকে আমরা ধরেছি। দশজনের দশজনকেই। এমনকী এখানে আসার আগেই পাকড়ানো হয়েছে।’ ডগলাস একটা বাঁকা হাসি দিয়ে বলল, ‘এই ভাইব্রো-রে দিয়ে সব ক-টাকে নিকেশ করা হয়েছে।’
লেস্টারের মুখ যেন পলকে সাদা হয়ে গেল। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দিল। বুকপকেট থেকে সিল্কের রুমাল বের করে মুছল লেস্টার। ‘তাই? হবে হয়তো।’ কোনওমতে উচ্চারণ করল লেস্টার।
‘আমাদের বোকা বানানোর চেষ্টা করে লাভ নেই। সারা পৃথিবীর লোক সতর্ক হয়ে গেছে রেক্সরিয়ানদের থেকে। আমি ভেবে পাচ্ছি না রেক্সর থেকে বেরোতে পারলে কী করে। হেরিক বোধহয় চরম অসতর্ক ছিল। অন্যদের তো মহাকাশযানেই আটকে দেওয়া হয়েছিল। মহাকাশেই তাদের সৎকার করা হয়ে গেছে।’
‘হেরিকের নিজস্ব যান ছিল’, বসে থাকা মানুষটা আবার বিড়বিড় করে বলে ওঠে। ‘ও স্বাস্থ্যপরীক্ষা কেন্দ্র এড়িয়ে যানে ঢুকেছিল। ওর আগমনের কোনও নথিই নেই। ওর কোনও পরীক্ষাই হয়নি।’
ডগলাস থ’ হয়ে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ।
‘এই, পুড়িয়ে দে তো এটাকে!’ ডগলাস রাগে চেঁচিয়ে উঠল। তিনজন অফিসার তাদের ভাইব্রো-টিউবের মুখ উঁচিয়ে সামনে আসতে লাগল।
‘না, দাঁড়ান’ ফ্র্যাঙ্ক মাথা নেড়ে তাদের আটকালো। ‘আমরা সেটা পারি না। এখন পরিস্থিতি অন্যরকম।’
‘তার মানে কী? না পোড়ানোর কী আছে? বাকিগুলোকে তো তাই করা হয়েছে!’
‘ওদের কে ধরা হয়েছিল বহির্মহাকাশে। এটা পৃথিবী। এখানে পৃথিবীর আইন বলবত হবে, মিলিটারি আইন না।’ তারপর চেয়ারে বসা মানুষটাকে দেখিয়ে বলল ফ্র্যাঙ্ক, ‘আর এটা একটা মানুষের শরীর, সাধারণ নাগরিক আইন প্রযোজ্য এর ওপর। আমাদের আগে প্রমাণ করে দেখাতে হবে ইনি লেস্টার হেরিক নন, একজন রেক্সরিয়ান অনুপ্রবেশকারী। কাজটা কঠিন সন্দেহ নেই, কিন্তু অসম্ভব নয়।’
‘কীভাবে?’
‘কেন জিলের স্বাক্ষ্য আছে না? জিল মানে লেস্টার হেরিকের স্ত্রী। সেই ভালো বলতে পারবে আসল লেস্টার হেরিকের সঙ্গে এই জন্তুটার কী কী পার্থক্য আছে। জিল হেরিক সবই খেয়াল করেছে— আশা করি কোর্টে কেসটা আমরা দাঁড় করাতে পারব।’
সন্ধে হয়ে গেছিল। ফ্র্যাঙ্ক তার সারফেস ক্রুজার চালিয়ে বাড়িয়ে ফিরে এল। বাড়িতে ফিরে জিল বা ফ্র্যাঙ্ক কেউই কোন কথা বলল না।
(৬)
‘ও তাহলে এই ব্যাপার,’ জিল অনেকক্ষণ পর বলে উঠল। চোখে মুখে কোনও আনন্দ বা উত্তেজনার লেশমাত্র ছিল না। ‘আমি আগেই জানতাম, এত সৌভাগ্য কি আমার সইবে?’ হাসার মৃদু চেষ্টা করল জিল, ‘কিন্তু কি দারুণ যে কেটেছিল এই ক-টা দিন।’
‘তোর মনের অবস্থা বুঝতে পারছি রে।’ ফ্র্যাঙ্ক বলল, ‘তবে এটা খুবই ভয়ানক জিনিস। ধর যদি…’
‘কেন? কেন এটা আমার সঙ্গেই হতে হল? কেন লেস্টারকেই পেতে হল শুধু?’
‘শোন শোন, রেক্সর ফোর গ্রহটা প্রাচীন মৃত গ্রহ একটা। ওখানকার জীবজগৎটাই বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে।’
‘আমার এখন মনে পড়ল, ও মাঝে রেক্সর নিয়ে কি একটা বলেছিল। কপালের জোরে ওখান থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছি না এরকম কিছু একটা কথা।’
‘এই রেক্সরিয়ানরা প্রাচীন জাতি একটা। এখন যারা রয়েছে তারা খুবই দুর্বল। কয়েকশো বছর ধরে তারা চেষ্টা করে যাচ্ছে গ্রহ ছেড়ে পালিয়ে আসার। কিন্তু একমাত্র বাধা হচ্ছে তাদের দুর্বল দেহ। আগে কেউ কেউ শুক্রগ্রহে চলে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল— সঙ্গে সঙ্গে মারা গেছিল। এই পদ্ধতিটা ওরা একশো বছর হল বের করেছে।’
‘কিন্তু এরা আমাদের সব জানে কী করে? আমাদের জীবনের নানা ঘটনা। আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি…’
‘সব জানে না। এই যে তুই যে পার্থক্যগুলো খেয়াল করেছিস। সেকেলে কথাবার্তার ধরণ। মানুষের সভ্যতা সংস্কৃতি সম্পর্কে ওদের একটা ভাসা ভাসা জ্ঞান আছে। পৃথিবীর বই-টই ইত্যাদি থেকে যেটুকু জানা যায়। যেমন ধর পুরোনো নানা রোমান্টিক উপন্যাস, বই ইত্যাদি থেকে এরা আমাদের ভাষা, রীতিনীতি, ব্যবহার ইত্যাদি জেনেছে। যার জন্যে এরা এখনও সেকেলে বুলি আউড়ে যায়। ওরা পৃথিবী নিয়ে চর্চা করেছে বটে, কিন্তু চর্চা ভুল পথে চলে গেছে।’ ফ্র্যাঙ্ক বাঁকা হেসে বলল, ‘ওরা মোটামুটি দুশো বছর পিছিয়ে আছে। এবং সেটাই আমাদের রেক্সরিয়ান চেনার একমাত্র উপায়।’
‘আচ্ছা এরকম কি প্রায়ই হয়? আমার তো এখনও বিশ্বাসই হচ্ছে না’ জিল কপালটা ঘষতে ঘষতে বলল, ‘কিছুটা বুঝতে পারছি এখন মনে হয়।’
‘সারা গ্যালাক্সি এরকম অচেনা অপার্থিব জীবে ভরে রয়েছে। এরকম ক্ষতিকর পরজীবী প্রচূর রয়েছে। পৃথিবীর নিয়মকানুন তো তাদের ওপর চলে না। আমাদের নিজেদেরই সবসময় সুরক্ষিত রাখতে হয়। লেস্টার বেচারা এসব চিন্তা না করেই চলে গেছে, কোনও সুরক্ষা না নিয়ে। আর ওই প্রাণীটাও সুযোগ বুঝে লেস্টারকে আক্রমণ করে ওর দেহটার দখল নিয়ে নিয়েছে।’
ফ্র্যাঙ্ক একবার জিলের দিকে তাকাল। জিলের মুখে কোন অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ নেই। কঠিন মুখে নিজেকে সামলে আছে বটে, কিন্তু চোখে বিস্ময়টা এখনও রয়ে গেছে। কোলে হাত দিয়ে চেয়ারে সোজা হয়ে বসেছিল, অনির্দিষ্টের পানে চেয়ে।
‘তুই চাইলে কোর্টে নাও যেতে পারিস, তোর বিবৃতিটা ভিডিয়ো করে পাঠিয়ে দিলেই হবে, ওরা সেটাকেই প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করবে। কোর্ট বলেছে সবরকম সাহায্য করবে। কিন্তু ওদের এগানোর জন্য তো কিছু প্রমাণ দরকার। আমি নিশ্চিত তোর বিবৃতিতেই কাজ হয়ে যাবে।’
জিল নিরুত্তর হয়ে বসে থাকে।
‘কি রে কী বক্তব্য তোর?’ ফ্র্যাঙ্ক জিজ্ঞাসা করল।
‘কোর্টের রায় বেরিয়ে গেলে তারপর কী হবে?’
‘তারপর ভাইব্রো-রে দিয়ে রেক্সরিয়ান প্রাণীর চেতনাটা নষ্ট করে দেওয়া হবে। লেস্টারের আসল চেতনাবস্তুটি খুঁজে আনার জন্যে হয়তো রেক্সর ফোরে লোক নামানো হবে পেট্রল শিপ থেকে।’
উত্তেজনায় জিলের দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগল, ‘তার মানে লেস্টারের…’ চমৎকৃত হয়ে ফ্র্যাঙ্কের দিকে তাকাল।
‘হ্যাঁ, লেস্টার সম্ভবত এখনও বেঁচে আছে। রেক্সরের কোনও ধ্বংসাবশেষ বা গুহায় হয়তো ঝুলিয়ে রাখা রয়েছে তার চেতনাবস্তু। এমনিতে দেবে না, তবে জোর করলে ওরা দিয়ে দিতে পারে। আগেও দিয়েছে এরকম। ব্যাস তারপরেই আসল লেস্টারকে ফেরৎ পেয়ে যাবি তুই। একদম স্বশরীরে, স্বমহিমায়। কি? খুশি তো এবার? তুই যেরকম দুঃস্বপ্নের মতো সময়ের মধ্যে দিয়ে চলছিস সেটাও তখন অতীত হয়ে যাবে।’
(৭)
‘আমরা পৌঁছে গেছি।’ সারফেস ক্রুজারটা আন্তঃগ্রহ ছাড়পত্র ভবনের পাশে দাঁড় করালো ফ্র্যাঙ্ক। দ্রুত ক্রুজার থেকে নেমে বোনের জন্য দরজা খুলে দিল। জিল ধীরে ধীরে নামল। ফ্র্যাঙ্ক জিজ্ঞাসা করল, ‘সব ঠিক আছে তো?’
‘হুমম’ বলে জিল এগিয়ে গেল।
সদরে তাদেরকে ভালো করে পরীক্ষা করে ঢোকার অনুমতি দেওয়া হল। জিলের হাইহিল জুতোর আওয়াজে চারিদিকের নিস্তব্ধতাকে ভেঙে দিতে দিতে দীর্ঘ বারান্দাটা তারা পেরিয়ে যেতে লাগল।
‘জায়গা বটে একটা’ ফ্র্যাঙ্ক বলল।
‘কিন্তু ব্যবহার খুব একটা ভালো না লোকেদের।’
‘ধরে নে একটা বিশাল বড় একটা থানা। এখানে কে ভদ্রতা দেখাতে আসবে?’ বলতে বলতে ফ্র্যাঙ্ক থেমে গেল। সামনেই আরেকটা দরজা, এখানেও পাহারা। ‘এসে গেছি আমরা।’
‘দাঁড়া দাঁড়া…’ জিল প্রবল উদ্বেগে ফ্র্যাঙ্ককে টেনে ধরল। ‘আমি তো…’
‘ঠিক আছে ঠিক আছে, চিন্তা নেই। তুই আগে নিজেকে গুছিয়ে নে, তুই বললে তবেই আমরা ভেতরে ঢুকব।’ ফ্র্যাঙ্ক ইশারা করে দু-একজন অফিসার যারা ওদের দেখে এগিয়ে এসেছিল তাদেরকে সরিয়ে দেয়। ‘আমি জানি, কাজটা কঠিন।’
জিল কয়েক মুহূর্ত মাথা নীচু করে, লম্বা শ্বাস নিয়ে, মুঠোটা শক্ত করে ধরে নিজেকে প্রস্তুত করে নিতে লাগল। অতঃপর মাথা উঁচু করে দৃঢ়ভাবে বলল, ‘চল, আমি রেডি।’
ফ্র্যাঙ্ক দরজা ঠেলে ঢুকে জানান দিল, ‘আমরা এসে গেছি।’
অধিকর্তা ডগলাস আর আরও তিনজন ছাড়পত্র দপ্তরের কর্মকর্তা যেন ওদের পথ চেয়েই বসে ছিল। ‘এই তো’ ডগলাস বলল, ‘এসে গেছ, চিন্তা হচ্ছিল তোমরা শেষ পর্যন্ত আসবে কি না।’
লেস্টার হেরিক এর নাম নিয়ে যে মানুষটা বসে ছিল, জিলকে দেখেই হাতির দাঁত দিয়ে বাঁধানো লাঠিটায় ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল, কিন্তু কিছু বলল না। জিলের পেছন পেছন ফ্র্যাঙ্ক এল। ফ্র্যাঙ্ক পরিচয় করিয়ে দিল, ‘ইনি হলেন মিসেস হেরিক। আর জিল, ইনি ছাড়পত্র দপ্তরের অধিকর্তা ডগলাস।’
‘আমি আপনার কথা শুনেছি।’ জিল বলল ডগলাসকে।
‘তাহলে তো আপনি আমাদের কর্মপদ্ধতিটাও জেনেছেন নিশ্চয়ই।’
‘হ্যাঁ, সেটাও জানি।’
‘খুবই দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার মিসেস হেরিক। তবে এরকম আগে যে হয়নি তা নয়। ফ্র্যাঙ্ক আপনাকে কি বলেছে জানিনা তবে…’
‘ফ্র্যাঙ্ক আমাকে গোটা ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলেছে।’
‘বেশ।’ ডগলাস যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। ‘তাহলে তো ভালোই, এটা বোঝানোটা খুবই দুষ্কর। তাহলে আপনি জানেন যে আমরা কী চাইছি আপনার থেকে? আগের ঘটনাগুলি সবই বহির্মহাকাশে ঘটেছে, আমরা ভাইব্রো-রে দিয়ে তাদের নিকেশ করেছিলাম, আর তাদের নিজস্ব চেতনাবস্তুও আমরা জোগাড় করে নিয়েছিলাম। কিন্তু এবার আমাদের এখানকার আইন মেনে সব কাজ করতে হবে।’ ডগলাস একটি ভিড-টেপ রেকর্ডার নিয়ে বলল, ‘আপনার স্বাক্ষ্য কিন্তু আমাদের খুব দরকার, মিসেস হেরিক। যেহেতু চেহারায় কোনও পরিবর্তন ধরা পড়েনি, আমাদের হাতে কোনও শক্ত প্রমাণ নেই যাতে কেসটা দাঁড়ায়। একমাত্র আপনার স্বাক্ষই কোর্টে আমরা পেশ করব, যদি চরিত্র পরিবর্তনের ব্যাপারটা আপনি খোলসা করে বলেন তাহলে খুব ভালো হয়।’
এই বলে ডগলাস ভিড-টেপ রেকর্ডারটা জিলকে দিল। জিল হাত বাড়িয়ে নিল সেটা।
‘আপনার স্বাক্ষ্য কোর্ট কিছুতেই অগ্রাহ্য করতে পারবে না। কোর্ট যদি একবার আমাদের অনুমতি দিয়ে দেয়, তাহলেই আমরা পরের কাজগুলো করতে পারব। আর আপনার স্বামীকে সম্পূর্ণ আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দেব।’
জিল সেই কোট-পরা, হাতে হাতির দাঁত দিয়ে বাঁধানো লাঠি ধরে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার দিকেই তাকিয়ে ছিল। ‘আগের অবস্থা? আপনি কি বলতে চাইছেন?’
‘কেন? এই পরিবর্তনের আগের অবস্থা?’
ভিড-টেপ রেকর্ডারটাকে নামিয়ে রেখে সরাসরি ডগলাসের দিকে তাকিয়ে জিল বলল, ‘কোন পরিবর্তনের কথা বলছেন আপনি? আমি বুঝতে পারছি না।’
ডগলাসের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। ঘরের সবার নজর এখন জিলের দিকে। দুবার ঠোঁট চেটে ডগলাস বলল, ‘ওই লোকটার মধ্যে যে পরিবর্তন আপনি দেখেছেন…’
‘জিল!’ ফ্র্যাঙ্ক চেঁচিয়ে উঠল, ‘তো কী হল হঠাৎ? কী পরিবর্তনের কথা এখানে বলা হচ্ছে বুঝতে পারছিস না?’ ফ্র্যাঙ্ক জিলের কাছে চলে এসে বলল।
‘অদ্ভুত তো?’ জিল ভেবে বলল, ‘আমি তো কোন পরিবর্তন লক্ষ করিনি।’
ফ্র্যাঙ্ক আর ডগলাস একে অন্যের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। ‘কিছুই বুঝতে পারছি না’ ফ্র্যাঙ্ক বিড়বিড় করতে লাগল।
‘শুনুন মিসেস হেরিক—’ ডগলাস কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। তার আগেই জিল কোনায় বসে থাকা সেই মানুষটার কাছে এসে বলল, ‘এবার যাওয়া যাক?’ বলে মানুষটার একটা হাত জড়িয়ে নিল জিল। ‘না কি আরও কিছু নিয়মকানুন আছে?’
অন্ধকার নেমে আসছিল, একটা রাস্তা দিয়ে তারা হেঁটে আসছিল চুপ করে। জিল বলল, ‘বাড়ি ফিরব আমরা এখন, তাড়াতাড়ি হাঁটো।’
মানুষটি জিলের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বলল, ‘বেশ মনোরম বিকেল, কি বল?’ বলে একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে নির্মল বাতাস অনেকটা ফুসফুসে নিয়ে নিল। ‘বসন্তের তো আর দেরি নেই, তাই না?’
জিল মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল।
‘আমি ঠিক নিশ্চিত ছিলাম না। একটা সুন্দর গন্ধ ভেসে আসছে। মাটি, গাছপালা আর অন্যান্য জীবন্ত প্রাণীর গায়ের গন্ধের সমারোহ যেন।’
‘ঠিক ধরেছ।’
‘আমরা কি হেঁটেই বাড়ি ফিরব?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ। খুব একটা বেশি রাস্তা না।’
এবার মানুষটা জিলের দিকে তাকিয়ে আন্তরিকভাবে বলে উঠল, ‘তুমি যা করেছ আমার জন্যে তার জন্য আজীবন আমি ঋণী থেকে যাব তোমার কাছে।’
জিল আবার মাথা নাড়ল।
‘আমার তোমাকে ধন্যবাদ জানানো উচিৎ। সত্যি বলতে কি আমি কোনওরকম আশাই করিনি যে…’
জিল হঠাৎ মানুষটার দিকে ঘুরে গিয়ে সামনাসামনি দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করল, ‘তোমার নামটা কী বলত? তোমার আসল নামটা কী?’
মানুষটার ধূসর চোখে যেন একটা ঝলক খেলে গেল। মৃদু হাসল, নম্রভাবে। ‘নামটা বোধহয় তুমি উচ্চারণ করতে পারবে না। আমার নামটা কোনও শব্দ দিয়ে প্রকাশ করা যায় না…’
সারাটা রাস্তাটা জিল আর কোনও কথা না বলেই চলে এল। গভীর চিন্তায় নিমগ্ন ছিল। শহরের উঁচু উঁচু লাইট পোস্টের হলুদ আলোগুলো তাদের হঠাৎ যেন ঘিরে ধরল। যেন পেল্লায় একেকটা মোমবাতি। ‘কী এত ভাবছ জিল?’
‘আমি ভাবছি আমি তোমাকে লেস্টার নামেই ডাকব এবার থেকে,’ জিল বলল, ‘যদি আপত্তি না থাকে তোমার।’
‘না আমার কোনও সমস্যা নেই।’ মানুষটা হাত বাড়িয়ে জিলকে আরও কাছে টেনে নিল। ‘তোমার যা প্রাণ চায় তাই হবে, তুমি খুশি হলেই আমি খুশি।’
চারপাশে নেমে আসা ঘন অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে লেস্টার জিলের গা ঘেঁষে চলে যেতে লাগল, হলুদ আলো দেওয়া শহুরে মোমবাতির আলোয়ে আলোকিত পথ ধরে।
মূল গল্প: হিউম্যান ইজ
মূল লেখক: ফিলিপ কে. ডিক
ফিলিপ কে. ডিক ‘হিউম্যান ইজ’ গল্পটি লেখেন ২ ফেব্রুরারি, ১৯৫৩ সালে। ১৯৫৫ সালে স্টার্টলিং স্টোরিজ পত্রিকার শীত সংখ্যায় এটি প্রথম প্রকাশ পায়।
Tags: অনুবাদ গল্প, কল্পবিজ্ঞান, পঞ্চম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, ফিলিপ কে. ডিক, রাকেশকুমার দাস, সৌরভ ঘোষ
দারুণ লাগল। আমার খুব-খুব প্রিয় গল্প। সেটার এমন সহজ ও সাবলীল অনুবাদই প্রয়োজন ছিল।
ধন্যবাদ ঋজুবাবু। আপনার ভালো লেগেছে যেনে খুব ভালো লাগল, মনে হচ্ছে উতরে গেছে অনুবাদটা এই বারের মতো।