ডাইন
লেখক: শংকর লাল সরকার
শিল্পী: রনিন
বড়দিনের ছুটিতে কোথাও বেড়াতে যাবার প্রস্তাবটা রক্তিমের। প্রস্তাবটা পাওয়া মাত্র অদ্রিজা লুফে নিল। ঘাটশিলায় ওদের পৈত্রিক বাড়িটা এখন ফাঁকাই পড়ে থাকে। ঠিক হল, ওই বাড়িতেই দিন দুয়েক থাকা যাবে। শুক্রবার ওরা চারজন রক্তিম, জয়ন্ত, সৌমী আর অদ্রিজা রওনা দিল ঘাটশিলার উদ্দেশে।
ঘাটশিলা স্টেশনে যখন নামল তখন বিকাল। পশ্চিমদিগন্তে লাল বলের মতো সূর্য সমস্ত আকাশটাকে রাঙিয়ে দিয়েছে। চারদিকে সবুজের সমারোহ। ঝকঝকে নীল আকাশ আর দূরের সিপিয়া রঙের পাহাড়শ্রেণি কেমন এক অদ্ভুত মাদকতার সৃষ্টি করেছে।
স্টেশন থেকে একটা অটো ভাড়া করে ওরা মিনিট দশেকের মধ্যেই পৌঁছে গেল অদ্রিজাদের বাড়ি। পাঁচিল ঘেরা বেশ বড় কম্পাউণ্ড। বাইরে থেকে বাড়ির কোন চিহ্নই দেখা যায় না। কেবল বড় বড় শাল সেগুন আর শিশু গাছ। পাঁচিলের ধার দিয়ে একটা ছোট খাল এঁকে বেঁকে চলেছে। ঝরঝর শব্দে বৃষ্টির জল বয়ে চলেছে সুবর্ণরেখা নদীতে।
গেটের মুখেই দাঁড়িয়ে ছিল বনমালী। পুরুষানুক্রমে ওরা এই বাড়ির কেয়ারটেকারের কাজ করে। রোগা হাড্ডিসার চেহারা। মুখ ভরতি বলিরেখা ওর বয়স জানান দিচ্ছে। বাড়ির পরিবেশের সঙ্গে একেবারে চমৎকার মানিয়ে গেছে। এখানে সময় যেন থমকে দাঁড়িয়ে আছে।
বাইরে থেকে যতই জঙ্গলাকীর্ণ মনে হোক, গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকলে বোঝা যায় নিয়মিত পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করা হয়। ওদের আসার খবর আগে থেকেই দেওয়া ছিল। দুটো ঘরকে ঝাড়পোছ করে গুছিয়ে রেখেছে বনমালী।
পরদিন সকালেই রক্তিম আর সৌমী বেরিয়ে পড়ল ফুলডুংরি পাহাড়, বুরুডি লেক দেখবে বলে। জয়ন্তও যেতে চাইছিল, অদ্রিজা বলল, “পরে যাব, আগে বাড়িটা ভালো করে ঘুরে ফিরে দেখি। এই প্রথম এলাম।” জয়ন্ত আর অদ্রিজা রয়ে গেল বাড়িটার চারপাশ ভালো করে দেখবে বলে। সামনের দুটো ঘরে ওদের রাত্রে থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল। এরপর টানা লম্বা দালান, তার ওপাশে রান্নাঘর। দীর্ঘদিন রান্নাঘর ব্যবহার হয়নি। বনমালী কাল ওদের জন্য রান্না করে এনেছিল। আজও সেই ব্যবস্থা।
শিকল খুলে অদ্রিজা ঢুকে পড়ল রান্নাঘরের ভিতর। ওকে রান্নাঘরে ঢুকতে দেখে জয়ন্ত টিপ্পনি কাটল, “মেয়েদের সবচেয়ে আগ্রহের আর প্রিয় জায়গা হল রান্নাঘর।” জয়ন্তকে পাত্তা না দিয়ে অদ্রিজা রান্নাঘরের ভিতরটা দেখতে লাগল।
“এদিকে দেখ, আগেকার দিনে কীরকম উনুনে রান্না করত।”
“এমন করে দেখছিস যেন নালন্দার ধ্বংসাবশেষ।”
রান্নাঘরের ভিতর দিকে আর একটা ছোট ঘর। বোধহয় ভাঁড়ারঘর হিসাবে ব্যবহার করা হত। ছোট দরজা। বাইরে থেকে শিকল তোলা। বহুদিন অব্যবহারের ফলে মরচে পড়ে শক্ত হয়ে এঁটে আছে। অদ্রিজা কয়েকবার টানাটানি করে হতাশ হয়ে পড়ল। এদিক ওদিক তাকাতে জয়ন্তর চোখে পড়ল একপাশে পড়ে রয়েছে একটা বড় কয়লা-ভাঙা হাতুড়ি। হাতুড়ির কয়েকটা ঘা মারতে ঝনাৎ করে শিকলটা ভেঙে পড়ল। ভিতরটা ভ্যাপসা গুমোট অন্ধকার। দরজা খুলেই অদ্রিজা ভিতরে ঢুকে যাচ্ছিল। জয়ন্ত হাত ধরে ওকে আটকাল।
“তাড়াহুড়া করিস না। বহুদিন দরজা খোলা হয়নি। ব্যাগ থেকে আগে টর্চটা নিয়ে আসি।” ঘরের ভিতরটা ঠান্ডা, স্যাঁতসেতে। অদ্রিজা বলল, “দেখেছিস কিরকম ঠান্ডা, যেন এয়ারকণ্ডিশন্ড। খালটা তো ঘরের পাশ দিয়েই গেছে।”
“এ ঘরটা নিশ্চয়ই তোর ঠাকুমাদের ফ্রিজ ছিল।”
“দেওয়ালে একটা কুলুঙ্গী। টর্চটা একবার নিয়ে আয় তো এদিকে।”
টর্চ জ্বালিয়ে জয়ন্ত দেখল, কুলুঙ্গীতে একটা খবরের কাগজের মোড়ক। হাত দিতেই পচা থুসথুসে কাগজ খসে পড়ল। ভিতরে পোড়া চালের মতো কালো কালো রাইয়ের দানা। “অদ্রিজা, তোর ঠাকুমারা চলে যাবার পর আর কেউ এই রান্নাঘর ব্যবহার করেনি?”
“যতদূর শুনেছি ঠাকুমার মা মারা যাওয়ার পর, ঠাকুমাদের তিন ভাই বোনকে নিয়ে ঠাকুমার বাবা কলকাতায় চলে গিয়েছিলেন। তারপর থেকে এই রান্নাঘরে আর কেউ পদার্পণ করেনি।”
“তার মানে এগুলো কমপক্ষে একশো বছরের পুরোনো!”
“সেটা আশ্চর্যের কিছু নয়।”
রাইয়ের দানাগুলোর গায়ে ছাতা পড়ে কালো হয়ে আছে। জয়ন্ত আত্মগতভাবে বলল, এগুলো ক্ল্যাভিসেপ্স্ পারপিউরা না হয়ে যায় না। একটুখানি শস্যদানা কাগজে মুড়ে ও পকেটে নিল।
“কী করছিস?”
“রাইয়ের একটুখানি দানা নিলাম। ল্যাবরেটরিতে কয়েকটা টেস্ট করব।”
“কতকালের পুরোনো কালো হয়ে যাওয়া এই দানাগুলো থেকে কী পাবি?”
“বিভিন্ন ধরনের খাদ্যশস্য, বিশেষ করে রাইয়ের উপর ক্ল্যাভিসেপ্স পারপিউরা নামক একরকমের ছত্রাক জন্মায়। ছত্রাকের দেহে ক্লেরোসিয়া নামক এক রকমের অঙ্গ উদ্ভুত হয়, সেটাকেই আরগট বলে। আরগটে আছে লাইসারজিক অ্যাসিড অ্যামাইড যা এল এস ডির প্রধান উপাদান। মানুষের মস্তিস্কের উপর এর ব্যাপক ক্ষতিকর প্রভাব। আরগটের বিষক্রিয়ায় হ্যালুসিনেসানের শিকার হয় লোকে। মানুষের আচরনগত পরিবর্তনও ঘটাতে সক্ষম আরগট।”
“তুই বায়েকেমিস্ট্রির কচ্কচি বন্ধ কর তো। সুন্দর সকালটা বাজে বকবক করে নষ্ট করিস না, চল ফুলডুংরি পাহাড়ের দিক থেকে ঘুরে আসি। অদ্রিজার হাতের স্পর্শে জয়স্ত বাস্তবে ফিরে আসে।”
।। দুই ।।
ঘাটশিলা থেকে ফিরে জয়ন্তর সবুর সয় না। সুদীপ্ত ছত্রাকের উপর গবেষণা করে, ওর থেকেই জানতে হবে রাইয়ের দানার গায়ের এই ছত্রাক ক্ল্যাভিসেপ্স্ পারপিউরা কিনা। গবেষণাগারে হাজির হয়েই সামান্য একটু নমুনা নিয়ে ছুটল সুদীপ্তর কাছে। ওর মতামত নেওয়া জরুরি।
পরদিন সুদীপ্ত জয়ন্তকে ফোন করল। ওগুলো ক্ল্যাভিসেপ্স্ পারপিউরা নয় জেনে প্রথমটায় ভীষণ হতাশ হয়ে পড়েছিল।
সুদীপ্ত বলল, “এত হতাশার কিছু নেই, ছত্রাকটি শরীরগত ভাবে ক্ল্যাভিসেপ্স্ পারপিউরারই সমগোত্রীয়। প্রকৃতপক্ষে এটা একটা নতূন ছত্রাক, আগে এর সম্পর্কে কিছু জানা ছিল না।”
“তুই বলতে চাস নূতন ছত্রাক আবিস্কার করেছি!”
“তুই আবার উত্তেজিত হয়ে পড়ছিস। নতূন ছত্রাক তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু তুই কী জানিস বর্তমানে মাত্র পঞ্চাশ হাজার প্রজাতির ছত্রাকের কথা জানা আছে, কিন্তু অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন পৃথিবীতে প্রায় এক লক্ষ বিভিন্ন প্রজাতির ছত্রাকের অস্তিত্ব আছে।”
জয়ন্ত বলল, “সে তুই যাই বল না কেন যত নগন্য হোক না কেন এটা একটা নতূন আবিস্কার। তা ছাড়া ক্ল্যাভিসেপ্স্ পারপিউরার সঙ্গে যখন মিল আছে তখন এটাও নিশ্চয়ই কোন না কোন উপাক্ষার তৈরি করে। একটু অপেক্ষা কর আমি ঘণ্টা খানেকের মধ্যে তোর ওখানে যাচ্ছি।”
ফোনে বলল ঘণ্টাখানেক কিন্তু আধ ঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছে গেল সুদীপ্তর ল্যাবে। “এরই মধ্যে চলে এলি!”
জয়ন্ত এক নিশ্বাসে বলল, “তোর ল্যাবরেটরিতেই একটা ছোট পরীক্ষা করি। খল নুড়ি, ডিস্টিল ওয়াটার, উপাক্ষারের প্রেশিপিটেশান ফেলার মতো যে কোন উইক অ্যাসিড, একটা লিটার ফ্লাস্ক আর একটা মিলিলিটার পিপেট নিয়ে আয়।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছোট একচিলতে ঘরে সুদীপ্ত কাজ করে। শনিবার ওর গাইড আসেননি। ল্যাবে ঢুকেই জয়ন্ত নিজের মতো কাজ শুরু করল। রাইয়ের কয়েকটা দানা নিয়ে এসেছিল। কালো পোড়া চালের মতো দানাগুলোকে খল নুড়ির সাহায্যে ভালো করে পেষাই করল। তারপর পরিস্রুত জল দিয়ে খল নুড়ি ধুয়ে একটা কনিকাল ফ্লাস্কে নিয়ে সামান্য একটু অ্যাসিড দিয়ে নাড়তেই সাদা অধঃক্ষেপ ফ্লাস্কের নীচে জমা হল। ফিল্টার পেপার থেকে কয়েকটা সাদা কৃষ্টাল নিয়ে লিটার ফ্লাস্কে জল দিয়ে বেশ ভালো করে নাড়াল। থাকতে না পেরে সুদীপ্ত জিজ্ঞাসা করল, ‘তুই কী করতে চাইছিস বলত?’
ওর উদ্বিগ্ন মুখের দিকে তাকিয়ে জয়ন্ত হেসে ফেলে। “এই উপাক্ষার হ্যালুসিনোজেনিক কিনা পরীক্ষা করব। তুই নিশ্চয়ই জিজ্ঞাসা করবি কীভাবে। ছয় মাস ধরে বিভিন্ন পরীক্ষা করলেও কোন পদার্থর হ্যালুসিনোজেনিক ধর্ম আছে কিনা তা নিশ্চিতভাবে জানা যায় না। যতক্ষণ না মানব মস্তিস্কর উপর এর প্রভাব পরীক্ষা করা যাচ্ছে। এই মুহূর্তে নিজের সেরিব্রামটাই সবচেয়ে সহজলভ্য।”
“তুই কী পাগল? এই ধরনের বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা দারুণ বিপজ্জনক। এ জন্য তোর কিডনির ক্ষতি হতে পারে।”
“সেটা কখনও সম্ভব নয়। এখন পর্যন্ত মানুষের জানা সবচেয়ে ক্ষতিকর বিষ বটুলিনামের ক্ষতিকর মাত্রার দশ ভাগের একভাগ নিয়ে পরীক্ষা করছি। তার উপর জলে দ্রবীভূত অবস্থায়।” কথা বলতে বলতেই মিলিলিটার পিপেট ভরতি করে জয়ন্ত নিজের মুখে দ্রবণটা ঢেলে দিল। মুখ বুজে একটুক্ষণ চুপ করে স্বাদ নিতে চেষ্টা করল। সুদীপ্ত রীতিমতো আতঙ্কিত স্বরে জিজ্ঞাসা করে, “কিরকম মনে হচ্ছে?”
“তেমন কিছু নয়, স্বাদটা একটু কষা এই যা। দাঁড়া কিছু একটা যেন ঘটছে।”
উত্তেজিত সুদীপ্ত আতঙ্কিত স্বরে বলল, “কাউকে ডাকব?”
“চারদিকে রঙের বন্যা। বিভিন্ন রং অ্যামিবার মতো চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যেন ক্যালিডোস্কোপে চোখ রেখেছি। সিন্থেসাইজারের সুর কানে বাজছে।”
সুদীপ্ত বেশ ভয় পেয়ে গেল। কী করবে বুঝে উঠতে পারে না। জয়ন্ত যাই বলুক না কেন ল্যাব অ্যাসিস্টান্টকে ডাকা উচিত বলে ওর মনে হল।
সুদীপ্ত দরজার দিকে এগোতে যেতেই জয়ন্ত হাত ধরে ওকে আটকাল। হাতে আসুরিক শক্তি। সুদীপ্ত একটুও নড়তে পারে না। জয়ন্ত তখনও বিড়বিড় করে বলে চলেছে,”ওঃ গলা শুকিয়ে যাচ্ছে, বড় তৃষ্ণা। সারা শরীরে ছুঁচ ফোটানের মতো বেদনা। কেউ যেন বেত দিয়ে মারছে। মাঝে মাঝে ঘরটা দুলে দুলে উঠছে।” টেবিলের উপর রাখা মোবাইল ফোনটার দিকে সুদীপ্ত হাত বাড়াল। কিন্তু জয়ন্ত এমন ভাবে ওকে ধরে রেখেছে যে এক চুল নড়তে পারে না।
আস্তে আস্তে জয়ন্তর দেহটা শিথিল হয়ে আসে। “এখন স্বাভাবিক লাগছে। রংগুলো সব ফিকে হয়ে যাচ্ছে।” সুদীপ্ত দেখল জয়ন্তর চোখের অস্বাভাবিকতা অনেকটা কেটে গেছে। হাত ছেড়ে দিতে সুদীপ্ত যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। ধমকের সুরে বলল,”এভাবে নিজের উপর পরীক্ষা করা মোটেই তোর উচিত হয়নি। আমি রীতিমতো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। প্রায় আধঘণ্টা তুই অস্বাভাবিক অবস্থায় ছিলিস।”
“তার মানে সময় জ্ঞানও চলে গিয়েছিল! আমি ভাবছিলাম মাত্র পাঁচ মিনিট।”
রাইয়ের গায়ে উৎপন্ন ছত্রাক ক্ল্যাভিসেপ্স্ পারপিউরা না হলেও, ক্ল্যাভিসেপ্স্ গোত্রের এই ছত্রাকের ক্লেরোসিয়াতে আরগট এর মতোই উপাক্ষার আছে। উপাক্ষারে আরগটের থেকেও শক্তিশালী সাইকোথেরাপিক ড্রাগের উপাদান রয়েছে। সামান্য মাত্রার দ্রবণেও যে শক্তি তা অকল্পনীয়। জয়ন্তর মনে হল সদ্য ঘুম থেকে উঠেছে। শরীর মন দুই চাঙ্গা। নূতন এই আরগটের প্রতিক্রিয়া সুদীপ্ত স্বচক্ষে দেখেছে। জয়ন্ত উৎসাহিত হলেও ওর কেমন ভয় ভয় লাগে। সামান্য পরিমাণে উপাক্ষার গ্রহণ করার পর জয়ন্তর মধ্যে যে দানবীয় শক্তির পরিচয় পেয়েছে তা বেশ চিন্তার।
।। তিন ।।
ক-দিন ধরেই অদ্রিজার মন খারাপ। জয়ন্ত কাজ নিয়ে এতই ব্যস্ত যে দেখা সাক্ষাৎ প্রায় হচ্ছেই না। বেশির ভাগ সময়েই মোবাইল ফোন বন্ধ। ফেসবুকেও কোন আপডেট নেই। হোয়াটসআপ করলেও বেশির ভাগ সময়ে কোন উত্তর নেই। ইউনিভর্সিটির সাততলার ক্যান্টিনে জানলার ধারে একটা চেয়ারে অদ্রিজা চুপচাপ বসেছিল। ইন্দ্র, রক্তিম, মৌমিতা, সৌমী সকলেই আগের মতো এসে বসেছে। আড্ডা চলছে জোর কদমে।
“অদ্রিজা এত চুপচাপ কেন?” রক্তিমের কথার জের টেনেই পাশ থেকে মৌমিতা ফোড়ন কাটে, “কেবল জয়ন্তর কথাই ভাবছিস!”
রক্তিম বলল, “জয়ন্ত ল্যাবরেটরীতে ভীষন ব্যস্ত থাকে। আগে মাঝেমধ্যেই আমার ঘরে এসে আড্ডা দিয়ে যেত। আজকাল প্রায় আসেই না সবসময়েই দেখি কাজে ডুবে আছে। ঘাটশিলা থেকে আসার পর থেকেই যেন কেমন বদলে গেছে।”
“অদ্রিজা একটু নজর রাখিস, সুস্মিতা নামে নূতন একটা মেয়ে কিন্তু জয়ন্তর সঙ্গে ল্যাবরেটরীতে কাজ করছে।” মৌমিতার কথায় অদ্রিজা কোন প্রতিক্রিয়া দেখাল না কিন্তু একটা খচখচানি থেকেই যায়। দু-দিন পর অদ্রিজা চলে আসে জয়ন্তর ল্যাবরেটরীতে। জয়ন্ত দরজার দিকে পিছন ফিরে একমনে কাজ করছে। সুস্মিতা অদ্রিজাকে দেখতে পেয়ে ডাকে, ‘অদ্রিজাদি ভিতরে এসো’।
সুস্মিতা দুবছরের জুনিয়র। সদ্য মাস্টার্স করে ইউনিভার্সিটির ফেলোশিপে রিসার্চ করতে ঢুকেছে। ফর্সা গোলগাল পুতুল পুতুল চেহারা। খুব সুন্দরী না হলেও বেশ আকর্ষনীয় চেহারা। তার উপর সব সময় এমন সেজেগুজে থাকে যে ছেলেরা তো বটেই মেয়েরাও না তাকিয়ে পারে না। জয়ন্ত, রক্তিম দুজনের কাছেই সুস্মিতার অনেক গল্প শুনেছে, কিন্তু চাক্ষুস পরিচয় এই প্রথম। সুস্মিতাকে দেখে অদ্রিজার মেজাজটা তেতো হয়ে গেল। গল্প শোনা আর চোখে দেখার মধ্যে অনেক ফারাক। ছেলেদের মন, কিছুই বলা যায় না। ল্যাবে ঢুকেই অদ্রিজা বকবক করতে শুরু করল, “জয়ন্ত, তোর কী ব্যাপার বলত, আশ্চর্য রকমের কাজের আঠা, ল্যাব থেকে বাইরে বের হচ্ছিস না, মোবাইলটাও অফ্ করে রেখেছিস।”
“নূতন একটা সাইকোথেরাপিক ড্রাগ নিয়ে কাজ করছি। এটা আমাদের চেনা জানা আরগটের থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী। এন-এম-আর স্পেক্ট্রোস্কোপি করে গঠনবৈশিষ্ট্য সম্পর্কেও মোটামুটি একটা ধারনা করা গেছে। একটা ইলেকট্রোলাইটিক মূলক জুড়ে দিতে পারলেই কাজ শেষ। বাজারে তখন একেবারে হইহই পড়ে যাবে।
“জয়ন্ত, তুই ক্রোমাটোগ্রাফি করে বিশুদ্ধ ড্রাগ আলাদা করেছিস?” গলার স্বরে অদ্রিজা পিছন ফিরে তাকায়, “রক্তিম, তুই কখন এলি?”
“তোকে ল্যাবে ঢুকতে দেখলাম, হাতে তত কাজ নেই ভাবলাম একটু আড্ডা গিয়ে যাই।”
রক্তিমের উপস্থিতি মোটেই অদ্রিজার ভালো লাগে না। একে সুস্মিতা আর উপর আবার ও। বেশ বোঝা যায় রক্তিম এই ঘরের দিকে নজর রাখছিল। জয়ন্তর সঙ্গে যে একটু একান্তে কথা বলবে তার উপায় নেই। রক্তিমকে পেয়ে জয়ন্তও বকতে শুরু করল, “জৈব দ্রাবক দিয়ে ক্লেরোসিয়া থেকে কিছুটা উপাক্ষার সংগ্রহ করেছিলাম। তারপর ক্যাপিলারি ইলেকট্রোফোরেসিস করেছি, তিনটে উপাক্ষার মিশে আছে। কোনটা নিউরোট্রান্সমিটারের কাজ করে সেটা জানার চেষ্টা করছি।”
অদ্রিজা বলল, “এলাম একটু আড্ডা দিতে আর তুই ভারী ভারী বায়োকেমিস্ট্রীর টার্ম বলতে শুরু করলি। তা তোর ক্যাপিলারি ইলেকট্রোফোরেসিস ব্যাপারটি কী?”
জয়ন্ত হেসে বলল, “তুইতো আবার পিওর ম্যাথস ছাড়া আর কিছুই বুঝিস না। সূক্ষ ক্যাপিলারি টিউবের মধ্যে বিভিন্ন রকমের অণুর দ্রবীভূত মিশ্রণকে তড়িৎ ক্ষেত্রের মধ্যে রাখলে অণুগুলো নিজেদের গঠন, চার্জ আর ভিস্কোসিটির উপর নির্ভর করে ধীরে ধীরে পৃথক হয়ে যায়।”
রক্তিম জিজ্ঞাসা করল, “উপাক্ষারের বায়োলজিকাল টেস্ট কিছু করেছিস?”
জয়ন্ত বলল, “একদিন সামান্য একটু উপাক্ষারের দ্রবণ মুখে নিয়েছিলাম, মস্তিস্ক একেবারে চাঙ্গা হয়ে যায়, কোন ক্লান্তিবোধ থাকে না।”
“তুই কী পাগল হয়েছিস। আনবিক স্তরে ড্রাগের কার্যকারীতার কোন পরীক্ষা করলি না। বিষক্রিয়ার মাত্রা সম্পর্কে তোর কোন ধারনা নেই। এমন কী ড্রাগ হিসাবে ব্যবহার করলে শারীরিক প্রতিক্রয়া কী হতে পারে, তাও নিশ্চিত না হয়ে ওটা মুখে দেওয়া বিপজ্জনক হতে পারত।”
জয়ন্ত নিরুত্তাপ ভাবে বলল, “বিপদ যে কিছু হয়নি সে তো দেখতেই পাচ্ছিস। তা ছাড়া অত কিছু ভেবে কাজকরা মুশকিল। নিজের সেরিব্রামের উপর পরীক্ষা করেছি, ফলে শারীরিক প্রতিক্রয়া সম্পর্কে একটা সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া গেছে।”
“তবুও বলব তুই এটা ঠিক করিস নি। একটা নতুন ড্রাগ আবিস্কার করতে পারলে রাতারাতি কোটিপতি হয়ে যাবি। কিন্তু তাই বলে নিজেকেই গিনিপিগ বানানো! এরকম হটকারিতা করা মোটেই উচিত নয়।”
জোরাজুরি সত্ত্বেও সেদিন জয়ন্ত ল্যাব ছেড়ে বেরতে রাজি হল না। অদ্রিজার কেমন সন্দেহ হয় জয়ন্তর উপর। নিজের মুখেই বলল একদিন উপাক্ষার মুখে দিয়েছিল। রোজই কী চেখে দেখে? যেহেতু উপাক্ষারটার গঠন আরগটের মতো সেক্ষেত্রে এটাও অবশ্যই স্নায়ু উত্তেজক। জয়ন্তর কী নেশা হয়েছে, অজানা ওই পদার্থের? অদ্রিজা তা বছর তিনেক হল জয়ন্তর সঙ্গে মিশছে, কিন্তু ইদানিং ওর আচরনে যেন কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। সেটা কিজন্য? নেশাটা কিসের ড্রাগের না সুস্মিতার সেটা ঠিক পরিস্কার হল না। অদ্রিজা ঠিক করল সামনের রবিবার জয়ন্তর বাড়ি যাবে। রবিবার ইউনিভর্সিটি পুরোপুরি বন্ধ, কোন অজুহাতেই জয়ন্ত ওকে এড়াতে পারবে না।
।। চার ।।
রবিবার জয়ন্তর বাড়ি গিয়ে যে এমন এক বিচিত্র অভিজ্ঞতার সন্মুখীন হতে হবে তা অদ্রিজা ভাবতে পারে নি। পাড়ার একটা কুকুরের ছিন্নভিন্ন দেহ সকালেই জয়ন্তদের বাড়ির পিছনে ঝোপের মধ্যে পাওয়া গেছে। রাস্তার কুকুর হলেও ওটা জয়ন্তর বোন মঞ্জরীর পোষ্য। ওদের বাড়িতেই কুকুরটা খেত। বেশ তাগড়াই চেহারার ‘বুনো’, ছিল এলাকার পাহারাদার কুকুর। ওর জন্য উটকো কুকুর বেড়াল পাড়াতে ঢুকতেই পারত না।
বুনোর মৃতদেহটা দেখে অদ্রিজার সারা শরীরে ভয়ের শিহরণ খেলে গেল। বীভৎস শরীরটার দিকে তাকানো যায় না। কোন হিংস্র জন্তুতে গলার টুটি ছিড়ে নিয়েছে। শরীর রক্তশূন্য। একটা পা শরীর থেকে বিচ্ছিন। আক্রমণকারী জানোয়ারটা যে কী প্রচণ্ড শক্তি ধরে তা বুনোর মৃতদেহ দেখলেই বোঝা যায়। কুকুরটা টু শব্দও করতে পারেনি। জয়ন্তরা রাতে কোন আওয়াজ পায়নি। সকালে ঘুম থেকে উঠে ওরা জানতে পারে। কোন হিংস্র জন্তুর আক্রমনে বুনোর মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু কলকাতা শহরে এরকম বন্য জন্তু আসবে কোথা থেকে? তা ছাড়া ওটা লুকালই বা কোথায়? সকাল হতেই জানোয়ারটা ভোজবাজির মতো অদৃশ্য হয়ে গেছে। মনের মধ্যে একটা অস্বস্তি নিয়েই অদ্রিজা সেদিন ফিরে এল।
সপ্তাহ খানেক পরের ঘটনা। বিয়ে বাড়ির নেমন্তন্ন খেয়ে রক্তিম সেদিন একটু রাত করেই ফিরছিল। রাস্তাঘাট শুনশান। শীতটা বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে। সমস্ত শহরটাই কম্বল মুড়ি দিয়ে জানলা দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়েছে। কুয়াশার আস্তরণ ঘেরা রাস্তার টিউবগুলো টিমটিম করে জ্বলছে। আলো আঁধারির এক রহস্যময় পরিবেশ। বিরাট চওড়া রাস্তাটা বিশাল এক ময়াল সাপের মতো পড়ে আছে। দিনের বেলায় লোকের ভীড়ে এই রাস্তা দিয়ে চলা ফেরা করাই দায়, অথচ এখন কেমন জনমানবশূন্য। নিজের পায়ের শব্দ রক্তিমের অচেনা লাগে। জয়ন্তদের বাড়ির পিছনের বাগানে বুনোর মৃতদেহ দেখেছে। সেই বীভৎষ দৃশ্যের কথা কেবলই মনে পড়ে। সত্যিই যদি কোন বন্য জন্তু থেকে থাকে! এতরাতে একা পায়ে হেটে ফেরা ঠিক হয়নি। হাটার গতি বাড়িয়ে দিল রক্তিম। রাস্তার কুকুরগুলো পর্যন্ত অদৃশ্য। ঠান্ডায় কোথাও গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে। কুকুরের ডাক শুনলেও যেন কিছুটা প্রাণের আভাস পাওয়া যেত।
উলটো দিকের ফুটপথ ধরে একটা ছায়ামূর্তি এগিয়ে আসছে। রক্তিম হাটার গতি একটু কমায়। ভয়ও লাগছে কোন বদমাশ বা ছিনতাইবাজও হতে পারে। অস্বাভাবিক দ্রুত গতিতে লোকটা হাটছে। আরে ও তো জয়ন্ত!
জয়ন্ত-, এ-ই জ-য়-ন্ত!
আশ্চর্য, ও শুনতে পেল না। আর একবার জোরে চেঁচিয়ে ডাকতে জয়ন্ত ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে। কী বীভৎষ ক্রুর চোখের দৃষ্টি। রক্তিমের শিরদাঁড়ার ভিতর দিয়ে ভয়ের একটা ঠান্ডা স্রোত যেন বয়ে গেল। রাস্তার এপারে দাঁড়িয়েও স্পষ্ট দেখতে পায় সেই হিংস্র জিঘাংসাপূর্ণ দৃষ্টি। জয়ন্ত এক মুহূর্ত তাকিয়েই আবার হনহন করে চলে যায় নিজের রাস্তায়। এরকম আচরণে রক্তিম একেবারে হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে। বিশ্বাস করতে পারে না নিজের চোখকে।
পরদিন রক্তিমের জন্য আরও বড় বিস্ময় অপেক্ষা করে ছিল। ছুটির দিন হওয়ায় সে একটু বেলা অব্দি বিছানায় পড়ে ছিল। শুয়েশুয়েই শুনছে কাজের মেয়েটা মাকে বলছে বড় রাস্তার ধারে একটা ভবঘুরে পাগলী নৃসংশ ভাবে খুন হয়েছে। ঘাড় মটকে মাথা একেবারে পিছন দিকে ঘুরে গেছে। একটা হাত কেউ যেন দেহ থেকে টেনে ছিড়ে নিয়েছে। শরীরের এখান ওখান থেকে দাঁত দিয়ে মাংস ছিড়ে নেওয়ার চিহ্ন। কথাগুলো কানে যেতেই রক্তিম তড়াক করে বিছানা থেকে উঠে পড়ে। উঠতে উঠতেই শুনে মায়ের ভয়ার্ত কণ্ঠস্বর, “কাল রক্তিম অনেক রাত করে ফিরেছে। ভগবান ওকে রক্ষা করেছেন।” তাড়াতাড়ি করে একটা প্যান্ট গলিয়ে বেরিয়ে পড়ল। বড় রাস্তায় তখন পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ। লাশটা তখনও পথের ধারে পড়ে রয়েছে। একপলক দেখেই মনে হয় যেন কোন দানবের হাতে খুন হয়েছে। দানবীয় শক্তির অধিকারী খুনী হতভাগিনীকে খালি হাতেই খুন করেছে।
।। পাঁচ ।।
“সুস্মিতা কখন এসেছিস?” ল্যাবে ঢুকতে গিয়ে জয়ন্ত দেখল সুস্মিতা আগে এসে কাজ করতে শুরু করে দিয়েছে। সুস্মিতা বলল, “জয়ন্তদা তোমার কাজ এগিয়ে রাখছি।” কথাটা বলার সময়েই ও জয়ন্তর দিকে হাসিমুখে তাকাল। এক মুহূর্ত, জয়ন্তর চোখ ওর চোখে যেন আটকে গেল। সুস্মিতা এখন সেই বয়সে পৌঁছেছে যখন মেয়েরা ঠোঁটের কোনের একচিলতে হাসি আর চোখের তির্যক দৃষ্টিকে নূতন পাওয়া গহনার মতো ব্যবহার করতে শিখেছে। আকাশী নীল জিনসের সঙ্গে আজ সে একটা হলদে টপ পরে এসেছে। বেশ আকর্ষণীয় লাগছে। প্রসাধন সামান্য, কিন্তু সেটাই যেন আগুনকে আরও উস্কে দিয়েছে। সুস্মিতা আজ একটু চঞ্চল, একটু অন্যরকম। হাতদুটো কাজে ব্যস্ত ঠিকই কিন্তু মন যেন সেখানে নেই। জয়ন্ত ওর দিকে পিছন ফিরে গতকালের পরীক্ষার ফলগুলো পরপর সাজিয়ে লিখছিল। সুস্মিতা ওর হাতে হাত রাখল। হাতের স্পর্শে জয়ন্ত শিউরে উঠে। যৌনতার জ্যান্ত স্পর্শ। হাতের মাধ্যমে সুস্মিতা প্রচণ্ড তাপ ছড়িয়ে দিচ্ছে ওর শরীরে। নারী দেহের স্পর্শ এই প্রথম নয়। অদ্রিজার সঙ্গে অনেক ঘনিষ্ট মুহূর্ত কাটিয়েছে। কিন্তু এএক অন্যরকমের আহ্বান। আগুন যেমন পতঙ্গকে নিজের দিকে আকর্ষন করে তেমনি নিজেকে নিঃশেষ করে দেবার আহ্বান। এক অদ্ভুত হিসহিসে গলায় সুস্মিতা বলল, “জয়ন্তদা আমাকে তোমার ভালো লাগে না? কেবল দূরে দূরে থাক কেন!”
আকাশ থেকে পড়ে জয়ন্ত। আজ বছরখানেক হল সুস্মিতার সঙ্গে গবেষণা করছে। কিন্তু কখনও ওকে এরকম আচরণ দেখেনি। তা ছাড়া সুস্মিতা ওরই এক ক্লাসমেট, অনুপম না কি যেন নাম তার সঙ্গে ডেটিং করে। অনুপম কতদিন ল্যাবে এসেছে সুস্মিতার খোজে। অদ্রিজার সঙ্গে জয়ন্তর সম্পর্কের কথাও সুস্মিতার জানা। বেশ রাগত ভাবেই জয়ন্ত ঘুরে তাকাল। সুস্মিতার অবস্থা তখন রীতিমতো খারাপ। দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে কোনরকমে নিজের আবেগকে আটকাচ্ছে। নিশ্বাসের তালে তালে বুকটা ভয়ানক রকম উঠানামা করছে। জয়ন্ত ওর দিকে ফিরতেই দুহাতে ওকে আঁকড়ে ধরল। নিজের ঠোঁট দিয়ে ওর ঠোঁট চেপে ধরেছে। প্রচণ্ড আকর্ষণে জয়ন্তর ভিতর থেকে সবকিছু যেন নিংড়ে শুষে নিতে চায়। জয়ন্ত একচুলও নড়তে পারে না। সুস্মিতার মতো পুতুল পুতুল বার্বি ডল চেহারার মেয়ের গায়ে যে এত শক্তি থাকতে পারে তা অকল্পনীয়। ভিতরে ভিতরে শক্ত হয় জয়ন্ত। কিন্তু শারীরিক শক্তিতে পারে না সুস্মিতার সঙ্গে। দুজনে মেঝের উপর গড়িয়ে পড়ে। এবারে জয়ন্ত ভয় পেয়ে গেল। রক্তমাংসের মানুষ তো! কতক্ষণ নিজেকে সংযত রাখতে পারবে?
মোবাইলটা শব্দ করে বেজে উঠতে সুস্মিতার আলিঙ্গন মুহূর্তের জন্য শিথিল হয়। জোর করেই এবার নিজেকে মুক্ত করে জয়ন্ত। অদ্রিজার ফোন। কদিন কলকাতায় থাকবে না তাই জানাচ্ছে। অভিমানী গলার স্বর। ট্রেনের আওয়াজ শুনে জয়ন্ত বুঝতে পারে স্টেশন থেকে ফোন করছে, কিন্তু কোথায় যাচ্ছে তা বলল না।
সুস্মিতা একটানে ছিনিয়ে নেয় মোবাইলটা। জয়ন্ত আর নিজেকে সংযত রাখতে পারল না। জোরে একটা ধাক্কা মারে ওকে। হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায় সুস্মিতা। পড়েই গোঁ গোঁ শব্দ করে অজ্ঞান হয়ে যায়। সুস্মিতার অবস্থা দেখে জয়ন্ত ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। বেশ কয়েকবার চোখে মুখে জলের ঝাপটা দেওয়ার পর আস্তে আস্তে সুস্মিতা চোখ মেলে তাকাল। থেমে থেমে ক্লান্ত গলায় বলল “জয়ন্তদা কী হয়েছিল আমার?” গলার স্বর, চোখের দৃষ্টি এখন স্বাভাবিক। একটু আগের সুস্মিতার সঙ্গে কোন মিল নেই।
জয়ন্ত বলল, “কাজ করতে করতে হঠাৎ পড়ে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলি, এখন শরীর কেমন লাগছে?”
সুস্মিতা বলল, “উপাক্ষারের ইলেকট্রোফোরেসিস্ করতে ওটা তিনটে অংশে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। মাঝের বি ব্যাণ্ড হ্যালুসিনোজেনিক কিনা যাচাই করার জন্য সামান্য একটু অংশ মুখে দিয়েছিলাম। তুমি ল্যাবে আসার আগে থেকেই মাথাটা ঝিমঝিম করছিল। তারপর আর কিছু মনে নেই।”
জয়ন্ত মনে মনে ভাবল তার মানে ওটা যৌন উত্তেজক। নার্ভের উপর ক্রিয়া করে যৌন আকাক্ষাকে ভয়ানক রকমের বাড়িয়ে দেয়, শারীরিক শক্তিও পাল্লা দিয়ে বেড়ে যায়। আর এসব হয় ভোক্তার সম্পূর্ণ অজ্ঞাতে।
।। ছয় ।।
ঘাটশিলা ঘুরে যাবার পর থেকেই জয়ন্ত কেমন বদলে গেছে। তা ছাড়া রক্তিমের মুখে সেদিন রাত্রের ঘটনাটা শুনবার পর থেকেই অদ্রিজা স্থির থাকতে পারছিল না। ঘাটশিলার বাড়িটা সম্পর্কে একটা ভীতি, আতঙ্ক ওদের পরিবারের সকলের মধ্যেই আছে। সকলেই বাড়িটাকে ভীষন অপয়া বলে মনে করে। ভয় পাওয়ার কারণটা অদ্রিজার কাছে পরিস্কার নয়। কিন্তু অজানা ভয়টা মুখেমুখেই সকলের মধ্যে চারিয়ে গেছিল। প্রথম যখন ওরা ওখানে বেড়াতে যাবার পরিকল্পনা করেছিল মা ভীষন আপত্তি করেছিল। জেদের বশেই তখন তাতে আমল দেয়নি। এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও যদি আধিভৌতিক শক্তি ডাইনিবিদ্যা ইত্যাদিতে বিশ্বাস করতে হয় তাহলে এত লেখাপড়া শেখার প্রয়োজন কী?
ঘাটশিলা যাবার কথা নিয়ে কালরাত্রে আর একপ্রস্থ অশান্তি হয়ে গেল মায়ের সঙ্গে। মা একদমই আসতে দিত না যদি না ঠাকুমা ওর সমর্থনে এগিয়ে আসতেন। ওরা অনেককাল ঘাটশিলার বাড়ি ছেড়ে কলকাতায় এসে বসবাস করছে। ঠাকুমার বাবা মারা যাবার বছরখানেক পর উনি একবার ঘাটশিলার বাড়িতে গিয়েছিলেন। সেই সময়ে মায়ের বন্ধু শৈলজামাসির সঙ্গে দেখা হয়। একদিন মায়ের সঙ্গে দেখা করতে এসে শৈলজামাসি এক অদ্ভুত ঘটনার সন্মুখিন হয়েছিলেন। সে অভিজ্ঞতার কথা উনি ঠাকুমাকে শুনিয়েছিলেন।
কাল রাত্রে অদ্রিজাকে ঠাকুমা বললেন শৈলজামাসির মুখে শোনা সেই অভিজ্ঞতার কথা। শৈলজামাসি গিয়েছিলেন ঘাটশিলার বাংলো বাড়িতে। সেসময় ঠাকুমার মা, কুসুমলতাদেবী রান্নাঘরে ব্যস্ত। আটার সঙ্গে রাই মিশিয়ে রুটি বানাতে দেখে উনি খুব আশ্চর্য হয়েছিলেন, কেননা ওদের মতো স্বচ্ছল পরিবারের লোকদের রাইএর রুটি খাবার কথা ভাবা যায় না। জিজ্ঞাসা করতে মা বলেছিলেন যে আশপাশের গরীব মানুষগুলো দুবেলা পেট পুরে খেতে পায় না, যদি রাইয়ের রুটি খেতে অভ্যাস করে তবে দুবেলা অন্তত পেটপুরে খেতে পাবে। কেবলমাত্র কুসংস্কারের জন্য ওরা এরকম উৎকৃষ্ট খাদ্যগুন সম্পন্ন খাবার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ঠাকুমার মায়ের সম্পর্কে একটা গুজব অনেক দিন ধরেই কানে আসছিল শৈলজামাসির। সেদিন উনি স্বচক্ষে তার প্রমাণ পেয়েছিলেন।
ঠাকুমারা তিন ভাই বোন তখন খুব ছোট ছোট। আদিবাসীদের কয়েকজন ছেলেমেয়ে ওদের সঙ্গে খেলা করছিল। ঠাকুমার মা সকলকেই সেই রাইএর রুটি খাইয়েছিল। খাওয়াদাওয়ার পর দুই সই পাশের ঘরে গল্প করছিল এমন সময়ে ছেলে মেয়েদের ঘর থেকে একটা বীভৎস চিৎকার, হইচই এক হুলুস্থুল ব্যাপার। দুজনেই পড়িমরি করে ছুটে গিয়েছিল।
ঘরে তখন এক লণ্ডভণ্ড অবস্থা। দুটো চেয়ার উলটে পড়ে আছে। মাটির কুঁজো ভেঙে চারদিকে জল থইথই করছে। তারই মাঝে পার্বতী নামের আদিবাসী মেয়েটা মেঝেতে শুয়ে মৃগী রোগীর মতো ছটফট করছে। অন্যসব বাচ্ছারা ওকে ঘিরে দাঁড়িয়ে ভয়ে চিৎকার করছে। ওরা দেখল পার্বতী একেবারে বাহ্যজ্ঞান শূণ্য। চোখেমুখে জলের ঝাপটা দেওয়ার কিছুক্ষণ পর ফ্যালফ্যাল করে চোখ মেলে চাইল। ভয়ে বিবর্ণ। মুখ রক্তশূণ্য। সারা শরীরে নাকি অদৃশ্য কিছু কীট ঘুরে বেড়াচ্ছে আর কামড়াচ্ছে। শরীর জুড়ে তীব্র জ্বালা। উঠে বসতে যাবে এমন সময়ে নিজের গলার কাছটা খামছে ধরল। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। বীভৎস আতঙ্ক আর তীব্র যন্ত্রণা মিলেমিশে মুখটা বিকৃত হয়ে গেছে। আস্তে আস্তে পার্বতী নেতিয়ে পড়ল। আবার অজ্ঞান হয়ে গেল। ধরাধরি করে ওকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ চোখেমুখে জলের ঝাপটা দিয়ে পাখার বাতাস দেওয়ার পর পার্বতী চোখ মেলে চাইল। আশ্চর্য এতক্ষণের অসুস্থতার কথা কিন্তু ওর একদম মনে নেই।
আদিবাসীরা বিশ্বাস করে রাই ডাইনিদের খাদ্য। কুসুমলতাদেবীর নামে এরকম একটা বদনাম সেদিনের পর থেকে আরও বেশি করে ছড়িয়ে পড়েছিল। তার কিছুদিন পরই ঘটল সেই বীভৎষ ঘটনা। কুসুমলতাকে ডাইনি সন্দেহে স্থানীয় লোকেরা পুড়িয়ে মেরে ফেলল। প্রতিবেশী থেকে বন্ধুবান্ধব সকলেই, এমনকী ঠাকুমার বাবা পর্যন্ত বিশ্বাস করতেন, মা কে ডাইনিতে পেয়েছিল। না মেরে ফেললে আরও অমঙ্গল ঘটত।
মা, কুসুমলতার কথা উঠলেই ঠাকুমার চোখ ছলছল করে উঠে। অদ্রিজাকে ঠাকুমা বলেছেন যে মাকে যখন ডাকাতের মতো কয়েকজন লোক ঘর থেকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে তখন ঠাকুমার সঙ্গে তার চোখাচুখি হয়েগিয়েছিল। মায়ের সেই ভীত, আতঙ্কিত, কাতর মুখটা ঠাকুমা কোনদিন ভুলতে পারেননি। ঠাকুমা কোনদিন বিশ্বাস করেননি যে মা ডাইনি ছিল।
ট্রেনের একটানা ঝমঝম শব্দে অদ্রিজার কেমন যেন ঝিম ধরে গিয়েছিল। দুপাশের দিগন্ত বিস্তৃত ঘন সবুজ ঘানক্ষেত, ঝকঝকে রৌদ্যকরোজ্জ্বল নীল আকাশ সবকিছু থেকে ওর চোখ হারিয়ে গিয়েছিল দূরে আরও দূরে, ধূষর অতীতে।
।। সাত ।।
কুরলা এক্সপ্রেস যখন ঘাটশিলা স্টেশনে পৌছল তখন বিকাল। আকাশে ঘন কালো মেঘ। প্রকৃতি থুম মেরে আছে, এখুনি বৃষ্টি নামবে। দূরের পাহাড়টা যেন কালো মেঘের রূপ ধরে আকাশে ছেয়ে গেছে। অদ্রিজা একাই এসেছে। বনমালীকে খবর দেওয়া আছে, সব ব্যবস্থা করে রাখবে।
বাড়ির কম্পাউণ্ডে ঢুকেই অদ্রিজার মন কেন জানি এক অজানা আশঙ্কায় সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল। আগের বার সবাই যখন একসঙ্গে এসেছিল তখন কত হইচই আনন্দে চারদিক মেতে ছিল। বেড়িয়ে ফিরে যাবার পর থেকেই কিন্তু জয়ন্ত অদ্ভুত আচরণ করতে শুরু করেছে। রক্তিমের কাছ থেকে সেই ভয়ানক ঘটনাটা শোনার পর থেকেই অদ্রিজা এক অজানা উদ্বেগে ছটফট করছে। জয়ন্তর এই অস্বাভাবিক আচরনের রহস্য নিশ্চয়ই এই বাড়িতেই কোথাও লুকিয়ে আছে।
ঘরে ঢুকে পোশাক পালটে অদ্রিজা বারান্দায় চেয়ারে বসল। লম্বা ট্রেন জার্নির ধকল। বসে বসেই একটু ঝিমুনি আসছিল, “দিদিমনি, চা এনেছি” বনমালীর ডাকে তন্দ্রা কেটে গেল। হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপটা নেবার পর, বনমালীকে ইতস্তত করতে দেখে অদ্রিজা জিজ্ঞাসা করল. “কিছু বলবে?”
অদ্রিজার এই প্রশ্নটা প্রতীক্ষায় ছিল বনমালী। জিজ্ঞাসা করা মাত্র সামনের টুলটার উপর বসে পড়ল। বনমালী বলল, “দিদিমনি, আগেরবার যে দাদাবাবুরা এসেছিলেন তাদের একজন কদিন আগে একদিন হঠাৎ এখানে এসেছিলেন। দুপুরে এসে বললেন, রাতটা থেকে পরদিন সকালে চলে যাবেন। আমি সেইমতো ব্যবস্থা করছিলাম, তারপর বিকালেই কী একটা জরুরি খবর পেয়ে চলে গেলেন। আমি ভাবছি আমার তরফে কোন ত্রুটি হল কিনা।”
বনমালীর কথা শুনে অদ্রিজা আকাশ থেকে পড়ল। কে এসেছিল? ওকে না জানিয়েই বা এল কেন? হাজার প্রশ্ন ওর মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল। চেহারার বর্ণনা শুনে বোঝা গেল রক্তিম এসেছিল। কিন্তু কেন? কদিন আগেই তো ওর সঙ্গে ওর সঙ্গে দেখা হয়েছিল তখন তো কিছু বলল না!
রাত্রে বিছানায় শুয়ে অদ্রিজার কিছুতেই ঘুম আসতে চায় না। নানারকমের চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। ঘরের মধ্যে আসবাব বিশেষ নেই। বিরাট বড় পালঙ্ক যেটাতে সে এখন শুয়ে আছে আর কোনের দিকে একটা সিন্দুক। জমাট বাঁধা অন্ধকারের মধ্যে কী একটা অজানা রহস্য নিয়ে সিন্দুকটা কতকাল ধরে চুপ করে বসে আছে যেন। অদ্রিজার ঠাকুমারা এই বাড়ি ছেড়ে কলকাতায় চলে যাবার পর থেকে ওই সিন্দুক কেউ খোলেনি। কেমন যেন একটা অস্বস্তি অদ্রিজাকে চেপে ধরে। ভাবে কিছুতেই তাকাবে না তবুও বারেবারেই চোখ চলে যায় ঝুপসি অন্ধকারের মধ্যে সিন্দুকের ছায়াছায়া অবয়বটার দিকে। বিছানা থেকে উঠে জানলার ধারে আসে। বাইরে জ্যোৎস্নার আলোয় প্রকৃতি ভেসে যাচ্ছে। সামনের খালের জলে চাঁদের হাজার প্রতিবিম্ব। শাল সেগুন গাছের বৃষ্টি ধোয়া পাতাগুলি চাঁদের আলোয় রূপার পাতের মতো ঝকমক করছে। জয়ন্তর কথা খুব মনে হচ্ছে। গোয়ার্তুমি করে একা একা না এসে দুজনে এলেই ভালো হত। এখন আর ভেবে লাভ নেই। মনকে শক্ত করে। কাল সকালে উঠে আগে এই ঘরের ওই কাঠের সিন্দুকটাতে তল্লাসি চালাতে হবে।
রাতে একটা বাজে স্বপ্ন দেখে অদ্রিজার মন খারাপ হয়ে গেল। স্বপ্নে দেখল জয়ন্তর সঙ্গে ওর ব্রেকআপ হয়ে গেছে। সৌমীর সঙ্গে জয়ন্ত ডেটিং করতে শুরু করেছে। ঘুম ভাঙতে কেমন এক অদ্ভুত বিষন্নতার আঁধার অদ্রিজাকে ঘিরে ধরল। নিজেকে বোঝাতে চেষ্টা করে এসব ওর আজেবাজে চিন্তার ফল, কিন্তু মনের মধ্যে একটা খচ্খচানি থেকেই যায়।
সকাল থেকেই অদ্রিজা সিন্দুকটা খোলার চেষ্টা করতে শুরু করল। একটা বড় ভারী তালা লাগানো। বনমালীর কাছে কোন চাবি নেই। আর চাবি থাকলেও জং ধরা তালা এতদিন পর খোলা যেত না। বনমালী একটা হাতুড়ি নিয়ে এল। কয়েক ঘা মারতেই তালাটা ধটাং করে খুলে গেল। কী আছে ভিতরে? একশো বছর পর সিন্দুক খোলা হল। সিন্দুক খোলার পর কিন্তু হতাশ হতে হল। কয়েকটা পুরোনো লাল হয়ে যাওয়া খবরের কাগজ, পাঁজি, ছিড়ে যাওয়া পুরোনো পত্রপত্রিকা এরকম সব বাজে নোংরা জিনিষে ভরতি। একটা প্যাঁচানো স্ক্রুর মতো রিংতে কয়েকটা জং ধরা চাবি। না কিছুই নেই। অনেক আশা নিয়ে ঘাটশিলা এসেছিল। তবু ভালো বন্ধুরা কেউ জানে না তাহলে সকলের হাসির খোরাক হতে হত। বনমালী সিন্দুকের জিনিসগুলো ঝুড়িতে করে বাইরে নিয়ে গেছে। অদ্রিজা হতাশ হয়ে মেঝেতে বসে পড়ল। সামনে সিন্দুকের পাল্লাটা হাট করে খোলা।
সিন্দুকটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একটা জিনিস দেখে সে আশ্চর্য হয়ে গেল। সিন্দুকের ভিতরের গভীরতা বাইরের থেকে অনেকটা কম। ভিতরে কোন গুপ্ত কুঠুরি নেই তো? আগেকার দিনের সিন্দুকে এরকম গোপন কুঠুরি হামেশাই থাকত। হাত দিয়ে আওয়াজ করতে বুঝল ওর ধারনাই ঠিক, ভিতরটা ফাঁপা। কিন্তু খোলা যাবে কিভাবে? চাবি ঢোকানোর মতো একটা ছোট ছিদ্র রয়েছে বটে কিন্তু সিন্দুকের ভিতরে পাওয়া চাবির গোছাটার কোনটাই ঢুকবে না। অনেকক্ষণ টানাটানি করার পর যখন ওটা খোলার আশা প্রায় ছেড়ে দিয়েছে তখনই আইডিয়াটা এল। চাবির রিংটা প্যাঁচানো স্ক্রুর মতো। তামার রিংতে জংও ধরেনি। স্ক্রুএর মতো অংশটা চাবির ছিদ্রে ঢোকাতে গিয়ে দেখল বেশ খাপে খাপে লেগে যাচ্ছে। পুরোটা আটকে একবার জোরে চাপ দিতেই খুট করে লকটা খুলে গেল। আনন্দে উত্তেজনায় ওর তখন আর সবুর সইছে না। কী আছে ভিতরে?
লাল রঙের একটা ডায়েরি। ভিতরের পাতাগুলো লাল হয়ে একেবারে থুসথুসে হয়ে গেছে। ভাঁজ করতে গেলেই ছিড়ে যাবে। ডায়েরির প্রথম পাতাতেই নাম লেখা আছে সুরেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়, তার মানে অদ্রিজার ঠাকুমার বাবা। প্রথম কয়েকটা পাতায় বাজারের হিসাব লেখা। পাতা উলটাতে উলটাতে এক জায়গায় এসে থেমে গেল, যত পড়তে থাকে ঘৃণা আর আতঙ্কের এক মিশ্র অনুভূতি যেন ওর চেতনাকে ক্রমশ গ্রাস করতে থাকে।
হাতের লেখা জড়ানো, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কালিটাও ফ্যাকাশে হয়ে গেছে তা সত্ত্বেও পড়া যায়। “আজ যে অবস্থায় ডায়েরি লিখিতেছি তাহা বলিয়া বুঝানো যাইবে না। এমনিতে আমি নিয়মিত ডায়েরি লিখি না। কিন্তু কাল যে অভিজ্ঞতার সাক্ষী হইয়াছি তাহা লিপিবদ্ধ করিয়া রাখা প্রয়োজন। জীবনের কিছু কিছু কথা এতই গোপনীয় যে তা কারুর কাছে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। বন্ধু বান্ধবকে বলিলে বিশ্বাস করিবে না। যদি কেউ বিশ্বাস করে তবে আমাকে সে ঘৃণা করিবে। সত্যি বলিতে কী আমারও সব কেমন যেন গুলিয়ে যাইতেছে।
বিহারী আমাদের খুব পুরোনো বিশ্বাসী চাকর। অনেকদিন যাবৎ আমাদের বাড়িতে কাজ করে। কিন্তু যখন সে কুসুমের নামে বাজে কথা বলিতে লাগিল তখন উহার উপরে আমার যথেষ্ট রাগ হইয়াছিল। অসভ্য বর্বর আদিবাসীরা কুসুমকে নৃশংস ভাবে খুন করিয়াছিল, তাদের হয়ে বিহারী সাফাই গাহিতেছে। বিহারী বলিতেছিল দিদিমণি নাকি ইদানিং রাই দিয়া রুটি বানাইয়া খাইত। কয়েকজন আদিবাসী ছেলেমেয়ে বাবু, ছোট্টু আর বুড়ির সঙ্গে খেলা করিতে আসিত, তাদেরও ওই রুটি খাওয়াইত। আদিবাসীদের মধ্যে প্রচলিত সংস্কার রাই শয়তানের পূজার উপাচার, একমাত্র ডাইন ডাইনিরাই ওসব খায়। কুসুম অনেকবার বলা সত্ত্বেও উহারা কখনও রাই এর রুটি চাখিয়া দেখে নাই। কুসুম কাঁচা মাংস খাওয়ারও নাকি অভ্যাস করিয়াছিল। প্রায়ই ওর জন্য মুরগী আনিতে হইত। বাড়ির পোষা বিড়ালটারও কয়েকদিন ধরিয়া কোন হদিশ পাওয়া যাইতেছিল না। বিহারীর অনুমান কুসুমই ওর মৃত্যুর কারণ।
বিহারীর কথা শুনে রাগ দুঃখ হইলেও ওকে কিছু বলিনাই। কিন্তু এরপর বিহারী কুসুমের চরিত্রহরণ করিতে শুরু করিল। এক আদিবাসী যুবক নাকি প্রায়ই কুসুমের কাছে আসিত। এই কথা শুনিয়া আমি আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করিতে পারি নাই। বিহারীর গালে সজোরে একটা চড় বসাইয়া দিলাম। ও হাঁউমাউ করে কাঁদিয়া উঠল। এরপর সে আমাকে একটা অকাট্য প্রমাণ দেখাইল। ওটা না দেখিলেই বোধহয় ভালো হইত।
বাড়ির পিছনের বাগানের মাটি খুঁড়িয়া বিহারী একটা মৃতদেহ বাহির করিল। একজন আদিবাসী যুবকের দেহ। ঘাড়টা মটকানো। দেহের বিভিন্ন অংশের মাংস কেহ খুবলাইয়া খাইয়াছে। ভীম নামের যুবকটি নাকি কুসুমের কাছে প্রায়ই আসিত। বিহারী বলিল সে স্বচক্ষে দেখিয়াছিল কুসুম জোর করিয়া ভীমকে ভোগ করিবার পর উহাকে মারিয়া ফেলিয়াছে। দিদিমণিকে ভীমের দেহ থেকে মাংস খুবলাইয়া ছিড়িয়া লইতে দেখিয়া বিহারী ভয়ে চিৎকার করিয়া উঠিয়াছিল। কুসুম পরে টাকার লোভ দেখাইয়া দেহটিকে উহাকে দিয়াই বাগানে পুঁতাইয়া দিয়াছে। বীভৎষ মৃতদেহটা দেখিয়া বিহারীর কথার কোন প্রতিবাদ করিতে পারি নাই। কুসুম কেন এমন হইয়া গেল তার কোন সদুত্তর পাইলাম না। ভয়, বিশ্ময়, আতঙ্ক সব অনুভূতি যেন মিলিয়ামিশিয়া একাকার হইয়া গেল। তবে আর নয় ঠিক করিয়া ফেলিয়াছি ঘাটশিলার এই বাড়ি ছাড়িয়া বাবু, ছোট্টু আর বুড়িকে লইয়া কলিকাতায় চলিয়া যাইব।”
ডায়েরির লেখা এখানেই শেষ। কিছুক্ষণ হতবুদ্ধি হয়ে অদ্রিজা চুপ করে বসে রইল। এক্ষুনি কলকাতায় ফিরতে হবে। বনমালীকে বলে তাড়াতাড়ি কিছু খেয়ে সে রওনা হল স্টেশনের দিকে।
।। আট ।।
ট্রেন খড়গপুর ছেড়ে হাওড়ার দিকে রওনা হয়েছে। ট্রেনের জানলা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখতে দেখতে একঘেয়ে লাগছে। অগতির গতি মোবাইলটা নিয়ে অদ্রিজা নাড়াচাড়া করতে লাগল। সৌমী হোয়াটসআপে লিখেছে “রক্তিম বাড়িতে একা, ও যাচ্ছে ওদের বাড়ি।” বিদ্যুৎচমকের মতো একটা চিন্তা অদ্রিজার মাথায় আসতেই ও ভয়ে থরথর করে কেঁপে উঠল। সৌমী এখন কোথায়? সৌমীকে ফোন করার চেষ্টা করল অদ্রিজা। সৌমীর ফোন সুইচ্ অফ। কাউকে কিছু না জানিয়ে রক্তিম কেন ঘাটশিলায় এসেছিল? ডায়েরিটা পড়বার পর অদ্রিজা স্পষ্ট বুঝতে পারছে সেদিন রান্নাঘরের পিছনের খুপরি ভাঁড়ার ঘর থেকে যে পুরোনো রাইএর একটু অংশ জয়ন্ত সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল সেটার মধ্যেই সব রহস্য লুকিয়ে আছে। জয়ন্তর কাছে শুনেছিল পুরোনো ওই রাইএর উপর ক্ল্যাভিসেপস্ পারপিউরা নামের একধরনের ছত্রাক গজিয়েছিল। যা থেকে আরগট তৈরি হয়। আরগটের স্নায়ু উত্তেজক ক্ষমতা প্রচণ্ড। মানুষের মধ্যে দানবীয় শক্তি জাগিয়ে তুলতে পারে। যৌন উত্তজনায় হিতাহিত জ্ঞানশূন্য করে দেয়। ছত্রাকের থেকে পাওয়া উপাক্ষারের হ্যালুসিনোজেনিক ক্ষমতা আছে কিনা জয়ন্ত মুখে দিয়ে পরীক্ষা করেছে। এই ধরনের বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা পদ্ধতিকে অদ্রিজা সমর্থন করে না। কিন্তু ঠাকুমার বাবার ডায়েরিতে যেরকম লেখা আছে সেধরনের কোন পরিবর্তন ও জয়ন্তর মধ্যে লক্ষ করেনি। লাগামছাড়া যৌন উত্তেজনা যদি ওর হত তবে অদ্রিজা অবশ্যই তা টের পেত। তবে রক্তিম জয়ন্তর সম্পর্কে ওই সব বলল কেন?
অদ্রিজা ট্রেন থেকেই জয়ন্তকে ফোন করে, রক্তিম যে কাউকে কিছু না জানিয়ে ঘাটশিলার বাড়িতে এসেছিল সে কথা জানাল। অদ্রিজার সন্দেহ হচ্ছে রক্তিমও রাইএর উপর গজানো ছত্রাক নিয়ে গবেষণা করতে শুরু করেছে।
জয়ন্ত অদ্রিজাকে বলল, “ও কয়দিন যাবৎ রক্তিমের মধ্যে আচরণগত কিছু অসংগতি লক্ষ্য করেছে।” ড্রাগের প্রতিক্রিয়ায় কীরকম অবস্থা হতে পারে তার কিছু আভাস পেয়ে জয়ন্ত রীতিমতো ভয় পেয়ে গেল। অদ্রিজার কাছে যখন শুনল রক্তিমের বাবা মা আজ বাড়ি নেই আর সেই অবসরে সৌমী ওদের বাড়ি যাবে বলেছে, তখন ও বিপদের আশঙ্কা করল।
জয়ন্ত বলল, “ক্লাবের বন্ধুদের নিয়ে সে রক্তিমের বাড়ি যাচ্ছে অদ্রিজা হাওড়ায় পৌঁছেই যেন সোজা রক্তিমের বাড়ি চলে যায়।”
ঘণ্টাদুয়েক পরে অদ্রিজা রক্তিমদের বাড়ির সামনে পৌঁছে দেখল সেখানে ভীড় জমে গেছে। রক্তিম, সৌমী দুজনকেই হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। জয়ন্ত বলল, অদ্রিজা ফোন করার জন্যই সৌমী আজ প্রাণে বেঁচে গেছে। অদ্রিজার ফোন পাবার কিছুক্ষণের মধ্যেই জয়ন্তরা পাঁচ ছয় জন মিলে রক্তিমের বাড়ি চলে আসে। ডাকাডাকিতে কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে ওরা দরজা ধাক্কাতে শুরু করে। ভিতর থেকে দরজার ছিটকিনি বোধহয় ভালো করে আটকানো ছিল না। ধাক্কাধাক্কিতে দরজা খুলে যেতেই সবাই মিলে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করে। ড্রাগের যৌন উত্তেজক ক্ষমতার সম্পর্কে জয়ন্তর ধারনা ছিল। সে ভয় পাচ্ছিল ওদের আসতে দেরি হয়ে যায়নি তো। এমন সময়ে উপরের ঘর থেকে চাপা গোঙানির শব্দ পেয়ে ওরা ছুটে দুতলায় উঠে। রক্তিমের শোবার ঘরের দরজা ভেজানো। ঠেলতেই হাট হয়ে খুলে গেল। ঘরের ভিতরের ভয়ংকর দৃশ্য দেখার জন্য ওরা প্রস্তুত ছিল না। আতঙ্কে শরীর অবশ হয়ে যায়।
সৌমী বিছানায় শুয়ে ছটফট করছে, রক্তিম ওর উপর চেপে বসে দাঁত নখ দিযে ওকে ক্ষতবিক্ষত করছ। জায়গাটা রক্তে ভেসে যাচ্ছে। ওদের চেনা রক্তিম নয় কোন নরপিশাচ যেন আক্রমণ করেছে সৌমীকে। সহ্য করতে না পেরে জয়ন্ত চিৎকার করে উঠে। চিৎকার শুনে রক্তিম ঘুরে তাকায় ওদের দিকে। ওঃ! কী বীভৎষ দৃশ্য। মুখের দুপাশের কশে রক্ত লেগে রয়েছে। চোখের দৃষ্টি হিংস্র শ্বাপদের মতো। মানুষের চোখের দৃষ্টি এত ভয়ংকর হতে পারে!
এর পরের ঘটনা অতি সংক্ষিপ্ত, তিনচারজন মিলে রক্তিমকে জাপটে ধরে ফেলে। ধস্তাধস্তি করতে করতেই সে একসময়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে। সৌমীর অবস্থাও তখন শোচনীয়। দুজনকেই হাসপাতালে পাঠাতে হয়।
মাসখানেক বাদে এক বিষন্ন সন্ধ্যায় জয়ন্ত মিলেনিয়াম পার্কের একটা বেঞ্চে বসে রয়েছে। আজ ওর সঙ্গে কেউ নেই। অদ্রিজার সঙ্গে কতদিন এখানে বসে কত সুন্দর মুহূর্ত কাটিয়েছে। জয়ন্তর মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে ভীষণ এক অপরাধবোধে সে ভিতরে ভিতরে দগ্ধাচ্ছে। জয়ন্তর নিজেকে আজ যেন ডাইন বলে মনে হচ্ছে। কাজটা কী সে ঠিক করেছে। সৌমীকে ওর ভালো লাগত। কিন্তু সৌমী ছিল রক্তিমের। বহু চেষ্টা করা সত্ত্বেও সৌমীর মন জয় করতে পারেনি। অদ্রিজা ওর বন্ধু। বুঝতে পারত অদ্রিজা ওকে ভালোবাসে, ওকে সবকিছু সমর্পন করতে চায়। কিন্তু অদ্রিজাকে কখনও সেভাবে ও চায়নি। শারীরিক সম্পর্ক হয়েছে কিন্তু জীবনসঙ্গী হিসাবে অদ্রিজাকে কখনও ভাবেনি। সৌমীকে পেতে চেয়েছিল। ভীষনভাবেই চেয়েছিল। কিন্তু তাকেও পেল না। তিনতিনটে জীবন ওর জন্য নষ্ট হয়ে গেল। গতকাল সৌমী নিজের ওড়না গলায় বেঁধে আত্মহত্যা করেছে। রক্তিমকে ভালোবেসেছিল সে। ওর দেহটা ইচ্ছা করলেই রক্তিম পেতে পারত। কিন্তু ওর কাছে ওরকম অসন্মান সৌমীর সহ্য হয়নি। নিজের প্রেমিকের দ্বারা ধর্ষিত হয়ে সৌমী মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু জানে না রক্তিম নয় সবকিছুর জন্য দায়ী জয়ন্ত। সৌমীর নিস্পাপ ফুলের মতো সুন্দর মুখটা দেখে জয়ন্তর চোখে জল এসেছিল। বুঝতে পেরেছিল এভাবে মানুষের মন জয় করা যায় না, বেদনার ভারই বাড়ে এতে।
সুস্মিতার ঘটনাটার পর ড্রাগের তীব্র যৌন উত্তেজক গুণটা জয়ন্তর কাছে পরিস্কার হয়েছিল। প্রথম প্রথম জয়ন্ত একটু একটু ড্রাগ নিত। ওদের পাড়ার পরপর দুটো দুর্ঘটনার জন্য সে নিজেকেই সবচেয়ে বেশি সন্দেহ করে। এরপর বেশ কয়েকদিন ড্রাগের অ্যান্টিডোট নিয়ে ড্রাগের ঘোর সে কাটিয়ে ফেলে। কিন্তু ড্রাগের বায়োলজিকাল প্রভাব দেখার জন্য আরও গবেষনার প্রয়োজন ছিল। নিজের উপরে প্রয়োগ করলে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে ড্রাগের প্রভাব ভালোভাবে বোঝা যায় না। অন্য একজন মানুষের সেরিব্রামের প্রয়োজন ছিল ওর, যাকে খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করা যাবে। রক্তিমকে বেছে নিয়েছিল গিনিপিগ হিসাবে। তারপর থেকেই রক্তিমকে একটু একটু করে ড্রাগ আশক্ত করে ফেলে। রক্তিমের সম্পুর্ন অজ্ঞাতে ওর খাবারে সামান্য পরিমাণে ড্রাগ মিশিয়ে দিতে থাকে। রক্তিম জানতেও পারে না সে ড্রাগ আশক্ত। ড্রাগের প্রভাবে ওর আচরণের যেসব পরিবর্তন হত। স্বাভাবিক অবস্থায় তার কোন কথা মনে থাকত না। খুব ধীরে ধীরে পরিকল্পনা মাফিক জয়ন্ত রক্তিমকে ওর খেলার পুতুলে পরিণত করে। ড্রাগ আশক্ত অবস্থায় ও কোন ঘটনাকে যেরকম ভাবে ব্যাখা করত রক্তিম তাই সত্যি বলে বিশ্বাস করতে বাধ্য হত। আরও ড্রাগের প্রয়োজন হওয়ায় জয়ন্তই রক্তিমকে ঘাটশিলায় পাঠিয়েছিল, যাতে ওর উপর কেউ সন্দেহ না করে। রক্তিমের বাবামার অনুপস্থিতিতে সৌমীকে ফাঁকা বাড়িতে ডাকার পরিকল্পটাও জয়ন্তর মস্তিস্কপ্রসুত। সেদিনও সৌমী আসার কিছুক্ষণ আগে জয়ন্ত রক্তিমদের বাড়ি গিয়েছিল। রক্তিমের সম্পূর্ণ অজ্ঞাতে ওর চায়ের সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছিল উগ্র ড্রাগের কয়েকটা দানা। কিন্তু কী লাভ হল? এতকিছু করেও জয়ন্ত সৌমীকে পেল না।
নিজের ভাবনায় জয়ন্ত বুঁদ হয়েছিল। হঠাৎ একটা হইহই চিৎকারে চমকে তাকিয়ে দেখে এক মধ্যবয়সি মহিলা একটা ছোট ছেলেকে ছুড়ে গঙ্গার জলে ফেলে দিয়েছে। স্রোতের টানে ভেসে যেতে যেতে বাচ্ছাটা তখন জলের উপরে হাত তুলে আঁকড়ে ধরতে চাইছে উপরের বাতাস। অনেকেই পাড়ে দাঁড়িয়ে ভীড় করে দেখছে। ওই মহিলাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে হইচই করছে অনেকে, কিন্তু বাচ্চাটাকে বাঁচাবার চেষ্টা কেউ করছে না। মুহূর্তের মধ্যে জয়ন্তর কী হল, জলে ঝাপিয়ে পড়ল বাচ্ছাটাকে বাঁচাবার জন্য। জীবনে এমন অনেক ছোটছোট মুহূর্ত আসে যখন নিতান্ত সাধারণ মানুষও নির্ভীক সাহসিকতার পরিচয় দেয়। জয়ন্ত বাচ্ছাটাকে ঠেলে পাড়ের দিকে পাঠিয়ে দিল বটে কিন্তু নিজে আর উঠতে পারল না। নাকি উঠল না। ডাইন তার জীবন দিয়ে অন্তত একটা প্রাণকে বাঁচিয়ে দিয়ে গেল। জলের টানে ও কোথায় ভেসে গেল। বহু খোঁজাখুঁজির পরও ওর দেহ পাওয়া গেল না।
Tags: কল্পবিজ্ঞান গল্প, পঞ্চম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, বিজ্ঞানভিত্তিক গল্প, রনিন, শংকর লাল সরকার
Robin Cook এর Acceptable Risk উপন্যাস এর সাথে এই গল্পের plot এর বেশ মিল পেলাম।