দেবশিশু
লেখক: প্রদীপ কুমার দাস
শিল্পী: রনিন
সাল ২১৩৯, হিউম্যান রিপ্রোডাকশন অ্যান্ড নারচারিং সেন্টার (এইচ আর এন সি), মিরশা সিটি
“মিস্টার অ্যান্ড মিসেস টি৯ ইউ ভি, আজকে আপনাদের এই বোর্ডের সামনে কেন উপস্থিত হতে বলা হয়েছে সে সম্বন্ধে আপনারা নিশ্চয়ই অবগত আছেন। তাও প্রোটোকলের স্বার্থে আমি গোটা বিষয়টা সংক্ষেপে এই বোর্ডের সামনে তুলে ধরছি।
“মিস্টার অ্যান্ড মিসেস টি৯ ইউ ভি আপনারা দুজন পূর্ণবয়স্ক জি ই এইচ বা জেনেটিক্যালি ইঞ্জিনিয়ার্ড হিউম্যান। গত দু-বছর আপনারা রাষ্ট্র অনুমোদিত পারস্পরিক সমঝোতা সাপেক্ষে একসঙ্গে আছেন। গত সেপ্টেম্বর মাসে আপনারা এইচ আর এন সি বোর্ডের কাছে একটা আবেদন জমা করেছেন যাতে আপনারা আপনাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্মদানের ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। প্রোটোকল অনুযায়ী এই বোর্ড ছাড়পত্র দিলে আপনাদের শরীর থেকে ডিম্বাণু ও শুক্রাণু সংগ্রহ করে ল্যাবরেটরিতে পাঠানো হবে। সেখানে কৃত্রিম মাধ্যমে বিশেষজ্ঞদের পর্যবেক্ষণে আপনাদের সন্তানের জন্ম হবে। তারপর সেই সন্তান এইচ আর এন সি-র যে কোনও একটি শাখায় বিশেষজ্ঞদের তত্ত্বাবধানে প্রতিপালিত হবে। আপনারা নির্দিষ্ট সময়ের অন্তর আপনাদের সন্তানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারবেন এবং নির্দিষ্ট নিয়মাবলীর মধ্যে তাকে আপনাদের কাছে কিছুদিনের জন্য নিয়ে রাখতে পারবেন। কিন্তু আপনাদের মনে রাখতে হবে যে আপনাদের জেনেটিক স্ট্রাকচার নিয়ে বেড়ে উঠলেও এই সন্তান হবে রাষ্ট্রের সম্পত্তি। সে ভবিষ্যতে কী করবে তা নির্ধারণ করার পূর্ণ স্বাধীনতা রাষ্ট্রের হাতে থাকবে। এর অন্যথা হলে রাষ্ট্র প্রয়োজনমতো ব্যবস্থা নিতে পারবে।”
এই পর্যন্ত বলে জুনিয়ার অ্যাসিস্ট্যান্ট এস২ এম এল থামলেন। তার হাতে ধরা প্লাজমাস্ক্রিনে ফুটে ওঠা টি৯ ইউ ভি-র আবেদনপত্রে আর-একবার চোখ বুলালেন। তারপর সরাসরি তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, “কিন্তু আপনারা আপনাদের আবেদনপত্রে একটা অদ্ভুত ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। আপনারা চাইছেন প্রাকৃতিক নিয়মে— অর্থাৎ যে নিয়মে আজ থেকে বহু বছর পূর্বে আমাদের পূর্বপুরুষদের জন্ম হত সেই নিয়মে আপনাদের সন্তানের জন্ম দিতে। যদিও আপনাদের এই ইচ্ছা রাষ্ট্রের প্রচলিত নিয়মের বিরুদ্ধে, তবু মানবাধিকার রক্ষার্থে আপনাদের আজকে এই বোর্ডের সামনে ডাকা হয়েছে। এখন আপনারা আপনাদের বক্তব্য এই বোর্ডের সামনে তুলে ধরুন।”
বিশাল হলঘরটার একটি লম্বা কনফারেন্স টেবিলের অপর প্রান্তে বসে আছে দুজন তরুণ-তরুণী— যাদের পরিচয় টি৯ ইউ ভি। তাদের দুজনেরই পরনে নীল রঙের স্যুট আর প্যান্ট। বুকে লাগানো ম্যাগনেটিক স্ট্রিপে লেখা আছে তাদের সম্পূর্ণ তথ্য। যে তথ্য হাতে ধরা প্লাজমা স্ক্রিনে বোর্ডের প্রতিটি সদস্য দেখতে পাচ্ছেন। দুজনেরই চেহারা বিশেষত্বহীন— রোগাটে গড়ন, ফ্যাকাসে রং, ছোট করে কাটা চুল। চেহারার একমাত্র বৈশিষ্ট্য তাদের ঝকঝকে দুটি চোখ। যে চোখে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে প্রত্যাশার ঝলক প্রতিফলিত হচ্ছে। দুজনেই মেরুদণ্ড সোজা করে টেবিলের উপর হাত রেখে বসে আছে।
তরুণ টি৯ ইউ ভি তার মোলায়েম কিন্তু পরিষ্কার কণ্ঠে বলতে শুরু করল, “মাননীয় ডিরেক্টর স্যার এবং বোর্ডের সদস্যবৃন্দ। প্রথমেই আমরা আপনাদের ধন্যবাদ জানাই আমাদের বক্তব্য জানাবার সুযোগ দেবার জন্য। আমরা রাষ্ট্রের প্রতি সমর্পিত একনিষ্ঠ নাগরিক এবং আমৃত্যু তাই থাকব। আমরা রাষ্ট্রের দ্বারা প্রতিপালিত এবং রাষ্ট্রই আমাদের পিতা-মাতা। আমাদের মৌলিক শিক্ষায় আমরা জানি বর্তমান পৃথিবীতে মানুষের জন্ম নিয়ন্ত্রিত এবং রাষ্ট্রের ইচ্ছাধীন। আমাদের নিজেদের জন্মও সেই ভাবেই হয়েছে। যদিও আমরা যে নারী-পুরুষের জেনেটিক স্ট্রাকচার বহন করছি সেই জৈবিক পিতা-মাতা এখনও জীবিত আছেন। আমরা বছরে দু-বার তাদের সঙ্গে মিলিত হই এবং আনন্দ উদযাপন করি।” সামান্য বিরতি নিয়ে তরুণটি বলতে থাকল, “রাষ্ট্রের ইচ্ছানুসারে এবং নির্বাচনক্রমে আমরা দুজন বিগত দু-বছর যাবৎ একসঙ্গে বসবাস করছি। আমরা একে অপরের প্রতি নিবেদিত এবং আজীবন একসঙ্গে থাকার অঙ্গীকারবদ্ধ। এখন আমাদের দুজনেরই বাসনা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে জন্মদান করা। আমরা জানি রাষ্ট্র আমাদের সন্তানের জন্মদান ও প্রতিপালনের সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত। কিন্তু অতীতে মানব-মানবী যেভাবে সন্তানের জন্ম দিত এবং যৌথভাবে তাকে প্রতিপালন করত আমরা সেইভাবে আমাদের সন্তানকে জন্ম দিতে ইচ্ছুক। আমরা অবগত আছি যে রাষ্ট্র আমাদের অনুমতি না দিলে আমরা স্বেচ্ছায় সন্তান ধারণ করতে পারি না। আমরা এই বোর্ডের কাছে জানাতে চাই যে আমরা সম্পূর্ণ সজ্ঞানে এবং দায়িত্ব সহকারে আমাদের এই ইচ্ছা প্রকাশ করছি। আমাদের আশা রাষ্ট্র আমাদের এই ইচ্ছা পূরণ করার অনুমতি দেবে।”
গোটা সভাকক্ষে কিছুক্ষণের জন্য সম্পূর্ণ নীরবতা বিরাজ করল। তারপর বোর্ডের ডিরেক্টর এ১ বি টি বললেন, “আপনাদের এরকম ইচ্ছার কারণ আমরা জানতে পারি কি?”
“নিশ্চয়ই। আমাদের দুজনেরই জন্ম এই এইচ আর এন সি-তে। বলাই বাহুল্য জন্মমুহূর্ত থেকে রাষ্ট্র আমাদের একে অপরের জন্য নির্বাচন করায় আমাদের দুজনেরই আইডেন্টিফিকেশন নাম্বার এক। ষোলো বছর বয়স পর্যন্ত আমরা বেড়ে উঠেছি আলাদা আলাদা পরিবেশে। আমি ছিলাম ফেসিলিটি ৮৭ এ সি-তে এবং আমার সঙ্গী ছিল ফেসিলিটি ৯৪ বি ওয়াই-তে। ষোলো বছর বয়সে আমরা দুজনেই গ্র্যাজুয়েশন সম্পূর্ণ করি। পরবর্তী দু-বছরে আমরা পূর্বনির্ধারিত সূচি অনুযায়ী শিক্ষকতার ট্রেনিং গ্রহণ করি। আঠারো বছর বয়সে আমরা কর্মক্ষেত্রে যোগদান করি। আমি ফেসিলিটি ৫৪ এস এন এবং আমার সঙ্গী ৩৭ পি টি-তে। গত দু-বছর রাষ্ট্রের নির্দেশে আমরা একসঙ্গে বাস করছি। আমরা নিজেদের দায়িত্ববান এবং সুখী দম্পতি বলে মনে করি। আমাদের দাম্পত্য স্কোর দশে নয়। সুতরাং নিয়ম অনুযায়ী আমরা আমাদের সন্তানের জন্ম দেওয়ার কথা ভাবতে পারি। এইরূপ সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর আমরা সন্তান জন্মদান সম্বন্ধে পড়াশুনা শুরু করি। আমরা এতদিন জানতাম যে কৃত্রিম প্রজনন সন্তানের জন্ম লাভের একমাত্র উপায়। কিন্তু গত এক বছরে আমরা বিভিন্ন বইপত্র ঘেঁটে জানতে পেরেছি যে অতীতে পরীক্ষাগারে নয়, সন্তান ধারণ হত নারী-গর্ভে। পরীক্ষাগারের কৃত্রিম রাসায়নিকে নয় সেই ভ্রুণ গড়ে উঠত মাতৃ-রক্ত থেকে জীবনরস আহরণ করে। আনুমানিক দশ মাস পর সেই সন্তান ভূমিষ্ঠ হত। আমরা এও জেনেছি যে সন্তানের জন্মদান করা পিতা-মাতার কাছে এক অপার্থিব আনন্দদায়ক ঘটনা ছিল। তারপর বাবা-মায়ের স্নেহশীল ছত্রছায়ায় সেই শিশু বেড়ে উঠত। এর মাধ্যমে পিতা-মাতা ও সন্তানের মধ্যে যে দৃঢ় বন্ধন তৈরি হত তার সমতুল্য আর কিছুই হয় না। দুঃখের বিষয় সেই বন্ধন বর্তমান সময়ে অনুপস্থিত। বর্তমানে পিতা-মাতা তাদের সন্তান-সন্ততির প্রতি স্নেহপ্রবণ হলেও প্রকৃত বাৎসল্যরস অনুভবে তারা বঞ্চিত। ‘পরিবার’ বলতে যা বোঝায়, বর্তমান যুগে তা অবলুপ্ত। এমনকী আমাদের ভাই-বোনেরাও পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন এবং কদাচিৎ তাদের দেখা সাক্ষাৎ হয়। সবকিছু জেনেশুনে আমাদের মনে হয়েছে বর্তমান পদ্ধতির তুলনায় অতীতের প্রাকৃতিক নিয়ম ছিল অনেক বেশি মানবিক। তাই আমাদের ইচ্ছে আমরা অতীতের সেই অভিজ্ঞতায় ফিরে যাব।”
ডিরেক্টর এ১ বিটি কিছুক্ষণ চিবুকে হাত দিয়ে বসে ভাবলেন। তারপর বললেন, “আমরা আপনাদের আবেগ বুঝতে পারছি। কিন্তু বিগত একশো বছর ধরে এই নিয়ম চলে আসছে। এতদিন কেউ এ নিয়ে কোনও প্রশ্ন তোলেনি। কারণ এই ব্যবস্থার সুফল সবাই বুঝতে পেরেছে। আপনারা বলতে পারেন, কেন আপনাদের ক্ষেত্রে এর ব্যাতিক্রম হবে?”
“তার কারণ আমাদের সংবিধান ব্যক্তি-স্বাধীনতাকে সর্বোচ্চ আসনে স্থাপন করেছে। বর্তমান পৃথিবীতে অন্যের এবং পৃথিবীর ক্ষতি সাধন না করে মানুষ যা কিছু করতে পারে। আমরা যা চাইছি তাতে কারও কোনও ক্ষতি হবে না, বরং আমরা নতুনভাবে মনুষ্যত্বকে চিনতে পারব। এতে রাষ্ট্রের কোনও আপত্তির কারণ থাকতে পারে না।”
ডিরেক্টর এ১ বি টি তৎক্ষণাৎ কোনও কথা খুঁজে পেলেন না। তাকে চুপ করে থাকতে দেখে বোর্ডের মেডিক্যাল বিভাগের প্রধান এম৪ ওয়াই সি সেই মুহূর্তে আলোচনায় অংশগ্রহণ করলেন, “আপনারা কি অবগত আছেন যে প্রাকৃতিক নিয়মে সন্তানের জন্ম দেওয়া একটা চান্স ইনসিডেন্স? আপনারা চাইলেই যে প্রাকৃতিক নিয়মে আপনাদের সন্তান ধারণ হবে তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। আপনারা হয়তো জানেন না গত শতকে আমাদের পূর্বপুরুষদের কৃতকর্ম স্বরূপ মানুষ একসময় তার স্বাভাবিক প্রজনন ক্ষমতা হারাতে বসেছিল। পৃথিবীর জনসংখ্যা বিপজ্জনকভাবে কমতে শুরু করেছিল। সেই সময় বিভিন্ন রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা সম্মিলিতভাবে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে মনুষ্য প্রজাতিকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে পরীক্ষাগারে কৃত্রিমভাবে জন্মদানের ব্যবস্থা করতে হবে। আমাদের বৈজ্ঞানিকেরা তার আগেই কৃত্রিম গর্ভধারণ ও সন্তান উৎপাদনের নির্দিষ্ট এবং অব্যর্থ উপায় খুঁজে বের করেছিল। আগে যে ইন-ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন অ্যান্ড এমব্রায়ো ট্রান্সফার করা হত তাতে কোনও মানবীর জরায়ুতে সন্তান ধারণের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু এই শতকে কৃত্রিম গর্ভ আবিষ্কারের পর সে প্রয়োজন ফুরিয়েছে। এখন সন্তানের জন্ম দেওয়া আর প্রকৃতির ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল নয়। আমরা মানুষেরা তাকে ইচ্ছামতো নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। এই একশো বছরে এই ব্যবস্থার সুফল গোটা পৃথিবী পেয়েছে। পৃথিবীর জনসংখ্যা এখন স্থিতিশীল এবং পৃথিবীর সার্বিক উৎপাদনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এর ফলে যেমন প্রতিটি মানুষ সমান অধিকার লাভ করেছে তেমনি খাদ্য বা বাসস্থানের জন্য নিজেদের মধ্যে হানাহানি বন্ধ হয়েছে। এমতাবস্থায় আপনাদের এই ইচ্ছা প্রকাশ অনৈতিক এবং অবাস্তব বলে আমি মনে করি।”
এম৪ ওয়াই সি-র শেষ মন্তব্য সকলের কানেই রুঢ় বলে মনে হল। ডেপুটি ডিরেক্টর এ২ এন এস বললেন, “আসলে মেডিক্যাল ডিরেক্টর স্যার যা বলতে চাইছেন তা হল, কৃত্রিম প্রজননের ফলে আমরা মনুষ্যসমাজকে এক উন্নততর ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাচ্ছি। আপনারা নিজেরা জেনেটিক্যালি ইঞ্জিনিয়ার্ড। আপনাদের আইডেন্টিফিকেশন নাম্বার দেখে বোঝা যাচ্ছে যে আপনারা শিক্ষক। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর সুফল আপনারা নিশ্চয়ই পেয়েছেন। আপনাদের কি কোনও গুরুতর অসুস্থতা রয়েছে?”
“না।” টি৯ ইউ ভি মাথা নাড়ল।
“বর্তমান যুগে বেশির ভাগ মানুষেরই কোনও গুরুতর অসুস্থতা নেই। তার কারণ সমস্ত জেনেটিক্যালি ইঞ্জিনিয়ার্ড মানুষেরই ভ্রুণ অবস্থায় আমরা তাদের সম্ভাব্য সকল রোগ সৃষ্টিকারী জিনকে সরিয়ে দিতে পেরেছি। আজকের পৃথিবীতে ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন এইসব ক্রনিক ডিজিজের কোনও সম্ভাবনা নেই। বেশির ভাগ জিন-ঘটিত রোগকে আমরা পূর্বেই নির্মূল করেছি। ক্যান্সারকেও আমরা বহুলাংশে বশীভূত করতে পেরেছি। শুধু তা-ই নয়, টেলোমারেজ এনজাইমের পরিবর্তন করে আমরা মানুষের জীবনকাল প্রলম্বিত করতে সক্ষম হয়েছি। আজকে সাধারণ মানুষ হেসে খেলে একশো বছরের বেশি জীবিত থাকে। এ সবই সম্ভব হয়েছে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে। আপনারা যদি প্রাকৃতিক নিয়মে সন্তানের জন্ম দিতে চান সে ক্ষেত্রে আপনাদের সন্তান নানা অসুবিধা নিয়ে ভূমিষ্ঠ হতে পারে। পিতা-মাতা হিসেবে আপনারা নিশ্চয়ই তা চাইবেন না?”
ডেপুটি ডিরেক্টর টি৯ ইউ ভি-কে ভালো করে দেখলেন। ছেলে-মেয়ে দুটি অত্যন্ত শান্তভাবে বসে রয়েছে। তিনি জানেন তাদের আই কিউ একশোর উপরে। তাই তার কথা যে তারা বুঝতে পারছে এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তবু তাদের মনোভাব বোঝার জন্য তিনি কিছুটা সময় নিলেন। তথাপি টি৯ ইউ ভি চুপচাপ আছে দেখে তিনি আবার বলতে শুরু করলেন, “আপনারা নিশ্চয় জানেন আজকের সমাজে দু-ধরনের মানুষ বাস করে— অর্ডিনারি বা সাধারণ এবং স্পেশাল বা বিশেষ গুণসম্পন্ন। আপনারা যদি সাধারণ মানুষ হতেন তা হলে আপনাদের আবেদন আমরা প্রথমেই খারিজ করে দিতাম। কিন্তু আপনারা টি সিরিজের জি ই এইচ। তাই আপনাদের আবেদনের প্রেক্ষিতে এই শুনানির আয়োজন করা হয়েছে। আপনাদের কাছে অনুরোধ আপনারা আপনাদের আবেদন ফিরিয়ে নিয়ে প্রচলিত এবং প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতিতে সন্তানের জন্ম দিন।” এই বলে এ২ এনএস থামলেন।
ঘরের প্রত্যেকের চোখ টি৯ ইউ ভি দুজনের উপর স্থিত হয়ে আছে। একটা চাপা টেনশনের স্রোত প্রতিটি মানুষের মধ্যে খেলে যাচ্ছে। ডিরেক্টর, ডেপুটি ডিরেক্টর, মেডিক্যাল ডিরেক্টর, জুনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট সবাই অপেক্ষা করছেন টি৯ ইউ ভি কী বলে তা শোনার জন্য।
মিসেস টি৯ ইউ ভি এবার মুখ খুললেন। তার কণ্ঠস্বর সুললিত এবং মৃদু। “মাননীয় ডিরেক্টর স্যার এবং বোর্ডের সদস্যবৃন্দ। আমাদের আবেদন শুনানির জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনারা যা বললেন একজন শিক্ষিত নাগরিক হিসেবে তার সবটাই আমাদের জানা আছে। আপনাদের প্রতিটি বক্তব্যই সঠিক এবং আমরা তার সঙ্গে সহমত পোষণ করি। কিন্তু বর্তমান পৃথিবীতে যেমন অ্যাডমিনিস্ট্রেটর বা এ, মেডিক্যাল বা এম, টিচার বা টি ইত্যাদি সিরিজ রয়েছে তেমনি রাইটার বা ডাবলু, পেন্টার বা পিসিরিজও রয়েছে। যদিও সাহিত্য রচনা বা ছবি আঁকা মনুষ্য প্রজাতির জীবনধারণের জন্য অপরিহার্য নয়। এর থেকে প্রমাণিত হয় আমরা শুধুমাত্র কার্যোপযোগী রোবট নই। শুধু খেয়ে-পড়ে বেঁচে থাকা মনুষ্য জীবনের উদ্দেশ্য হতে পারে না। সে ক্ষেত্রে মানুষ এবং পশুর মধ্যে কোনও ফারাক থাকে না। মানুষের শারীরিক এবং মানসিক দুই বিকাশেরই প্রয়োজন আছে। মানবিকতাকে আমরা কখনওই ভুলে যেতে পারি না। আমি এবং আমার সঙ্গী সেই মানবিকতাকে ফিরে পেতে চাইছি। তা ছাড়া জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ফলে যেমন পছন্দসই মানুষ তৈরি করা সম্ভব, কিন্তু তার ফলে স্বাভাবিক প্রাকৃতিক মিউটেশনের মাধ্যমে অর্জিত জীব-বৈচিত্র্য থেকে আমরা বঞ্চিত হচ্ছি। আমরা অসংখ্য বুদ্ধিমান বৈজ্ঞানিক বা শক্তিশালী শ্রমিকের জন্ম দিতে পারছি, কিন্তু বিগত একশো বছরে আর-একজন আইনস্টাইন বা রবীন্দ্রনাথের জন্ম আমরা দিতে পারিনি। বিগত একশো বছর কোনও নারী গর্ভযন্ত্রণা অনুভব করেনি, এই পৃথিবী কোনও নবজাতকের ক্রন্দনধ্বনি শোনেনি। আমরা ভুলে গেছি কীভাবে একজন শিশুর দায়িত্ব নিতে হয়। অতীতে সন্তান শুধুই পিতা-মাতার জেনেটিক স্ট্রাকচার বহন করত না, সন্তানের মধ্যে বাবা-মা তাদের নিজস্ব গুণাবলীও বপন করার চেষ্টা করতেন। ইতিহাস ঘেঁটে আমাদের মনে হয়েছে যে সেই অভিজ্ঞতা থেকে মনুষ্য সমাজ আজ পুরোপুরি বঞ্চিত। তাই আমরা চাই স্বাভাবিক পদ্ধতিতে আমাদের সন্তানের জন্ম হোক।”
ডেপুটি ডিরেক্টর একটু ব্যঙ্গাত্মক হাসি হেসে বললেন, “আপনারা বলছেন আপনারা ইতিহাস পড়েছেন! সেই ইতিহাসে কি লেখা আছে যে মায়ের গর্ভের সন্তান বড় হয়ে বাবা-মাকে দেখত না, ভাইয়ে-ভাইয়ে ঝগড়া-ঝঞ্ঝাট নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার ছিল? আপনি পারিবারিক বন্ধনের জয়গান করছেন। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি বিগত শতকে পারিবারিক বন্ধন খুবই শিথিল হয়ে গিয়েছিল। বাবা-মা সন্তান-সন্ততি সবাই আলাদা আলাদা থাকতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল। তা-ই যদি হয় তাহলে এই কৃত্রিম ব্যবস্থাতে আপত্তি কোথায়? বিশেষত যেখানে রাষ্ট্র আপনার সন্তানের নিরাপদে ভূমিষ্ঠ হওয়া ও বেড়ে ওঠার নিশ্চয়তা দিচ্ছে? ঠিক আছে… আমরা আপনাদের একটা প্রস্তাব দিচ্ছি। আপনারা ঠিক করুন আপনাদের সন্তানকে আপনারা কী বানাতে চান— বৈজ্ঞানিক, খেলোয়াড়, শিল্পী নাকি অন্য কিছু। আপনারা যা চাইবেন আমরা চেষ্টা করব আপনাদের সন্তানের জেনেটিক গঠন সেইভাবে তৈরি করার। বুঝতেই পারছেন সবার ক্ষেত্রে এই সুযোগ দেওয়া হয় না। কিন্তু আপনারা বুদ্ধিমান এবং রাষ্ট্রের অনুগত নাগরিক— তাই আপনাদের আমরা এই সুযোগ দিচ্ছি।”
কিন্তু এই প্রস্তাবেও টি৯ ইউ ভি দুজন সম্মত হল না। বরং তাদের মধ্যে এই প্রথম একটু অস্থিরতা দেখা গেল। তারা বুঝতে পারছিল এই বোর্ড তাদের ইচ্ছার সম্মতি দেবে না। তরুণটি খানিক মরিয়া হয়ে বলল, “আপনাদের প্রস্তাবের জন্য ধন্যবাদ। কিন্তু আমরা তা চাই না। আমরা যন্ত্রমানব হয়ে থাকতে চাই না।”
ডিরেক্টর এ১ বি টি মাথা নাড়লেন। এই দম্পতির মতো মাঝে-মধ্যে কিছু মানুষ একই অনুরোধ নিয়ে তাদের কাছে আসে। বর্তমান পৃথিবীতে যেহেতু মানবাধিকার কমিশন খুবই সক্রিয় তাই তাদের প্রত্যেকের আবেদনের শুনানি করতে হয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত তারা প্রত্যেককেই নিরস্ত করতে পেরেছেন। কিন্তু এই দম্পতি ব্যতিক্রম। অন্তত সন্তানের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের সুযোগ কেউই ছাড়তে চায় না। কিন্তু এরা তাতেও রাজি নয়। সুতরাং তাকে এবার কঠোর হতেই হবে। তিনি বললেন, “আপনাদের ইচ্ছা পূরণের জন্য একটা প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতিকে আমরা বাদ দিতে পারি না। অনেক ভাবনা-চিন্তা পরীক্ষানিরীক্ষার পর মনুষ্য প্রজাতির মঙ্গলের স্বার্থেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সেই পদ্ধতির কোনওরকম অন্যথা হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি যে এই বোর্ড আপনাদের আবেদন খারিজ করল। তার সঙ্গে আপনাদের এই আশ্বাসও দেওয়া হচ্ছে যে আপনারা চাইলে প্রচলিত পদ্ধতিতে সন্তানের জন্ম দিতে পারেন। এইচ আর এন সি আপনাদের সম্পূর্ণ সহায়তা করবে।”
তরুণটি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। তারপর হাত জোড় করে বলল, “দয়া করে আমাদের কথা শুনুন। আমরা আপনাদের নিশ্চয়তা দিচ্ছি যে আমাদের সন্তানের যাবতীয় দায়িত্ব হবে আমাদের। ভবিষ্যতে তার কোনও সমস্যা হলে সে জন্য আমরা রাষ্ট্রকে দায়ী করব না। আপনারা খালি আমাদের আশ্বাস দিন যাতে স্বাভাবিক পদ্ধতিতে সন্তান ধারণ ও প্রসব করার জন্য যে মেডিক্যাল সাহায্য দরকার তা আপনারা আমাদের দেবেন।”
মেডিক্যাল ডিরেক্টর এম৪ ওয়াই সি এই তরুণ-তরুণীর আকুতিতে বোধহয় মজা পাচ্ছিলেন। তিনি হেসে বললেন, “আপনারা কি ইতিমধ্যে প্রাকৃতিক গর্ভধারণের চেষ্টা করেছেন?”
টি৯ ইউ ভি দুজন চুপ করে রইল। তাদের নীরবতাই বুঝিয়ে দিচ্ছিল মেডিক্যাল ডিরেক্টর ঠিক অনুমান করেছেন।
“আপনাদের নীরবতাকে সম্মতির লক্ষণ বলে ধরে নিচ্ছি।” এম৪ ওয়াই সি বললেন, “সে ক্ষেত্রে আপনারা এটাও নিশ্চয়ই বুঝেছেন যে আপনারা কোনওদিনই তাতে কৃতকার্য হতে পারবেন না। তার কারণ কী জানেন? অফ দ্য রেকর্ড বলছি, তার কারণ আপনারা দুজনে পূর্ণবয়স্ক হওয়ার পূর্বে একটা ছোট্ট অপারেশনের মাধ্যমে আপনাদের দুজনকেই বন্ধ্যা করে দেওয়া হয়েছে। আপনারা নিশ্চয়ই আপনাদের বারো বছর বয়সে অ্যাপেন্ডিক্স অপারেশনের কথা ভুলে যাননি!” এম৪ ওয়াইসির মুখে চতুরতাপূর্ণ হাসি খেলে গেল।
টি৯ ইউ ভি-দের মনে পড়ল সত্যিই তাদের দুজনেরই অ্যাপেন্ডিক্স অপারেশন হয়ে গেছে। তাহলে কী সেটাও পূর্ব নির্ধারিত ছিল? এবং সেটা ছিল আসলে তাদের বন্ধ্যা করার অপারেশন?
মিসেস টি৯ ইউ ভি হতাশভাবে জিজ্ঞেস করল, “সেটা সংশোধনের কি আর কোনও উপায় নেই? কোনওভাবেই কি আমরা আবার পূর্বাবস্থায় ফিরে যেতে পারি না?”
এম৪ ওয়াই সি একবার ডিরেক্টর এবং ডেপুটি ডিরেক্টরের মুখের দিকে তাকিয়ে নিলেন। তারপর হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বললেন, “সত্যের খাতিরে বলতে হলে বলতে হয় যে আমরা তা পারি। আপনাদের বন্ধ্যাত্ব সারিয়ে দেওয়ার প্রযুক্তি আমাদের আছে। কিন্তু সেই প্রযুক্তি নিষিদ্ধ এবং আমরা কোনওদিনই তার প্রয়োগ করব না।”
“কিন্তু যদি প্রকৃতি নিজে সেই উপায় করে নেয়?” হঠাৎ তরুণীটির কণ্ঠস্বরে একটা অদ্ভুত দৃঢ়তা ও আত্মবিশ্বাসের ছোঁয়া শোনা গেল।
বোর্ডের প্রতিটি সদস্যই তাদের চেয়ার ছেড়ে সামনে ঝুঁকে এলেন। হঠাৎই তাদের চোখেমুখে একটা চাঞ্চল্যের ভাব দেখা গেল। ডিরেক্টর এ১ বি টি ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি ঠিক কী বলতে চাইছেন?”
এই প্রথম তরুণ-তরুণী দুজনের মুখে হাসির আভা দেখা গেল। তরুণীটি বলল, “বৈজ্ঞানিকদের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই আপনাদের জিজ্ঞেস করতে চাই প্রকৃতিকে মানুষ কি পুরোপুরি জয় করতে পেরেছে? নাকি তার সব রহস্যের সমাধান মানুষ করতে পেরেছে? আজকেও আমরা ভূমিকম্প, অতিবৃষ্টি এইসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্বাভাস দিতে সক্ষম হলেও সেগুলোকে প্রতিরোধ করতে পারিনি। আজকেও আমরা সমস্ত ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসকে নির্মূল করতে পারিনি। অভিযোজনের মাধ্যমে তারা নতুন নতুন রূপে আমাদের সামনে উপস্থিত হচ্ছে এবং চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে। আজকের পৃথিবীতেও মানুষ কোনও অজ্ঞাত ব্যাখ্যাতীত শক্তিকে, পূর্বে দেবদেবীরূপে যাদের পুজো করা হত মান্য করে। আজও পৃথিবীতে অঘটন ঘটে। তাই নয় কি স্যার?”
“হেঁয়ালি ছেড়ে আপনি কী বলতে চাইছেন তা স্পষ্ট করে বলুন।” ডিরেক্টরের গলায় অসহিষ্ণুতার ছোঁয়া।
“আপনার ধৈর্যচ্যুতি ঘটে থাকলে আমাকে ক্ষমা করবেন স্যার। আমরা রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত নাগরিক। রাষ্ট্রদ্রোহী কোনও কাজ আমরা করব না। কিন্তু আমরা নিশ্চয়ই সংবিধান প্রদত্ত ক্ষমতা অনুযায়ী আমাদের যে-কোনও শারীরিক সমস্যায় রাষ্ট্রের পূর্ণ সহযোগিতা পাব?”
ডিরেক্টরের কণ্ঠে সংশয়ের ছোঁয়া, “নিশ্চয়ই! কিন্তু আপনাদের সমস্যাটা কী, সেটা তো বলবেন।”
“না স্যার। আমাদের কোনও সমস্যা নেই। আপনাদের অমূল্য সময় নষ্ট করার জন্য আমরা ক্ষমাপ্রার্থী। আমরা এবার বিদায় নেব। শুধু এটুকু বলে যাব ভবিষ্যতে আমাদের যে-কোনও শারীরিক সমস্যায় আপনারা আমাদের সাহায্য করবেন এটাই রাষ্ট্রের নির্দেশ। ধন্যবাদ।”
এই বলে টি৯ ইউ ভি দুজন চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। সামনে ঝুঁকে বোর্ডের সদস্যদের অভিবাদন করে তারা একে অপরের হাত ধরে বন্ধ দরজার দিকে এগিয়ে গেল। বোর্ডের সদস্যরা অবাক হয়ে লক্ষ করলেন তাদের পাণ্ডুর মুখে হঠাৎ কোথা থেকে একরাশ উজ্জ্বলতা এসে হাজির হয়েছে। তারা আর চিন্তিত বা অস্থির নয়, তাদের পদক্ষেপে ধীরতা এবং বিশ্বাস। বোর্ডের সদস্যরা ভেবে পেলেন না, তবে কি প্রকৃতি নিজের নিয়মে মানুষের তৈরি বাধা অতিক্রম করে তরুণীটির মধ্যে নতুন প্রাণের সঞ্চার করেছে?
Tags: কল্পবিজ্ঞান গল্প, পঞ্চম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, প্রদীপ কুমার দাস, রনিন