কল্পাণু গল্প
লেখক: কল্পবিশ্ব ইভেন্ট
শিল্পী: সৌরভ ঘোষ
টেলিফোন
পার্থ দে
ঋতার বায়োপসি রিপোর্টটার অপেক্ষায় ওয়েটিং জোনে বসে আছি। সাতটা বাজতে পাঁচ। কাউন্টারে বসা মেয়েটা বলেছে, “ঠিক সাতটায় আসুন, স্যার। আমি দিয়ে দেব।”
ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছি ঘন ঘন। এসি-তে বসেও শার্টের তলায় দরদর করে ঘামছি। ভাবছি, ফোনটা আসবে কি? আর তো পাঁচ মিনিট… না না… আমার ডিজিটাল ঘড়ি বলছে চার মিনিট ছত্রিশ সেকেন্ড! আসবে তো ফোনটা?
আজ পর্যন্ত কোনোদিন এর ব্যত্যয় হয়নি। প্রতিবার ফোনটা এসেছে। বাবার সময় এসেছিল, মায়ের সময়ও এসেছিল। তার আগেও কয়েকবার এসেছিল। বছর পঁচিশেক আগে প্রথম যখন এসেছিল তখন আমাদের বসার ঘরের পুরোনো ল্যান্ডফোনটা বেজে উঠেছিল। দু-বার বাবা ধরে বলেছিল, “ব্ল্যাঙ্ক কল, কেউ বোধহয় বাঁদরামি করছে রে, রনো।” তৃতীয়বার যখন আমি গিয়ে ধরেছিলাম তখন কিন্তু সে কথা বলেছিল। সেদিন বুঝেছিলাম কলার শুধু আমার সঙ্গেই কথা বলতে চায়। বিয়ের পরে ঋতাও দু-বার ভুল করে মোবাইলে আসা কলটা ধরেছিল, কিন্তু ওপাশ থেকে জবাব আসেনি। সেই নিয়ে আমাকে সন্দেহ, মন কষাকষিও করেছিল।
ফোনটা বাজল। ঠিক সাতটা বাজতে তেইশ সেকেন্ড আগে। ফোনটা ধরে বললাম, “হ্যালো।”
ওপাশের গলাটা যেন ঈষৎ কাঁপছে। মায়ের সময় এমন হয়েছিল, বাবার সময় ওর গলা কাঁপেনি।
“হ্যালো রনো, ঋতার ক্যান্সার, স্টেজ ফোর, ওকে বোধহয় আর বাঁচাতে পারলাম না,” ওপাশের গলাটা কান্নায় বুঁজে এল।
আমার বুকের কাছে একটা খুশির বুদ্বুদ, কিন্তু ওকে তো আর বলা যায় না— “থ্যাঙ্কিউ রনো!”
ফোনটা কেটে একটা স্বস্তির শ্বাস ফেলে এগিয়ে গেলাম রিপোর্ট কাউন্টারের দিকে।
জীব
রুশদী শামস
মহাবিশ্বের মহাবিস্ময়!’ অনেকটা স্বগতোক্তি করল তরুণ বিজ্ঞানী। ইঙ্গিত তার সামনে কাচের একটা পাত্রে রাখা অর্ধস্বচ্ছ তরলটার দিকে। প্রতিপ্রভ হবার কারণে তরলটা রকেটের গবেষণাগারের অতিবেগুনি আলোয় ফসফরাসের মতো জ্বলজ্বল করছে।
তরলটা বলে একটা জীব! ব্যাপারটাকে সে সহজে মেনে নিতে পারছে না। একটা জৈবিক প্রাণ কীভাবে একই সঙ্গে উদ্ভিদ এবং প্রাণী হতে পারে? অথচ কোটি বছরে বহুবিবর্তিত এই জীবটার কোষে যে প্লাজমা মেমব্রেন আর সেন্ট্রোজোম দুটোরই দেখা পেয়েছে সে!
রুটিন পরীক্ষাগুলো সব করা শেষ। জীবটাকে নিয়ে আরও অনেক পরীক্ষা চালানো দরকার। কিছুক্ষণের ভেতরে তাই রকেটটাকে নিয়ে নিজের গ্রহের দিকে একটা হাইপারড্রাইভ দেবে বিজ্ঞানী। কনট্রোল ডেকের দিকে রওনা দেবার আগে হঠাৎ কী মনে করে থেমে গেল সে। কাচপাত্রটার মুখ আটকে ভেতরে কয়েক সিএফটি ক্রিনিলিন গ্যাস প্রবেশ করিয়ে দিল। বলা যায় না! হাইপারড্রাইভের সময়টুকুতে যদি উভলিঙ্গ জীবটার আবার বংশবিস্তারের ইচ্ছা জাগে? ক্রিনিলিন সে ইচ্ছাটাকে দমিয়ে রাখতে পারবে বলে আশা করা যায়।
রকেটের আয়ন ইঞ্জিনগুলো চালুর শব্দ শুনতে পেয়ে তরল জীবটা সামান্য নড়ে ওঠে।
‘আমি যেতে চাই না, ক্রান্তো,’ বিষাদময় গলায় নিজের প্রতিস্বত্ত্বাকে যোগাযোগ তরঙ্গ পাঠাল ক্রান্তো। ‘আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।’
তরঙ্গটা পেয়ে ক্রান্তো কী বলবে বুঝতে পারে না। গবেষণাগারের গোল জানালা দিয়ে তাদের ফেলে আসা ধূসর-মলিন-বিবর্ণ-কুৎসিত গ্রহটিকে দেখে তার নিজেরও যে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে!
পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে মানুষের তো কষ্ট হবেই!
বন্ধুত্বের ভাইরাস
অতনু কুমার
আমার বানানো ভাইরাসটা একটা নতুন প্রজাতির ওপর প্রয়োগ করলাম৷ আগে সত্তরটা প্রজাতির দেহে তাড়াতাড়ি ইমিউনিটি গজিয়ে গেছিল৷ আমার ভাইরাসের কার্যকারিতা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছবে যদি এরা অন্তত হাজারটা প্রজন্মের আগে ইমিউনিটি অর্জন করতে না পারে।”
হইচইয়ের শব্দ পেয়ে ইয়ো তার মস্তিস্কে লাগানো ডায়েরির চিপটার সঙ্গে মনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করল৷ মানুষের দলটা শিকার করে ফিরেছে৷ সঙ্গে একটা বাইসনের মৃতদেহ৷ এবার ওটাকে গাছে ঝুলিয়ে নাচগান করবে, তারপর ভাগ করে খাবে৷ সবার গায়ে ভাল্লুকের চামড়া৷
ইয়োর ঠাকুরদা লিও এই প্রজাতিটার কথাই লিখেছিলেন৷ মৃত্যুর আগে লিও ডায়েরিটা নিজের মস্তিস্ক থেকে খুলে নাতিকে দিয়ে যান৷ এই গ্রহের হিসেবে দশ লক্ষ বছর আগে এখানে এসে কিছু পরীক্ষা করে গেছিলেন৷ সেই পরীক্ষার ফলাফল পর্যবেক্ষণ করতেই ইয়োর পৃথিবীতে আগমন৷
ফের ডায়েরিতে মনঃসংযোগ করল ইয়ো৷ “ভাইরাসটার নাম দিলাম ‘বন্ধুত্বের ভাইরাস’৷ এটা যে প্রজাতিকে পুরোপুরি সংক্রামিত করতে পারবে তাদের জেনেটিক গঠন এমনভাবে বদলে যাবে যে তারা এক শক্তিশালী সমাজবদ্ধ জীব হিসেবে পৃথিবী শাসন করার ক্ষমতা অর্জন করবে৷ যে প্রাইমেটগুলো গাছ থেকে মাটিতে নেমে এসে দু-পায়ে হাঁটতে শুরু করেছিল সেই স্যাপিয়েন্সদের মধ্যেই বন্ধুত্বের ভাইরাস ছড়িয়ে দিলাম৷”
বিকট আর্তনাদে ফের মনঃসংযোগ ছিন্ন হল৷ সংখ্যায় অনেক বেশি আর একদল মানুষ আগের দলটাকে আক্রমণ করেছে৷ খুন, লুটপাট চালিয়ে, জোয়ান নারীপুরুষদের বন্দি করে নতুন দলটা উল্লাস করতে করতে চলে গেল৷ নতুন দলের সবার গায়ে সিংহের চামড়া৷
ইয়ো ডায়েরি চিপটার সঙ্গে পুনরায় মনঃসংযোগ করল৷ তার চিন্তাগুলো চিপে লেখা হয়ে গেল৷ “বন্ধুত্বের ভাইরাস স্যাপিয়েন্স প্রজাতিটাকে ভালোভাবেই সংক্রামিত করেছে৷ কিন্তু তারা এতদিনে ইমিউনিটিও অর্জন করে ফেলেছে৷ সেই ইমিউনিটির নাম— সাম্প্রদায়িকতা৷”
ডাক
ড. পিয়াস গড়গড়ি
২৫° উত্তর, ১৩৬.৯৯° পূর্ব, সাল ১৯৫০
আকাশ একদম পরিষ্কার। জাপানি মাছধরার জাহাজটা নিজের গতিতে এগিয়ে চলেছে। খানিকক্ষণ আগে বড় একটা মাছের ঝাঁক দেখা গেছে রাডারে, নাকামুরা আর তার দুই সঙ্গী তাই বেশ উত্তেজিত। হঠাৎ তানাকা মাস্তুলের ওপর থেকে চেঁচিয়ে বলল, “আরে ওটা কী দেখা যাচ্ছে?” সকলে সেইদিকে তাকিয়ে দেখল— সত্যিই তো! দুটো বিশাল ডানা সমুদ্রের জল থেকে বেরিয়ে এসেছে, চারপাশের ফেনিল জলে যেন ঘূর্ণি লেগেছে। হঠাৎ জাহাজটা ভীষণ জোরে দুলে উঠল, সকলে ছিটকে পড়ল জলে। জাহাজটা ডুবে যাবার আগে নাকামুরা দেখলেন বিশাল একটা প্রাণী, দেখতে মানুষের মতন, পিঠে ড্রাগনের মতন ডানা, মুখের জায়গায় অজস্র শুঁড়। মুখ দিয়ে বিস্ময়ে বেরিয়ে এল, “দ্য ড্রাগনস সি…”
২৫° উত্তর, ৭১° পশ্চিম, সাল ১৯১৯
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সবে শেষ হয়েছে। চারদিকে কেবল মৃত্যুর হাহাকার। এর মাঝেই একটা মহাকাশযান নেমে আসল আটলান্টিক সাগরের বুকে। এল-৩৩০ গ্ৰহের তিন মহাকাশচারী বেরিয়ে এলেন যান থেকে। দলপতি আদেশ দিলেন, “আপনাদের বিশেষ উদ্দেশ্যে আনা হয়েছে এখানে। এখানকার বাসিন্দারা নিজেদের মধ্যে যুদ্ধরত, আপনাদের প্রধান কাজ হবে শান্তি স্থাপন করা। যে কোনও রূপ হিংসার আবির্ভাবেই তাকে নির্মূল করতে হবে। আপনাদের জন্য নির্মিত বিশেষ পোশাকে শতসহস্র উপাঙ্গ আছে, যার সাহায্যে আপনারা জলের মধ্যে সহজে বিচরণ এবং শ্বাস নিতে পারবেন, আকাশে উড়তে পারবেন।”
“তাই হবে, হে মহান কথুলু” বিশাল দুই ডানা মেলে উড়ে গেল দুই নভোচর। জল আবার শান্ত হয়ে গেল…
অলীক সত্য
ড. সাম্য মণ্ডল
একটু একটু করে সংজ্ঞা ফিরতেই নিজেকে একটা ছিমছাম কেবিনে আবিষ্কার করে অদিতি। জানালার পর্দার ওপারে শেষ বিকেলের আলো। ওষুধপত্র, ফ্লোর ক্লিনারের পরিচিত গন্ধ দ্রুত বুঝিয়ে দিল ওর বর্তমান অবস্থান।
তলপেটে একটা চিনচিনে আড়ষ্ট বেদনার অনুভূতি।
সহসা দরজায় একটা আওয়াজ হতেই নির্জন কেবিনটাও যেন ওর সঙ্গেই ঘুম ভেঙে জেগে উঠল। দরজা ঠেলে সৌরভ কাছে এসে, অদিতি কোলে নামিয়ে দিল একটি ছোট্ট কাপড়ের পুঁটুলি। সারা শরীর ঢাকা, শুধু অনাবৃত কচি মুখখানি, স্ফুরিত লাল ওষ্ঠ। যেন ঘুমন্ত এক দেবশিশু! সৌরভের মুখে তখন গর্বিত পিতার বিশ্বজয়ী ঔজ্জ্বল্য।
অন্তরের কোনও সুদূরতম অন্তঃস্থল থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে নেমে আসছিল অকৃত্রিম স্নেহময় স্রোত। বারবার দেখেও যেন আশ মিটছিল না অদিতির। এই সজীব রক্তমাংসের অস্তিত্বটি কি ওরই শরীরের অংশজাত! পরম মমতায় সদ্যোজাতের কপালে এঁকে দেয় স্নেহ চুম্বন।
বুকের উষ্ণতার ওকে মিশিয়ে, এই স্বর্গীয় মুহূর্তটিকে নিজের চোখের শাটারে চিরতরে ফ্রেমবন্দি করে নিতে চাইল।
… ভি.আর. সেটটা খুলে রাখার অনেকক্ষণ পরেও যেন পুরোপুরি ঘোর কাটতে চাইছিল না। একবিংশ শতকের শেষ প্রান্তে এসে ভার্চুয়াল রিয়েলিটির অভিজ্ঞতা এতটাই অলীক সত্য এখন!
গত মাসে করা হিস্টেরেকটমিতে, জরায়ুর সঙ্গে সঙ্গে চিরকালের মতো বিদায় নিয়েছে সন্তানধারণের ক্ষমতাও।
একসময় ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ায় ও। বাস্তব দুনিয়ায় এখন মধ্যরাত্রির অখণ্ড নীরবতা। কৃষ্ণপক্ষের ঝকঝকে মেঘমুক্ত আকাশ। সেই সীমাহীন অনন্ত মহাকাশের অগণিত নক্ষত্রমণ্ডলীর মাঝে নিজের অনাগত নবজাতকের মুখচ্ছবি কল্পনা করে অদিতি।
নিয়ন্ত্রিত মূল্য
তাহমিদ হোসেন
মোবাইলে একটা নাম্বার ডায়াল করতেই যান্ত্রিক নারীকণ্ঠ শোনা যায়। “…রিচার্জ করতে ১ চাপুন…।”
নিজের ব্যবহৃত অপারেটর সিলেক্ট করে শামীম রিচার্জের পরিমাণে লিখল ১৫ টাকা।
ঢুকেই তমসাকে দেখতে পেয়ে শামীমের মধ্যে এক সর্বগ্রাসী অনুভূতি ছড়িয়ে যায়। তমসার কাছে আসামাত্র তার ঘ্রাণ শামীমের সব অনুভূতি কেড়ে নেয়। তমসার ঠোঁটে একটা মাদকতাময় হাসি। শামীমের ঠোঁট তমসার ঠোঁট ছোঁয়…
বাইরের ঘরে শামীমের ল্যাপটপের পর্দায় বিজ্ঞাপন চলতে থাকে। “এলটক নিয়ে এল চারটি কাজে সক্ষম গৃহকর্মী রোবট…” এরপরই শুরু হয় সরকারি বিজ্ঞপ্তি: “সংক্রামক মহামারী থেকে বাঁচতে প্রিয়জনের সঙ্গে যৌনমিলনে ভার্চুয়াল রিয়ালিটি কল ব্যবহার করুন। সেক্স টাইমের সরকার নির্ধারিত সর্বোচ্চ মূল্য প্রতি এক মিনিট দেড় টাকা। জনস্বার্থে রাজ্য সরকার।”
একটি লাল বল
সম্রাট লস্কর
আরও দু-ঘণ্টা। ঘড়ি তাই বলছে। অসহ্য গরম পড়েছে আজ। এত গরমে এই বিরক্তিকর ডিউটি! মনে মনে একটা গালাগালি দিলাম। আর্মিতে যোগ দেবার সময় ভাবিনি যে পাহারাদারের মতো এই বিরক্তিকর কাজ করতে হবে। কাজটা খালি বিরক্তিকরই নয়, অস্বস্তিকরও বটে। কারণ গত তিন মাস ধরে পাহারা দিতে হচ্ছে কিম্ভূতকিমাকার কিছু ভিনগ্রহী প্রাণীদের।
প্রায় বছর দুয়েক আগে পৃথিবীতে এদের স্পেসশিপ ল্যান্ড করেছিল। এরা কারা, কোথা থেকে এসেছে, কেন এসেছে— কোনও কিছুই জানা যায়নি। কারণ এদের সঙ্গে যোগাযোগের কোনও সরাসরি উপায় এতদিনেও আবিষ্কার হয়নি। কয়েকটা এলিয়েনকে ল্যাবরেটরিতে রেখে বাকিগুলোকে রাখা হয়েছে এই ঘেটোতে। সেই ঘেটোই পাহারা দিচ্ছি আমরা আর্মির লোকেরা।
এমনি এই এলিয়েনগুলোকে নিয়ে সমস্যা নেই। কোনও ঝামেলা করে না, নিজেদের নিয়েই থাকে। কিন্তু ওদের এতটাই বীভৎস দেখতে যে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না। আমার ভাগ্যেই কেন যে এই ডিউটিটা পড়ল! আজ যেন আরও বেশি খারাপ লাগছে। বাড়ি ফেরার তীব্র ইচ্ছা হচ্ছে। ছেলে একটা খেলার বলের জন্য বায়না করছিল ক-দিন ধরে। কিনেছি গতকালই। আজ নিয়ে যাব। অজান্তেই হাতটা পকেট থেকে বের করে এনেছে বলটা। লাল রঙের।
হঠাৎ একটা আওয়াজ এল ঘেটোর ভিতর থেকে। একটা ছোট আকারের এলিয়েন তাকিয়ে আছে বলটার দিকে। তারপর অদ্ভুত আওয়াজ করতে করতে ছুটতে লাগল আমার দিকে। ‘সাবধান’ আমার সঙ্গী চেঁচিয়ে উঠল। ঘটনার আকস্মিকতায় আমার হাত থেকে বলটা পড়ে গেছে। আমাদের আঙুল অটোমেটিক গানের ট্রিগারে। ছোট এলিয়েনটা কিন্তু এসব কিছুই দেখছে না। লাল বলটা কুড়িয়ে নিয়ে সে খেলা শুরু করে দিয়েছে। একদম মানব শিশুর মতো। আমরা তাকিয়েই রইলাম।
দংশন
শাম্ব চ্যাটার্জী
আকাশের আজ মুখ ভার। সকাল থেকেই ঘন কালো মেঘের আস্তরণে ঢেকেছে তিলোত্তমা। প্রগতির কবজিতে বাঁধা স্মার্ট গ্যাজেট ঘন ঘন আবহাওয়ার হাল হকিকত জানান দিচ্ছে। আগামী কয়েকদিন এই মেজাজ বদলানোর ইঙ্গিত সেখানা অন্তত দিতে পারছে না। মনটা বড্ড কফির জন্য আনচান করছে। সারাদিনের কাজকর্মের ক্লান্তি এসে ভর করেছে দু-চোখের পাতায়। স্নায়ু তাই উত্তেজকের অপেক্ষায়। কিচেন থেকে ভেসে আসা কফি মেকারের যান্ত্রিক শব্দ তাকে জানিয়ে দিল যে তার আবদারের বস্তুটি তৈরি হতে আর বেশি দেরি নেই। নাহ, টেলিপ্যাথির জোর বা হাউস-হেল্পারের সময়জ্ঞান— এর কোনটাই আসল কারণ নয়। এই ফ্ল্যাটে সে আর তার বছর দুয়েকের ছোট্ট বাচ্চা ছাড়া আর কেউ থাকে না। প্রগতি সিঙ্গল মাদার। শিশুটি এখন দিব্যি ঘুমের দেশে। অটোম্যাটিক দোলনায় মৃদু দোল খাচ্ছে। দোলনার সেন্সর থেকে ইতিবাচক মেসেজ প্রগতির কব্জিতে বাঁধা গ্যাজেটে বিদ্যমান। বাচ্চার সুবিধা-অসুবিধার খবর তাই সে অনবরত পেয়ে চলেছে। এখন ওয়ার্ক ফ্রম হোম বলে এতক্ষণ অফিসের কাজেই ব্যস্ত ছিল প্রগতি। তার স্নায়ুর চাহিদা অনুযায়ী কিচেনে কফি তৈরির নির্দেশ পাঠিয়ে দিয়েছে ওই একই গ্যাজেট। কাপটা যন্ত্র থেকে নেওয়ার সময় সেটার আর্টিফিশিয়াল ইন্টালিজেন্স সিস্টেম বলে উঠল, “আজকের মতো কফির কোটা শেষ। আপনার শরীরে ক্যাফেনের মাত্রা দৈনিক সীমার সর্বোচ্চ স্তর ছুঁইছুঁই করছে।” মৃদু হেসে ব্যালকনির দিকে এগোল প্রগতি। পনেরো তলা বিল্ডিঙের টপ ফ্লোরে তার ফ্ল্যাট। কৃত্রিম ঘাস বিছানো সুপরিসর ব্যালকনিতে দাঁড়ালে শহরের রূপরেখার বহু দূর পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা মেলে। আজকাল খুব একটা বেরোন হয় না। আসলে বেরোনর ব্যাপারে হরেকরকম নিয়মকানুনের বায়নাক্কা রয়েছে প্রশাসনের তরফ থেকে। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র অনলাইনেই উপলব্ধ। ফ্রিজে রাখা মজুত খাবার শেষ হলে যন্ত্রে ফিড করা তথ্য অনুযায়ী সেটার অটোমেটিক অর্ডার চলে যায় ফুড অ্যান্ড গ্রসারি শপে। এমনকী প্রগতির মনে বিশেষ কোনও রান্নার স্বাদ চাখার ইচ্ছে জাগলে, কব্জির গ্যাজেট সে ব্যবস্থাও সেরে রাখে। ঘরের বাইরে শেষ কবে বেরিয়েছে মনে পড়ে না তার। গ্যাজেটের বিপ বিপ শব্দে হেসে ফেলে প্রগতি। ব্যাটারা মনের কথাও পড়ে ফেলে চিন্তার তরঙ্গ ধরে। ইলেকট্রনিক প্যানেলে জ্বলজ্বল করছে শেষ বেরনোর তারিখটা। কফিতে চুমুক দিতে দিতে অচেনা শহরটার দিকে তাকায় প্রগতি। হ্যাঁ, তার চেনা সিটি অফ জয় আজ সত্যিই অচেনা। ব্যস্ত শহরের বাসিন্দারা সব নিজের নিজের চার দেওয়ালের চৌহদ্দিতে বন্দি। বছর কুড়ি আগে হানা দিয়েছিল অণুজীবটা। তারপর একের পর এক ভ্যাকসিনের দৌলতে ঠেকানো গিয়েছিল তাকে। কিছুকাল স্তিমিত থাকার পর মিউটেশন ঘটিয়ে আবার থাবা বসিয়েছে বাছাধন। এবারে মারণলীলা আরও দুঃসহ। ফলস্বরূপ সকলে… এদেশের বিজ্ঞানীরা উপায় একটা বার করেছে বটে, কিন্তু… নিজের দুর্বুদ্ধির উপর তার নিজেরই বেশ রাগ হচ্ছিল এই মুহূর্তে। কেন যে মরতে এই ফ্ল্যাটটা কিনেছিল সে। কাপে আবার চুমুক দিতে খেয়াল হল সেটায় আর অবশিষ্ট কিছু নেই। বিরক্তিসহকারে ঘরমুখো হল প্রগতি। এমন সময় কানে গ্যাজেটের সতর্কবাণীর আওয়াজ প্রবেশ করতে ছুট্টে ভিতরের ঘরে গেল সে। একরাশ উদ্বেগ নিয়ে দোলনার দিকে তাকাতে যেটা নজরে এল, তার অবাক হওয়ার পক্ষে সেটা যথেষ্ট! দেখল ঘুমন্ত বাচ্চার গায়ে বসে একটা… শিথিল শরীরে মেঝেতে বসে পড়ল প্রগতি। নাহ, শেষমেশ উচ্চতা বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি তাহলে। বিজ্ঞান…
খোলা জানালার পাশে এসে দাঁড়াল প্রগতি। সন্ধের মায়ামাখা আলোয় নজরে এল গোটা আকাশ জুড়ে নির্দিষ্ট লয়ে উড়ে চলেছে মশার ঝাঁক। ওদের লক্ষ্য একটাই, দ্রুত এই শহরে ছড়িয়ে পড়া। রোগ সংক্রমণ ঠেকানোর একমাত্র পথ লুকিয়ে তাদের দংশনে। হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন। এদেশে মশাদের নির্বীজ করা হয়েছে বহুদিন। বিভিন্ন মানব অ্যান্টিভাইরাস অ্যান্টিবডির জিনের গাঠনিক সরলীকরণ করে মশাদের জিনোমে ঢোকানোর দৌলতে মশাবাহিত রোগের সম্ভাবনা আর নেই। দেশিয় বিজ্ঞানের নবতম আবিষ্কার এই ন্যানোবটবাহী মশার দল। এদের দংশনে প্রবোসিসে থাকা ন্যানোবটেরা নিমেষে ঢুকে পড়ে মানব শরীরে। শুরু হয় আসল খেলা। শরীরের ভিতরে গিয়ে এরা মুক্ত করে দেয় অণুজীবের সংক্রামক স্পাইক প্রোটিনের মতো কার্যকারী নকল রিসেপ্টর ইনহিবিটর। ব্যাস খেল খতম। ব্যাটাচ্ছেলেদের সাধ্য কী আর নতুন শরীরে থাবা বসায়।
প্রগতি নির্নিমেষ নয়নে তাকিয়ে থাকে ওদের যাত্রাপথের দিকে। ভ্যাকসিনের চেয়েও দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ছে দলটা। লক্ষ্য একের পর এক শহর।
(সব চরিত্র ও প্রেক্ষাপট কাল্পনিক)
Tags: অতনু কুমার, অনুগল্প সংকলন, কল্পবিশ্ব ইভেন্ট, ড. পিয়াস গড়গড়ি, ড. সাম্য মণ্ডল, তাহমিদ হোসেন, পঞ্চম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, পার্থ দে, রুশদী শামস, শাম্ব চ্যাটার্জী, সম্রাট লস্কর, সৌরভ ঘোষ
চমৎকার! সবগুলো কল্পানু গল্পই দারুন ছিলো। শুভেচ্ছা।