ওসেনবোরো
লেখক: অঙ্কিতা
শিল্পী: সৌমেন
বুড়োটা শালা অসুস্থ নাকি!
কথাটা বাসুর মনের মধ্যে ভেসে উঠেই হারিয়ে গেল। সামনে বসে থাকা বৃদ্ধের চোখেমুখে এক অসহায় ভয় আর আতঙ্ক খেলা করে বেড়াচ্ছে। এই ধরনের মুখচ্ছবির সঙ্গে বাসু যথেষ্ট পরিচিত। চোখের সামনে মৃত্যুকে দেখলে মানুষের মুখ চোখ এরকম হয়ে যায়। অনেক সময় বাসুকে দেখলেও… হবে নাই বা কেন? মৃত্যু আর ভয় নিয়েই তো তার কারবার। এই আঠারো বছরের কর্মী জীবনে বাইশ খানা লাশ সে শুধু পিস্তলের গুলিতে নামিয়ে দিয়েছে। এ ছাড়াও, তার ছোড়া বোমা আর পাইপগানের এলোপাথাড়ি গুলিতে কোথায় কতজন মরেছে সে সব হিসাব বাসু রাখে না। নাগাল্যান্ডের ত্রাস বলে চেনে সবাই তাকে। অনেকের চোখেই বাসু ওই প্রতিবিম্ব দেখেছে। সে জানে কেমন দেখতে হয় মৃত্যু।
কিন্তু… শুধু মৃত্যু নয়! বুড়োটাকে ঘিরে কেমন একটা অদ্ভুত অসুস্থতা!
এই বাড়িটা… প্রাসাদ বললেও অত্যুক্তি হবে না… অন্তত বাসুর কাছে তো বটেই… দোতলা বাংলো স্টাইলের বাড়ি। এককালে হয়তো কোনও ইংরেজ শখ করে বানিয়েছিল, পরে বুড়োটা কিনে নিয়েছে। চওড়া বারান্দায় চমৎকার আরামকেদারা, বসার ঘরে কাঠের উপরে মলমল মোড়া নরম সোফা। মাথার উপরে একটা বড়সড়ো ঝাড়বাতি। অবশ্য তাতে আলো জ্বলছে না। দেওয়ালে লাগানো কয়েকটা টিউবলাইট থেকে জোরালো আলো আসছে। বড় ঘরটা যথেষ্ট আলোকিত। যদিও আলো যে জ্বলছে এটাই বিশাল ব্যাপার। বাসু যখন এসেছিল তখনই জেনারেটরের আওয়াজ পেয়েছে। জেনারেটর ছাড়া ইলেকট্রিক আলো জ্বালা এইসব অঞ্চলে সম্ভব নয়। আর এই গন্ডগ্রামে জেনারেটর যাদের বাড়িতে থাকে, তাঁরা যে কোন উচ্চতার মানুষ তা বাসু ভালোই জানে। একটু দূরে ফায়ারপ্লেসে কাঠ পুড়ছে, উত্তাপ ছড়াচ্ছে; অতি মৃদু সেই পটর পটর শব্দটাও কানে আসছে নিস্তব্ধতার দরুন। রঙিন কাচের জানলার বাইরে নভেম্বরের হিমশীতল অন্ধকার ক্রমে জাঁকিয়ে বসছে। বাড়িটা বড্ডই বেশি শান্ত আর ঠান্ডা।
‘তোমায় একটা খুন করতে হবে।’ বৃদ্ধ বলে উঠলেন। গলার স্বরটা কেমন যেন তীক্ষ্ণ শোনাল বাসুর কানে। মনে হল স্বরের হালকা কাঁপনটা ঢাকা দিতেই এরকম তীক্ষ্মতা। বাসুর দিক থেকে কোনও তৎপর উত্তর না পেয়ে তিনি আবার নিজেই বললেন, ‘ওটাই তো তোমার কাজ নাকি? সাগন তো তাই বলছিল।’
‘হুম। অবশ্য আজকাল আর আমি ফিল্ডে নামি না। আমার অ্যাসিস্ট্যান্টরাই এসবের জন্য যথেষ্ট। কিন্তু সাগন বলল, আপনি আমাকেই কাজটা দিতে চান।’
বৃদ্ধের কুতকুতে চোখ জোড়া আরও সরু হয়ে এল। ‘তুমি কতদিন নিজে হাতে কাজ করো না?’
বাসুর মুখে একটা চেরা হাসি ফুটে উঠল, ‘আমি গত শীতেও চারটে লাশ একরাত্রে নামিয়েছি স্যার। তবে ওটা পারসোনাল অ্যাজেন্ডা ছিল… কাজের ব্যাপারে আমার একটা শর্ত আছে।’
‘কী?’
‘আমি বরাত নিয়ে মেয়েছেলে আর বাচ্চাদের খুন করি না। কাজের রাস্তায় পড়ে গেছিল বলে দু–তিনটেকে নিকেশ করতে হয়েছে। কিন্তু বরাত নিয়ে ও কাজ আমি করি না।’
‘না না। তোমাকে মেয়েমানুষ বা বাচ্চা খুন করতে হবে না।’ বৃদ্ধ বললেন।
‘তাহলে, কাকে?’
হুইল চেয়ারটা ঘষটে বৃদ্ধ কয়েক পাক এগিয়ে এলেন। ভয়, জরা আর পেচ্ছাপের একটা মিশ্রিত হলদেটে গন্ধ বাসুর নাকে আছড়ে পড়ল। ওই প্রত্যেকটাকে বাসু ঘৃণা করে; কিন্তু তার মসৃণ মুখের একটা পেশিও কাঁপল না। আগের মতোই স্মিতমুখে সে বৃদ্ধের দিকে চেয়ে রইল।
‘শিকার তোমার পিছনেই।’
বাসু বিদ্যুতের মতো ঘুরল। রিফ্লেক্সই তার প্রাণভোমরা। অত্যন্ত টানটান করে বাঁধা বাদ্যযন্ত্রের তারের মতো বাসুর স্নায়ুমণ্ডলী। পরিবেশের সামান্যতম কম্পনেও রিনরিন করে বেজে ওঠে। এক ঝটকায় বাসু মাটিতে গড়িয়ে পড়ল সোফা থেকে। নিঁখুত মোচড়ে এক হাঁটুতে ভর দিয়ে পিছনে ফিরল। তার শক্ত মুঠিতে চেপে ধরল পিস্তলটা। পয়েন্ট ফর্টিফাইভের এই শর্ট ব্যারেলড হাইব্রিড মালটা সবসময় তার পাঁজর ঘেঁষে ঝোলে। স্প্রিং দেওয়া একটা হোলস্টারও ব্যবহার করে সে। চকিতের মধ্যে বাসু উদ্যত নলের সামনে দেখা গেল… তার শিকার।
কয়েক সেকেন্ডের জন্য শিকার আর শিকারী পরস্পরের দিকে চেয়ে রইল। এরকম অদ্ভুত মুহূর্ত বাসুর এই দীর্ঘ কর্মজীবনে আগে আসেনি। এর আগে বহু শিকারের সঙ্গেই তাঁর চোখাচুখি হয়েছে। শিকারের চোখে ফুটে ওঠা আতঙ্ক, মৃত্যুভয়, ঔদ্ধত্ব্য, এমনকি সাহসও দেখেছে বাসু। কোনও কিছুই তার মনে কোনও ধরনের কল্পনার জন্ম দেয়নি। এমনিতে সে যথেষ্ট রুখুশুখু মানুষ। তার পিস্তলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা শিকারের চোখের তারায় খেলে যাওয়া বিভিন্ন ধরনের অনুভূতি নিয়ে চিন্তাভাবনার সময় পায়নি কখনও বাসু। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তার কাছে কয়েক সেকেন্ডই যথেষ্ট ছিল ওই সমস্ত চোখের জ্যোতিকে নিবিয়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু এবারে চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে বাসু কেমন যেন বিমূঢ় হয়ে গেল… তার পিস্তলটা তাগ করা আছে একটা পাখির দিকে। একটা… পাখি!
এক হাঁটুতে ভর দিয়ে বসে থাকা অবস্থানটা চট করে পরিবর্তন করল না বাসু। সে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল পাখিটার দিকে। ঘরের উজ্জ্বল আলোয় পাখিটাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। জানালার গোবরাটে বসে পাখিটা তাকিয়ে আছে বাসুর দিকে। বাসুর মনে হল সে যেন এরকম একটা পাখি আগেও কোথাও দেখেছে। কিন্তু না, এরকম অদ্ভুতরঙা পাখি আগে দেখে থাকলে তার মস্তিষ্ক সেটা কখনওই তাকে ভুলতে দিত না।
পাখিটা আমুর ফ্যালকন। নাগাল্যান্ডের আকাশে এই অক্টোবর নভেম্বর মাসে এই জাতের বাজপাখি ভীড় করে ওড়ে। কিন্তু এই বাজপাখিটার সবচেয়ে বড় বিশেষত্ব হল এটার পালকের রং। উজ্জ্বল নীলচে ধূসর রঙের পালক। কিন্তু আমুর ফ্যালকনের মাথায় এরকম ধপধপে সাদা মুকুটের মতো বৃত্ত এর আগে দেখেছে কিনা মনে করতে পারল না বাসু।
সাদা মুকুট যেন কার মাথায় থাকে? কী যেন একটা গল্প শুনেছিল বহু বছর আগে দাদীর কাছে বাসু। গল্পটা মনে পড়ল না সময় মতো। যেন, তাকে কিছু মনে করিয়ে দেবার জন্যেই বাজপাখিটা ডানা দুটো মেলল। বিস্তৃত হল পালকের শরীর। ডানা দুটোর ভিতরের অংশ যেখানে নরম সাদা ধূসর পালক থাকার কথা, সেগুলো রক্ত লাল। ফটফটে বৈদ্যুতিক আলোয় লাল রংটা ভুল করার কোনও প্রশ্নই নেই। দেখে মনে হচ্ছিল বাজপাখিটার হাতের তেলো যেন রক্তে চুবানো।
নাহ, এরকম অদ্ভুত রঙের আমুর ফ্যালকন বাসু আগে দেখেনি। বাসুর ঘাড় দুলে উঠল। তীক্ষ্ম চোখে বাজপাখিটা তাকে লক্ষ করছে। হলুদ অক্ষিপটলের মাঝে নিকষ কালো তারাদুটোতে যেন নরকের অন্ধকার। কোন এক প্রাচীন ঘৃণার আঁচে জ্বলজ্বল করছে কালো কয়লার মতো।
একটা বাক্য গুনগুন করে উঠল বাসুর মাথার মধ্যে, আমরা বড় পরিচিত, তাই না! এর আগেও আমাদের দেখা হয়েছিল। তোমার এবং আমার।
পিস্তলটা হোলস্টারে রেখে শান্তভাবে উঠে দাঁড়াল বাসু। ‘আপনাকে আমি মেরে ফেলতে পারি এটার জন্য। আমি ইয়ার্কি পছন্দ করি না।’
‘আমিও করি না।’ বৃদ্ধ বললেন। ‘বসো। এদিকে দেখ।’
সোফায় বসতে গিয়েও বাসু বসল না। বন্ধ জানালাটার কাছে এগিয়ে গেল। তখুনি সে লক্ষ করল ওই দিকের দেওয়াল ঘেঁষে অনেকটা উপরে কড়িকাঠে একটা খড়কুটো দিয়ে তৈরি পাখির বাসা। এতক্ষণ হয়তো তার মাথার উপরেই বসে ছিল পাখিটা অথবা পিছনে, সে টেরই পায়নি!
কী চায় তার কাছ থেকে এই বুড়োটা? দশরথ বিঠাং। হুঁ, দশরথ বিঠাং। নাগাল্যান্ডের সবথেকে ধনী পোচার।
বাসু হাত বাড়াতেই পাখিটা ডানা ঝাপটাল। বাসুর হাতে এসে বসল। পাখিটা বোধহয় বহুদিন মানুষের সঙ্গে আছে, তাই মানুষকে ভয় করে না। বাসু লক্ষ করল বিঠাংমশাইয়ের শরীরি ভাষায় অস্বস্তি যোগ হল। পাখিটাকে হাতের মধ্যে নিয়ে বাসু সোফায় গুছিয়ে বসল। বাজপাখিটা হাত ছেড়ে টুপ টুপ করে বাসুর কোলের মধ্যে নেমে গেল। বড় বড় কালো চোখ তুলে ঘাড় বেঁকিয়ে চারিদিক দেখল একবার। তারপর পাখাটাখা মুড়ে থিতু হয়ে বসল উরুর উপর। বাসু ধীরে ধীরে একটা আঙুল রাখল পাখিটার সামনে। পাখিটা সামান্য গলা বাড়িয়ে বাসুর আঙুলে মাথা ঘষে নিল। বাসু আস্তে আস্তে ওর গলার তলার নরম পালকে আঙুল বুলিয়ে দিল। ওটার শান্ত শ্বাসপ্রশ্বাসের মৃদু কম্পন অনুভাব করল আঙুলে বাসু। বাজপাখিটা একদম পোষমানা।
এবার সে ভুরু কুঁচকে দশরথের দিকে তাকাল।
‘হ্যাঁ। খুবই বন্ধুভাবাপন্ন।’ দশরথ খসখসে গলায় বললেন, ‘অন্তত প্রথম দর্শনে তো বটেই। আর এই বন্ধুভাবাপন্ন পুঁচকে পাখিটা অন্তত বাইশটা মানুষকে মেরে দিয়েছে। আমার পুরো পরিবারকে শেষ করে দিয়েছে, শুধু আমি বেঁচে আছি। এই পুরো বাড়িতে আমি একা… আমি অসুস্থ… আমি বুড়ো হয়েছি ঠিকই, কিন্তু আমি নিজের মতো মরতে চাই। ওই পাখিটার হাতে মরতে চাই না।’
বাসু বুড়োর কথাগুলো শুনে হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারল না কিছুক্ষণ।
বাইশ! অ্যাবসার্ড! একটা পাখি কখনও… তাও আবার আমুর ফ্যালকনের মতো নরমসরম পাখি! হতে পারে ওরা বাজপাখিরই একটা প্রজাতি, কিন্তু যথেষ্ট ছোটখাটো পাখি। খুব বেশি হলে ফুটখানেকের মতো লম্বা হয়। কখনও কোনও আমুর ফ্যালকন একা তো দূরের কথা দল বেঁধেও মানুষকে আক্রমণ করেছে বলে এই নাগাল্যান্ডে কোথাও শোনা যায়নি।
অক্টোবর–নভেম্বর মাসে নাগাল্যান্ডের আকাশে আমুর ফ্যালকনের বন্যা বয়ে যায়। ঝাঁকে ঝাঁকে নীল–ধূসর অথবা সাদা–ধূসর বাজপাখির দল উড়ে যায় নাগাল্যান্ড, মিজোরাম, মণিপুর, আসামের উপরে দিয়ে। ওটা ওদের মাইগ্রেশনের সময়। সেই সুদূর সাইবেরিয়া থেকে উড়ে উড়ে ভারত হয়ে পাখিগুলো চলে যায় আফ্রিকায়। প্রায় বাইশ হাজার কিলোমিটারের পরিক্রমা।
বাসু এই পাখিগুলোকে ছোটবেলা থেকে দেখে দেখে বড় হয়েছে। শহুরে কাক, চড়ুই বা শালিকের মতোই নাগাল্যান্ডের বনেজঙ্গলে কাতারে কাতারে আমুর ফ্যালকন দেখা যায়। অবশ্য এই বিশেষ প্রজাতির বাজপাখি সম্বন্ধে এত কথা বাসু বছরখানেক আগে পর্যন্তও জানত না। বছরখানেক আগে এই ওখা জেলারই সোপান গ্রামে এই সময় তিন তিনটে ইকোকালচার ক্যাম্প হয়েছিল। ওই ক্যাম্পেই আমুর ফ্যালকনের ব্যাপারে কিছু তথ্য জানতে হয়েছিল তাকে। পুলিশ আর মিলিটারির হাত ছাড়িয়ে লুকিয়ে থাকার জন্য এই ক্যাম্পগুলো আদর্শ। একটু এদিক ওদিক হলেই বনেজঙ্গলে মিশে যাওয়া যায়। আর সোপান গ্রামে তাঁর কিছু পুরোনো হিসাবও চোকানোর ছিল। যাক গে যাক।
বাসু একটু নড়ে চড়ে বসল। বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বিশ্বাস হচ্ছে না স্যার। একটা পাখি মারার জন্য আপনি আমাকে সুপারি দিচ্ছেন?’
দশরথ বিঠাং একটা ছোট হ্যান্ডব্যাগ আলগোছে ছুড়ে দিল বাসুর দিকে। শান্ত গলায় বললেন, ‘খুলে দেখ। দশ আছে। কাজ হয়ে গেলে আরও দশ।’ সোফার উপরে এসে থপ করে পড়ল ছোট পেটমোটা ব্যাগটা।
বাসু ব্যাগটা তুলল। ভারী। চেইনটা খুলে দেখল। কড়কড়ে নতুন গোলাপি নোটের মোটা মোটা বান্ডিল।
‘সোগান বলেছিল তুমি এমনিতে দশই নাও। আমি তোমায় ডবল দিচ্ছি। প্রতিপক্ষের স্কোরও তোমার সমান বলে।’ বাসু চকিতে একবার চোখ তুলে দশরথ বিঠাংকে দেখে নিল। সে ভাবছিল দশরথ হয়তো হাসছে, কিন্তু না বৃদ্ধ একদম গম্ভীর শান্ত, মুখে হাসির চিহ্নমাত্র নেই, বরং খানিক চিন্তিত।
বাসুর হাতটা আপসেই পাখিটার কাছে ফিরে গেল। পাখিটার ডানার আর ঘাড়ের পালকে আঙুল বোলাল সে। পাখিটা এখন ঘাড় গুঁজে ঘুমাচ্ছে। বাসুর হাতের ওমে সে নিজেকে আরও গুঁজে দিল।
আমুর ফ্যালকন। এই বিশেষ প্রজাতির বাজপাখি। বাজপাখি বাসুর বড় পছন্দের। পক্ষীকুলের মধ্যে এই প্রজাতিটাকেই বাসু বেশ ভালোবাসে। এরা যথেষ্ট ক্ষিপ্র, একা থাকতে ভালোবাসে এবং শিকারের প্রতি অবিচল। ঠিক বাসুর মতোই। সাধে কী বাসু এই নাগাল্যান্ডের অন্ধকার জগতের শিকারীদের মধ্যে কালোবাজ বলে নাম কিনেছে। বাজপাখি হল পক্ষীকুলের মাঝে জাতশিকারী। আমুর ফ্যালকন যতই ছোট পাখি হোক না কেন, বাজপাখির জাত তো। বাসু ওদেরকে শ্রদ্ধা করে।
‘দেখো। তোমাকে কিছু খুলে বলার কোনও দরকার নেই। কিন্তু আমি বলব।’ দশরথ বিঠাং হুইল চেয়ারের ব্যাকসিটে হেলান দিলেন। ‘সাবধানতা হল একটা অস্ত্র। পুরো ব্যাপারটা যাতে তুমি হালকাভাবে না–নাও সেইজন্যেই।’ বাসু ঘাড় নাড়ল। সে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে। কাজটা করবে। অবশ্যই অদ্ভুত কাজ। একটা আমুর ফ্যালকনকে খুন। ফুঃ। বাড়তি কথার কোনও প্রয়োজন ছিল না আর, কিন্তু বুড়োটা যদি কথা বলতে চায় বলুক। সে শুনবে। কারণটা বেশ ভারী। কুড়ি লাখ।
কুড়ি লাখ! একটা পাখি মারার জন্য! আবসার্ড! হয় বাসু স্বপ্ন দেখছে, নয়তো এই বুড়োটা পাগল। সে নিশ্চিত দ্বিতীয়টাই ঠিক। তবু বুড়োটাকে বাজিয়ে দেখা উচিত। কুড়ি লাখের থেকেও বড় কথা নাম খারাপ হয়ে যাওয়া। একটা পাগল মাতাল বুড়োকে ঠকিয়ে কুড়ি লাখ নিয়ে নিলে ব্যাবসার জগতে নাম খারাপ হয়ে যাবে বাসুর। তাই সে শুনবে বুড়োর গল্প।
***
‘তুমি কি জানো আমি কে? এই এত টাকা কোথা থেকে এসেছে?’
‘কাঠের ব্যাবসা।’ দশরথ বিঠাং কিছু একটা বলার জন্য মুখ খুলল, বাসু তাকে হাত তুলে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘তবে স্যার আমি আপনার অন্য ব্যাবসাটারও খবর রাখি। পোচিং।’
নাগাল্যান্ডে বাস করে দশরথ বিঠাং–কে কে না চেনে? অবশ্য পুলিশের এখনও সাধ্য হয়নি বিঠাংকে ধরার। বুড়ো খুবই ধূর্ত। একটা কাঠের ব্যাবসা আছে, তার তলায় তলায় পোচিং–এর কাজ চালায়। বাসু সবসময়ই নিজের কাজে নামার আগে ক্লায়েন্টের পূর্বাপর সন্ধান করে নেয়। বাসুর মনে পড়ল বিঠাংদের বিশাল বাড়ি আছে কোহিমাতে। তাহলে বুড়ো এই নির্জনে ওখা জেলার পাংটি জঙ্গলের মাঝখানে পড়ে আছে কেন?
‘হ্যাঁ। আমি দশরথ বিঠাং। নাগাল্যান্ডের সবথেকে বড় পোচারদের মধ্যে একজন… ছিলাম,’ দশরথ হুইল চেয়ারটা নিয়ে ঘরের মধ্যে ঘুরল।
‘আমার বাবাকে রাজরাজড়ারা ডেকে নিয়ে যেত শিকারের জন্য। তামাম পূর্ব ভারতে আমার বাবার মতো বন্দুকের হাত কারও ছিল না। কমবয়সে আমিও কত গেছি অমন! কিন্তু ততদিনে দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। নিষিদ্ধ হয়ে গেছে বন্যপ্রাণী মারা। তবু রক্তের তেজ যাবে কোথায়? আমরা, নাগা–রা, জাত শিকারি। আমার ঠাকুরদা শুধু একগাছি দড়ি নিয়ে হাতি শিকারে যেত। দশ বছর আগে মিলিটারির গুলিতে আমার কোমরের কাছে হাড় সরে যাওয়াতে এই হুইল চেয়ার আমার সঙ্গী। কিন্তু এই পঙ্গু পা নিয়েই আমি হরিণ মেরেছি, লেপার্ড মেরেছি, ভালুক মেরেছি। আমার হাতের গুলি অর্জুনের মতো লক্ষ্যভেদ করত… নাতিনাতনীদের সঙ্গে বাজী ধরে গুনে গুনে উড়ন্ত হাঁস নামিয়েছি গেল বসন্তেও’ বৃদ্ধের গলার আওয়াজ ক্রমেই বাড়ছিল। ‘আর আমি! আর আমি! একটা গোটা রাইফেল দিয়ে মাত্র পাঁচ গজ দূর থেকে ওই হতচ্ছাড়া পাখিটাকে মারতে পারলাম না।’ বৃদ্ধ ঠক ঠক করে কাঁপছিল। বাসু ভাবল, বুড়োর না হার্ট অ্যাটাক হয়ে যায়।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে নিজেকে সামলে নিল দশরথ। হুইল চেয়ার ঠেলে টেবিলের সামনে এগিয়ে এল। একটা বোতল আর দুটো গ্লাস অনেকক্ষণ থেকেই রাখা। অতিথি সৎকারের জন্যই। কিন্তু কাজে নামতে গেলে বাসু ওসব ছোঁয় না। বৃদ্ধ গেলাসটেলাসের ধার ধারল না, ঢকঢক করে আধ বোতল উড়িয়ে দিল। বাসুর মনে হল একবার জিজ্ঞেস করে সন্ধে থেকে কয় বোতল বুড়ো গিলেছে। কিন্তু না, তার বদলে বাসু অন্য প্রশ্ন করল।
‘কত পশু শিকার করেছেন আপনি?’
‘তার কি কোনও ইয়ত্তা আছে ছেলে? বাঘই মেরেছি প্রায় পঁয়ত্রিশটা। গন্ডার তো শখানেক হবেই। আর অন্যান্য বঠা জানবর মানে তোমরা যাদেরকে বিগ কিল বলো, যেমন ধর, স্নো লেপার্ড, হাতি, গউর… ওগুলো ধরলে তো হাজার পেরিয়ে যাবে।’
‘আর পাখি?’
‘কী?’
‘পাখি? আমুর ফ্যালকন? মারেননি?’
‘পাখি তো আমরা এমনি এমনি মারি হে খোকন। দুধে দাঁত পড়ার আগে থেকে পাখি মারছি। গুলতি, এয়ারগান… ওর কি কোনও হিসেব থাকে?’ বৃদ্ধ দশরথ মাথা নাড়লেন। ‘তবে তুমি ঠিকই বলেছ। গত দশ পনেরো বছরে আমাদের দেশে পাখি খাওয়াটা বড্ড বেড়ে গেছে। আগে ওসেনবোরোদের আমরা খেতাম না। বলতেম হিমালয় পাহাড় পার করে যারা আসে তারা দেওতার পাখি। দেওপাখি। তাদের খাওয়া যায় না। তা বাপু, এখন নতুন যুগের ছেলেপিলের ওসব মানে না, সব ধরে ধরে খায়। আমি কিন্তু এখনও ওসেনবোরো খাইনি।’
‘বিক্রি করেছেন?’
‘হ্যাঁ। বিক্রি তো করতেই হয়। বছর সাতেক আগে মিলিটারির গুলিতে আমার ছেলেটা মারা যাওয়ার পর থেকে পোচিং–এর কাজ আমি অনেক কমিয়ে দিয়েছি। এখন পাখি বিক্রি করেই…’
ওসেনবোরো। বাসু জানে, নাগা–রা পাখিদের দুটো নামে ডাকে। এনিনাম আর ওসেনবোরো। সাধারণত, মাইগ্রেটর বার্ড, বা বিদেশি পাখিদেরকেই বলা হয় ওসেনবোরো। আগে নাগারা শুধু স্থানীয় পাখিই শিকার করত। কিন্তু গত ছয়–সাত বছর ধরে মাইগ্রেটরি বার্ডও প্রচুর পরিমাণে শিকার করা শুরু হয়েছে।
‘হিসাব আছে কিছু?’ বাসু জিজ্ঞেস করল।
‘উঁ।’ দশরথ একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল। বাসুর প্রশ্নে তিনি ফিরে তাকালেন। ‘হ্যাঁ… এই ধর না কেন… গেল সিজনের সময় ওই পাখিটাই…’ বৃদ্ধ আঙুল তুলে নির্দেশ করলেন খাঁচাটার দিকে। ‘ওটাই আমরা বেচেছি প্রতিদিন প্রায় একশো ঝুড়ি।’
বাসু একটা শিষ দিয়ে উঠল। একশো ঝুড়ি… মানে দশ হাজার… এক এক ঝুড়িতে একশো করে পাখি যায়। ক্যাম্পিং–এর দৌলতে বাসু জেনেছে গতবছরই কয়েক লক্ষ আমুর ফ্যালকন এই নাগাল্যান্ড, মণিপুর, মেঘালয় আসাম পার করে মূল ভারত ভূখণ্ডে যেতে পারেনি। প্রতিদিন দশ হাজার! লক্ষাধিক পাখি প্রতি মাসে!
দশরথ হাতে হাত ঘষল। বুড়োর কি ঠান্ডা লাগছে নাকি? আগুনের উত্তাপে ঘরটা যথেষ্ট গরম।
‘আমি নিজের হাতে কিছুই করি না। লোক আছে পাংটি গ্রামে। ওরাই পাখি ধরে। অক্টোবর–নভেম্বর মাসে ওই পাখিটার ব্যাবসাই আমি মূলত করে থাকি।’ বৃদ্ধ আবার ইঙ্গিতে বাজপাখিটাকে। ‘আমার কাছে এনে জমা করে দেয়। এই বাড়ির পিছনে কারখানা আছে আমার। ওখানে জনাপাঁচেক নাগা ছেলে আর জনা ত্রিশ মেয়ে বৌ কাজ করে। পাখিগুলোকে মেরে ফেলে পালক, নখ, ঠোঁট আর মাংস আলাদা করে ফেলা হয়। সব আলাদা আলাদা বিক্রির ব্যবস্থা আছে। আমি নিজের হাতে কিছুই ছুঁই না।’ একঘেয়েভাবে দশরথ বিঠাং কথাগুলো বলে যাচ্ছিল। ঠিক যেন গির্জায় পাদরির কাছে পাপ স্বীকার করে নিচ্ছে।
বাসু আবার একবার শিষ দিল।
‘বেশ বেশ। আর এখন আপনি মনে করছেন এই আমুর ফ্যালকনটাকে দেবতারা পাঠিয়েছে আপনাকে মারার জন্যে?’
‘আমি… আমি… না না আমার কোনও পাপ নেই… আমি মনে করি না এতে নাগাদের পাপ হয়। প্রকৃতি দেয়, আমরা নিই। এখন মানুষ যদি হিমালয় পেরোন পাখি খেতে শুরু করে তাতে আমার কী দোষ? যারা খাবে তাদের দোষ। আমার কী?’ বৃদ্ধ প্রায় পাগলের মতো মাথা ঝাঁকাল।
‘হ্যাঁ। হ্যাঁ। সে তো ঠিকই।’ বাসু বুড়োর প্রলাপ থামানোর জন্য বলে উঠল। ‘এই বিশেষ বাজপাখিটাকে কবে পেয়েছেন আপনি?’
উত্তেজনার পরে বৃদ্ধ কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে রইল। তারপর ঘাড় উঁচিয়ে বলল, ‘অ্যাঁ! কি বলছ? কবে পেয়েছি? বেশিদিন নয়। গেল বারের সিজন শেষ হওয়ার পরেই…’ দশরথ চাপাঘেন্নার সঙ্গে তাকালেন বাসুর পাশে রাখা খাঁচাটার দিকে। বাজপাখিটা এখনও ঘুমাচ্ছে।
‘আপনি বলছিলেন এই পাখিটা বাইশ জন লোককে মেরে দিয়েছে।’
বুড়ো ঘাড় দোলাল। পাখিটা বেশ আনন্দেই ঘুমাচ্ছে, বাসুর উরুতে নরম পেট পেতে ঘাড় গুঁজে। মাঝে মাঝে পেটের ভিতর থেকে ভুর ভুর করে আওয়াজ আসছে। বাসুর সরু সরু খুনে আঙুলগুলো সুন্দর পাখিটার ঘাড়ের পালকে বিলি কাটতে শুরু করল। পাখিটা আরামে অদ্ভুত একটা শব্দ করল। নিজেকে আরও একটু সঁপে দিল বাসুর চওড়া হাতের থাবার মধ্যে।
বাইরে রাত বাড়ছে। মার্চ মাসের হাড় কাঁপানো হাওয়া বয়ে চলছে নাগাল্যান্ডের পাহাড়ে পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে। শীতল হাওয়ার দাপটে বাংলোর কাঠের দরজা জানলাগুলো অদ্ভুতভাবে খক খক করে শব্দ তুলে কেশে কেশে উঠছে।
বাড়িটার বুকের মাঝে শ্লেষ্মা জমেছে।
কথাটা আচমকাই যেন ভেসে উঠল বাসুর মনের মধ্যে।
***
‘এই বছর, মে মাসে আমি প্রথম দেখেছি পাখিটাকে। অবশ্য পাখিটা এই বাড়িতে এসে ঢুকেছে তারও আগে, এপ্রিল নাগাদ। এই অঞ্চলে যখন একটাও আমুর ফ্যালকন থাকে না তখন ওই পাখিটা নেমে এসেছিল।
তুমি তো জানোই ছেলে, পাংটিতে ডিসেম্বরের পর থেকে পাখি প্রায় থাকে না বললেই চলে। জানুয়ারি থেকে মে বছরের এই সময়টাতেই আমার বিশেষ কিছু কাজ থাকে না পাংটিতে। তাই ওই সময়টা আমি কোহিমা চলে যাই। পাখির কারবার বন্ধ থাকে। কাঠ কাটার কাজ তো চলে। সেইসব দেখাশোনার জন্য আমার মেয়ের পরিবার এইখানেই থাকে সেই সময়টা। ছেলে মারা যাবার পর ব্যাবসার দায়িত্ব নিয়েছে আমার জামাই। জামাই খুবই ভালো। মেঘালয়ের ছেলে হলেও যথেষ্ট কাজের।
তো গেল বারে পাখি বেচে বেশ ভালোই লাভ হয়েছিল। অত পাখি আগে কখনও ধরতে পারিনি। অবশ্য আমি অনেকটাই টাকা ঢেলেছিলাম গত বছর। দোয়াং–এর খাই জুড়ে মাছের নেট টাঙ্গাতে ভালোই খরচ হয়েছিল।
পাখিগুলোকে কীভাবে ধরি জানো তো?’
বুড়োর প্রশ্নে বাসু ঘাড় নাড়ে। তা বাসু জানে। ওখা স্টেটের মাঝখানে দোয়াং নদীর বিশাল ড্যাম। এই নদী গিরিখাত বেয়ে নেমে গেছে দক্ষিণ পশ্চিমে। আগে এই অঞ্চলে এত যাযাবর পাখি আসত না। দোয়াং নদীর ড্যামটা হওয়ার পর থেকেই আমুর ফ্যালকনের ঝাঁক এই নতুন রুটটাকে বেশি পছন্দ করে ফেলেছে।
এই গিরিখাত ধরেই হাজারে হাজারে যাযাবর পাখি উড়ে যায়। দোয়াং রিজার্ভারের মাছ আর মাঠজঙ্গলের অন্যান্য খাদ্যের প্রতুলতা এই জায়াগাটাকে আমুর ফ্যালকনের স্বর্গরাজ্যে পরিণত করেছে। ওই গিরিখাতের দু–ধারের পাহাড়ের ঢালে অথবা ফাঁকা মাঠের মাঝে মাঝে গাছে গাছে দশরথ বিঠাং–এর লোক মাছ ধরার জাল লাগিয়ে দেয়। পাখিরা সারাদিন উড়ে এসে পরিশ্রান্ত হয়ে গাছে বসতে গেলেই পা জড়িয়ে যায় জালের মধ্যে। তারপর যতই ডানা ঝাপটাক, সে পাখির আর ওড়ার ক্ষমতা থাকে না।
অনেক সময় আশপাশের সরু সরু গিরিখাতে এপার ওপার জাল টাঙ্গানো হয়। যাতে উড়ন্ত পাখি সোজাসুজি জালে আটকা পরে। পাংটি গ্রামটা এই দোয়াং রিজার্ভারের সবথেকে কাছের গ্রাম। পাখিশিকারীদের স্বর্গরাজ্য। বিঠাং–এর কারখানাটাও তাই এইখানেই। গত বছরের ইকো ক্যাম্পেনিং এই গ্রামেও হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু দশরথ বিঠাং–এর ভয়ে তা আর হতে পারেনি। বাসুর কাছে খবর আছে, সিজনের সময় এই অঞ্চলের কয়েকশো অধিবাসী নাগা এই দশরথ বিঠাং–এর অধীনেই কাজ করে। পাখি ধরা, পাখির শরীরের বিভিন্ন অংশ আলাদা করা, মাংস তৈরি করা, বাজারে বিক্রি করা সব কিছুই চলে দশরথ বিঠাং–এর অঙ্গুলিহেলনে।
পুরো নাগাল্যান্ডে যারাই অল্পবিস্তর পোচিং–এর কাজের সঙ্গে যুক্ত তারা সবাই এসব কথা জানে। বাসুও জীবনের প্রথম হত্যাটা পাখি দিয়েই শুরু করেছিল। পোচিং করে দশরথ বিঠাং যা রোজগার করেছে তার থেকে কয়েকগুণ বেশি শুধু পাখি ধরেই পেয়েছে গত কয়েক বছর। নয়তো বিঠাং–এর মতো নাম করা পোচার, ব্যাবসা গুটিয়ে পাখি ধরবে এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়।
বাসুর ঠোঁট দুটোয় বাঁকা হাসি ফুটে উঠতে চাইল। গত বছর অক্টোবর–নভেম্বরে কোহিমার এই অঞ্চলে প্রতিদিন দশ থেকে পনের হাজার আমুর ফ্যালকন ধরা হয়েছে। সংখ্যাটা অন্য যে কোনও মানুষের কাছে অবিশ্বাস্য লাগলেও বাসুর কাছে লাগেনি। আমুর ফ্যালকনের প্রতি এত আগ্রহ কেন দশরথ বিঠাং–এর তাও বাসু জানে।
সদ্য সদ্য কী এক বায়োলজি গবেষণা নাকি শুধু কিছু ফার্স ওষুধ তৈরির জন্য আমুর ফ্যালকনের ঠোঁট আর চোখের খুব দাম হয়েছে বাজারে। যেমন গন্ডারের শিঙ্গের গুঁড়ো দুধে মিশিয়ে খেলে পৌরুষ অটুট থাকে বলে অনেকের ধারণা। এই সমস্ত ব্যাপারে বাসু বিশ্বাস করে না। কিন্তু নকল খবরগুলো কখনও কখনও কিছু কিছু পশুপাখির মার্কেট চড়িয়ে দেয়। সেইভাবেই গত পাঁচ বছর ধরে আমুর ফ্যালকনের চড়া বাজার যাচ্ছে আন্ডারগ্রাউন্ডে।
‘পাখিটাকে আপনি প্রথম কবে দেখেছিলেন?’
‘মে–এর গোড়ার দিকে। তবে তার আগেই শুনেছিলাম পাখিটার কথা। এপ্রিলের মাঝামাঝি নাগাদ আমার বড় নাতনি পাংটি থেকে ফোন করে জানিয়েছিল সে একটা পাখি পুষেছে। তারপর থেকে যখনই সে ফোনে কথা বলত একবার না একবার পাখিটার কথা বলতই। এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে আমার তিন নাতিনাতনীসহ মেয়ে জামাই–এর আসার কথা ছিল কোহিমাতে। বড় নাতনী বলেছিল, পাখিটাকে সে নিয়েই আসবে। সে পাখি নাকি এতই পোষ মেনেছে যে শিকল ছাড়াই তার কাঁধে মাথায় বসে থাকে।
ওদের আর কোহিমা আসা হয়নি। রাস্তায় গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট করে… পাঁচজনেই স্পট ডেড। খবরটা আমার প্রথমে বিশ্বাসই হয়নি। যে ছেলে বেহেড মাতাল অবস্থাতেও অন্ধকার রাতে পাহাড়ি বাঁকে বাইক ছুটিয়ে পুলিশের সঙ্গে কার রেসিং–এ জিততে পারে; সেই ছেলে দিনেদুপুরে পাংটির রাস্তায় গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট কীভাবে করে?
খাড়াই পাহাড়ের অনেক নিচে পড়ে বডিগুলো একদম তালগোল পাকিয়ে গেছিল। মুখগুলো প্রায় চেনাই যাচ্ছিল না। তবুও কবর দেওয়ার সময় আমি দেখেছিলাম, ওয়াংখে মানে জামাইয়ের চোখ দুটো কেউ যেন গেলে দিয়েছে।
ওদের শেষকৃত্য করে আমরা পাংটিতে ফিরে আসি। তখনই খেয়াল করি পাখিটাকে। ওটা এই ঘরের মধ্যে কড়িকাঠের উপরে বাসা বেঁধেছে, সদ্য পাঁচজনকে শিকার করে গর্বে যেন ফেটে পড়ছিল।’
দশরথ থামল কিছুক্ষণের জন্য। বাসু কল্পনাবিলাসী নয়। তবু তার মানসচক্ষে একটা দৃশ্যপট ভেসে উঠল। একটা গাড়ি দ্রুতগতিতে ছুটে চলেছে পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে ঘুরে ঘুরে। শীতল হাওয়ার থেকে বাঁচতে সবকটা কাচ তোলা। এক যুবক নিজের পরিবারের সঙ্গে হেসে হেসে গল্প করতে করতে গাড়ি চালাচ্ছে। পাশের সিটে বসে বৌ চিপস বা বিস্কুট এগিয়ে দিচ্ছে মাঝে মাঝে। পিছনের সিটে তিনটে ছোট ছেলে মেয়ে আর একটা আমুর ফ্যালকন।
নাহ, ব্যাপারটা অবাস্তব কিছুই নয়। বন্ধ গাড়ির মধ্যে ছোট ছেলেমেয়েদের খোঁচাখুঁচিতে অস্থির হয়ে পাখিটা উড়ে গিয়ে উইন্ডস্ক্রিন জুড়ে ডানা ঝাপটাল। যুবক সজোরে ব্রেক চিপল। সামলে নেবার আগেই পাখিটা উইন্ডস্ক্রিন থেকে ছিটকে এল যুবকের মুখের উপর। হতচকিত ভয়ার্ত পাখির নখ সোজা বিঁধে গেল চোখে। হাতের স্টিয়ারিং ঘুরে গেল। সরু পাহাড়ি রাস্তা ছেড়ে গাড়ি সোজা…
বাসুর পেটের ভিতরটা কেমন পাকিয়ে উঠল। নিজের তার হাতের মুঠি বোধহয় শক্ত হয়ে উঠেছিল বাজপাখিটার ছোট্ট শরীর ঘিরে। একটা শক্ত ঠোক্কর খেয়ে চমকে উঠে সে হাত আলগা করল।
উফ্, এক ঠোক্করেই ব্যাটা রক্ত বার করে দিয়েছে। বাসু একবার আড়চোখে তাকাল দশরথের দিকে। দশরথ ঘটনাটা দেখেনি। বাসুর দিকে হুইল চেয়ারের পিঠটা ফেরানো। বুড়োটা আগুনের একদম সামনে গিয়ে বসেছে।
বাসু কটমট করে পাখিটা একবার দেখে নিয়ে, পকেট থেকে রুমাল বার করে আঙুলে জড়ালো। বুড়োটা দেখে ফেললে আবার কাজটা যদি ফিরিয়ে নেয়। দশ দশ কুড়ি লাখ টাকা একটা পাখি মারার জন্যে, ভাবাই যায় না।
বাসু একটা সিগারেট ধরালো। হাত সরিয়ে নেয়া সত্ত্বেও পাখিটা তার কোল ছেড়ে উড়ে যায়নি।
দশরথ আবার বলতে শুরু করেছেন।
মেয়ের পরিবারকে দিয়ে শুরু। ওই ঘটনার পরে আমাকে কোহিমা ছেড়ে পাংটিতে চলে আসতেই হল। ব্যাবসা সামলাতে হবে তো। মে মাসের গোড়ার দিকে আমরা এলাম এই বাড়িতে। সঙ্গে আমার ছেলের ঘরের একমাত্র ছেলে, বিটুন, ওর মা মানে আমার পুত্রবধূ। আর, বিটুনের মামা, টুন্ডলা, কোহিমায় কলেজ স্টুডেন্ট ছিল। ব্যাবসা সামলানোর জন্যে আমার সঙ্গে পাংটি চলে এল। বাড়িতে পা রাখতেই প্রথম যা চোখে পড়ল তা ওই পাখি। এই ঘরের কড়িকাঠে পাখি তখন বাসা বেঁধেছে। আমার নাতির পাখিটাকে বেশ ভালো লেগে গেল। নিজে হাতে খাওয়াত। তখনও পাখিটাকে নিয়ে আমাদের মনে কোনওরকম সন্দেহ দানা বাঁধেনি।
জুন নাগাদ টুন্ডলা ব্যাবসাটা দেখা শুরু করল। আজকালকার ছেলে তায় ইংলিশ জানে। ব্যাটার মাথা খুব সাফ। মাস গড়াতে পেল না সব ঘোঁতঘাত বুঝে নিয়ে, নিজের কাঁধে তুলে নিল ব্যাবসার দায়িত্ব।
জামাই মারা যাওয়ার পর থেকেই ব্যাবসায় সমস্যা দেখা দিতে শুরু করেছিল। পাখিমারারা ভয়ে ভয়ে কাজ কমিয়ে দিচ্ছিল। কিন্তু টুন্ডলা খুব বুদ্ধিমান ছেলে। সে ঠিকই সবাইকে বুঝিয়েসুঝিয়ে আবার কাজে লাগল। তখন অবশ্য ওসেনবোরোর সময় নয়। কাঠের কাজই চলছিল। আর টুকটাক পাখি ধরার কাজ। অবশ্য আমার গুদামে ওসেনবোরো ছাড়া অন্যান্য পাখির কাজ তেমন হয় না।
বর্ষার তিনটে মাস ভালোই কেটে গেল। কাঠের ব্যাবসাও ভালোই চলল। টুন্ডলার দৌলতে টুকটাক জানোয়ারের লটও ঢুকেছিল সেবারের বর্ষায়। তিনটে স্নো–লেপার্ড আর খানআষ্টেক হাতির পা, দাঁত ইত্যাদি। ভাবছিলাম নতুন করে পোচিং–এর ব্যাবসাটা আবার শুরু করব কি না? টুন্ডলার মতো একটা চালু মাথার ছেলে থাকলে…
সেপ্টেম্বরের শেষাশেষি আবার গাছে গাছে ওসেনবোরোর মেলা বসল। জামাই মারা যাওয়ার জন্যে যে একটা ভয় ছড়িয়েছিল নাগাদের মধ্যে সেসব টুন্ডলার সামনে টিকতে পারল না। সেপ্টেম্বর এন্ড উইকেই টুন্ডলা যে পরিমাণ পাখি ধরল তাতে আমি বুঝে গেলাম গতবারের চেয়েও এবারের ব্যাবসা বেশি হতে চলেছে।
সেদিন টুন্ডলা জনাদশেক নাগাকে নিয়ে রাতের বেলা হিসাব মেটাচ্ছিল গুদামে। আশপাশের গ্রামের যাদের ব্যাবসার বরাত দেওয়া থাকে সেরকম দশজন এসেছিল। বড় বড় পাখির লট নিয়ে। সেদিন গুদাম ভরতি ছিল সদ্য টিউনিং করা কাঠ। শুকনো কাঠের গায়ে একধরনের কেমিক্যাল লাগিয়ে সেগুলোকে পশ্চিমবঙ্গে পাঠাই আমরা। একে কাঠ দাহ্যপদার্থ, তায় ওই কেমিক্যালটাও। তাই গুদামে আমি বড় বড় ইলেকট্রিক লাইট আর জেনারেটরের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম। লম্ফ, হ্যারিকেন ঢুকতে দিতাম না।
সেদিন রাতে খেয়েদেয়ে আমি বারান্দায় বসেছিলাম। মাত্র দশ–বারো মিটার দূরে গুদামে সবার সঙ্গে হিসাব মেটাচ্ছে টুন্ডলা। জেনারেটর চলছে। আলোয় আলো চতুর্দিক। বিটুনের মা আর কাজের মেয়েটা ছাতা মাথায় খাবার নিয়ে গেল টুন্ডলার জন্য।
ঘটনাটা ঠিক কী ঘটল জানি না। দেখলাম পাখিটা উড়ে গিয়ে বসল জেনারেটরের উপর।
কয়েক সেকেন্ড কি খুটখাট করল, আচমকাই আমার চোখের সামনে বার্স্ট করল জেনারেটরটা। গুদামের মধ্যে আগুন আর তেলের একটা গোলা ছুটে গেল…
দশরথ অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইল। ঘরের মধ্যে একটা শীতল নিস্তব্ধতা খেলা করে বেড়াচ্ছিল। বাসুর মনে হল, সে যেন ঘটনাটা দেখতে পেল। পাখিটা বাসা বাঁধার জন্য খড়কুটো জোগাড় করছে। জেনারেটরের একটা খোলা তার ঠোঁটে করে টানাটানি করছে। মুহূর্তে শর্ট সার্কিট আর…
বাইরে ঠান্ডা হাওয়ার তোলপাড় আর কাচের দরজা জানলার খক খক শব্দটা যখন প্রায় অসহ্য উঠল তখন বাসু হালকা গলা খাঁকারি দিল, ‘তারপর?’
‘কেমিক্যালের ড্রামগুলো গুদামের মধ্যেই ছিল। কতগুলো বিস্ফোরণ হয়েছিল আমার মনে নেই। পরের সারাদিনেও আগুন নেভানো যায়নি। বৃষ্টির মধ্যেও আগুন জ্বলছিল একভাবে। পাখিটা পালিয়েছিল। বাড়ির ত্রিসীমানায় ছিল না। আমি বন্দুক নিয়ে পাখিটাকে খুঁজছিলাম। সেদিন গুদামে মারা গিয়েছিল তেরো জন। দশটা নাগা ছেলেমেয়ে, বাড়ির কাজের মেয়ে, বিটুনের মা আর টুন্ডলা।
ঠিক কুড়ি দিনের মাথায় সকালবেলা একটা ডাকাডাকি শুনে আমার ঘুম ভাঙ্গল। সোগান, আমার সবসময়ের কাজের লোক, বিটুনকে বকাবকি করছে। বারান্দায় গিয়ে দেখি এই অমঙ্গুলে পাখিটা। বিটুনের হাতে বসে আছে। সোগান পাখিটাকে কেড়ে নেবার চেষ্টা করছে কিন্তু বিটুন কিছুতেই দেবে না। আমি এক মুহূর্ত দেরি না করে ঘর থেকে বন্দুক নিয়ে এসে বারান্দা থেকেই পাখিটাকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়লাম। মাত্র পাঁচ গজ! মাত্র পাঁচ গজ দূর থেকে আমি পাখিটাকে গুলি লাগাতে পারলাম না। গুলিটা… গুলিটা গিয়ে লাগল… বিটুনের মাথায়…’
এবারের নিস্তব্ধতাটা দশরথ নিজেই ভাঙ্গল। ‘তোমার কি এখনও মনে হয় এগুলো সবই অ্যাক্সিডেন্ট ছিল?’
বাসু হ্যাঁ–না কিছুই বলল না। এগুলো অ্যাক্সিডেন্ট ছাড়া আর কি? কিন্তু সেকথা এই বৃদ্ধকে বলা না বলা সমান। একবার ঘড়িটা দেখে নিল। বেশ রাত হয়ে গেছে। বাইরে হাওয়ার তেজ ক্রমেই বাড়ছে। তবু গল্পটার শেষ জানা দরকার।
‘স্যার।’ বাসু বলে উঠল। তার হাতের আঙুলগুলো আবারও খেলা করছে পাখিটার গলার নরম পালকে। ‘আপনি তো কাউকে একজনকে ডেকেই পাখিটাকে মেরে দিতে পারতেন। একশো, দুশো, নাহয় পুরো হাজারই ধরলুম। ওই ক–টা টাকাতেই যে কেউ রাজি হয়ে যেত।’
‘তাই মনে হয় তোমার?’ দশরথ বলল, ‘অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহে বিটুনকে কবর দেওয়ার পরের দিনই আমি গ্রামে গ্রামে খবর পাঠিয়েছিলাম। কেউ যদি এসে পাখিটাকে মারে। দর বাড়িয়ে বাড়িয়ে লাখ অবধি উঠেছিলাম। কোহিমা থেকে দুজন পাখিমারা এসেছিল। পাখিটা ধরে নিয়ে গিয়েছিল। তারপরে টাকা নিতে ফিরে আসেনি। শুনেছি অত্যন্ত বীভৎসভাবে নাকি মরেছে দুজনেই। আর কেউ এগিয়ে আসেনি। আর আমিও কাউকে ভার দিতে রাজি হইনি। দু–মাস। তোমার জন্যে দু–মাস অপেক্ষা করেছি। বুঝেছ?’
বাসু ঘাড় নাড়ল। এক লাখ টাকাতেও কেউ রাজি হয়নি একটা পাখি মারতে! গুজবটা মারাত্মক ছড়িয়েছে তার মানে। এক লাখ টাকাটা ওই বুড়োর কাছে হাতের ময়লা হলেও এই অঞ্চলের লোকের কাছে জীবনতুল্য। এখন বুড়োটা ভয়ের চোটে কুড়ি লাখ পর্যন্ত খরচ করতে রাজি হয়ে গেছে। অবিশ্বাস্য বটে! কুড়ি লাখের অর্ধেক দিলেও শুধু কোহিমা কেন নাগাল্যান্ডের যে কোনও প্রান্তের পাখিমারা কী পোচাররা এগিয়ে আসবে। তাহলে বুড়ো খুঁজে খুঁজে তাকে কেন ডেকে এনেছে?
‘ওই পাখিটা… জানো তো ওসেনবোরোরা হিমালয়ের ওপার থেকে আসে। দেওতার পাখি… দেওপাখি… যে ঠিক গুনে গুনে চব্বিশজনকে মেরেছিল পাপকে পৃথিবী ছাড়া করতে।’ বিড় বিড় করল দশরথ।
এই নাগা উপকথাটা বাসু জানে। বহুযুগ আগে নাগারা এনিনাম আর ওসেনবোরো দুই প্রজাতির পাখিই খেত। একদিন হিমালয় পেরিয়ে আসা স্বর্গের পাখিরা মানুষের এই অপরিসীম হিংস্রতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। যুদ্ধ করে চব্বিশটা জনগোষ্ঠীর নেতাকে তারা ছিন্নভিন্ন করে দেয়। সেদিন থেকে ওসেনবোরোদের মারা মানা। প্রাচীন লোককথা। বাসু হাসল, ‘পুরোনো সব গল্পকথা।’
‘কিন্তু বাস্তবের উপরেই ভিত্তি করে।’ দশরথ বলে উঠলেন। ‘তোমাকে খবর দেবার পর পরে সোগান নিজেই পাখিটাকে ধরার চেষ্টা করছিল। ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করে, কড়িকাঠে উঠে…’
বাসুর ভুরু দুটো কুঁচকে গেল। সোগান কীভাবে মারা গেছে, সে জানে। উঁচু জায়গা থেকে পড়ে স্পাইনাল কর্ড ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গেছিল। জনহিবোটূ–র হাসপাতালে বেঁচে ছিল দু–দিন। তার মানে ওই কড়িবরগা থেকেই।
বাসু মানস চক্ষে দেখতে পেল, গাছে চড়ায় ওস্তাদ সোগান টিকটিকির মতো কাঠের প্যানেলিং, দেওয়ালের খাঁজ, জানালার গোবরাটে পা রেখে রেখে উঠে যাচ্ছে একদম উপরে। দেড়তলা সমান উঁচু কড়িবরগায় বসে আছে পাখিটা। সোগান মন্ত্রমুগ্ধের মতো কড়িকাঠ বেয়ে বেয়ে পাখিটার কাছে এগিয়ে গেল। রোগা রোগা হাত বাড়িয়েছে পাখিটাকে ধরবে বলে, আর পাখিটা আচমকাই ডানা ঝটপট করে উড়ে পালাতে চাইল। সোগান পাগলের মতো দু–হাতে চেপে ধরল পাখিটার ডানার অংশ… আর পা পিছলে সোজা সিমেন্টের মেঝেতে আছড়ে পড়ল সোগানের ক্ষয়াটে দেহটা।
বাসু একটা ঢোঁক গিলল। শুকনো গলায় একটা অদ্ভুত খট আওয়াজ উঠল।
তার মানে ফ্যালকনটা সত্যিসত্যি বাইশ জনের মৃত্যুর জন্য দায়ী। বুড়ো অবশ্য নিজের নাতিকে নিজেই খুন করেছে। দায়টা ফ্যালকনের ঘাড়ে চেপেছে। তবু ধরতে গেলে ভয়ে আতঙ্কেই হোক কি দুর্ঘটনায়, ফ্যালকনটা একুশ, বাইশটা মানুষের মৃত্যুর জন্যেই দায়ী। এটাও একটা অবিশ্বাস্য সংখ্যা। এতক্ষণে একটা পাখি মারার জন্যে কুড়ি লাখ খরচ আর তাকে ডেকে আনার ব্যাপারটা স্পষ্ট হল বাসুর কাছে। লোককথায় আছে চব্বিশ জনের কথা। বাইশ জন মারা গেছে। আরেক জন মরলেই হয়ে যায় তেইশ। বাকি থাকে শুধু বুড়ো। তাই ভয়ের চোটে বুড়ো পূর্ব ভারতের সবথেকে পেশাদার আর দক্ষ লোকটাকে খুঁজে বার করেছে।
ফায়ারপ্লেস থেকে বিজ বিজ করে কাঠ পোড়ার শব্দ আসছে। ‘বিটুনের ঘটনার পর থেকেই… মানে আমি ভাবছিলাম… ওটা কী…’
‘দেওপাখি!’ বুড়োকে কথা শেষ করতে দেয় না বাসু।
‘হুম। হয়তো দেওতারা ওটাকে পাঠিয়েছে আমাকে…’
‘শাস্তি দেওয়ার জন্য।’
‘আমি জানি না। আমি কিছুই জানি না। শুধু এটা জানি যে দু–মাস আগে আমার সব কিছু ছিল। আমার বিশাল ব্যাবসা, মেয়েজামাই, পুত্রবধূ, নাতি, নাতনি, ভরা সংসার… মাত্র তিন মাসে সব শেষ হয়ে গেছে। সব। এখন আমি… দশরথ বিঠাং… একটা পাখিকে ভয় পাচ্ছি। পাখি। যে বউটা আমাকে এখন রান্না করে দিয়ে যায় সেই বলছিল… ওটা… ওটা একটা দেওপাখি… অবশ্যই… অবশ্যই বউটা লোকাল। পাংটির সবাই খুব ভয় পেয়ে আছে। তুমি যাও পাখিমারার হাটে, দেখবে শুনশান, কেউ নেই। অথচ এই কথা নভেম্বর মাসে বসে কেউ ভাবতে পারে?’ বুড়োটা ফ্যাকাশেভাবে হাসল, সামান্য কেঁপেও উঠল। ‘আমি চাই ওটাকে তুমি মারো। গত সাত–আট মাস ধরে ওটা এই বাড়িতে থানা গেড়ে বসে আছে। আজকাল মনে হয় ওটা ঠায় আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। যেন মনে হচ্ছে… অপেক্ষা করছে। প্রত্যেকদিন, প্রত্যেকদিন আমি নিজেকে ঘরে বন্ধ করে ঘুমাই। তবু, তবু প্রত্যেকদিনই আমার মনে হয়; আজকে আমার ঘুম ভাঙ্গবে তীব্র আগুনের বেড়াজালে। হয়তো… হয়তো কোনওদিন বাজপাখিটা এই বাড়িটাতেও আগুন ধরিয়ে দেবে… আমি ঘুমন্ত অবস্থাতেই… পুড়ে ছাই হয়ে যাব।’
তীব্র হাওয়া একাকী পাক খাচ্ছিল বাড়িটা ঘিরে। পাথরের ফায়ারপ্লেসের মধ্যে দিয়ে একটা তীব্র শিষের মতো আওয়াজ তুলে ঢুকে আসছিল ঘরটার মধ্যে। বাসুর কেমন যেন মনে হল, একটা বিশাল বাজপাখি দানবাকার পাখার ঝাপটা তুলে বাড়িটা ঘিরে ঘুরপাক খাচ্ছে আর তার তীব্র হাহাকারের শব্দ ভেসে আসছে ফায়ারপ্লেসের মধ্যে দিয়ে। সন্তান হারানোর হাহাকার। লক্ষ লক্ষ সন্তান হারানোর হাহাকার…
বাসু টেবিলে রাখা বোতলটা থেকে কয়েক ঢোঁক খেয়ে বিশ্রী চিন্তাটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে চাইল। সন্ধে থেকে এই প্রথম।
‘তোমার খোঁজ আমি পেয়েছিলাম সোগানের থেকে। ও–ই বলেছিল তোমাকে ডেকে পাঠাতে। তোমার নাম বলল, কালোবাজ।’
‘হ্যাঁ। লোকে আমাকে ওই নামেই ডাকে।’
‘হু। সোগান বলছিল তোমাকে নাকি কখনও ধরা যায় না। তুমি ক্ষিপ্র, তীব্র, নিজের শিকারের প্রতি অবিচল… শিকরেবাজ–এর মতোই।’
বাসু হুইল চেয়ারে বসা বুড়োটার দিকে তাকাল। হঠাৎই তাঁর লম্বা লম্বা শক্ত আঙুলগুলো পাখিটার গলার চারপাশে চেপে বসল।
‘আপনি চাইলে আমি এক্ষুনি।’ ভীষণ শান্ত গলায় বলল বাসু। ‘জাস্ট দুই আঙুলের একটু ঝটকা।’
‘না।’ বুড়োটা যেন চিৎকার করে উঠল। একটা লম্বা তীব্র শ্বাস টানল। ‘না। এখানে নয়। আমার সামনে নয়।’
বাসু হাসল। ঠান্ডা শীতল হাসি। আঙুলগুলো শিথিল হল আবার পাখিটার গলার নরম পালকে ধীরে ধীরে বিলি কাটতে লাগল। ‘ওকে।’ বাসু বলল, ‘আমি কাজটা নিচ্ছি। আপনি কি বডিটা চান?’
‘না না। ওটাকে মেরে কোথাও একট পুঁতে দাও। না, পুঁতো না। জ্বালিয়ে দাও। পুড়িয়ে ফেল।’ বুড়োটা থামল। হুইল চেয়ারের হাতল চেপে সামনে ঝুঁকে এসেছে। গলার স্বর নামিয়ে অদ্ভুত ফিসফিসে স্বরে বলল, ‘এক কাজ করো। ওই মাথাটা। ওই মুকুট পড়া মাথাটা আমাকে দেখিয়ে যেও। যাতে আমি ওটাকে নিজের হাতে আগুনে পোড়াতে পারি।’
***
বাসু তার পুরোনো টাটা সুমোটা চালাচ্ছিল। এমনিতে সে যে কোনও জায়গায় যেতে নিজের হান্ড্রেড সিসির বুলেটটাকেই বেশি ভালোবাসে। কিন্তু পাহাড়ি রাস্তায় শীতকালে গাড়িই ভালো।
এসব অঞ্চলে হঠাৎ হঠাৎ টেম্পারেচর নেমে যায়। শুধু সাবজিরো টেম্পারেচারই নয়। রাত বাড়লেই মারাত্মক ঝোড়ো হাওয়া বয় বছরের এই সময়টা। সবদিক ভেবে চিনতে বাসু গাড়িটাকেই এনেছে আজকে।
পাহাড়ের পাকদণ্ডী বেয়ে গাড়িটা ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছে। পাহাড়ের অনেক নিচে দোয়াং নদীর ঝিম ঝিমে বহতা জল যেন উত্তরোত্তর বেড়ে চলা শীতের সঙ্গেই সঙ্গত করে চলেছে ক্রমান্বয়ে।
দশরথের বাড়ি থেকে সে বেরিয়েছে প্রায় পৌনে দশটা নাগাদ। এক টুকরো ক্ষীণ একাদশী চাঁদ আকাশের একপাশে লটকে ছিল। নভেম্বরের শীতের ঝোড়ো হাওয়া কেটে কেটে বসছিল বাসুর শরীরের খোলা অংশগুলোয়। অন্যান্য কাচগুলো বন্ধ তবে সামনের দুটো জানালার কাচ নামিয়েই বাসু গাড়িটাকে প্রায় ষাটে ছোটাচ্ছিল।
এই ভালো। এই বরফের সুচের মতো তীব্র ঠান্ডা হাওয়া। বাসু যখন দশরথের বাড়ি থেকে বেরিয়ে গাড়িতে বসল তখনই কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছিল ওর। ওই হলদেটে বৃদ্ধত্ব আর মৃত্যুর একটা অস্বাভাবিক গন্ধ যেন জামাকাপড়ের ভাঁজে ভাঁজে ঢুকে গেছে বলে মনে হচ্ছিল বাসুর। এই ভালো। এই তীব্র ঠান্ডা হাওয়ায় অন্তত বুক ভরে শ্বাস নিতে পারছে সে। পাহাড়ি হাওয়াটা ওই হলদেটে গন্ধটাকে ধীরে ধীরে মুছে দিচ্ছে।
আরও খানিকক্ষণ গাড়িটা চালানোর পরে বাসু একটা ছোট ব্রিজ পার হল। আরও মিনিট দশেক পরে পেরিয়ে গেল শেষ বস্তিটা। ছোট ছোট কাঠ আর প্লাস্টিকের চাদরে ঘেরা ঝুপড়িগুলো এখন দূর পাহাড়ের মতোই নিস্তব্ধ। সুমোর হেডলাইট ছাড়া কোথাও এক টুকরো আলো নেই আশপাশে।
গাড়ির বাইরে নদীর মতো মেঘের স্রোত বয়ে যাচ্ছে। হেডলাইটের জোরালো আলোতেও খুব বেশি দূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। দু–তিনটে বাঁক পরপর কাটানোর পরে বাসু গাড়ির গতিটা আরও একটু বাড়িয়ে দিল। আশি ছুঁই ছুঁই হল স্পিডোমিটারের কাঁটা।
বাসু একবার আড়চোখে পাশের সিটের থলেটার দিকে তাকাল। একটা চটের থলে, মুখটা শক্ত করে নারকেল দড়ি দিয়ে বাঁধা। পাখিটা বিশেষ ছটফট করছে না। যখন বাসু যখন ওটাকে থলেতে ভরছিল তখনও বেশি ঝামেলা করেনি। একদম যেন পোষমানা পাখি। ওটা যেন বুঝতে পেরেছে যে বাসু ওকে বেশ পছন্দই করেছে। বাজপাখি, একাকী, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, শিকারের প্রতি অবিচল লক্ষ্য। বাসুর মতোই এই পাখিটাও।
অদ্ভুত সুপারি! বাসুর মনে ভাবনাটা খেলে গেল, সঙ্গে সঙ্গে, কাজটাকে সে অন্যান্য কাজের মতোই সিরিয়াসলি নিতে পারল কী করে এই ভেবে সে একটু অবাকও হল। এটা কি একটা খুন হল! পাখিমারা! আর সবকিছুর মধ্যে সবথেকে অদ্ভুত ব্যাপার হল পাখিটাকে তাঁর ভালো লেগেছে। কেমন একটা একাত্মতা বোধ করছে সে।
বাইশটা মানুষের রক্ত পাখিটার ডানায় লেগে। বাইশ! ঠিক যেন বাইশটা সিঁড়ি পার করে দুজনেই একটা চাতালে দাঁড়িয়ে আছে। সামনে আরও অসংখ্য সিঁড়ি উঠে গেছে। বাসুকে এখনও ডিঙ্গিয়ে যেতে হবে ওই সিঁড়িগুলো। ওই বাজপাখিটাকে সে সিঁড়ি চড়ার কষ্ট থেকে মুক্তি দিয়ে দেবে আজকেই।
জনহিবোটুতে একজনের বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করে রেখেছে সে। মাঝ রাস্তায় কাজ শেষ করে দেবে সে। মুণ্ডুটা আগামীকাল কারোর হাত দিয়ে প্যাকেট করে পাঠিয়ে দেবে বুড়োর কাছে। নয়তো নিজেই নিয়ে যাবে।
ওখা পেরিয়ে জনহিবোটু যাওয়ার মাঝ রাস্তাতেই পড়বে বিখ্যাত পাখিমারার হাট। বুড়োটা বলল গত দু–মাস নাকি হাট বসেইনি। কয়েকজন পাখিমারা শুধু লুকিয়েচুরিয়ে আলাদা করে পাখির মাংস বেচছে। আগে যে কেজি কেজি বিভিন্ন জাতের পাখির মাংস বিক্রি হত, তা প্রায় বন্ধ।
বাসু ঠিক করেছে কাজটা সে ওই মাঠেই শেষ করবে। এর আগেও সে ওখার পাখিমারার হাট থেকে কেজি কেজি মাংস কিনে নিয়ে গেছে। রাস্তা সে চেনে। অবশ্য পাহাড়ের ঢালে গাড়ি রেখে পায়ে চলা পাকদন্ডী বেয়ে নেমে যেতে ষাট–সত্তর ফিট। তবু ঠিক আছে।
মাঠের মাঝখানে একটা বিশাল জারুল গাছ আছে। বাসু ভেবে রেখেছে ওই জারুল গাছে পাখিটার ধড়টা টাঙ্গিয়ে দেবে। রক্ত দিয়ে লিখে দেবে ‘ওসেনবোরো খতম’।
কথাটা মনে মনে ভাবতেই বাসুর হাসি পেল। লোকে ভাববে কোনও পেল্লায় গুণীনের কাজ নির্ঘাত। কাল থেকে আবার পাখিমারার হাট বসবে।
পাখিটার প্রতি মনে মনে এতটা প্রতিদ্বন্দ্বিতা অনুভব না করলে, বাসু বোধহয় এতটা নৃশংস হত না। কে বলতে পারে হয়তো পাখিটাকে সে যত্ন নিয়েই কবর দিত। পাখিটার আত্মার জন্যে একটু প্রার্থনাও করত। কিন্তু পাখিটা তার সঙ্গে একই সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আছে। বাসুর মনের মধ্যে অদ্ভুত এক প্রতিহিংসা ছড়িয়ে পরল। ওসেনবোরোর অভিশাপ শেষ হয়ে যাবে আজকে রাতে। কাল সকালে নাগাদের বস্তিতে বস্তিতে খবরটা ছড়িয়ে পরলেই ছেলেবুড়ো সবাই আবার পাখি শিকারে বেরিয়ে পরবে।
এইসব ভাবতে ভাবতেই গাড়ি ছোটাচ্ছিল বাসু। কুয়াশা চিরে নীলরঙ্গা গাড়িটা উড়ে যাচ্ছিল। আর একটু পরেই পাখিমারার মাঠ। ঠিক তখনই বাসুর চোখের একদম সামনে ড্যাসবোর্ডের উপরে এক্কাদোক্কা খেলার ভঙ্গিমাতে হেঁটে এল বাজপাখিটা। উদ্ধত ভঙ্গিতে মাথা উঁচিয়ে। ডানা ছড়িয়ে উইন্ডগ্লাস আটকে।
‘হুস, হুস।’ বাসু হিসিয়ে উঠল। চকিতে একবার পাশের সিটটা দেখে নিল। থলেটা খালি পড়ে আছে দলা পাকিয়ে। থলেটার পাশে একটা আঁচড়ে আঁচড়ে… অথবা শক্ত ঠোঁটে কামড়ে কামড়ে বানানো বড় একটা ফুটো।
বাসু ঝট করে মাথা তুলে সামনের দিকে তাকাল। পাখিটা সম্পূর্ণ রক্তরঙা ডানাদুটো তার চোখের সামনে মেলে ধরে ঝাপটাল। বাঁকানো তীক্ষ্ম ঠোঁটটা এসে আছড়ে পড়ল বাসুর ঠিক কপালের মাঝখানে।
বাসু চমকে গিয়ে পিছু হটল। স্টিয়ারিঙ–এ রাখা হাতদুটো ক্ষণিকের জন্য নিয়ন্ত্রণ হারাল। সুমোর চাকাটা দ্রুত ঘুরে গেল।
বাসু এক হাতে স্টিয়ারিংটাকে সজোরে আঁকড়ে ধরে অন্য হাত দিয়ে বাজপাখিটাকে ছুড়ে ফেলতে চাইল উইন্ডস্ক্রিনের সামনে থেকে। এটার জন্য বাসু সামনের রাস্তা কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। পাখিটা আবারও ডানা ঝাপটাল কিন্তু সামনে থেকে নড়ল না। বাসু আবারও হাত বাড়িয়ে ডানাদুটো চেপে ধরার চেষ্টা করল। বাসুর সামনে থেকে সরে যাওয়ার বদলে পাখিটা সোজা ঝাঁপিয়ে পরল বাসুর মুখের উপর।
বাসুর ডান পাটা সজোরে ব্রেক চেপে ধরল। চাকা গড়িয়েই চলেছে। ব্রেক কী আটকাচ্ছে না! কেন? আর কিছু ভাবতে পারল না বাসু। বাজপাখিটা এখন ওর মুখের উপরে। বড় বড় ডানা আর লেজের ঝাপটায় বাসুর চোখের দৃষ্টি অন্ধ হয়ে গেছে। ধারালো নখে বাসুর গালদুটোকে খামচে ধরেছে পাখিটা।
বাসু পাগলের মতো স্টিয়ারিং থেকে হাত সরিয়ে পাখিটাকে চেপে ধরল। আপ্রাণ চেষ্টা করছিল ওটাকে টেনে তোলার। তীব্র যন্ত্রণায় বাসুর মনে হল তার মুখের চামড়া যেন খুলে চলে আসবে পাখিটার সঙ্গে সঙ্গে।
হঠাৎই রাস্তাটা হারিয়ে গেল। গাড়িটা শূন্যে উড়াল দিল কয়েক ফিট। বাসুর শরীরটাও আচমকা সিট ছেড়ে শূন্যে উড়তে চাইল, কিন্তু সিটবেল্টের দৌলতে আঁটকে রইল নিজের জায়গাতেই। পরক্ষণেই মারত্মক একটা ঝাঁকুনিতে বাসুর মুখের উপর থেকে বাজপাখির শরীরটা সরে গেল। এক ঝলকের জন্য বাসু দেখতে পেল, তার গাড়িটা নিচের দিকে মুখ করে সজোরে গড়িয়ে পরছে, তার দিকে ধেয়ে আসছে পাখিমারার মাঠ।
জ্ঞান হারাবার আগে বাসু যা শুনতে পেল তা হল বাজপাখির তীব্র শিষের শব্দ। যেন কয়েক লক্ষ বাজপাখি একসঙ্গে হাহাকার করে উঠছে।
গাড়িটা সশব্দে এসে আছড়ে পড়ল পাহাড়ের মাঝের ছোট্ট চাতালের মতো জায়গাটায়। জমাট অন্ধকার নেমে এল।
***
চাঁদটা আকাশের গা বেয়ে নেমে এসেছে অনেকটা। দিকচক্রবালের খানিক উপরেই ঝুলে আছে। আর ঘণ্টাখানেক বাদেই ভোর হবে।
টাটাসুমোটা অদ্ভুতভাবে ঠিক চার চাকাতেই ল্যান্ড করেছে মাঠের মাঝখানে। একটা হেডলাইট তখনও দপদপ করছে। উইন্ডস্ক্রিনটা গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে ইঞ্জিনের উপরে, গাড়ির ভিতরে, সিটে, বাসুর জামাকাপড় মুখেও…
বাসু কষ্ট করে চোখ খুলল। আবছা ধোঁয়া ধোঁয়া ভাবটা কেটে যাওয়ার জন্য একটু সময় নিল বাসু। পরক্ষণেই বুঝতে পারল ওটা আসলে কুয়াশা। গুঁড়ি মেরে উঠে আসছে গাড়িটাকে ঘিরে। তাও হেডলাইটের আলোয় ছেঁড়া ছেঁড়ে কুয়াশার মধ্যে দিয়ে সে স্পষ্ট দেখতে পেল জারুল গাছটাকে। পাখিমারার মাঠ।
বাসু এবার নড়ে বসার চেষ্টা করল।
পায়ে কোনও সাড় নেই।
নিচের দিকে তাকাল সে। এঞ্জিনের খানিকটা অংশ তুবড়ে ভেঙে ঢুকে এসেছে গাড়ির মধ্যে। বাম পা–টা গিয়ার বক্স আর এঞ্জিনের মধ্যে জট পাকিয়ে গেছে। ডানপায়ের পাতাটাও গাড়ির তলার দিকে কোথাও হারিয়ে গেছে। পা দুটো ছড়িয়ে গেছে দু–পাশে। বিশ্রীভাবে পা ফাঁক করে বাসুর অবশ শরীরটা এলিয়ে বসে রইল ভাঙা গাড়ির মধ্যে।
বাইরে থেকে একটা অদ্ভুত আওয়াজ ভেসে এল। বাচ্চার কান্নার মতো। শব্দটা বহু সহস্রবার শুনলেও এই মুহূর্তে বাসুর হৃৎপিণ্ডটা একবার ধড়াস করে উঠল। মনে মনে নিজেকে থাপ্পড় মারল বাসু। ছিঃ! শেষমেশ শকুনের কান্না শুনে…
পরক্ষণেই বাসু আর কিছুতেই নিজেকে সামলাতে পার না। লম্বা লম্বা লাফ দিয়ে ছুটতে শুরু করেছে তাঁর হৃৎপিণ্ডটা। গাড়ির মধ্যে… খুব কাছ থেকেই একটা আওয়াজ আসছে… সিটের গায়ে পালক ঘষার খসখসে শব্দ, সঙ্গে খুব মৃদু একটা শিষের আওয়াজ… বাজপাখিটা!
বাসু ঘাড় ঘোরাল। পাশের দোমড়ানো মোচড়ানো সিটটায় শান্ত হয়ে বসে আছে বাজপাখিটা। মাঝে মাঝে ঘাড় মুচড়ে পালকের মধ্যে গুঁজে দিচ্ছে ঠোঁট। দু–বার আঁচড় কাটল সিটের লেদারের উপর। বিশ্রী একটা ফড় ফড় করে চামড়া ছেঁড়ার শব্দ উঠল। ঠিক যেন চামড়ায় ঘষে শানিয়ে নিচ্ছে নখগুলো।
বাসু হাত বাড়িয়ে পাখিটাকে গাড়ির মধ্যে থেকে ঠেলে সরিয়ে দেবার চেষ্টা করল।
তাঁর হাত নড়ল না।
স্পাইনাল শক! বাসু ভাবল। প্যারালাইজড। টেম্পোরারি মনে হচ্ছে, নাকি, পার্মানেন্ট! বাসু সঠিক বুঝে উঠতে পারল না।
বাজপাখিটা আচমকা ডেকে উঠল। বাসুর কানে কে যেন একগাদা গরম সুচ ঢুকিয়ে দিল।
‘দূর হ হতচ্ছাড়া।’ বাসু প্রায় চেঁচিয়ে উঠল। গলার স্বর এখন শুকনো… কর্কশ। বাজপাখিটা কিছুক্ষণ বাসুকে ঘাড় বেঁকিয়ে দেখল। তারপর আচমকা ডানা মেলল, বাসুর মনে হল এবার ব্যাটা উড়ে যাবে। কিন্তু পাখিটা সোজা নখ তুলে আঁচড়ে দিল থুতনিতে। বিদ্যুৎ চমকের মতো একটা যন্ত্রণা গলা বেয়ে নেমে গেল। ঠান্ডা চামড়ার উপরে গরম রক্তের ধারাটা স্পষ্ট বুঝতে পারল বাসু।
যন্ত্রণা!
অনুভূতি…
এবার তাঁর মস্তিষ্ক দেহকে আদেশ করল মাথাটা ডাইনে ঘোরাবার জন্য। মাথা ডাইনে ঘুরল। কয়েক মুহূর্তের জন্য মুখটা যেন নরম স্পঞ্জের মতো কিছু একটার মধ্যে ডুবে গেল। নাকের পাশে, কপালে শুকনো ছোট ছোট পালকগুলো সুড়সুড়ি দিয়ে উঠল। প্রতিক্রিয়াবশত মাথা দিয়েই বস্তুটাকে এক গোঁত্তা মারল সে। ওটা সামান্য সরে গেল। একটা অদ্ভুত আওয়াজ বেরোল পাখিটার গলা থেকে– কঁক্!- পাখিটা পাখা ঝাপটে সরে গেল পাশের সিটে।
তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল বাসুর দিকে। পিঠের পালকগুলো ফুলে উঠেছে।
বাসু কর্কশস্বরে বলে উঠল, ‘কী ভেবেছিস? এমনি এমনি ছেড়ে দেব?’
পাখিটা ঠোঁটদুটো ফাঁক করে তীব্র চিৎকার করে উঠল। ডানা দুটো মেলে ধরল সঙ্গে সঙ্গে। অদ্ভুত মুকুট পড়া মাথা আর রক্তিম বর্ণের ডানাদুটোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বাসুর হঠাৎ বুঝতে পারল কেন এটাকে দশরথ দেওপাখি বলছিল। এটা…
বাসুর চিন্তাজাল ছিঁড়ে গেল। একটা ভোঁতা চিনচিনে যন্ত্রণার অনুভূতি দুই হাত আর বাহু বেয়ে উঠে আসতে শুরু করেছে।
অনুভূতি। ফিরে আসছে। সুচ ফোটানোর মতো… পেরেক মারার মতো যন্ত্রণার অনুভূতি… উঠে আসছে অসাড় হাতদুটো বেয়ে।
বাজপাখিটা ঝাঁপ দিল। তীক্ষ্ণ নখ বার করে। ডানা মেলে।
বাসু চোখ দুটো বন্ধ করে মুখ হাঁ করে মাথাটা এগিয়ে দিল। পাখিটার ঠিক পেটের অংশটা কামড়ে ধরল দাঁতে। কিন্তু পালক ছাড়া আর কিছুই পেল না।
পাখিটার নখগুলো আবারও চেপে বসল বাসুর দুই গালের গভীরে। যন্ত্রণাটা যেন মস্তিষ্ককে অসাড় করে দিল। বাসু পাগলের মতো চেষ্টা করল হাতটা তোলার। অসাড় হাতদুটো সামান্য নড়ল কিন্তু কিছুতেই কোল ছেড়ে উঠে এল না।
এবার যন্ত্রণায় বাসু মাথা ঝাঁকাতে শুরু করল। সামনে পিছনে, ঠিক যেভাবে মানুষ চোখে সাবান পড়লে মাথা ঝাঁকায়। ছোট ছোট কিঁক কিঁক আওয়াজ আর পাখা ঝাপটানোর মধ্যে বাজপাখিটা ঠিক বাসুর মুখের উপরে লেপটে থাকল। কপালে, গালে রক্তের ধারা টের পেল বাসু। শ্বাস নেওয়া ক্রমে কঠিন হয়ে উঠছে। পাখিটার নরম বুক তার নাকের উপরে লেপটে বসেছে। মুখ খুলে বাতাস টানতে গেল বাসু। বাতাসের সঙ্গে সঙ্গে ফড় ফড় করে কিছু পালক ঢুকে এল মুখের মধ্যে।
বাসুর মনে হচ্ছে গালদুটোতে তরলের ধারা বয়ে যাচ্ছে। একই সঙ্গে আগুন ধরে যাওয়ার মতো জ্বালাপোড়া।
এবার বাসু প্রাণপনে ডাইনে বাঁয়ে মাথা ঝাঁকাতে লাগল। একই সঙ্গে চিৎকার শুরু করল। কাজ হল। পাখিটা আচমকা ঝাঁকানিতে ছিটকে সরে গেল বাসুর মুখ ছেড়ে।
প্রথমে, একটা ভোঁতা থাপ। তারপরে কাচের কেঁপে ওঠা, পরক্ষণেই ঝপ করে একটা আওয়াজ শুনল বাসু। বাসুর মনে হল পাখিটা গিয়ে পিছনের কোনও একটা জানালায় ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেছে।
রক্ত পড়ে বাসুর চোখদুটো প্রায় বুজে এসেছে। সে আবারও হাতটা নাড়ার চেষ্টা করল। কোনওরকমে একটা হাত তুলতে পারলে, চোখের রক্তটা আগে মুছবে সে। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে। চোখ খুললেই সমস্ত দৃশ্যপটের উপরে একটা লালচে পর্দা ভাসছে।
কিন্তু হাতদুটো কোলের উপরে কেঁপে উঠল শুধু। নড়ল না। বগলের সামান্য নিচে পাঁজরের ধার ঘেঁষে গুলিভরতি পিস্তলটা এখনও ঠিক আছে, টের পেল বাসু।
‘একবার। শুধু একবার ওটা হাতে পেলে। শালা পাখির বাচ্চা, তোর সমস্ত দেওগিরি কীভাবে পিছন দিয়ে ঢোকাতে হয় আমি দেখে নেব।’
দাঁতে দাঁত চেপে ভাবল বাসু।
হাতের চিনচিনে যন্ত্রণাটা বাড়ছে, ক্রমশ তার সঙ্গে পায়ের আঙুল থেকে কোমর অবধি উঠে আসা একটা ভোঁতা সাড় ফেরানো যন্ত্রণা যোগ হল। ঠিক যেন পার্শিয়াল অ্যানাস্থেসিয়ার পরে আহত মাংসপেশিগুলোর সাড় ফিরছে। যন্ত্রণাটা বাসুর মনের মধ্যে আশা জাগাল, ওই দুমড়ে যাওয়া ইঞ্জিনের জট পাকানো অবস্থার মধ্যে কোথাও তার পা দুটো এখনও হয়তো গোটা আছে।
অবশ্য এই মুহূর্তে বাসুর নিজের পা দুটোকে নিয়ে খুব একটা চিন্তা হল না। শিড়দাঁড়াটা যে গুঁড়িয়ে যায়নি এই ঢের। অন্তত বাকি জীবনটা তাকে একটা মৃত শরীরের উপরে সুস্থ স্বাভাবিক মস্তিষ্ক বহন করে কাটাতে হবে না, এই চিন্তাটায় বাসুকে যথেষ্ট আনন্দ দিচ্ছিল।
‘আমিও কালোবাজ। এত সহজে আমার শরীর লড়াই ছাড়ে না।‘
নিজেই নিজেকে বলল বাসু।
এবার ওই হতাচ্ছাড়া পাখিটার গতি করতে হবে। ওটাই প্রথম কাজ… তারপর এই ভাঙাচোরা গাড়িটা ছেড়ে বেরোতে হবে। অবশ্য কেউ যদি চলে আসে তাহলে দুটো সমস্যাই একবারে মিটে যায়। সকাল সাড়ে পাঁচটায় এই জঙ্গলের মধ্যে কারোর দেখা পাওয়াটা একটু দুরাশা বটে, তবুও এই পাখিমারার হাটে অনেক সময় ভোরবেলাও লোকজন আসে। আর…
আর… পাখিটা কী করছে পিছনে?
নিজের মুখের উপরে ওটাকে মোটেও চায় না বাসু, কিন্তু এটাও চায় না যে পাখিটা তার চোখের আড়ালে মাথার পিছনে বসে থাকুক। একবার রিয়ার ভিউ মিররটা দেখার চেষ্টা করল বাসু। নাহ, অ্যাক্সিডেন্টে গাড়িটার সামনেটা পুরোই ধ্বংসস্তূপ হয়ে গেছে। রিয়ারভিউ আয়নাটা বেঁকে ঘুরে এখন ওই অবশিষ্ট হেডলাইটের আলোয় চিকচিক করে সবুজ ঘাষগুলোর প্রতিবিম্ব দেখাচ্ছে।
পিছন থেকে খচ খচ শব্দ এল। এলো ডানা ঝাপটানোর শব্দ। ধারাল নখে সিটের চামড়া ছেঁড়ার শব্দ।
দেওপাখি, শালা শকুনের বাচ্চা। কী করছিস তুই পিছনে?
হতচ্ছাড়ী ভাবছেটা কী? বাসু কে খুন করবে নাকি? হাঃ, কীভাবে? প্ল্যান করছে নাকি বসে বসে? একটা দেড় ফুটিয়া চামচিকের বাচ্চা। পালকসমেত দাড়িপাল্লায় তুললেও কেজিখানেক ওজন হবে না। আর শিগগিরি… খুব শিগগিরিই বাসু হাত দুটো নাড়াতে পারবে। একবার বন্দুকটা হাত পেলেই… শালা, পাখির চৌদ্দোপুরুষের পেটে বুলেট ফুঁড়ে দেবে একেবারে।
দূরের পাহাড়ের আশপাশ ঘিরে আকাশটা সামান্য ফ্যাকাশে হয়ে এল। রক্তবেগুনি বর্ণের আকাশের কোলে পাহাড়ের অবয়বটা ক্রমে আরও কালো, আরও বিশাল হয়ে ফুটে উঠল। কোথায় যেন, হয়তো সামনের জারুল গাছটা থেকেই, একটা পাখি ডেকে উঠল।
বাসু আরও একবার হাত দুটো তোলার চেষ্টা। ঠিক এক ইঞ্চির আট ভাগের এক ভাগ উঠল হাতটা কোল ছেড়ে। তারপর আবার পড়ে গেল।
এখনও সাড় ফেরেনি, কিন্তু আর দেরি নেই।
নরম ঝটফট আওয়াজ তুলে সামনের স্টিয়ারিং–এর উপরে পাখিটা এসে বসল। পাখিটার সাদা মুকুটটা অন্ধকারেও জ্বলজ্বল করছে। হলদে চোখের মধ্যে কালো মণিগুলো তীক্ষ্মতর হয়ে উঠেছে।
বাসু কথা বলে উঠল, ‘হাই… ওসেনবোরো… আমি কিন্তু এর আগে একটাও হিট কোনওদিনও মিস করিনি। এটা প্রথম হতে পারে। পাঁচ মিনিট, ওকে, খুব বেশি হলে দশ। আমার উপদেশ শুনবে? ওই ভাঙা উইন্ডস্ক্রিন দিয়ে উড়ে পালিয়ে যাও। তোমার গর্দান বেঁচে যাবে তাহলে।’
পাখিটা পাশের দিকে প্রায় ২৮০ ডিগ্রী ঘাড় বাঁকাল, তাকে দেখল।
আমি কি কোনও ভুল করছি?
বাসু মনে মনেই ভাবল একবার। তাঁর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় কেমন যেন সাড়া দিয়ে উঠল ঘাড়ের লোম খাড়া হয়ে উঠল। আচমকা একটা শীতল কাঁপুনি বাসুর সারা দেহে ছড়িয়ে পড়ল। পাখিটার গায়ের পালক ফুলে উঠেছে, ডানা দুটোয় ঝাড়া দিয়ে পাখিটা টান টান করল ছোট দেহটা।
পাখিটা এসে তাঁর পেটের উপরে বসল। জামা ভেদ করে নখগুলো আগুনে জ্বালা ছড়িয়ে দিচ্ছে শরীরে। ধীরেসুস্থে তার দিকে পিছন ঘুরল পাখিটা। নেমে গেল নিচের দিকে। পরক্ষণেই বাসু টের পেল তলপেটের কাছে চেইনের দু–পাশে জিন্স ভেদ করে চামড়ায় আঁকড়ে ধরছে ধারাল নখগুলো। বাসু যেন অবচেতনেই বুঝতে পারল পাখিটা কী করতে চলছে। আতঙ্কে তাঁর মুখটা হাঁ হয়ে গেল। পরক্ষণেই একটা জান্তব প্রাণান্তকর চিৎকার বেরিয়ে এল হাঁ হয়ে যাওয়া মুখের ফাঁক দিয়ে। পাখিটা নখ দিয়ে আঁচড় মারছে পুরুষাঙ্গের উপর। তীক্ষ্ণ ধারাল নখ জিন্স, অন্তর্বাস ভেদ করে ঢুকে গেছে নরম যৌনাঙ্গ। ওই মুহূর্তে বাসুর মনে হল এর থেকে তাঁর শিঁরদাড়া ভেঙে সে পঙ্গু হয়ে গেলে ভালো হত। এরকম অসহনীয় যন্ত্রণা হতে পারে বাসুর কোনও ধারণা ছিল না। পাখিটা এবারে শক্ত মাংসাশী ঠোঁটটাও ব্যবহার করতে শুরু করল। বাসুর মনে হল কেউ তার শরীরের সবচেয়ে দূর্বল স্থানে কেউ একটা ভোঁতা পেরেক ঢোকানোর চেষ্টা চালাচ্ছে।
বাসু একটানা চিৎকার করে যাচ্ছিল। চিৎকারটা থামাতে পারছিল না কিছুতেই। ঠিক সেই সময়ে পাখিটা মুখ ফেরাল। সোজা উড়ে এল বাসুর মুখের উপরে। ঠিক অব্যক্ত যন্ত্রণায় হাঁ করা ঠোঁট দুটোর উপর। সেই মুহূর্তে বাসু বুঝে গেল ওটা কোনও সাধারণ পাখি নয়। একটা ভয়ঙ্কর রক্তপিপাসু খুনীর মস্তিষ্ক বসানো আছে বুঝি ওই পাখিটার মাথায়।
শেষ বারের জন্য বাসুর বিস্ফারিত চোখের সামনে ভেসে উঠল পাখিটার নীলচে–ধূসর মাথায় নতুন বরফের চেয়েও সাদা মুকুটটা। চোখে পড়ল রক্তলাল ডানার বিস্তার। একইসঙ্গে সে দেখতে পেল পাখিটার হলুদ চোখে কালো মণিদুটো বিশাল। যেন ওই অতলান্ত চোখে পৃথিবীর সমস্ত মানুষের বিরুদ্ধে ঘৃণা এসে জমা হয়েছে। এই পৃথিবীর সমস্ত পাখিমারাদের বিরুদ্ধে জমা হয়েছে শত শত বছরের ঘৃণা। কয়লার মতো কালো ঘৃণা জমে জমে এখন হীরার টুকরোর মতো জ্বলজ্বল করছে চোখ দুটো। এটা বাইশটা মানুষকে মেরেছে। এবার বাসুর পালা। তেইশ নম্বর।
শেষ কথাটা বাসুর মস্তিষ্কে ফুটে উঠবার আগেই পাখিটা হাঁ করা ঠোঁটদুটোর ফাঁকে নিজের মাথাসহ অর্ধেক শরীর ঢুকিয়ে দিল। বাসু হাঁকপাঁক করতে থাকল একটু বাতাসের জন্য। বাসুর নরম জিভে একটা একটা করে নখ বিঁধিয়ে বিঁধিয়ে পাখিটা নিজের শরীরটাকে ক্রমেই ঢোকাতে লাগল বাসুর গলার মধ্যে।
বাসুর চোয়ালের জোড় কড়ড়ক শব্দ তুলে খুলে গেল।
অচিরেই গলার মধ্যে পাখিটার শক্ত ঠোঁটের খোঁচা খেল বাসু।
বমি পাক খেয়ে উঠে এল খাদ্যনালী বেয়ে। পাখিটার সমস্ত শরীর দিয়ে মুখবন্ধ করে রেখেছে। বমিটা শ্বাসনালীতে জমা হল। দম আটকাতে আটকাতে বাসু অনুভব করল তাঁর অবশ হয়ে যাওয়া হাতদুটো আবার সচল হয়ে উঠেছে।
সে কোনওরকমে হাত দুটো তুলে আনল মুখের কাছে। কিন্তু! এ কি! কী এক অসম্ভব উপায়ে পাখিটা সম্পূর্ণভাবে ঢুকে গেছে তাঁর মুখের মধ্যে! তাঁর গলা বেয়ে ক্রমে ঢুকে যাচ্ছে আরও। বাসুর আঙুলে কয়েক মুহূর্তের জন্য পাখিটার লেজের পালকগুলো ঠেকল। পরক্ষণেই হাতদুটো আছড়ে পড়ল কোলের পাশে।
গগ্ গগ্ গগ্… শরীরের কোন দূরবর্তী অঞ্চল থেকে বীভৎস দমচাপা আওয়াজটা উঠে আসছিল ক্রমশ।
বাসুর শরীরটা অস্বাভাবিক ছটফট করে উঠল। অবশ আঙুলগুলো নিজে নিজেই কেঁপে কেঁপে তবলার বোল তুলল সিটের উপর। চোখের বিস্ফারিত মণিদুটো জ্বলে উঠল ক্ষণিকের জন্য।
লক্ষ্যহীন মণিদুটো নিবদ্ধ হয়ে রইল দূরের ভোরের আকাশের গায়ে। সূর্যের আলো ক্রমে ভরিয়ে দিচ্ছে পিছনের পাহাড়। সামনের জারুল গাছটাতেও এসে লাগছে ভোরের ঠান্ডা বাতাস। জঙ্গল থেকে একটা দুটো পাখি ডেকে উঠল। অনেকটা উপরে পাহাড়ের গায়ে পায়ে চলা রাস্তার মুখে কাদের যেন সাড়া পাওয়া গেল।
***
ওরা আসছিল। পাখিমারার হাটে বসবে বলে জনাছয়েক নাগা নারীপুরুষ ফাঁদ পেতে ধরা গুটিকতক পশুপাখি নিয়ে আসছিল। ভোর ভোর এইসব লেনদেন হয়ে যাওয়াই ভালো। বেলা চড়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেক সময় শহরের লোক অথবা পুলিশ মিলিটারি এসে হাজির হয়।
উপর থেকে পাখিমারার মাঠের মাঝখানে জারুল গাছ থেকে সামান্য দূরে অ্যাক্সিডেন্ট করা গাড়িটা সবারই চোখে পড়ল।
দুড়দাড় করে নেমে এল মানুষগুলো। ততক্ষণে কয়েকজন ক্রেতার একটা ছোট দলও এসে হাজির হয়েছে নিকটবর্তী শহর থেকে।
সকালের নরম আলোয় ভাঙা উইন্ডস্ক্রিনের মধ্যে দিয়ে বাসুর সিটবেল্ট বাঁধা, শক্ত হয়ে বসে থাকা চেহারাটা সবারই চোখে পড়ল। মুখের অসংখ্য ক্ষত থেকে তখনও রক্ত চোঁয়াচ্ছে।
দুজন এগিয়ে এসে টানাটানি করে জ্যাম হয়ে যাওয়া ড্রাইভারের দরজাটা খুলল। কোনওমতে সিটবেল্টটা খুলে দেহটাকে ভাঙা গাড়িটা থেকে বের করে নিয়ে এল।
মাঠে শোয়াতেই বাসুর শরীরে অদ্ভুত এক কম্পন দেখা গেল। লোকগুলো আঁতকে উঠে কয়েক পা পিছিয়ে গেল। কয়েক সেকেন্ড পরেই একটা তীব্র আতঙ্কের চিৎকার বেরলো মানুষগুলোর গলা থেকে।
মাঠে শোয়ানোর সময় মৃতের শরীরের গেঞ্জিটা সরে যেতে, দৃশ্যটা স্পষ্টই দেখতে পেল সবাই। ঠিক জিনসের ধার ঘেঁষে, নাভির নিচের নরম চামড়ার ভিতর থেকে কী যেন একটা ফুলে ফুলে উঠছে। রক্ত ছিটকে পড়ল সবুজ ঘাষে। তলপেটের মধ্যে যেন একটা বিস্ফোরণ হয়ে গেছে।
মাংস আর চামড়া ছেঁড়ার একটা চাপা ভোঁতা আওয়াজ ছড়িয়ে পড়ল ভোরের বাতাসে। ক্রমে একটা রক্তমাখা কালো গর্ত তৈরি হল নাভির নিচে।
একটা ধূসর–নীল রঙা বাজপাখি গর্তটা থেকে বেরিয়ে এল। সূর্যের আলোয় তার সাদা মুকুট থেকে আলো ঠিকরাচ্ছে। রক্তাভ দুই ডানা। ঠিক প্রাচীন নাগা উপাখ্যানের বর্ণিত রূপ। যুদ্ধ জয়ের পর মানুষের রক্ত নিজেদের হাত থেকে মুছে ফেলেনি ওসেনবোরোরা। তাই তাদের ডানার তলা লাল, আর, মাথায় বিজয়ীর শ্বেতমুকুট। তারা, দেওপাখি।
পাখিটা উড়াল দিল। পুরো পাখিমারা মাঠ দেখল পাখিটার তীক্ষ্ণ নখে আঁকড়ে ধরা একটা মানুষের নাড়ি। বিজয়ের পতাকার মতো পাখিটা লম্বা নাড়িটা সবাইকে দেখিয়ে দেখিয়ে ঘুরপাক খেয়ে উঠতে লাগল উপরের দিকে। তারপর রক্ত ছড়াতে ছড়াতে সোজা উড়ে গেল উত্তরের দিকে।
চব্বিশ নম্বরের খোঁজে।
আর একজন বাকি।
তারপরে পৃথিবী থেকে মুছে যাবে সব পাপ। সব হিংস্রতা।
তথ্যসূত্র:
স্টিফেন কিং রচিত ‘ক্যাট ফ্রম হেল’ গল্পটির ছায়া অবলম্বনে লিখিত।
Tags: অঙ্কিতা, অনুবাদ গল্প, পঞ্চম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, ফ্যান্টাসি গল্প, হরর গল্প
2019 সালে THE HINDU কাগজে পড়েছিলাম নাগাল্যান্ডের পাংটি গ্রাম আমুর বাজদের স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠেছে স্থানীয় মানুষের রক্ষণাবেক্ষণে। অঙ্কিতার “ওসেনবোরো” উপন্যাস যা বিদেশী উপন্যাসের ছায়া অবলম্বনে হলেও নিজস্বতায় অনন্য। গতকাল ই-বুক থেকে পড়েছি গল্পটি।
বন্যপশু ও পাখির ধ্বংসলীলায় মেতে ওঠা মানুষজন কিভাবে একে একে অন্তিম কালের দিকে এগিয়ে যায় তার একটা রোমহর্ষক বর্ণনা লেখিকা দিয়েছেন। উপভোগ করেছি। সবচেয়ে ভালো লাগলো মাইগ্রেশন, আমুর বাজ প্রভৃতি সম্পর্কে তথ্যনিষ্ঠ লেখা। হরর স্টাইলে লেখা গল্পটি একনিঃশ্বাসে পড়ে ফেলা যায়।
অদ্ভুত সুন্দর একটা গল্প পড়লাম। লেখিকার লেখার স্টাইলের সাথে আগে থেকেই পরিচয় থাকাতে প্রত্যাশার পারদ বেশ উঁচু ছিল। এই গল্পটা সেই প্রত্যাশাকেও ছাড়িয়ে গেছে।
কাল্পনিক একটা মিথকে যেভাবে উপস্থাপন করেছেন, যেভাবে দেশীয় আমেজে গল্পটি তুলে ধরেছেন! এককথায় অসাধারণ। লেখিকার কল্পনাশক্তির প্রশংসা না করে পারছিনা।
সরলরৈখিক স্টাইলে গল্প এগিয়েছে, এই কারণে কিছুটা প্রেডিকটেবল হয়ে গেছে, তবে সাবলীল উপস্থাপনা, ভাষার ব্যবহার গল্পটিকে অনন্য উচ্চতা নিয়ে গেছে। কখন যে শেষ প্যারায় চলে এসেছি খেয়ালই করতে পারিনি। এমন চুম্বকীয় আকর্ষণ ছিলো সম্পূর্ণ লেখাটি।
অঙ্কিতাদির কাছে প্রত্যাশা আরও বেড়ে গেল। সামনে এমন দুর্দান্ত লেখা আরও পড়ার ইচ্ছা জানিয়ে রাখলাম।