সাত্যকি সোমের বন্ধুরা
লেখক: রেবন্ত গোস্বামী ও সুদীপ দেব
শিল্পী: বিজন কর্মকার
মধ্যভারতের এক জনবিরল গ্রামেরও নিভৃত স্থানের এক কুটিরে সকালবেলা উদ্ভ্রান্তের মতো প্রবেশ করল এক মধ্যতিরিশের যুবক। ঘরের একপাশে অনেক যন্ত্রপাতির সামনে চেয়ারে বসে এক বৃদ্ধ নিবিষ্টমনে কাজ করছিলেন। আওয়াজ শুনে ফিরে তাকালেন। তারপর বললেন, ‘ও গৌতম তুমি। অনেক কাল পরে এলে এবার।’
‘আসব কী করে? জানেন না, বিশ্বব্যাপী এক মারণ ভাইরাস সবাইকে কেমন ঘরবন্দি করে রেখেছিল? আপনি ঠিক আছেন তো ডক্টর সোম? সব যোগাযোগ বন্ধ রেখেছেন।’
বিজ্ঞানী সাত্যকি সোম হেসে বললেন, ‘সব খবরই পাই। আউটলেট বন্ধ রাখলেও ইনলেট খোলা। হ্যাঁ, ভালোই আছি। বন্ধুরাই আমাকে রক্ষা করেছে।’
‘বন্ধুরা?’
গৌতমের অবাক দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে সাত্যকি সোম চেয়ার থেকে উঠে বললেন, ‘সে আছে। তার আগে যুধিষ্ঠিরকে বলি তোমার আতিথ্যের ব্যবস্থা করতে।’ বলে বেরিয়ে গেলেন।
একটু পরে ফিরে এলে গৌতম বলল, ‘বাবাঃ, এত যন্ত্রপাতি আনিয়েছেন! বলে না, ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে। আপনি কলকাতায় ফিরে যেতে পারেন তো। সেই কৃত্রিম চাঁদের প্রকল্প কবে বাতিল হয়েছে। শহরগুলোতে রাতের অন্ধকার কেড়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে প্রকৃতিপ্রেমীরা খেপে উঠেছিল।’
‘ওরা আছে বলেই মানুষ অনেক কিছু থেকে রক্ষা পাচ্ছে। এই সব দূরদৃষ্টিহীন বিজ্ঞানী আর দেশবিদেশের রাজনৈতিক নেতারা বিজ্ঞানের অভিশাপের দিকটাকেই প্রতিপালন করছেন। আমি চেয়েছি আশীর্বাদের দিক।’
‘তা হলে ফিরে গিয়ে এই ভাইরাসকে মেরে ফেলার উপায় আবিষ্কার করতে পারতেন।’
সাত্যকি সোম হেসে বললেন, ‘ভাইরাস পৃথিবীতে চিরকালই ছিল। চিরকালই থাকবে।’
গৌতম ব্রহ্ম উৎসাহিত হয়ে বলল, ‘আমি এইটা নিয়েই এতদিন গবেষণা করছিলাম। আগেকার দিনের মুনিঋষিরা চোখের দৃষ্টিতে ভাইরাস সৃষ্টি করতেন। এই যে বিশ্বামিত্র সাগররাজার ষাট হাজার পুত্রকে ভস্ম করলেন, আসলে ভাইরাস ছড়িয়ে তাঁদের মেরেছিলেন। ভগীরথ গিয়ে—’
ডক্টর সোম তাকে থামিয়ে বললেন, ‘সেটা নিয়ে তুমি গবেষণা করো। তবে ভাইরাস রামায়ণ-মহাভারতের, এমনকী মনুষ্যজাতি সৃষ্টির আগেও ছিল, মানুষ পৃথিবী থেকে লোপ পেয়ে গেলেও থাকবে। যে সব গ্রহ-উপগ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব নেই— যেমন চাঁদ বা মঙ্গল গ্রহ, সেখানেও হয়তো আছে।’
‘কী সর্বনাশ! সেখানেও ভাইরাস কিলবিল করছে?’
‘করতেও তো পারে— তবে সে-সব নিয়ে গবেষণা চলছে। গৌতম জানো, মেরুদেশে একরকম মাছ আছে। শীতে বরফ জমে গেলে তারাও বরফের মধ্যে জমে মৃত হয়ে যায়। আবার গরমে যখন বরফ গলে যায়, তখন তারা আবার জ্যান্ত হয়ে জলের মধ্যে তোমার ভাষায় কিলবিল করে।’
‘হাইবারনেশন?’
‘হ্যাঁ, অনেকটা সেইভাবেই ভাইরাসও অনেক গ্রহে-উপগ্রহে হয়তো জড় পদার্থ হয়ে আছে কোটি কোটি বছর ধরে। কারণ জ্যান্ত প্রাণী বা মানুষ না-পেলে এরা জীবন পায় না।’
‘কী সর্বনাশ! তা হলে যারা অন্য গ্রহে বা চাঁদ থেকে ঘুরে আসছে—’
‘হ্যাঁ, ঝুঁকি তো আছেই। আমিই তো কয়েক বছর আগে দুজনকে পাঠিয়েছি* পৃথিবীর মতো এক গ্রহের উদ্দেশে… আচ্ছা গৌতম, আমার রোবট তৈরির ল্যাবরেটরিতে ওরা, মানে আমার ছাত্ররা কী করছে?’
‘ওরা শিশু রোবট তৈরি করছে। তারা তাদের শৈশব দেখছে। পরে তাদের ব্রেন খুলে বড় রোবটের শরীরে বসাবে। যেমন মহাভারতে—’
সাত্যকি সোম তাড়াতাড়ি তাকে থামিয়ে বললেন, ‘ভালো করছে। আমি যে দুজনকে মহাকাশযানে পাঠিয়েছি তার একজন নিজের জীবনরহস্য জানলেও অন্যজন জানে না। তার ধারণা, তার ছোটবেলায় অ্যামনেশিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ছোটবেলার কথা ভুলে গিয়েছে।’
‘তারাও তো অজানা ভাইরাস নিয়ে আসতে পারে?’
‘পারেই তো। তখন তুমিও থাকবে না, আমিও থাকব না। মানুষ জাতি হঠকারী হতে থাকলে তারাও থাকবে না। আর যদি সুবুদ্ধি সম্পন্ন হয়, ততদিনে তার থেকে রক্ষা পাওয়ার ব্যবস্থা করবে।’
গৌতম এবারে বলল, ‘কিন্তু ডক্টর সোম, আপনি বললেন, আপনাকে বন্ধুরাই রক্ষা করছিল। কিন্তু এখানে তো যুধিষ্ঠির ছাড়া এই বাড়িতে কাউকে দেখলাম না।’
ডক্টর সোম হেসে বললেন, ‘তাদের যে দেখা যায় না। তাদেরও নাম যে ভাইরাস।’
‘ভাইরাস! বন্ধু?’ গৌতম আকাশ থেকে পড়ে।
ডক্টর সোম মুচকি হাসলেন, ‘আমাদের শরীরে, শুধু আমাদের কেন, পশুপাখি সবার দেহে সব সময় ভাইরাসের আনাগোনা আছে। আমাদের ফুসফুসেই এত রকমের ভাইরাসের অস্বিত্ব রয়েছে, তাদের শতকরা নব্বই ভাগের ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা কিছুই জানেন না। আমাদের যে জ্বর সর্দি কাশি হয়, তার মূলে তো রয়েছে বহু প্রাচীন এক ভাইরাসের যোগ— রাইনোভাইরাস। যদিও সর্দি-কাশি মোটেই ভালো জিনিস নয়, তবুও রাইনোভাইরাস ছিল বলেই-না আমাদের শরীরে প্রতিরোধ বা দরকারী অ্যান্টিবডি গড়ে উঠতে পেরেছে।’
‘কিন্তু তাই বলে ভাইরাসকে বন্ধু বলা যায় কি?’
‘কেন যায় না? ছোটবেলায় বিজ্ঞান বইতে ব্যাকটিরিও ফাজের নাম পড়োনি? সেও তো এক ধরনের উপকারী ভাইরাস। তা ছাড়া এই যে ফ্লু ভাইরাস, সেও আমাদের দেহে অ্যান্টিবডি তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়— এরা বন্ধু ছাড়া কী?’
‘কিন্তু আপনি এভাবে এক অজ-পাড়াগাঁয়ে বসে গবেষণা করলে আপনার আবিষ্কারের সুফল তো পৃথিবীবাসী পাবে না। আপনার উচিত কলকাতায় ফিরে যাওয়া।’
‘দ্যাখো গৌতম, আমি নিজে যে আমার বন্ধুদের সাহায্যে সুস্থ আছি সে তো তুমি দেখতেই পাচ্ছ। যুধিষ্ঠিরকেও দেখলে। শুধু তা-ই নয়, তোমার ভাষায় এই অজ-পাড়াগাঁয়ের সবাই কিন্তু বাকি পৃথিবীর সেই মারণ ভাইরাসের আক্রমণ থেকে মুক্ত। এই যে তুমি কলকাতা থেকে আমার সঙ্গে দেখা করতে এলে, যদি তুমি সেখান থেকে ওই ভাইরাস বহন করেও নিয়ে আসো, আমার বন্ধু ভাইরাসরা অবিলম্বে তাদের মেরে ফেলবে।’
‘বলেন কী! আর আপনি সেটা এখনও বাইরের বিশ্বকে জানাননি?’
‘বিশ্বের তাবড় বৈজ্ঞানিকরা এখন আমাকে বাতিলের খাতায় ফেলে দিয়েছে। সেই কৃত্রিম চাঁদের প্রকল্পে বিরোধিতা করায় অনেকেই আমাকে বিদ্রূপ করেছিল। কেউ-কেউ পরে নিজেদের ভুল বুঝতে পারলেও আমি আর কারও সঙ্গে যোগাযোগ রাখিনি। শুধু আমার এক সুহৃদ আছে, জার্মান বৈজ্ঞানিক। তার সঙ্গে আমার কথা হয়, তাকে আমার এই আবিষ্কার সম্বন্ধে ই-মেলে সব জানিয়েছি।’
‘কী বললে সে?’
‘বিশেষ বিমানে হয়তো দু-একদিনের মধ্যেই এসে পড়বে। আমার এই বাসস্থানের জিপিএস অবস্থান তাকে জানিয়ে দিয়েছি।’
ঠিক সেই সময় ঘরে প্রবেশ করলেন দুজন ব্যক্তি। একজন এই বাড়ির মালিক, স্থানীয় প্রাথমিক স্কুলের মাস্টার ভিনসেন্ট টিগা। তাঁর সঙ্গে একজন সাদা চামড়ার প্রৌঢ়, বয়স বছর ষাটেক, চেহারার মধ্যে প্রথমেই নজর কাড়ে তাঁর উচ্চতা। প্রায় সাড়ে ছ-ফুট তো হবেই।
‘এই ভদ্রলোক আপনার খোঁজ করছিলেন, ডাক্তারবাবু।’ টিগা বললেন।
ভদ্রলোক সাত্যকি সোমের দিকে অভ্যাসবশত হাত বাড়িয়ে তারপর আবার হাতটা গুটিয়ে নিয়ে ভারতীয় কায়দায় অনভ্যস্ত নমস্কার জানিয়ে ইংরেজিতে বললেন, ‘ডক্টর সোম? আমি ওয়াল্টার কোবল্ড।’
‘কী আশ্চর্য! এক্ষুনি তোমার কথাই হচ্ছিল। তুমি যে এত তাড়াতাড়ি এসে যাবে সেটা ভাবতে পারিনি।’
‘তার একটা বিশেষ কারণ আছে, সোম। তুমি তো জানোই, মারণ ভাইরাসে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বয়স্ক লোকেরা। আক্রান্ত হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই তাদের অধিকাংশ মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ছে। আর আমার বয়সটাও তো কম হল না—’
‘তার মানে তুমিও কি ওই ভাইরাসের শিকার?’
‘হ্যাঁ। তোমার মেল পাওয়ার পরের দিন আমার শরীরে ওই ভাইরাসের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। কপাল ভালো সেই সময়ে আমি এ-দেশে ছিলাম— সবে নিজের দেশে যাওয়ার তোড়জোড় করছিলাম। রোগটা ধরা পড়তেই আমি আর দেরি করিনি। কিন্তু এমন একটা জায়গায় তুমি এসে রয়েছ যেখানে আসার জন্যও মেলা হ্যাপা পোহাতে হল। সেই সবই সার্থক হবে যদি তোমার আবিষ্কার করা প্রতিষেধকে আমি রোগমুক্ত হই।’
‘আমি তো ঠিক প্রতিষেধক আবিষ্কার করিনি, তা তো তোমাকে সবিস্তারে বলেছি। ঠিক আছে, তুমি একটু বিশ্রাম নাও। তারপর তোমাকে আমার গবেষণাগারে নিয়ে গিয়ে হাতে-কলমে দেখাব বিষয়টা।’
ভিনসেন্ট টিগা সবার অনুমতি নিয়ে বিদায় নিলেন। সাত্যকি সোম যুধিষ্ঠিরকে ডেকে গৌতম আর কোবল্ডের থাকার ব্যবস্থা করতে বললেন।
বিকেলের দিকে ডক্টর সোম একটা ব্লাড সুগার মাপার মতো ছোট যন্ত্রের খোলামুখের দিকে একটা ইনজেকশনের সুচ লাগিয়ে বললেন, ‘এবার তোমার হাতটা এদিকে দাও দেখি, এক বিন্দু রক্তের প্রয়োজন। সেটার স্পর্শ পেলে এই যে দেখছ এই যন্ত্রে দুটো আলো আছে— একটা লাল আরেকটা সবুজ, যে কোনও একটা জ্বলে উঠবে।’
কোবল্ডের রক্তের সংস্পর্শে লাল আলো জ্বলে উঠল। সাত্যকি সোম বললেন, ‘এর মানে আশাকরি বুঝতে পারছ, তুমি যে ওই মারণ ভাইরাসে আক্রান্ত তার সংকেত নিমেষমধ্যে ফুটে উঠল। এবার বন্ধু-ভাইরাসের কাজ এদের ধ্বংস করা। আর তখন যদি আরেকবার পরীক্ষা করা যায়, দেখবে সবুজ আলো জ্বলছে।’
কোবল্ড চমৎকৃত হয়ে বলল, ‘সোম, শুধু তোমার এই যন্ত্রটাই তো যুগান্তকারী। এখন যে-পদ্ধতিতে রোগ নির্ণয় হচ্ছে, তাতে যা সময় লাগছে, তার আগেই অনেকে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ছেন। যদি এত তাড়াতাড়ি রোগ নির্ণয় করা যায়, তা হলে জীবনদায়ী চিকিৎসা চালু করা যাবে অনেক তাড়াতাড়ি। তার ফলেই অনেকের মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব হবে।’
অল্প হেসে ডক্টর সোম বললেন, ‘সেইজন্যই তো তোমাকে তলব করলাম। আমার পক্ষে ঢাক পিটিয়ে এখন আর এসব প্রচার করা বা বহুল পরিমাণে তৈরি করে বাজারজাত করার উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব নয়। তুমি ওসব দিক সামলিও। আমার নিজের নামও দরকার নেই। আবিষ্কারক দেশ হিসেবে ভারতের স্বীকৃতি থাকলেই চলবে। আর সব থেকে বড় কথা, মানবজাতি যাতে উপকৃত হয় সেটাই আমার আসল লক্ষ্য।’
নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী সাত্যকি সোমের অনেক নাম শুনলেও এই প্রথম স্বচক্ষে তাঁর আবিষ্কারের নমুনা দেখে কোবল্ড বেশ অবাক হয়েছে বোঝা গেল তার হাবভাবে। বিশেষ করে এমন পাণ্ডব-বর্জিত জায়গায় সামান্য যন্ত্রপাতির সাহায্যে একটি ছোট ল্যাবরেটরিতে যেভাবে এই বয়সে জগদ্বিখ্যাত বিজ্ঞানী তাঁর গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন, তাতে অবাক হওয়ারই কথা। তবু যেন সংশয় ফুটে বেরোল তার পরবর্তী বক্তব্যের মধ্যে, ‘তুমি কি এবার আমার দেহে বন্ধু-ভাইরাস প্রয়োগ করবে? সেটা নিরাপদ তো?’
‘আমি বাইরে থেকে কোনও ভাইরাস বা অ্যান্টি-ভাইরাস তোমার শরীরে প্রয়োগ করব না। আমার আবিষ্কৃত কৃত্রিম ভাইরাস, যাকে আমি বলছি বন্ধু-ভাইরাস, তারা আসলে একরকমের ন্যানোবট। এরা তোমার শরীরের ক্ষতিকারক ভাইরাসদের সঙ্গে যুদ্ধ করে তাদের মেরে ফেলবে। আপাতত আমার সফলতা এইটুকুই। আসলে প্রকৃতিতে ভাইরাসের তো অভাব নেই— কিন্তু স্বাভাবিকভাবে ভাইরাসকে অন্য ভাইরাস মারার কাজে আজ অবধি ব্যবহার করা যায়নি। তবে সেরকম প্রাকৃতিক বন্ধু-ভাইরাস যদি কেউ থাকে— তাদের চিহ্নিত করে, কীভাবে পোষক কোষের বাইরে তাদের বংশবৃদ্ধি ঘটানো যায়, আমি এখনও সেই নিয়ে গবেষণা করছি।’
‘তোমার পদ্ধতিতে কত দিন লাগবে মারণ ভাইরাসকে সম্পূর্ণরূপে বিনাশ করতে?’
‘সেটা একেকজনের ক্ষেত্রে একেক রকম হতে পারে। তবে দু-দিনের বেশি সময় লাগার কথা নয়।’
পরের দিনটা গৌতমকে সঙ্গে নিয়ে কোবল্ড গ্রামে ঘোরাঘুরি করে কাটাল। তাকে বেশ উৎফুল্ল লাগছে আগের তুলনায়। হয়তো ইতিমধ্যেই ডক্টর সোমের বন্ধু-ভাইরাসেরা তাদের কাজ শুরু করে দিয়েছে।
ডক্টর সোম সারাদিন নিজের কাজ নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। রাতে খাওয়ার সময় বললেন, ‘আগামী কাল একবার পরীক্ষা করে দেখা হবে, তুমি রোগমুক্ত হলে কি না।’
সেইমতো পরের দিন আরেকবার কোবল্ডের হাতে সুচ ফুটিয়ে রক্ত নিয়ে সাত্যকি সোমের ভাইরাস ডিটেকশন যন্ত্রে দেখা হল। এবারেও লাল আলো জ্বলে উঠল। সাত্যকি সোম ভুরু কুঁচকিয়ে গম্ভীর স্বরে বললেন, ‘এরকম তো হওয়ার কথা নয়! এর আগে প্রত্যেকবার দ্বিতীয় দিনেই ফল পেয়েছি। টিগা অথবা আমার বয়স তো তোমার থেকেও অনেক বেশি। তাতেও আমার বন্ধু-ভাইরাসেরা খুব তাড়াতাড়িই কাজ করেছে। আমি ইচ্ছে করে এক দিন বেশি সময় নিয়ে দেখলাম। এখনও…’
কোবল্ডের মুখ আরও গম্ভীর, ছায়াচ্ছন্ন। সাত্যকি সোমের ওপর তার ভরসা কোথাও যেন টাল খেয়েছে বলে মনে হল।
সন্ধের পর খোলা বারান্দায় হেলান-চেয়ারে বসে উদাত্ত গলায় গান গাইছিলেন সাত্যকি সোম, ‘নৃত্যে তোমার মুক্তির রূপ, নৃত্যে তোমার মায়া, বিশ্বতনুতে অণুতে অণুতে কাঁপে নৃত্যের ছায়া…’
তাঁর পাশে বসে পরম বিস্ময়ে ভাবছিল সংস্কারাচ্ছন্ন প্রাচীনপন্থী তর্কবাগীশ তরুণ গৌতম ব্রহ্ম, এই বিশ্বনন্দিত বিজ্ঞানীকে কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতার কথা। যিনি আদর্শের খাতিরে সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানীদের বিপক্ষে গিয়ে নিজের বাসস্থান, গবেষণা, নাম-যশ এক মুহূর্তে ছেড়ে চলে আসতে পারেন বাণপ্রস্থে। আবার পৃথিবী যখন দুরারোগ্য জরায় আক্রান্ত তখন আবার পরিত্রাতা হয়ে ফিরে আসেন, এমন তুলনা আর কোথায় আছে! এমন সময় তার চটকা ভাঙে সাত্যকি সোমের কথায়, ‘এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড অণু-পরমাণুর খেলা। তোমার জ্যোতিষ বলো, আর গ্রহ-উপগ্রহের দোষ-গুণ— যা-ই বলো-না কেন, সবই তা-ই। একটি অণু থেকে আরও অণু, ঠিক ভাইরাসের প্রতিলিপি গঠন করার মতো ব্যাপার। নৃত্যের বশে সুন্দর হল বিদ্রোহী পরমাণু, পদযুগ ঘিরে জ্যোতিমঞ্জীরে বাজিল চন্দ্র ভানু…’
‘আজকে তৃতীয় দিনেও দেখা গেল কোবল্ড সাহেবের দেহ থেকে মারণ ভাইরাস নিশ্চিহ্ন হয়নি। আপনি কালকে শেষ একবার দেখবেন বলেছেন, তখনও যদি দেখা যায় আপনার বন্ধু ভাইরাসেরা ব্যর্থ হয়েছে?’ গৌতম জিজ্ঞেস করল।
‘তা হলে আমি আবার শুরু থেকে শুরু করব গৌতম। আমার তো হারানোর কিছু নেই। যুগে যুগে ব্যর্থতার মধ্যে দিয়েই বিজ্ঞানের সাফল্য এসেছে। এতে ভেঙে পড়লে চলবে কেন?’
প্রায় শোনা যায় না এমন কণ্ঠস্বরে গৌতম বলল, ‘মহাভারতে একটা ঘটনা আছে যেখানে অজেয় বর্বরিককে হত্যা করার জন্য শ্রীকৃষ্ণ একটি বটগাছের দুটি পাতা হাতের মুঠোয় আর পায়ের পাতার নীচে লুকিয়ে রেখে তাকে বলেন, ওই গাছের সব পাতা একটিমাত্র তির নিক্ষেপ করে ছেদন করতে। এই যে প্রবঞ্চনার আশ্রয় নিয়েছিলেন ভগবান, তা কি ঠিক করেছিলেন?’
‘তোমার ভগবানই তো বলেছেন, তোমার আচরণ, ব্যবহার এবং কথায় যদি কোনও নিরাপরাধ ব্যথিত না হয়, তবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে করা সবরকম কাজই শ্রেয়।’
আজ গৌতম ফিরে যাচ্ছে কলকাতায়। সাত্যকি সোম তাকে কিছু দরকারি নির্দেশ দিয়েছেন তাঁর রোবট তৈরির ল্যাবরেটরির ছাত্রদের জন্য। গতকাল কোবল্ডও ফিরে গেছে তার দেশে। ডক্টর সোমের বন্ধু-ভাইরাস তাকে রোগমুক্ত করতে পারেনি। অবশ্য সে নিজেই বলেছে, তার শরীরের যা প্রতিরোধ ক্ষমতা আছে, এমনিতেই আর দু-একদিনের মধ্যে মারণ ভাইরাস হার মেনে যাবে। তবে ডক্টর সোমের ওপর ভরসা করে এত দূরে ছুটে আসাটা একরকম হঠকারিতাই হয়ে গেছে।
বিজ্ঞানী সাত্যকি সোম সেই থেকে একটু মুষড়ে পড়েছেন। এত বড় ভুল হয়ে গেল তাঁর গবেষণায়। গ্রামের অল্পশিক্ষিত মানুষ তাঁর নামের আগে ডক্টর লেখা দেখে তাঁকে ডাক্তার বলে মনে করে। ভাইরাস আক্রমণের পর এই একটি ব্যাপারে তিনি যেন সত্যিই ডাক্তারের ভূমিকা নিয়েছেন। এর আগে সবার ক্ষেত্রে তিনি সফল হয়েছেন। ঠেকিয়ে রেখেছেন মারণ ভাইরাসের আক্রমণ এই ছায়াঘেরা নির্জন গ্রামটিতে। তবে এবার তাঁর ভুলটা হল কোথায়? তবে কি মারণ ভাইরাসেরা আরও শক্তিশালী হয়ে উঠছে?
গৌতম যাওয়ার আগে সাত্যকি সোমের ঘরে প্রবেশ করে একবার গলা খাঁকারি দিল।
‘বলো গৌতম, এই ব্যর্থ বিজ্ঞানীকে তুমিও কিছু বলে যাও যাওয়ার আগে।’
‘আপনি তো ব্যর্থ নন। আপনার বন্ধু-ভাইরাসেরা ঠিকই কাজ করেছে।’
‘মানে? তুমি তো দেখলেই, চার দিনেও আমার নির্দেশক যন্ত্র সবুজ সংকেত দেখাল না। অর্থাৎ—’
‘ও যন্ত্র তো আমিই খারাপ করে দিয়েছি।’ মুচকি হেসে বলল গৌতম।
‘তার মানে? কেন করলে এ কাজ তুমি, গৌতম?’
‘আপনার আবিষ্কার নিয়ে ওই কোবল্ড সাহেব যে নিজের নামে, নিজের দেশের নামে চালানোর চেষ্টা করছিল। সারা পৃথিবীব্যাপী এই মারণ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে এক অভূতপূর্ব বিশ্ব-রাজনীতি দেখা দিয়েছে। সব দেশই চেষ্টা করছে সবার প্রথমে এর প্রতিষেধক আবিষ্কার করার। অনেকেই আবার তা আবিষ্কার হয়ে গেছে বলে দাবিও জানাচ্ছে। পরে দেখা যাচ্ছে, প্রতিষেধক কাজ হয়তো করছে, কিন্তু তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হচ্ছে মারাত্মক। এই অবস্থায় আপনার মতো একজন বিজ্ঞানীর এই আবিষ্কার নিজেদের দেশের কৃতিত্ব বলে দাবি করার জন্য সে দেশ থেকেই কোবল্ডকে পাঠানো হয়েছিল আপনার আবিষ্কারের ফরমুলা হাতিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আপনি সমগ্র মানবজাতির ভালো চেয়েছিলেন ডক্টর সোম। কিন্তু ইনি এই গবেষণা বাগিয়ে নিয়ে সেটাকে ব্যাবসার কাজে লাগিয়ে তার থেকে বিপুল অর্থোপার্জনের কথাটা বারবার বলছিলেন। তাতে আখেরে হয়তো কিছু ধনকুবেরেরই লাভ হত। তাই আমি সেটা জেনে চুপ করে থাকতে পারিনি। আমি কি ভুল করেছি ডক্টর সোম?’
‘কিন্তু তুমি এত কথা জানতে পারলে কী করে?’
‘প্রথমদিন রাতেই কোবল্ড নিজের ঘরে বসে মোবাইলে কারও সঙ্গে কথা বলছিল। ঠিক তার পাশেই ঘরটাই আমার জন্য বরাদ্দ করেছে যুধিষ্ঠির। মাঝখানে কাঠের পাতলা দেয়াল। খাটে বসে দিব্যি সব কথা শুনে ফেললাম। আর তারপরই আমার কর্তব্য স্থির করে নিলাম। আপনার ওই নির্দেশক যন্ত্রের খোলসটা স্ক্রুড্রাইভার দিয়ে খুলে ফেলা এমন কোনও কঠিন কাজ নয়। তারপর ওই লাল আলোর তার খুলে সবুজ আলোয়, আর সবুজ আলোর তার খুলে লাল আলোর পেছনে লাগিয়ে দিলাম। ওটা আবার ঠিক করে নেবেন।’
সাত্যকি সোম চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে গৌতমকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, ‘বন্ধু মনে করে যে বিজ্ঞানীকে ডেকে এনেছিলাম, তুমি তার মুখোশ আমার সামনে খুলে দিলে গৌতম। তুমিই আমার প্রকৃত বন্ধু। আমি আমার গবেষণা চালিয়ে যাব। এই পৃথিবীর মানুষকে যেন মুখোশ পরে আর বাইরে না বেরোতে হয়, সেটা নিশ্চিত করাই হবে আমার পাখির চোখ।’
*সাত্যকি সোমের দুই ছাত্রের মহাকাশ অভিযান নিয়ে খুব শিগগিরি আসছে রেবন্ত গোস্বামীর লেখা প্রথম কল্পবিজ্ঞান উপন্যাস, “সোনার তরীর দুই যাত্রী।”
[শ্রদ্ধেয় লেখক রেবন্ত গোস্বামীর কাছে আর্জি রেখেছিলাম, সাত্যকি সোমকে ফিরিয়ে আনার জন্য। তিনি একটা গল্পের কিছুটা লিখে তারপর আমাকে গল্পটা এগিয়ে নিয়ে যেতে বললেন। এমন একটা দায়িত্ব পেয়ে আমি তো হতভম্ব! বললাম, “আপনিই শেষ করুন-না।” কয়েকদিন আগেই লেখালেখির দীর্ঘ বিরতি থেকে ফিরে এসে তিনি লিখেছেন তাঁর প্রথম কল্পবিজ্ঞান উপন্যাস— কিন্তু উনি রাজি হলেন না। বললেন, “এই গল্পটা তুমিই শেষ করো। একদম এরকম হতে হবে তার কোনও মানে নেই, তোমার মতো করেও ভাবতে পারো।” গৌতমকে সাত্যকি সোম যেখানে বলছেন, ‘তাদের যে দেখা যায় না। তাদেরও নাম যে ভাইরাস।’ —অগত্যা আমি তার পর থেকে লেখা শুরু করলাম। জানি না কতটা কী হল, তবে উনি পড়ে খুব খুশি হয়েছেন। প্রিয় লেখক আর প্রিয় চরিত্রকে এই গল্পটা আমার শ্রদ্ধাঞ্জলি হিসেবে নিবেদন করলাম। —সুদীপ দেব।]
Tags: কল্পবিজ্ঞান গল্প, পঞ্চম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, বিজন কর্মকার, রেবন্ত গোস্বামী, সুদীপ দেব
দুর্দান্ত! রেবন্ত গোস্বামী’র এই অনন্য সৃষ্টির নতুন কীর্তিকলাপ পরিবেশনের দায়িত্ব যে যোগ্যতমের হাতেই ন্যস্ত হয়েছে, তা প্রমাণিত হল এই প্যাস্টিশেই।
অনেক ধন্যবাদ ঋজুদা।