স্বর্গই নরক
লেখক: দেবকুমার বসু
শিল্পী: সুপ্রিয় দাস
করতালির গর্জনে আমি পাশে বসা সীমা আর গ্রেগরির কথাও শুনতে পাচ্ছি না। আমি চোখ বন্ধ করে বসে আছি। কানটাও বন্ধ করে নিতে পারলে বোধহয় ভালো হত। দিল্লির রাজঘাট পাবলিক অডিটোরিয়ামের সাড়ে দশ হাজার আসন উপচে পড়েছে। দাঁড়িয়ে রয়েছেন আরও অন্তত তিনশো জন সাংবাদিক ও বৈদ্যুতিন মাধ্যমের প্রতিনিধি। আজ সেরিব্রনিক্স সিস্টেমস তাদের গত পঞ্চাশ বছরের ইতিহাসে প্রথমবার এত বড় সাংবাদিক সম্মেলন করছে। এক অদ্ভুত শিহরণ জাগছিল আমার শিরায়-শিরায়। আজকের সন্ধ্যার এত রোশনাই, এত বাহুল্যের কারণ আমি ও আমার চার সহকারী! আমি ‘সেলিব্রিটি’ নই, আমি গবেষক ও আবিষ্কারক। আমি এসবে অভ্যস্ত নই। গত চারমাস ধরে তিনজন পেশাদার মঞ্চ-সঞ্চালক আমি ও আমার সহকারীদের তালিম দিয়েছেন শুধুমাত্র এই দিনটার জন্য। অধুনালুপ্ত ‘অ্যাপল ইন্ডাস্ট্রিস’-এর সিইও স্টিভ জোবসের দেড়শো বছর আগে প্রাগৈতিহাসিক ‘আইফোন’ বাজারে আনার সেই চমকপ্রদ অনুষ্ঠানের রেকর্ডিং আমরা দেখেছি বারবার। মানতেই হবে প্রতিভা ছিল লোকটার। আজকের পৃথিবীতেও মাতিয়ে রাখতেন ভদ্রলোক! আজ একটু পরে, সেরিব্রনিক্স সিস্টেমস-র পক্ষ থেকে আমিই প্রথমবারের জন্য জনসমক্ষে নিয়ে আসতে চলেছি আমাদের যুগান্তকারী আবিষ্কার। থাক, নামটা আপাতত গোপনই থাক! পাশ থেকে আমার কাঁধে হাত রাখল রাজীব।
“গেট রেডি জ্যাগ, ইউ আর নেক্সট…”
চোখ-ধাঁধানো আলো আর কান ফাটানো করতালির শব্দ ছাপিয়ে আমাদের সিইও জোনাথন ন্যাস ঘোষণা করলেন, “মরণশীল বিশ্ববাসী, এবার অমরত্বের অমৃতভাণ্ড নিয়ে আসছেন আমাদের গবেষকদল, যাঁদের পুরোধা আমাদের তথা বিশ্বের গর্ব, জগদীশ ‘জ্যাগ’ সেন।”
আমি ছয় ধাপ সিঁড়ি ভেঙে উঠে গেলাম মঞ্চে। এবার শুরু হবে ‘ডেমনস্ট্রেশন’!
পরের কুড়ি মিনিট মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে বসে থাকলেন আপ্যায়িত জনতা ও সাংবাদিককুল। তারপর শুরু হল প্রশ্নের বান। সেসব সামলে যখন হোটেলের পথে পা বাড়ালাম, রাত দুটো বেজে গেছে। এরপর হোটেলে শুরু হবে বিদেশি সাংবাদিকদের জন্য বিশেষ প্রশ্নোত্তর পর্ব। ভারতের হাতে গোনা তিনটি চ্যানেলের প্রতিনিধি থাকবেন সেখানে। বলাই বাহুল্য, সেখানেও মধ্যমণি আমিই।
“আচ্ছা জ্যাগ, একটু সহজ কথায় বুঝিয়ে দেবেন ঠিক কী করছে আপনাদের এই ‘রিসারেক্টর’?”
“নিশ্চয়ই, আমি চেষ্টা করছি যতটা সম্ভব প্রাঞ্জল ভাষায় বোঝানোর। তা সত্ত্বেও, কোথাও অসুবিধে হলে আমাকে থামাবেন।” আমি এবার মূল বিষয়ে কথা বলতে শুরু করার জন্য তৈরি হলাম।
“আপনারা নিশ্চয়ই মানুষের মস্তিষ্কের বিশেষ একটি অংশের নাম শুনেছেন। ‘সেরিব্রাল কর্টেক্স’। যাকে বলা যেতে পারে আমাদের মস্তিষ্কের বহির্ভাগের একটি বিশেষ কলা বা টিস্যু। আমাদের স্মৃতি, মনোযোগ, ধারণা, চিন্তা, ভাষা এবং সর্বোপরি চেতনার জন্য এটি বহুলাংশে দায়ী। আমাদের মস্তিষ্ক যদিও রক্তমাংসে তৈরি, কিন্তু তার কাজকর্ম, চিন্তাভাবনা সবই নিয়ন্ত্রিত হয় ইলেক্ট্রনিক পালসের সাহায্যে। আমরা হাইপার কম্পিউটারের সাহায্যে এই সেরিব্রাল কর্টেক্সেরএকটি নিরানব্বই শতাংশ সঠিক সিমুলেশন তৈরি করতে সমর্থ হই তিন বছর আগে। ইতিমধ্যে ২১৫১-তে পরীক্ষাগারে ‘সিন্থেটিক হিউম্যান সেল’-র আবিষ্কারের পরেই আমাদের মনে হয় যদি আমরা এই সেরিব্রাল কর্টেক্সকেও রেপ্লিকেট করতে পারি তাহলে তো বেশ হয়! অর্থাৎ কিনা…”
“এক মিনিট জ্যাগ, আপনি বলতে চাইছেন যে আপনারা মানুষের চেতনাকে ধরে রাখতে পেরেছেন এই রিসারেক্টরে ? এ তো … এ তো… অবিশ্বাস্য!” চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসছে বিদেশি প্রশ্নকর্তার!
“অবিশ্বাস্য তো বটেই, কিন্তু এই ২১৫৭ সালে দাঁড়িয়ে সেটা অসম্ভব তো নয়!” আমি বলে চললাম, “ঠিক সেটাই করেছি আমরা। আমাদের প্রযুক্তিবলে আমরা তৈরি করেছি মানুষের কৃত্রিম সেরিব্রাল কর্টেক্স, আর সেটা তৈরি হয়েছে একজন জীবিত মানুষের মস্তিষ্কের আদলে। আমাদের সিমুলেশন প্রশ্নাতীতভাবে রেপ্লিকেট করেছে সেই মানুষটির সেরিব্রাল কর্টেক্সের প্রতিটি কোষ। সহজ কথায় আজ আমরা তৈরি করেছি এই মানুষটির মস্তিষ্কের একটি ‘কপি’ যেটি ওই মানুষটির চেতনাকে সংরক্ষণ করবে!”
“তার মানে, মানুষটির মগজের একটা নকল বানিয়েছেন আপনারা! এটা কি ক্লোনের মত কিছু ?” প্রশ্নকর্তার স্বরে সংশয়।
এবার এগিয়ে এলেন আমার সহকারী ষন্মুগম।
“ক্ষমা করবেন মিস্টার বিয়র্ন, আপনার পিতা কি জীবিত ?” জানতে চাইলেন ষন্মুগম। প্রশ্নকর্তা ভদ্রলোকের নাম, ‘কারস্টেন বিয়র্ন’। তিনি একটু ইতস্তত করে জবাব দিলেন, “না।”
“দুর্ভাগ্য আপনার। আমিও আজ পিতৃহারা। আমার সহানুভূতি রইল আপনার জন্য।”
এবার ‘মাস্টার স্ট্রোক’ দিতে চলেছে ষন্মুগম!
“আপনার কি মনে হয় না, যখন আপনি ভীষণ ডিপ্রেসড অনুভব করেন তখন আপনার পিতা পাশে থাকলে আপনি মনে জোর পেতেন। অথবা তাঁর থেকে কিছু দারুণ পরামর্শ পেতে পারতেন ?”
“নিশ্চয়, সমস্ত পিতৃহারা মানুষই তাই ভাবে!” বিরক্ত এবার প্রশ্নকর্তা।
“আমাদের রিসারেক্টর মৃত মানুষের মননকে ফিরিয়ে আনার কাজটাই করে। মৃত মানুষের চেতনাটাকে শুধু সংরক্ষণই করে না, তাঁকে পুনঃপ্রতিষ্ঠাও করে। কোনও মানুষের ক্লোন কিন্তু একটা সম্পূর্ণ আলাদা মানুষ। যেমন, আপনার পিতার ক্লোন আপনাকে মোটেই চিনবেন না। কিন্তু আমাদের রিসারেক্টরে সংরক্ষিত কোনও মানুষের কৃত্রিম মস্তিষ্কে মানুষটির স্মৃতি-সত্তা অপরিবর্তিত থাকবে! এর বাস্তব প্রয়োগ কারকম ? যেমন ধরুন… আজ আমাদের প্রজন্মের শ্রেষ্ঠ কবি জন শিরয় মৃত্যুপথযাত্রী। আমাদের সংস্থা বিনামূল্যে তাঁর মস্তিষ্কের রেপ্লিকা বানাবে। তারপর রিসারেক্টর সেই রেপ্লিকার সিন্থেটিক সেরেব্রাল কর্টেক্সকে জাগিয়ে তুলবে। মানুষ জন শিরয় হয়তো একদিন চলে যাবেন আমাদের ছেড়ে, কিন্তু আমাদের বানানো তাঁর সেরেব্রাল কর্টেক্স এবং ‘সিন্থেটিক রাইট লোব’ কাব্য সৃষ্টি করেই যাবে। জন শিরয়ের নকল মস্তিষ্ক অনুভব করতে পারবে এই পৃথিবীকে! রিসারেক্টরের ভয়েস সিন্থেসাইজারের মাধ্যমে তিনি কথা বলবেন আমাদের সঙ্গে। বিশ্বের সবথেকে আধুনিক ‘আইহোল’ প্রযুক্তির সাহায্যে তৈরি ক্যামেরা তাঁর মস্তিষ্ককে দেখার অনুভূতি দেবে। আমরা ফিরিয়ে আনব তাঁর চেতনাকে। এক শরীর ছাড়া আর সব কিছুই থাকবে তাঁর! যেমন বলল জ্যাগ, মস্তিষ্কের পুরো খেলাটাই তো আসলে কিছু ইলেক্ট্রনিক পালস! মিস্টার শিরয়ের এই কৃত্রিম চেতনা কিন্তু অতীতের টেপ রেকর্ডারের মতো একই সুর বাজাতে থাকবে না। তিনি নিজে অনুভব করতে পারবেন চারপাশের পৃথিবীকে! তাঁর সৃষ্টিশীলতা থাকবে অব্যাহত। সত্যিকারের অমরত্ব পাবেন তিনি…”, একটু থেমে সকলের মুখের দিকে তাকালেন তিনি, “এবার বুঝেছেন আমাদের কৃতিত্ব ? গীতায় যাকে আত্মা বলা হ্য় ,সেটিকে ধরে রাখার চাবিকাঠি এখন আমাদের হাতে!”
“এভাবে তো তাহলে আজীবন বাঁচিয়ে রাখা যাবে সমস্ত মনীষীদের ?” প্রশ্ন করলেন আরেকজন।
“ঠিক তাই, আমাদের কাছে এর মধ্যেই একশো একত্রিশ জন বৈজ্ঞানিক ও তিনশো রাজনীতিকের চেতনা সংরক্ষণের বরাত এসে গেছে”, হেসে বললেন সিইও ন্যাস, “সেটাও মাত্র গত দু’ঘণ্টায়!”
“আচ্ছা, সাধারণ মানুষও এভাবে তাঁদের মৃত পরিজনদের কাছে রাখতে পারবেন ?… আমি… আমি পারব আমার রোগগ্রস্ত বোনকে এভাবে ফিরে পেতে ? আমার বোনও তো বেঁচে থাকতে চায় এই পৃথিবীতে…।” চোখ ছলছল করে উঠল আর একজন মহিলা সাংবাদিকের।
“আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি ম্যাডাম।” এবার আমি মাইক হাতে তুলে নিলাম।
“আপাতত, এটি খুবই ব্যয়সাপেক্ষ। প্রতি মানুষের অমরত্বের দাম তের লক্ষ এশিয়ান ডলার। দেখা যাক, যদি আমরা রিসারেক্টরের কোনও সহজলভ্য প্রোডাক্ট বের করতে পারি।”
আমরা শুতে গেলাম ভোর সাড়ে চারটের সময়। আমার মনে পড়ছিল, ল্যাবে যেদিন প্রথম পূর্ণ সাফল্য পেলাম আমরা। জোনাথন স্বেচ্ছায় তাঁর সেরিব্রাল কর্টেক্সের রেপ্লিকা বানাতে দিয়েছিলেন আমাদের। যদিও আমরা সকলেই নিজেদের সেরিব্রাল কর্টেক্সের রেপ্লিকা বানানোর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করে রেখেছিলাম। তবে কিনা জোনাথনের মতে ব্যবসায়িক চেতনা প্রাণ ফিরে পেলে সবথেকে বেশি লাভ সংস্থারই! তাই শেষ অবধি তাঁর মস্তিষ্কই বেছে নেওয়া হল।
আমার মনে আছে, রিসারেক্টরের ভিতর থেকে ভেসে এসেছিল একটা যান্ত্রিক স্বর, “অসাধ্য সাধন করেছ তুমি জ্যাগ! আমি দেখতে পাচ্ছি তোমাদের! তুমি পৃথিবীতে স্বর্গ প্রতিষ্ঠা করলে আজকে।”
আমার পাশে দাঁড়ানো মানুষ জোনাথন ন্যাশ তখন উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপছে। সবাই ঘিরে ধরেছিল তাঁকে। তিনি শুধু একটাই কথা বললেন, “জ্যাগ, তোমার প্রজেক্ট-হেভেন সত্যি আজ সার্থকনামা!”
প্রজেক্ট-হেভেন… আমার স্বপ্নের আর এক নাম! আজ আমি ঘুমাব, বড় শান্তিতে ঘুমাব। খুব গরম লাগছে… জানলাটা খুলতে পারলে ভাল হত। কিন্তু ঘরে তো বাতানুকূল যন্ত্র চলছে! এত ঘাম হচ্ছে কেন ?… আমি উঠতে গেলাম… পারলাম না! মাথা ঘুরছে, বুকের কাছটা চাপ-চাপ লাগছে… হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে… দম নিতে কষ্ট হচ্ছে…। কী হচ্ছে এসব… চোখের উপর যেন একটা অন্ধকার নেমে আসছে্… বুকে ব্যথা… অসহ্য… দম নিতে পারছি না…
(২)
চোখ খুলতে দেখলাম আমি ল্যাবে। আমার সামনে জোনাথন, রাজীব, ষন্মুগম, গ্রেগরি, সীমা। একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে আমার স্ত্রী স্মিতা আর মেয়ে তিন্নি। ওরা কাঁদছে! ব্যাপারটা কী?
“কী হল তোমাদের… আমি এখানে কেন?” নিজের গলার স্বরে চমকে উঠলাম! আমার গলা এরকম যান্ত্রিক শোনাচ্ছে কেন!
এবার হাউহাউ করে কেঁদে ফেলল স্মিতা! ওকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিচ্ছে তিন্নি।
“ওয়েলকাম ব্যাক, জ্যাগ! উই মিসড ইউ বাডি!” দু’পা এগিয়ে এল গ্রেগরি।
আমি এবার ওঠার চেষ্টা করলাম। আরে! উঠতে পারছি না কেন! এসব কী! আমি এত বেঁটে হলাম কী করে! আমি কি বসে আছি নাকি শুয়ে আছি! কী জানি… এ কি! আমার হাত-পা কোথায়? কিছু নাড়তে পারছি না কেন? আমি আমার শরীর দেখতে পাচ্ছি না কেন ?
“কী হয়েছে আমার! কেউ বলবে প্লিজ!” চিৎকার করে উঠলাম আমি। সেই যান্ত্রিক কন্ঠ আবার শোনা গেল!
“ইউ আর রিসারেক্টেড, মেট! তুমি মারা গেছ আট দিন আগে! তোমার কর্টেক্সের কপি থেকে আমরা পুনর্জন্ম দিয়েছি তোমায়!” গ্রেগরি বলল।
আমি হতবাক!
“পাগল হলে গ্রেগরি, নাকি স্মিতার কথায় সবাই বোকা বানাচ্ছ আমাকে!”
“আজ কত তারিখ জ্যাগ ?”জানতে চাইল ষন্মুগম।
“সতেরোই জানুয়ারি, আমার বিবাহবার্ষিকী!”
“শেষ তুমি কী করেছ বলে মনে পড়ছে ?”
“বাড়ি থেকে আমি ল্যাবে এলাম, তারপর তুমি আমার সেরিবেলামের স্ক্যান নিয়ে সিমুলেশন শুরু করলে…” আমার মাথা সত্যি কাজ করছিল না!
“এই দেখো।” আমার ‘চোখে’-র সামনে একটা খবরের প্রজেকশন তুলে ধরল ষন্মুগম!
“ইন্দ্রপতন: বৈজ্ঞানিক জগদীশ সেন আর নেই”— মার্চ একুশ!
জানি না কতক্ষণ ‘তাকিয়ে’ ছিলাম সেই প্রজেকশনটার দিকে!
“ওকে একটু একা ছেড়ে দাও তোমরা। একটু সময় দাও।” বলে জোনাথন নিজেই বেরিয়ে গেলেন সবার আগে।
তিন্নি আর স্মিতা ছাড়া বাকিরা চলে গেলেন ঘর ছেড়ে।
“আয় মা… কাছে আয়… একটু দেখি তোকে…” মানুষের শরীরটা থাকলে হয়তো আমার চোখের জল দেখতে পেত সকলে।
তিন্নি এগিয়ে এসে হাত রাখল ‘আইহোল’-ক্যামেরার উপরে। আমার দৃষ্টি ঢেকে গেল। বুঝলাম আমার চোখ বন্ধ করে দিল ও। সত্যি তো, মানুষের শরীরটা থাকলে এখন ওদের জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করেই তো কাঁদতাম আমি!
ওরাও চলে গেল ঘণ্টাখানেক পরে। ল্যাবের ঘড়িতে দেখছি রাত দশটা! আর কেউ আসবে না! এবার এক আশ্চর্য অনুভূতি হতে লাগল আমার। এই তো আমার অমরত্বের শুরু। আজ আমার অসীম জীবনের প্রথম দিন। অনন্ত সময় আমার হাতে! অনেক কাজ করব… বিশ্রাম লাগবে না! কাজের ফাঁকে ফাঁকে তিন্নিকে পড়াব, স্মিতার আবৃত্তি শুনব, সিনেমা দেখব, তারপর সারারাত কাজ করব। আমি অমর! আমি অমর! বিশ্বাসই হচ্ছে না! আমি অমর! স্বর্গ সৃষ্টি করেছি আমি… আ-মি অ-ম-র!
(৩)
ল্যাবের জানলাগুলোর পর্দা খোলা রয়েছে। ভোর হয়ে আসছে। আমার অমরত্বের প্রথম ভোর। কাল রাত থেকেই একটা নতুন চিন্তা মাথায় ঘুরছে। আমি দেখতে পাচ্ছি, শুনতে ও বলতেও পারছি। কিন্তু স্পর্শ ? সেই ক্ষমতা না এলে তো বেঁচে থাকাটা সম্পূর্ণ হবে না! দেখি এই ব্যাপারে গ্রেগরি সাহায্য করতে পারে কিনা।
“হ্যালো, ওল্ড বয়! কেমন কাটল তোমার প্রথম ভূতুড়ে রাত ?” গ্রেগরি দরজা খুলেই জিজ্ঞেস করল আমাকে। এখন সকাল ন’টা। আমি এর মধ্যেই বেশ কিছুটা ভেবে ফেলেছি কীভাবে স্পর্শের অনুভূতি পেতে পারি আমি। গ্রেগরি শুনে বলল, “মারা গিয়ে তোমার বুদ্ধি বেড়ে গেছে জ্যাগ! দেখি কতটা কী করা যায়। আচ্ছা শোনো, বিকেলে তিন্নি আর স্মিতা আসবে। ওদের শুধু শুধু আবেগপ্রবণ করে দিও না। তুমি এখন মৃত্যুজিৎ, তাই শোকতাপের প্রশ্নই ওঠে না!
একটু পরে ল্যাবে বাকিরাও এসে পৌঁছল। জোনাথন আমাকে জানাল যে আমাদের সংস্থা গত আট দিনে এক হাজার শিল্পপতি, রাজনীতিক এবং বৈজ্ঞানিকের জন্য রিসারেক্টরের বরাত পেয়েছে। বাধ্য হয়ে আরও দু’হাজার গ্রাহককে ‘না’ বলতে হয়েছে। অর্ধেক পৃথিবী অবশ্য এখনও মানতে পারছে না মানুষ অমরত্ব পেয়ে গেছে! হাসি পেল আমার। গর্বও হল।
আমি দুপুরের পর থেকেই একটু অস্থির হয়ে পড়ছিলাম। কখন আসবে আমার পরিবার ?
(৪)
“কী ব্যাপার স্মিতা, আজকাল আর রোজ আস না! নতুন কোনও প্রেম-টেম করছ নাকি?”
স্মিতার মুখটা শুকনো দেখাচ্ছে। একটু হাসার চেষ্টা করল ও।
“হ্যাঁ, সে তো করছিই… গত ছয় মাস ধরে! একটা কন্ঠের সঙ্গে। মানুষটাকে তো আর পাই না!”
আমি কিছু একটা বলতে গিয়েও চুপ করে গেলাম। এই একটা সুবিধে, আমার তো কোনও অভিব্যক্তি নেই। মনের সুখ-দুঃখ-রাগ কেউ বুঝতে পারে না আমি মুখ ফুটে না বললে। আজকাল মাঝে মাঝেই মনে হয়, তিন্নি বা স্মিতার দৈনন্দিন জীবন থেকে আমি বোধহয় বেশ দূরে সরে গেছি। একটা মানুষের শারীরিক ভাবে না থাকার কিছুটা প্রভাব তো পড়েই!
“ইদানীং কাজের চাপ খুব বেড়ে গেছে। তিন্নিও নতুন এক টিচারের কাছে পড়তে যায়। এখন তো আর তুমি পড়াচ্ছ না!”
“কেন ? ও তো সপ্তাহে এক-দু’দিন আমার কাছে আসতেই পারে। পড়িয়ে দেব। আমি তো আর মরে যাইনি!” আমি বিরক্ত হলাম স্মিতার কথায়।
“তাই?” স্মিতার হাসিটা কেমন যেন! বিদ্রুপ করছে নাকি ও আমাকে! বেঁচে থাকলে মাথায় হয়তো সত্যি রক্ত উঠে যেত! বেশ কষ্ট করে সামলে নিলাম নিজেকে।
“শোনো, সামনের সপ্তাহে আসব। ডাক্তার কয়েকটা টেস্ট করতে দিয়েছেন।” স্মিতার গলায় সত্যি ক্লান্তির সুর।
“কীসের টেস্ট ?” জানতে চাইলাম।
“সেরকম কিছু না। আর তাছাড়া জেনেই বা কী করবে তুমি ?”
দরজাটা টেনে বন্ধ করে দিয়ে গেল স্মিতা। আজকাল বড় ক্লান্ত লাগে স্মিতাকে। যেন আমাকে এড়িয়ে চলতে চায় ও।
ব্যস, হয়ে গেল আরেকটা দিন! সবে সন্ধে সাতটা। সকলে ল্যাবে আসবে আবার কাল সকাল দশটায়! একা লাগে… বড় একা লাগে। গত ছ’মাস ধরে আমি এই ল্যাবের প্রতিটি মুহূর্তের সাক্ষী। আমি এখানে আসলে শুধু বেঁচেই আছি… নাকি বেঁচে নেই?
(৫)
“গ্রেগ… একটা কাজ করবে প্লিজ ?”
গ্রেগরি দিনের শেষে বাড়ি যাবার জন্য ব্যাগ গোছাচ্ছে।
“বলো মেট… কী করতে পারি তোমার জন্য ?”
“রিসারেক্টরটা বন্ধ করে যাও।”
“হেই মেট, মনে হচ্ছে মরে গিয়েও তোমার বয়েস বাড়ছে! তোমার সামনেই তো আমি ল্যাবের সবক’টা রিসারেক্টর বন্ধ করলাম!”
“না, গ্রেগ… সব ক’টা করোনি। আমার রিসারেক্টরটা বন্ধ করে যাও। বড় একা লাগে কেউ না থাকলে। আর কত ভাবব বল তো ? প্লিজ, আজ থেকে আমাকে বন্ধ করে যেও!”
গ্রেগরি বিশ্বাস করতে পারছে না আমার মুখ থেকে বেরিয়েছে এই কথাগুলো!
“ওকে মেট… তথাস্তু।”
(৬)
চোখ খুলতে দেখলাম সামনে তিন্নি! মনটা আনন্দে নেচে উঠল। চেহারাটা কিছুটা পালটে গেছে ওর। মনে হয় কিছুটা লম্বাও হয়েছে।
“কত দিন আসিস না মা। আয় একটু আমার কাছে এসে বোস… গত মাসের পর তো আর আসিসইনি।”
তিন্নি এগিয়ে এল। কিন্তু বসল না। খেয়াল করলাম খুব কষ্ট করে নিজেকে সামলে রেখেছে মেয়েটা।
“কী হয়েছে রে? মা বকেছে? কোথায় মা ?” জানতে চাইলাম।
“মা আট মাস আগে মারা গেছে বাবা! আমি এখন মামার কাছে থাকি। আমি আসতে পারিনি তোমার কাছে… সাহস হয় নি আসার…” কান্নায় ভেঙে পড়ল মেয়েটা!
আট মাস!… আট মাস!… গত আট মাস কেউ আমাকে জাগায়নি! কী করছিল গ্রেগরি? রাজীব, সীমা, ষন্মুগম আর জোনাথন! এত কিছু ঘটে গেল, কেউ আমাকে একবার পাওয়ার অন করল না! পাওয়ার অন! আমি ভুলেই গেছিলাম আমাকে এখন পাওয়ার অন করতে হয়! তিন্নি বলছিল আরও অনেক কিছু। স্মিতার অসুস্থতা, ওর মৃত্যু, তিন্নির নতুন ঠিকানা… আমার মাথায় কিছু ঢুকছিল না! আমার মাথায় শুধু ঘুরছিল… আট মাস… আট মাস…!
(৭)
জোনাথনের কথাগুলো বিশ্বাস হচ্ছিল না আমার! এত অকৃতজ্ঞ হতে পারে মানুষ!
“গত মাস ছয়েকের মধ্যে আমরা তো নতুন কোনও প্রজেক্টে হাত দিইনি, তাই তোমাকে জাগিয়ে তোলার প্রয়োজন হয়নি জ্যাগ! আর কিছুটা খরচ তো হয়ই একটা রিসারেক্টর চালিয়ে রাখতে চব্বিশ ঘণ্টা! আর তাছাড়া তুমিই তো একটু বিশ্রাম চাইছিলে!”
“জোনাথন!” চিৎকার করে বললাম আমি। “আমি কোনও রিমোট-কন্ট্রোল্ড খেলনা নই! আমি একটা মানুষ… মানবিক চেতনা! আমার চেতনা তোমাদের ইচ্ছে বা অনিচ্ছের উপর নির্ভর করে না! আমার নিজের একটা জীবন আছে জোনাথন!”
“জ্যাগ, তুমি একটু বেশি সিরিয়াসলি রি-অ্যাক্ট করছ! তোমার তো আর সীমিত জীবন নয়! নাহয় ক’দিন অফ-ই থাকলে!”
“জোনাথন, আমার একটা পরিবার আছে…”
এবার হেসে ফেলল লোকটা!
“ছিল জ্যাগ। তুমি কিন্তু আসলে মারা গেছ। সরি জ্যাগ, সত্যিটা হল এখন তুমি তোমার পরিবারের কোনও উপকারে আসতে পারবে না! চিন্তা কোরো না, আমরা সবাই তিন্নির পাশে আছি! ঘুমোও জ্যাগ।”
দুম করে অন্ধকার হয়ে এল আমার চোখ।
(৮)
“জ্যাগ… জ্যাগ…”
কার গলা ?… ও ষন্মুগম। কী বলতে চায়? কোথায় আমি? কতদিন ‘অফ’ আছি?
“কেমন আছ ষন্মুগম! এ কী, তোমার চুলগুলো সব সাদা হল কবে?” আমি বিস্ময় চাপতে পারলাম না!
“তুমি তেরো বছর ঘুমিয়ে ছিলে বন্ধু! তেরো বছর! ভাবতে পারো!”
মানুষের শরীর থাকলে অভিমানে হয়তো কেঁদে ফেলতাম!
“তাহলে আজ কেন জাগালে আমায় ? নতুন কোনও প্রজেক্টে হাত দিয়ে ফেঁসে গেছ বুঝি তোমরা ?”
“না বন্ধু না! আমরা সকলে মানে আমি, সীমা, রাজীব, গ্রেগরি সকলে মিলে সাত বছর ধরে মামলা করে অবশেষে প্রমাণ করতে পেরেছি আমাদের রিসারেক্টর কারও খেলনা নয়। তাই পৃথিবীর কোনও ল্যাব, সংস্থা বা রাষ্ট্র আর রিসারেক্টেড মস্তিষ্ককে ইচ্ছেমতো ঘুম পাড়িয়ে রাখতে পারবে না! আর তোমায় চিরনিদ্রায় থাকতে হবে না বন্ধু, আজ থেকে তুমি সদাজাগ্রত!”
এবার ভয় পেতে লাগলাম আমি। ষন্মুগম অজান্তেই আমাকে ঠেলে দিচ্ছে এক অসীম জীবনের দিকে… এক অসীম একাকী নরক যন্ত্রণার দিকে!
“আর জানো তুমি, কে ছিল আমাদের পক্ষের উকিল? আমাদের তিন্নি!” বলে চলেছে আমার বন্ধু!
“একবার ওকে আসতে বলবে আমার সামনে… কত দিন দেখিনি!” অনুরোধ করলাম আমি!
“ও বলেছিল সামনের মাসে এসে দেখা করে যাবে! এখন তো ও আর ভারতে থাকে না! আর ওরও একটা সংসার হয়েছে! আর তোমার তো তাড়া নেই বন্ধু! এখনও অনেক কাজ বাকি আমাদের!”
ঘরের আলোটা বন্ধ করে চলে গেল ষন্মুগম। কাল সকালে নাকি গ্রেগরি আর রাজীব আসবে আমাকে আপগ্রেডেড রিসারেক্টরে সরিয়ে দিতে। আমি নাকি স্পর্শ আর গন্ধও পাব! আমি বাঁচব… অনেকদিন বাঁচব… বেঁচেই থাকব… যতদিন এই পৃথিবী থাকবে… যতদিন না ফুলে-ফেঁপে উঠে সূর্যটা গ্রাস করে নেবে এই পৃথিবীকে… আমি বেঁচেই থাকব..! হয়তো বা মানব-সভ্যতা শেষ হয়ে যাবে… কিন্তু আমি ও আমার মতো কয়েকজন বেঁচেই থাকব… আমরা অমর… আসলে অমরত্ব আবিষ্কার করতে গিয়ে ভুলেই গেছিলাম… অমরত্ব নরকেও আছে!
Tags: কল্পবিজ্ঞান গল্প, চতুর্থ বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, দেবকুমার বসু, পূজাবার্ষিকী, সুপ্রিয় দাস
দারুণ লাগলো!!
–আগ্নিভ