অন্ধকারের উৎস হতে
লেখক: সৌম্য সুন্দর মুখোপাধ্যায়
শিল্পী: সুদীপ্ত রায়
অন্ধকারের উৎস হতে
লেখক – সৌম্য সুন্দর মুখোপাধ্যায়
অলংকরণ – সুদীপ্ত রায়
আমাকে হাসতে দেখে ফকির আলি রেগেই গেল। বলল, “আপনারা এসবের কতোটুকু জানেন? এই শহরের অফিস আর বাড়ি আর টুকটাক দোকানপত্র আর ছুটিছাটায় পুরী কি সিমলা কি দার্জিলিং—আপনাদের দুনিয়া তো এইটুকুই।”
তার ধমক খেয়ে আমি হাসি কমালাম। ফকির আলি লোকটি বেশ ভালো; আমাদের বাড়িতে তার যাতায়াত আছে। তার বদগুণ বলতে ওই একটি—মাঝে মাঝে বড্ড রং চড়িয়ে কথা বলে। বয়স হবে তার ষাটের ওদিকেই। আমার বাবার কাছে একসময় একটা ব্যাপারে সাহায্য পেয়েছিল—সে কৃতজ্ঞতা ফকির আলি আজও ভোলেনি।
আমি হাসি থামালাম বটে, কিন্তু একটু চিমটি কাটার লোভও সামলাতে পারলাম না। বললাম, ‘তা আলিসাহেব, আপনার দুনিয়াটা কত বড়? মাঝে মধ্যে প্যারিস বা সুইজারল্যান্ড যাতায়াত করেন নিশ্চয়ই?’
ফকির আলি রাগল না; মুখ বাঁকিয়ে একটু হাসল। বলল, ‘আপনার আর কতই বা বয়স হবে মিশ্রবাবু? বড়জোর তিরিশ-বত্রিশ। সেই জন্যই জানেন না, আপনার ঘরের পাশেই এমন জিনিস লুকিয়ে থাকে, হাজার বিদেশ ঘুরেও তার জোড়া পাবেন না।’
বুঝলাম, জানা থাকলে ফকির আলি এক্ষুনি রবি-কবিতা আউড়ে যেত, ‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া/ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া’ ইত্যাদি। কিন্তু লোকটাকে আর খোঁচাতে ইচ্ছা হল না। বললাম, ‘ঠিক আছে, আপনি যে-টা বলছিলেন, সেটাই বলুন। কাঁটার ব্যাপারে কী বলছিলেন? গিরগিটির মতো?’
তার কথা মন দিয়ে শুনেছি দেখে ফকির আলি খুশি হল। বলল, ‘হ্যাঁ, ওদের হাতের উলটো পিঠে খুব সরু একসারি কাঁটার মতো জিনিস থাকে। গিরগিটির ঘাড় থেকে পিঠ পর্যন্ত যেমন থাকে, ঠিক সেরকম।’
আমি একটু নম্র তর্ক করার চেষ্টা করলাম, ‘কিন্তু এরকম কেউ দেখেছে কি? নাকি এটা একটা গণবিশ্বাস?’
ফকির আলি কিন্তু তর্ক করল না, কেমন যেন মিইয়ে গেল। বলল, ‘যে দেখেছে, তার কথা কেউ বিশ্বাস করবে না।’
আমি বললাম, ‘কে দেখেছে? আপনি নিজে?’
সে সরাসরি উত্তর দিল না। ‘তা হলে আপনাকে ঘটনাটা বলতে হয়।’
মনে মনে বললাম, শুরু হল আরব্য রজনী। মুখে বললাম, ‘বলুন, বলুন।’
ফকির আলি কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে একটু ভাবল। তারপর কাঁধ ঝাঁকুনি দিয়ে সোজা হয়ে বসল। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে সে শুরু করল—
‘আমার দেশের বাড়ি যে গ্রামে, তার নাম তো আপনি জানেন। ঘটনাটা ঘটেছিল সেখান থেকে মাইল তিনেক উত্তরে—গ্রামটার নামও আপনাকে বলি—কোয়ালপুর।’
‘কোয়ালপুর’ নামটা শুনেই আমার মনে পড়ে গেল অনেকদিন আগে খবরের কাগজে পড়া একটা ঘটনার কথা। বললাম, ‘আচ্ছা, এখানেই একটা বাচ্চা মেয়ে গর্তে পড়ে গিয়েছিল না? আর তাকে বাঁচানোর জন্য আরও দুটো ছেলে…’
ফকির আলি আমাকে হাত তুলে থামিয়ে দিল। —‘হ্যাঁ, খবরটা কাগজে বেরিয়েছিল। আপনিও ততটাই জানেন, যতটা কাগজে বেরিয়েছিল। বাকিটা আমার কাছে শুনুন।’
ফকির আলি আবার শুরু করল। —‘কোয়ালপুরে আমার দু-ঘর আত্মীয় আছে। তাই যাতায়াত লেগেই থাকে। সেদিনও সকালবেলায় কি একটা কাজে গেছি আমার শালা ফিরোজের কাছে। গিয়ে দেখি হইহই রইরই কান্ড। গ্রামের সব লোক জড়ো হয়েছে নারকেলতলার মাঠে।
ফিরোজ বলল, ‘কি হয়েছে জানো? একটা বাচ্চা মেয়ে পড়ে গেছে খোপড়িকুয়ার মধ্যে।’
আমি চমকে উঠলাম। খোপড়িকুয়া কোয়ালপুরের অন্যতম কুখ্যাত জায়গা। একটা বিশাল গর্ত—তার শেষ দেখা যায় না উপর থেকে—টর্চ ফেললেও বোঝা যায় না কিচ্ছু। ওর মধ্যে পড়লে উদ্ধারের আশা নেই বললেই চলে।
‘স্থানীয় লোকেরা জানে; তারা ছেলেমেয়েদের এদিকে আসতে দেয় না। কিন্তু গরু-ছাগল মাঝে মধ্যেই গিয়ে পড়ে ওর মধ্যে। তারা ওখানেই মরে। খোপড়িকুয়ার মুখের কাছে অনেক সুন্দর সুন্দর ঘাস হয়। বোকা জন্তুগুলো সেই ঘাসের লোভেই মরে। অনেকে বলে, খোপড়িকুয়ার মুখের সামনে দাঁড়ালেই নাকি ওর ভেতর ঝাঁপ দেওয়ার জন্য মনটা আকুলিবিকুলি করতে থাকে। জায়গাটা আসলে ভালো নয়। কুয়াটা জীবজন্তু মানুষ সবাইকে ডাকে।
বুঝলাম, বেচারি মেয়েটাকে আর পাওয়া যাবে না। খোপড়িকুয়ায় অনেক জীবজন্তুর খোপড়ির সঙ্গে একটা মানুষও যোগ হবে।
আমি বললাম, ‘কাদের ঘরের মেয়ে রে ফিরোজ?’
ফিরোজ বলল, ‘ওই তো মুশকিল। আমাদের কোয়ালপুরের কেউ নয় মেয়েটা।’
আমি বললাম, ‘তাহলে?’
ফিরোজ বলল, ‘ভরতপুরে মেলা বসেছে না? দূর দূর গাঁয়ের যত লোক সব তো কোয়ালপুরের ভেতর দিয়েই যাচ্ছে। এই মেয়েটাও বোধহয় অন্য কোনও গাঁয়ের মেয়ে। মেলা যেতে যেতে কোনও কারণে এসে পড়েছিল খোপড়িকুয়ার মুখে, আর…’
ফিরোজ কথাটা শেষ করল না, কিন্তু বাকিটা বুঝতে অসুবিধা হল না। স্থানীয় লোকেরা বলে, খোপড়িকুয়া নাকি বাচ্চাদের চুম্বকের মতো টানে।
মনটা খারাপ হয়ে গেল। গাঁয়ের লোক চেষ্টা করছে বটে মেয়েটাকে তোলার, কিন্তু এ যে বৃথা চেষ্টা সে আমরা সবাই জানি। খোপড়িকুয়ার মধ্যে যে থাকে, সে এতক্ষণ ওকে চুষে ছিবড়ে করে ফেলেছে।
সবাই বলে, খোপড়িকুয়াতে নাকি একজন থাকে। মাটির অনেক নিচে তার বাস। মাটির তলায়, পৃথিবীর পেটের মধ্যে যে সব অন্ধকার গলিঘুঁজি আছে, সেখানে তার চলাফেরা। জ্যান্ত প্রাণী যদি সে পায়, তাহলে আর রক্ষা নেই। বিশেষ করে বাচ্চাদের প্রতি তার যত লোভ।
আমি বললাম, ‘কিন্তু মেয়েটা যে ওর মধ্যে পড়েছে, জানা গেল কী করে?’
ফিরোজ বলল, ‘আরে আমাদের গাঁয়ের শামিম আর সান্টু তখন আসছিল নারকেলতলার মাঠের পাশ দিয়ে… দাঁড়াও, ওই তো ওরা। ওদেরকে ডাকি একবার।’
ফিরোজ গলা তুলে হাঁক দিল, ‘অ্যা শামিম, অ্যা সান্টু, এদিকে।’ দুটো তেরো চোদ্দ বছরের ছেলে আমাদের দিকে তাকাতে ফিরোজ হাত নেড়ে ইশারা করল।
ছেলে দুটো দৌড়ে এল, চোখেমুখে উত্তেজনা। সান্টু বলল, ‘ফকিরচাচা, শুনেছ?’
আমি বললাম, ‘আরে শুনব বলেই তো তোদের ডাকলাম। কী হয়েছে বল দেখি।’
শামিম বলল, ‘আর বলব কি, কাল বিকেলে আমি আর সান্টু যাচ্ছিলাম নারকেলতলার পাশ দিয়ে ফুফার বাড়ি। হঠাৎ দেখি, খোপড়িকুয়ার মুখের কাছে দাঁড়িয়ে একটা লাল ফ্রকপরা মেয়ে উঁকি মারছে ভেতরে।’
সান্টু বলল, ‘আমি তো দেখেই বুঝেছি, কেস খারাপ। বাচ্চা মেয়ে কুয়ায় উঁকি মারছে মানে কুয়া ওকে টানবেই। বিশেষ করে অনেকদিন কারও গরু-ছাগল হারায়নি। মানে কুয়াটা খিদেয় লকলক করছে। আমরা দুজন ছুটলাম মেয়েটার দিকে। ওকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিলে আপাতত নিশ্চিন্ত।’
শামিম বলল, ‘দুজনে তো ছুটছি আর প্রাণপণে চ্যাঁচাচ্ছি, সরে যাও, সরে যাও। মেয়েটা আমাদের দেখল, কিন্তু সরল না। ফকিরচাচা, কি বলব তোমাকে, কি সরল সাদাসিধে দেখতে মেয়েটা। ওই বছর দশ-এগারো বয়স হবে। কিন্তু ওর চোখদুটো… বল সান্টু?’
সান্টু বলল, ‘হ্যাঁ, চোখদুটো। মেয়েটার চোখ দেখেই আমরা বুঝে গেছি, ওর ঘোর লেগে গেছে। আমরা ধাক্কা মারতে ও কুয়া থেকে অন্য দিকে সরে গেল। কিন্তু…’
শামিম বলল, ‘কিন্তু তারপর মেয়েটা কি বলল জানো? বলল এই কুয়ার ভেতর থেকে কে একজন আমাকে ডাকল। আমি একবার দেখি।’—এই বলে আমরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই ছুটে গিয়ে দিল গর্তে ঝাঁপ।
সান্টু বলল, ‘আমরা তো তখন আর কথা বলতে পারছি না। চোখের সামনে কাউকে এভাবে মরতে তো কখনও দেখিনি। কিন্তু তারপর…’
শামিম বলল, ‘তারপর স্পষ্ট শুনলাম, মেয়েটা বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করছে। মাটির অনেক নিচ থেকে আসছে, কিন্তু আমরা দু-জনেই শুনেছি।’
সান্টু বলল, ‘তক্ষুণি গিয়ে দু-জনে খোপড়িকুয়ার মধ্যে উঁকি মারলাম। ততক্ষণে চিৎকার থেমে গেছে। কুয়ার মধ্যে শুধু অন্ধকার।’
ফিরোজ আমার মুখের দিকে তাকাল। বলল, ‘ব্যাপার বুঝলে?’
ব্যাপার বুঝতে আর বাকি কি আছে? আমি মাথা নাড়লাম। মনটা খারাপ হয়ে গেল। আহা গো, কাদের বাড়ির মেয়ে, কে জানে! ওর বাপ-মা এতক্ষণ কোথায় কোথায় মেয়েকে খুঁজে হয়রান হচ্ছে, আল্লা জানেন।
আমি আমার গ্রামে ফিরে এলাম। আসার পথে শামিম-সান্টুর সঙ্গে আরেকবার দেখা হল। শামিম বলল, ‘কি বলব ফকিরচাচা, মেয়েটার ওই ‘বাঁচাও বাঁচাও’ চিৎকারটাই শুধু কানে বাজছে।’
ছেলে দুটোকে যথাসাধ্য সান্ত্বনা দিয়ে বাড়ি ফিরলাম। তারপর সারাদিনের নানারকম কাজের চাপে কোয়ালপুরের ঘটনাটা কোথায় চাপা পড়ে গেল।
পরের দিন ঘুম ভাঙল মোবাইল ফোনের শব্দে। ‘হ্যালো’ বলতেই ফিরোজের উত্তেজিত গলা কানে এল। —‘কি হয়েছে জানো? সান্টু-শামিমকে পাওয়া যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে ওরাও…’
বাকিটা আর বলতে হল না। প্রচন্ড আতংকে সোজা হয়ে উঠে বসলাম। সাইকেলটা বার করে যত তাড়াতাড়ি চললাম কোয়ালপুরের দিকে।
ওখানে পৌঁছে জানতে পারলাম, শামিম আর সান্টু কাল রাতের বেলা কাউকে কিচ্ছু না জানিয়ে দড়ি আর টর্চ নিয়ে নেমেছে খোপড়িকুয়ার মধ্যে। যাওয়ার আগে দু-জনে বাড়ির লোককে স্রেফ দুটো চিঠি লিখে রেখে গেছে বিছানার উপর। চিঠির বক্তব্য— ‘আমরা যাচ্ছি মেয়েটিকে উদ্ধার করতে।’
‘চরম পাগলামি!’
তারপর মনে পড়ল, গতকাল সান্টু বলেছিল ওরা দুজনেই মেয়েটার সন্ধানে উঁকি মেরেছিল খোপড়িকুয়ার মধ্যে। বুঝলাম, ওদেরকেও আর পাওয়া যাবে না। খোপড়িকুয়া ওদের টেনে নিয়েছে।
কোয়ালপুর গ্রামে তখন চরম শোরগোল চলছে। শামিমের মা বুকফাটা কান্না কাঁদছেন, সান্টুর মা থেকে থেকে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছেন। শামিমের দুই দিদি কাঁদছে, সান্টুর ছোট ভাইটা বুঝতেই পারছে না, কি হয়ে গেছে। দুজনের বাবারাও দিশাহারা। গ্রামের লোকেরা খোপড়িকুয়ার ধারে গিয়ে চিৎকার করছে শামিম-সান্টুর নাম ধরে, কিন্তু কেউ আর ভেতরে তাকাতে ভরসা পাচ্ছে না। সে এক অদ্ভুত করুণ পরিবেশ।
ফকির আলি থামল, একটু জল খেল। আমি রুদ্ধশ্বাসে শুনছিলাম। বললাম, ‘তারপর?’
ফকির আলি হাসল—বড় ম্লান হাসি। বলল, ‘তারপর মিডিয়া খবর পেল, নিউজ চ্যানেলের গাড়ি জুটল, কোয়ালপুরে কলকাতার বাবুবিবিদের পা পড়ল। এ ছাড়া আরেকটা জিনিস হল। সেনাবাহিনী নামল উদ্ধারকার্যে।’
আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, বাকি নিউজ কাগজে পড়েছি, টিভিতেও দেখিয়েছে।’
ফকির আলির মুখ দেখেই বোঝা গেল, সে রেগে গেছে।
—‘কাগজে পড়েছেন? টিভিতে দেখিয়েছে? খোপড়িকুয়ার এত ইতিহাস খবরে বলেছে? মেয়েটার শেষ পরিণতি কি হয়েছিল, বলেছে? তার বাড়ি কোথায়, বাবার নাম কি, এগুলো বলেছে?’
স্বীকার করলাম, বলেনি।
ফকির আলি নিজেকে সামলে নিল—‘জানলে তো বলবে।’
আমি বললাম, ‘আপনি বলুন।’
ফকির আলি বলল, ‘আমিও জানি না। যেটুকু জানি, বলছি, শুনুন। সেনাবাহিনীর লোক তিনটে বডি উদ্ধার করেছিল—দুটো বাচ্চা ছেলে আর একটা লাল ফ্রক পরা বাচ্চা মেয়ে। আশ্চর্যের কথা, মেয়েটা তখনও বেঁচে ছিল।’
‘গাঁয়ের ছেলে দুটোর দেহ দেখে আমরা চমকে উঠলাম। দেহগুলো যেন খড়ের মতো শুকনো আর হালকা হয়ে গেছে।’
‘খোপড়িকুয়ার ভেতর থেকে সেই প্রথম কিছু ফেরত এল। শামিম-সান্টুর মৃতদেহগুলো তবুও পাওয়া গেল—এটুকুই সান্ত্বনা। ওদের কবর অন্তত দেওয়া যাবে। কিন্তু মেয়েটা বাঁচল কী করে?’
‘আমাদের সবার কৌতূহল, কী আছে খোপড়িকুয়ার মধ্যে। একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী যে, সেই লালফ্রক ততক্ষণে ভয়ে, খিদেয়, তেষ্টায় নেতিয়ে পড়েছে। দুদিনেরও বেশি সময় ধরে এই আতংকের সঙ্গে যুদ্ধ করে মেয়েটা যে বেঁচে আছে, এই ঢের।’
আমি আর ফিরোজ দায়িত্ব নিয়ে মেয়েটাকে ফিরোজের ঘরে নিয়ে গেলাম। তার উঠানে খাটিয়ায় বসে মেয়েটা ঠকঠক করে কাঁপছিল। ফিরোজের বউ একটা কম্বল এনে ওর গায়ে জড়িয়ে দিল। মনে হল, ওর খুব ঠান্ডা লাগছে।
ফিরোজ বলল, ‘ওকে এক গ্লাস গরম দুধ এনে দাও তো।’
পাঁচ মিনিটের মধ্যে দুধের গ্লাস এসে গেল। আমি মেয়েটার হাতদুটো ধরে গ্লাসটার উপর আটকে দিলাম। ভেবেছিলাম, এই ঠান্ডায় হয়তো গরম গ্লাসটা দু-হাতে আঁকড়ে ধরলে ওর একটু আরাম লাগবে।
হাতদুটো ধরেই চমকে উঠলাম। ওর হাতের পাতার পিঠের দিকে একসার সরু সরু গিরগিটির মতো কাঁটা আমার হাতে ফুটল। আমি ওর দিকে ভালো করে তাকালাম। ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে গেল।
আজ আড়াই দিন ধরে যে মেয়ে খায়নি, একটা ষাট-পঁয়ষট্টি ফুট অন্ধকার গর্তে কাটিয়েছে, ভয়-দুশ্চিন্তা-হতাশার সঙ্গে যুদ্ধ করেছে, একফোঁটা জলও পায়নি, সেই মেয়ের ঠোঁট এত পুরন্ত লাল হয় কী করে? তার গালে এত স্বাস্থ্যকর গোলাপী আভা আসে কোথা থেকে? আমার মনে শামিম আর সান্টুর শুকনো ছিবড়ে হয়ে যাওয়া মৃতদেহ দুটোর ছবি ভেসে উঠল।
সে একটু হাসল।
আমি কাঁপতে কাঁপতে সরে গেলাম খাটিয়ার সামনে থেকে। কাঁপা গলায় ডাকলাম, ‘ফিরোজ।’
ফিরোজ কি করতে ঘরে ঢুকেছিল। ভেতর থেকে সাড়া দিল, ‘আসছি।’
সে এসেই প্রথম প্রশ্ন করল।—‘আরে! মেয়েটা কোথায়?’
মাথা ফিরিয়ে তাকালাম। খাটিয়া ফাঁকা। কেউ কোত্থাও নেই, পড়ে আছে শুধু কম্বলটা আর দুধ ভরতি গ্লাস।
আমার হতভম্ব মুখের দিকে তাকিয়ে ফিরোজ বলল, ‘কি গো? মেয়েটা গেল কোথায়?’
আমি ফ্যাসফেসে গলায় শুধু বললাম, ‘জানি না।’
ফকির আলি থামতেই আমি বললাম, ‘তারপর?’
সে উঠে দাঁড়াল, আমার দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত স্বরে বলল, ‘তার পরের খবর কেউ জানে না।’
আমি বসে রইলাম। তার ব্যাগটা তুলে নিয়ে আমার দিকে একটু মাথা ঝুঁকিয়ে ফকির আলি বেরিয়ে গেল।
Tags: তৃতীয় বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, পূজাবার্ষিকী, সুদীপ্ত রায়, সৌম্য সুন্দর মুখোপাধ্যায়, হরর গল্প