চোখের আলোয়
লেখক: দ্বৈতা হাজরা গোস্বামী
শিল্পী: সুমিত রায়
চোখের আলোয়
লেখক – দ্বৈতা হাজরা গোস্বামী
অলংকরণ – সুমিত রায়
ভয়ানক একটা হুড়মুড় শব্দে কাকোর ঘুমটা ভেঙে গেল।
কাকোদের পাড়ায় গাছ কাটা হচ্ছে। কাকো আর নিনি বস্তিতে থাকে। কাকোর বয়স সাত, কাকোর দিদি নিনির বয়স দশ। ওদের শহরের রাস্তাগুলো ঢেউ খেলানো। দূরে অনেক পাহাড় দেখা যায়। মাঝে মাঝে পাহাড়ের মাথায় গোলাপি মেঘ দেখা যায়। এখনও অনেক গাছ আছে শহরে কিন্তু কাকোর দিদি নিনি বলেছে একদিন এই গাছগুলো আর থাকবে না।
নিনির চোখ দুটো নীলচে সবুজ। এমন চোখ এই বস্তিতে আর কারোর নেই।
নিনি অনেক কিছু বলে। কাকো সব বুঝতে পারে না। অবাক হয়ে শোনে। পুরানো জং ধরা সাইকেলের পেছনে কাকোকে বসিয়ে নিনি চক্কর দেয় শহরে। ওদের বাবা রিকশা চালায় আর মা বাড়ি বাড়ি কাজ করে। পাউরুটি কাকু, লজেন্স কাকু, সেলুন কাকু, সবাই নিনি আর কাকোকে চেনে।
নিনি একটা ছোট্ট কচ্ছপের পেটের মধ্যে একটাকা, দু-টাকা জমিয়ে কাকোকে লজেন কিনে দেয়, বেলুন কিনে দেয়, মিষ্টি পাউরুটি আর কিশমিশ বাদাম দেওয়া কেক কিনে দেয়।
নিনি হঠাৎ করেই অনেক কিছু দেখতে পায় যে-টা কাকো দেখতে পায় না, আর কেউ দেখতে পায় না।
তাই নিনিকে কেউ খেলায় নেয় না। নিনির বন্ধুরা হাসাহাসি করে। এই যেমন সেদিন নিনি হঠাৎ করে বলল, “আমাদের পাশ দিয়ে একটা আলো ঝলমলে লম্বা সবুজ গাড়ি চলে গেল, দেখলি কাকো?”
কাকো চোখ কচলে কিছুই দেখতে পায় না।
আরেকদিন নিনি বলল, “ওপরে একটা কালো বাক্স উড়তে উড়তে যাচ্ছে দেখেছিস?” কাকো আকাশের দিকে মাথা তুলে অনেক দূর দেখার চেষ্টা করল, সূর্যের ছটায় চোখে ধাঁধা লেগে গেল।
বস্তির মধ্যে একটা ঘরে ঠাসাঠাসি, গাদাগাদি করে বসে ওরা অনেকজন। ওটা ওদের স্কুল। এক দিদিমণি আসে। ওদের স্কেল দিয়ে খুব মারে। কাকোর কচি কচি হাতের পাতা লাল হয়ে যায়। নিনির নীল চোখ দুটো জলে ভরে ওঠে।
নিনি বলে ওঠে, “একদিন আর তোকে কেউ মারবেনা দেখবি কাকো। তুই অনেক বড় জায়গায় পড়বি, অনেক বড় চাকরি করবি।”
সামনের ব্ল্যাকবোর্ডের দিকে তাকিয়ে অনেকসময় নিনি বলে, “আমাদের বলা কথাগুলো উড়ে উড়ে কেমন ব্ল্যাকবোর্ডের গায়ে ফুটে উঠছে, আবার মিলিয়ে যাচ্ছে, কেমন ম্যাজিক তাই না কাকো?”
কাকো চুপ করে থাকে। নিনির মন রাখতে একটু পরেই আবার হেসে হাততালি দিয়ে ওঠে।
নিনির ছবি আঁকার খাতায় নিনি যে কী সব আশ্চর্য আশ্চর্য ছবি আঁকে। অদ্ভুত রকম মানুষ, অদ্ভুত রকম জন্তু, অদ্ভুত দেখতে গাড়ি, অদ্ভুত দেখতে গাছ। আঁকা প্রতিযোগিতা ফার্স্ট হয়ে নিনি একটা জলের বোতল, টিফিন বক্স পেয়েছে। টিফিন বক্সটা কাকো কে দিয়ে দিয়েছে। নিনি বলেছে , “দেখবি কাকো, একদিন আর টিফিন বক্স লাগবে না। খাবারগুলো উড়ে উড়েই তোর কাছে চলে আসবে।”
এসব কথা কাকোর মনে পড়ে।
দিদির দেওয়া টিফিন বক্সটা আজও নিজের কাছে রেখে দিয়েছে কাকো। আজ তিরিশ বছর কেটে গেছে। দিদির বলা সব কথাগুলোই এখন সত্যি। কাকো অনেক বড় চাকরি করে এখন। দিদি চলে যাওয়ার পরে কাকো অনেক খেটেছিল, বস্তির ছেলে স্কলারশিপ পেয়ে ভালো কলেজে ভর্তি হয়েছিল। খুব অদ্ভুতভাবেই চলে গিয়েছিল দিদি। ওদের শহরের পাশ দিয়ে যে নদী চলে গেছে, তার ওপরে একটা ব্রিজ দেখতে পেয়েছিল দিদি। সেটাতেই উঠতে গিয়েছিল।
এখন সেই ব্রিজটা হয়েছে। অনেক বড় ব্রিজ। শহরটাও আর আগের মতো নেই। বিভিন্ন রকমের গাছ আর পাখি শুধু মিউজিয়ামে গেলেই দেখতে পাওয়া যায়। উড়ন্ত কালো বাক্স সবার উপরে নজর রাখে। আইন ভাঙার সাহস নেই কারোর।
ড্রোনে চড়ে খাবার আসে যখন যেখানে চাই।
আর সেই সবুজ ঝলমলে গাড়ি, পৃথিবীর দ্রুততম গাড়ি, সেটাতে তো কাকো প্রায়ই চড়ে।
সেদিন একটা অদ্ভুত কান্ড হল, সেই গাড়ির জানলা দিয়ে তাকিয়ে এক মুহূর্তের জন্য কাকো দেখতে পেলো তাদের দুজনকে, ছোট্ট কাকো আর নিনি। নিনি আঙ্গুল বাড়িয়ে আছে গাড়ির দিকে।
মুহূর্তের মধ্যে দৃশ্যটা সরে গেল। কাকো চিৎকার করে উঠলো—“দিদিইইই”। গাড়ির মধ্যে কেউ শুনতে পেল না, সবার কানেই রয়েছে গান শোনার যন্ত্র। কিন্তু কাকোর যন্ত্রে যেন ভেসে এলো দিদির গলা, “আমি তোর সঙ্গেই আছি কাকো। সবসময় তোকে দেখতে পাই।”
Tags: অনুগল্প, চোখের আলোয়, তৃতীয় বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, দ্বৈতা হাজরা গোস্বামী, পূজাবার্ষিকী, সুমিত রায়