মায়াশূন্যযান
লেখক: সালেহ আহমেদ মুবিন
শিল্পী: সুপ্রিয় দাস
মায়াশূন্যযান
লেখক – সালেহ আহমেদ মুবিন
অলংকরণ – সুপ্রিয় দাস
(১)
হুনানপু আকাশের দিকে এক নজর তাকিয়ে বলল, “আমি ব্যাপারটা টের পাচ্ছি, কাস্টিলা। মহারাজ আমাদের আর বেশিদিন সহ্য করবেন না।”
কাস্টিলা অসন্তোষের শব্দ করল মুখ দিয়ে। “বুজরুক রাজপুরোহিতদের চেয়ে লোকে তোমাকে বেশি মানলে রাজার কাছে সেটা খারাপ লাগবেই। তারা আছে সারাদিন আনন্দ তামাশা নিয়ে। রাজ্যের জনগণ নিয়ে চিন্তা করার সময় কই তাদের!”
“বাদ দাও। সম্মানিত মানুষদেরকে নিয়ে এভাবে বলা ঠিক না। তবে আমার মাথায় ঘোরা পরিকল্পনাটার কথা বলেছিলাম না? সম্ভবত সেটার বাস্তবায়ন সম্ভব।”
কাস্টিলার মুখ কিছুটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। রোদে পড়া তামাটে চেহারা তার। ওর বংশীয় লোকেদের চেয়ে নাক কিছুটা খাড়া, চেহারায় মঙ্গোলিয়ান ধাঁচটাও প্রবল। পেটানো শরীর, সঙ্গে মাথায় বুদ্ধিটাও চমৎকার। এক কথায় সহকারী হিসেবে আদর্শ। সে বলল, “আমি জানতাম তুমি ব্যাপারটা সমাধান করবে। তোমার লিস্টে আরেকটা আজগুবি আবিষ্কার যোগ হচ্ছে তাহলে। বল আমাকে কী করতে হবে?”
হুনানপুর মুখে মৃদু হাসি ফুটে উঠল। তার সঙ্গে এই অঞ্চলের কারও চেহারার বিন্দুমাত্র মিল নেই। যে কেউ এক দেখাতেই বলে ফেলবে সে এখানকার স্থানীয় বাসিন্দা নয়। তার চেহারার সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ব্যাপারটা হচ্ছে কাস্টিলার সঙ্গে তার মৌখিক গঠনের মিল। কাস্টিলার মুখে মঙ্গোলিয়ান ধাঁচটা বাদ দিলে তাকে অনেকটাই হুনানপুর মতো দেখাবে। মায়াদের অন্যতম প্রভাবশালী নগররাষ্ট্র এই খারাখোলের অধিবাসী না হওয়া সত্ত্বেও সে-ই সম্ভবত এখানকার সবচেয়ে বিখ্যাত ব্যক্তি। এর পিছনে যথেষ্ট কারণ আছে বইকি। মায়াদের চোখ খুলে দেওয়ায় সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে সে-ই। তাদের গ্রামব্যবস্থা, কৃষিনীতিতে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি চালু করে রাজ্যের ব্যাপক উন্নয়ন সাধনে বড়সড় ভূমিকা রেখেছে হুনানপু। সেই সঙ্গে ছোটখাটো প্রয়োজনীয় আজগুবি আবিষ্কার করে সে হয়ে উঠেছে এই টিকালের মায়া অধিবাসীদের প্রিয় পাত্র। তারা তাকে সম্মান দিয়ে সম্বোধন করে ‘পবিত্র বিজ্ঞানী’ বলে।
পাথরে তৈরি গবেষণাগারের ছাদটায় বসে আছে হুনানপু আর তার সহকারী কাস্টিলা। অনেকটা অলস সময় যাপনের মতো ব্যাপার। তবে হুনানপুর সঙ্গে লম্বা নলাকার বস্তুটি দেখে ধারণা করে নেওয়া যায় শুধুই অলস সময় কাটানো তার উদ্দেশ্য নয়।
“আপাতত তোমার কিছু করতে হবে না। আমার মনে হচ্ছে যদি আমরা রাজবিজ্ঞানী আরাকজের সঙ্গে যোগাযোগ করি সেটা সবচেয়ে ভালো হবে। তাঁর মতো প্রতিভাবান বিজ্ঞানী সম্ভবত নেই আর ওই অঞ্চলে।”
“হ্যাঁ ঠিক, ওই অঞ্চলে। কারণ, এই অঞ্চলের সবচেয়ে প্রতিভাবান বিজ্ঞানী তুমি-ই। তোমার সম্পর্কে আমার ভালো জানা আছে, হুনানপু। তুমি তোমার সারাটা জীবনই কাটিয়ে দিয়েছ বিজ্ঞান সাধনায়। বিশেষত যে কায়দায় তুমি এ অঞ্চলে এসেছিলে মানুষ চিরদিন মনে রাখবে সেটা। আজগুবি একটা যন্ত্র নিয়ে আকাশে ভাসতে ভাসতে। চিন্তা করা যায়! পরে যখন তাদেরকে বোঝালে বাতাসকে ব্যবহার করে সুন্দর ভেসে থাকা যায়, তখন তাদের মুখের হতভম্ব আর মুগ্ধ ভাবটা আমি কখনো ভুলব না। সত্যি বলতে আমিও তখন মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। তারপর যখন তুমি এ অঞ্চলের উন্নয়ন শুরু করলে তাতে স্বয়ং রাজাও অবাক হয়ে গেলেন। তুমি এটুকুতেও থামলে না। তোমার আজগুবি কালচে পদার্থটা দিয়ে কী একটা অদ্ভুত যান বানিয়ে ফেললে। সেই যানটায় তরল গ্যাস ব্যবহার করে যখন গতি সঞ্চার করলে সেটা আরও বেশি অদ্ভুত ছিল। সেই যান দিয়ে তুমি উঠে গেলে আকাশে, পরে আবার ফিরে এলে মাটিতে। মানুষ যে উড়তে পারে সেটাই বা কে কল্পনা করতে পেরেছিল! আর তুমি শুধু উড়লেই না, সঙ্গে আকাশটাও জয় করে আসলে। তোমার মত বিজ্ঞানী খারাখোলে কখনো ছিল না, টিকালেও না। আরাকজে হাজারবার সাধনা করলেও তোমার ধারেকাছেও যেতে পারবে না।”
বিকেলের মৃদু আলোতে ছাদের উপর বসে এসব কথা শুনতে ভালোই লাগে হুনানপুর। ঘটনাগুলোর স্মৃতিচারণা তার মনটাকেও ভালো করে দেয়। সে-ই প্রথম ব্যক্তি যে মহাশূন্যে ভেসে বেড়িয়েছে। অনেক গবেষণার ফল ছিল সেটা। শূন্যারোহীদের পোশাক নিয়ে ভালো কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল। তবে সফল হয়েছিল সে। যখন পৃথিবীতে ফিরে আসল তখন যেন একটা প্রলয় ঘটে গেল মানুষের মধ্যে। তারা সবাই তাঁকে দেবতা জ্ঞান করা শুরু করে দিল। পালেংখুযের শিলালিপির মন্দিরে তার শূন্যারোহীর বিশেষ পোশাক পরিহিত চিত্রকর্মও খোদাই করে ফেলল তারা। সত্যি বলতে এই মন্দিরটা মায়াদের কাছে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। তাদের জ্যোতির্বিদ্যার জ্ঞানের জন্য এটি তাদের কাছে এত পবিত্র। মজার ব্যাপার হচ্ছে এই জ্যোতির্বিদ্যাতেও মায়াদের অগ্রগামী করতে হুনানপুর ভূমিকা সবচেয়ে বেশি।
হুনানপু চোখ পাকিয়ে বলল, “ধন্যবাদ কাস্টিলা। তবে তুমি বেশ বাড়িয়ে বলছ। আর আরাকজেকেও অসম্মান দেখাচ্ছ।”
“একটুও বাড়িয়ে বলছি না। তোমাকে নিয়ে ইতিমধ্যেই কিংবদন্তির সৃষ্টি হয়ে গেছে।”
হুনানপু কিছু বলল না। সামনে একমনে তাকিয়ে রইল। এখান থেকে দৃষ্টি বহুদুরে চলে যায়। সামনে বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ, মাঝে মাঝে ছোট ছোট খাল চোখে পড়ে। বিকেলের রহস্যময় লালচে আলোয় ভুট্টা ক্ষেতে কর্মরত নেংটি পরা কৃষকদের চকচকে ঘামে ভেজা শরীর দেখা যায়। এই দৃশ্য হুনানপুর মন ভালো করে দেয়। গত বছরের চেয়ে এবার ভালো ফসল ফলেছে। তার নেয়া পদক্ষেপগুলো কাজ করছে। আশপাশের নগর রাষ্ট্রগুলোতেও অনুসৃত হচ্ছে এই পদ্ধতি। হুনানপুর বড় ভালো লাগে। নিজের জীবনকে স্বার্থক বলে মনে হয়। সাধারণত অলস সময়গুলোতে সে কৃষকদের কাজকর্ম, সুবিধা অসুবিধা পর্যালোচনা করে সময় কাটায়। কাস্টিলা কোন এক ক্ষেতে কাজে লেগে পড়ে। তবে আজ একটু ব্যতিক্রম ঘটেছে।
গায়ের হরিণের চামড়ার পোশাকটা ভালোভাবে জড়িয়ে সে কাস্টিলার দিকে তাকাল। “বুঝলে কাস্টিলা, এবারের কাজটা হবে সবচেয়ে কঠিন। শুধু একটা যন্ত্র তৈরিই করব না, সেটার অনেকগুলো অনুরূপও বানাতে হবে। আমার কাছে লোহার ভালো মজুত আছে। সেটা কুলোবে কিনা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। তোমাদের এই লোকগুলোও এখনও লোহার ব্যবহার শিখেনি। যদি রাজার সাহায্য নিয়ে লোহার উত্তোলন শুরু করতে পারি তবে ব্যাপারটা চমৎকার হবে। সেই সঙ্গে এই শক্ত পদার্থটার সঙ্গে এই অঞ্চলের মানুষেরও পরিচয় ঘটল। বিষয়টা নিয়ে রাজবৈজ্ঞানিক আরাকজের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে।”
কাস্টিলা মুখ বাকাল। লালচে রোদ তার কাল শরীরে পড়ে অদ্ভুত এক বর্ণ সৃষ্টি করছে। কৃষকগুলোর মতো তার পরনেও একটা নেংটি। মায়াদের সাধারণ পোশাক। সে বলল, “আমার ওই ছুঁচোমুখো বিজ্ঞানীকে ঠিক বিশ্বাস হয়না। তারপরও তোমার নিজের স্বার্থে তার সঙ্গে আলাপ করাটাই বোধহয় ভালো হবে। তবে রাজসাহায্য ছাড়াও নিশ্চয়ই বিকল্প পরিকল্পনা আছে তোমার।”
হাসল হুনানপু। “তুমি জানো আমার আছে।”
সূর্য প্রায় ডুবে গেছে। কৃষকরা প্রস্তুত হচ্ছে বাড়ি ফেরার জন্য। প্রতিদিনই খুব ধকল যায় তাদের উপর। মাঝে একবেলা খেয়ে সারাদিন কাজ করতে হয়। তবে ইদানীং কেন জানি বেশ আনন্দের সঙ্গেই তারা কাজটা করে। আকাশে সন্ধ্যাতারা উঁকি দিচ্ছে। এই নক্ষত্র মায়াদের কাছে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এমনকী, সূর্যের চাইতেও এই শুক্র গ্রহ তাদের কাছে অধিক পবিত্র। হুনানপু তার সঙ্গে নিয়ে আসা নলাকার বস্তুটি কাস্টিলার সামনে রেখে বলল, “মনোযোগ দাও কাস্টিলা। এটাই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার। আমি এর নাম দিয়েছি টেলিস্কোপ।”
কাস্টিলার চোখে কৌতুহলী দৃষ্টি দেখা গেল। হুনানপু ভালোভাবে বস্তুটি দেখাল তাকে। নলের দু’ প্রান্তে ঘষা কাচ সাটানো রয়েছে। যখন কাস্টিলা সেটার একপ্রান্ত দিয়ে তাকাল, তার মুখ দিয়ে অস্ফুট একটা ধ্বনি বেরিয়ে আসল। “হলি ইটজাম্না! অদ্ভুত জিনিস।”
প্রাচীন দেখতে টেলিস্কোপটা থেকে চোখ সরিয়ে বিস্মিত দৃষ্টিতে হুনানপুর দিকে তাকাল সে।
“আস্তে। এই আবিষ্কারটা আপাতত গোপনীয়। এখনও এইরকম কিছু কেউ আবিষ্কার করতে পারেনি। আকাশের দিকে তাক করে দেখ, আরও মজা পাবে।”
কাস্টিলার বিস্মিত ভঙ্গি দূর হলো না, বরং বেড়ে গেল খানিকটা। “আমি হলফ করে বলতে পারি হাজার বছর সাধনা করলেও এরকম কিছু আরাকজে বানাতে পারবে না। তারপরও রাজবিজ্ঞানীর পদে সে কীভাবে থাকে বুঝি না।” সে আবার আকাশের দিকে তাক করল টেলিস্কোপটা।
হুনানপু হাসল। সে ভালো ভাবেই জানে রাজা কেন তাকে সে পদ থেকে দূরে রেখেছে। মায়াদের কাছে রাজারা হচ্ছে দেবতার পুত্র। কিন্তু দেবতাপুত্রকে রেখে যদি তারা অন্য কাউকে দেবতাজ্ঞান করে তবে সেটা দেবতাপুত্রের কাছে ভালো লাগার কথা না। তবে সে বলল, “আহ কাস্টিলা তোমাকে কতবার বলেছি রাজবৈজ্ঞানিকের বিরুদ্ধে অসম্মানজনক আচরণ করবে না।”
কাস্টিলা হুনানপুর কথা শুনল বলে বোধ হলো না। সে আশ্চর্য দৃষ্টিতে গ্রহ-নক্ষত্র দেখার চেষ্টা করছে। “হুনানপু! যদি এই আজব জিনিসটা পালেংখুযের শিলালিপির মন্দিরে দেয়া যায় তবে জ্যোতির্বিদরা কত উন্নতি করবে চিন্তা করতে পারছ? সত্যিই হুনানপু তুমি শতাব্দীর সেরা বৈজ্ঞানিক।”
“টেলিস্কোপের ব্যাপারটা আপাতত গোপন রাখবে। আর শোনো একটা কাজ করতে হবে তোমাকে। আটলান্টিসের ক্রিস্টালের ভালো একটা সংগ্রহ তুলে আনতে হবে। যতটুক জানি আটলান্টিসে প্রচুর ক্রিস্টাল পাওয়া যায়। কালকেই রওনা হয়ে যাবে। তিন-চারদিনের মাঝে ফিরে আসতে পারবে। আমি যাব আরাকজের সঙ্গে কথা বলতে।”
কাস্টিলা কোন জবাব দিল না। সে বিস্মিত চোখে আকাশ দেখছে। আকাশে এতকিছু দেখার আছে সে জানত না। হুনানপু তাকে নক্ষত্র দেখার পদ্ধতি শেখাল। শনির বলয়ও দেখাল। এরপর কাস্টিলাকে নিজের মতো পর্যবেক্ষণের সুযোগ দিয়ে সরে আসল সে।
আকাশ আগেই অন্ধকার হয়ে গেছে। নক্ষত্র ফুটে উঠেছে পুরো আকাশজুড়ে। মৃদু বাতাস বয়ে যাচ্ছে চারপাশে। নক্ষত্রের বিশালতায় তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হুনানপু। বহু পথ অতিক্রম করতে হবে তার। তবে সে বুঝতে পারল না যে তার পরিকল্পনা পুরোপুরি নির্ভুল নয়। এর মাশুল দিতে হবে তাকে।
(২)
খারাখোল থেকে টিকালের দুরত্ব বেশ ভালোই। পৌঁছোতে পৌঁছোতে সূর্য মাথার উপর উঠে গেল। হুনানপু অবশ্য স্বআবিষ্কৃত মোটর গাড়ি ব্যবহার করে সহজেই টিকালে চলে যেতে পারত। কিন্তু জনসম্মুখে সাধারণত এ ধরনের যন্ত্র সে ব্যবহার করে না। ফলে ঘোড়ার গাড়িই সম্বল। টিকালে আসলে প্রতিবারই হুনানপু চমৎকৃত হয়। এর কারন টিকাল নগররাষ্ট্র নিজেই। খারাখোল আর টিকালকে বলা হয় যমজ নগরী। অদ্ভুত কারণে এই দুই নগরের পরিকল্পনাএবং প্রতিটা দালানের অবস্থান এক। তাই টিকালে আসলে হুনানপু অবাক চোখে চারদিকে তাকায়। টিকাল আর খারাখোলের একমাত্র পার্থক্য হচ্ছে পিরামিড। টিকালে মোটমাট ছয়টা পিরামিড আর অন্যদিকে খারাখোলে পিরামিডের সংখ্যা শূন্য। যেখানে রাজারাজরার অবস্থান সেখানে পিরামিডের সংখ্যা বেশি থাকাটাই স্বাভাবিক। একসময় দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের মাঠের ওপাশে রাজপ্রাসাদটা দৃশ্যমান হল। বড়সড় একটা দূর্গ মাথা উচু করে নিজের প্রভাব ঘোষনা করছে যেন। বিস্তৃত ভূট্টা ক্ষেত পেরোনোর সময় হুনানপু ক্ষেতে কাজ করা কৃষকদের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এই ক্ষেতগুলোতে সবচেয়ে ভালো মানের শস্য ফলানো হয়। যেন সরাসরি রাজার কাছে খুব দ্রুত এবং সহজে সেটা পৌছে যায়। দীর্ঘকাল যাবৎ চলে আসা এ বৈষম্য হুনানপুর মনে জ্বালা ধরিয়ে দেয়।
রাজপ্রাসাদের কয়েক ধাপ নিরাপত্তা পেরিয়ে অবশেষে প্রাসাদে ঢোকার সৌভাগ্য হল হুনানপুর। সত্যিই সৌভাগ্য। দরবারে রাজবিজ্ঞানী আর রাজা দুজনকেই পেয়ে গেল সে। সত্যি বলতে সভাসদদের সবাই আছে দরবারে। সম্ভবত কোনও বিষয়ে সভা বসেছিল। হুনানপু রাজাকে সম্মান জানাল।
“আরে মহান বৈজ্ঞানিক হুনানপু যে। কী সৌভাগ্য আমাদের!”
রাজার কন্ঠে সূক্ষ্ম ব্যঙ্গ টের পেল হুনানপু। তবে তেমন পাত্তা দিল না ব্যাপারটায়। ক্ষমতাবান লোকেরা আশেপাশের সবাইকে কিছুটা তাচ্ছিল্যই করে। কিছুটা ইতস্তত করে নিজের দাবির কথা পেশ করল সে। কিভাবে সে মাটির তল থেকে খনিজ উত্তোলন করবে বা কিভাবে সব প্রক্রিয়াজাত করা হবে, সবই বুঝিয়ে বলল। সঙ্গে এও বলল যদি এ কাজটা সত্যিই করা যায়, মায়ারা পৃথিবীর বুকে অমর হয়ে থাকবে। সভাসদরা গম্ভীর মুখে তার কথাগুলো শুনল। রাজা তার পাশে রাখা ভূট্টা গেজানো মদে মৃদু চুমুক দিল। তিনি কিছু বলার আগেই রাজবৈজ্ঞানিক আরাকজে গলা খাকারি দিল।
“আমার মনে হয় হুনানপুর কথাবার্তা যথেষ্ট সন্দেহজনক। আর তার কথাবার্তা কোনক্রমেই বিজ্ঞানসম্মত মনে হচ্ছে না। আমার রীতিমতো সন্দেহ হচ্ছে সে কালো জাদুর চর্চা করছে কিনা।”
হুনানপু রাজবৈজ্ঞানিকের দিকে বিস্মিত চোখে তাকাল। তার কাছে এমন কথা সে সত্যিই আশা করেনি। “মহামান্য আরাকজে আপনি ভুল করছেন। আমি কোন জাদুকর নই। স্রেফ বিজ্ঞান ব্যবহার করে আমি এসব আবিষ্কার করেছি। সেখানে কোন বুজরুকি নেই। সেটা আপনিও জানেন।”
রাজা টেওটিহুয়া নড়েচড়ে বসলেন। তার জাগুয়ারের চামড়ার মোটা পোশাক আর অলংকার ঝলমল করে উঠল। রাজার খাড়া নাক বিশিষ্ট মঙ্গোলিয়ান ধাচের চেহারায় ফুটে উঠল কঠোর একটা ভাব। “হুনানপু তুমি পাতাল থেকে যে কাল বস্তু তুলতে চাইছ সেটা যে তোমার একটা চাল তা ভালোই বোঝা যাচ্ছে। পাতালের অশুভ কালো শক্তিকে জাগানোর জন্য তুমি ব্যবহার করতে চাইছ আমাদের। তুমি কি বুঝতে পারছ তোমার সাহস কতখানি বেড়ে গেছে?”
হুনানপু বুঝতে পারল পরিস্থিতি তার অনুকূলে নেই। আরাকজে যে তাকে সহ্য করতে পারেনি সেটা ভালোই বুঝতে পারছে সে। রাজার কান ভারী করায় সেই সম্ভবত মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। কে জানে একটু আগের বৈঠকটা তাকে নিয়েই হচ্ছিল কিনা। সম্ভাবনা প্রবল। শেষ একটা চেষ্টা করল সে।
“মহারাজ আমি জানি না আমার সম্পর্কে এমন কুকথা কে শুনিয়েছে আপনাকে। দেবতা ইটজাম্নার কসম খেয়ে বলতে পারি আমি জাদুকর না। তবে সেটা বড় কোন বিষয় না। আপনি দেখেছেন আমি আপনার রাজ্যের উন্নতিতে কতটা খেটেছি। আমি শুধুমাত্র কাজটা সবাই মিলেমিশে করতে চাইছি। এতে পৃথিবীবাসী আমাদের সবাইকে চিরদিন মনে রাখবে।”
রাজা মদের পেয়ালায় আরেকটা চুমক দিল। “তোমাকে বিশ্বাস করার মতো কোন কারণ নেই। এমনকী আমরা জানিও না কোথা থেকে এসেছ তুমি।”
“আমার জন্ম কামিনালজুযুতে। সেখানেই বেড়ে উঠেছি আমি। এবার বিশ্বাস করতে পারবেন?”
রাজার মুখভঙ্গি আরও গম্ভীর হয়ে গেল। কেমন ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে তাকে। “হুনানপু তুমি খুব বেড়ে গেছ। লোকজন তোমাকে আর তোমার ওই যমজ ভাইটাকে দেবতাজ্ঞান করা শুরু করেছে। ব্যাপারটা আমার জন্য কতটা অসম্মানজনক তুমি বুঝতে পারবে না। এতদিন তোমাকে কিছু বলার প্রয়োজন হয়নি, কারন তুমি রাজ্যের উন্নয়ন করে আমার কষ্ট লাঘব করে দিচ্ছিলে। কিন্তু সারা জীবন তোমাকে সহ্য করব না আমি।”
হুনানপু কিছুটা বিস্ময় বোধ করল। সে নিজেকে খুব সাদাসিধে সাধারণ একজন মনে করত। সে বুঝে উঠতে পারেনি তার আবিষ্কারগুলো তাকে এতটা প্রভাবশালী করে দিয়েছে যে অন্যান্য প্রভাবশালী ব্যক্তিরা তার প্রতি রীতিমতো ঈর্ষান্বিত। এদের নিয়ে কোনও আশা নেই।
“ঠিক আছে মহামান্য রাজা, গোস্তাকি মাপ করবেন। আমি যাচ্ছি তাহলে।”
“এবারের মতো যেতে দিচ্ছি তোমাকে। মাথা থেকে কালো জাদুর ভূত নামাও। নইলে টিকতে পারবে না বেশিদিন।”
রাজবৈজ্ঞানিক টিটকারির সুরে বলল, “ওহে বুরবক, পাতলা হরিণের চামড়ার পোশাক গায়ে দিয়ে আর বাহাদুরি ফলাতে এসো না। বাসায় বসে আঙুল চুষ গিয়ে।”
সভাসদরা এই কথাতে আজব কোনও কারণে হেসে উঠল।
হুনানপু সঙ্গে সঙ্গে কোন উত্তর দিতে পারল না। তার সামান্য উপার্জন সব আবিষ্কারের পিছনেই চলে যায়। হরিণের চামড়ার চেয়ে ভালো কোন পোশাক কেনার সামর্থ্য নেই তার। বিজ্ঞানীর মতো সম্মানজনক পেশায় না থাকলে স্থানীয়দের মতো খালি গায়েই থাকত। কিন্তু সেটা হবে নিয়ম বহির্ভূত। সভাসদদের প্রতি বিজাতীয় এক ঘৃণা অনুভব করল সে। কঠিন কোনও কথা শুনিয়ে দিতে ইচ্ছা হয়। কিন্তু সে জানে এখন সভাসদ কাউকে খেপানো একদম ঠিক হবে না। বহু কাজ এখনও বাকি। তবে রাজসভা ত্যাগ করার আগে ছোট্ট একটা কথা বলে আসল সে, “দেখা যাবে ইতিহাস কাকে মনে রাখে!”
(৩)
খারাখোলে নিজের ডেরায় ফিরতে রাত হয়ে গেল হুনানপুর। সে বেশ চিন্তিত। কাস্টিলা ক্রিস্টাল নিয়ে এখনও ফিরে আসেনি। মোটামুটি তিন থেকে চারদিন লাগবে তার ফিরে আসতে। তারপরেও তার জন্য চিন্তিত বোধ করল হুনানপু। তবে বেশিদিন দুশ্চিন্তা করতে হল না তাকে।
তৃতীয় দিনেই ফিরে এল কাস্টিলা। সঙ্গে দুটো ঘোড়ার গাড়ি ভর্তি ক্রিস্টাল। হুনানপু নিজেও ক্রিস্টালের আধিক্য দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। কাস্টিলা দাঁত বের করে বলল, “আরও প্রচুর আছে এগুলো। লাগলে আরও কয়েক গাড়ি আনতে পারব।”
হুনানপু রাজপ্রাসাদের ঘটনা কাস্টিলাকে খুলে বলল। কাস্টিলা হাত নাড়িয়ে বলল, “সেটা আমি আগেই জানতাম। তো এখন কী করব আমরা?”
“কাজটা শেষ করব। তবে আগে প্রকাশ্যে করতাম, এখন করব গোপনে। লোহা মাটি থেকে তোলা না গেলেও বিকল্প পরিকল্পনাআছে আমার। আমার যানগুলো শুধু শুধুই বানাইনি।”
“কিন্তু একা এত বড় কাজটা করতে পারবে না। বহু লোকবল লাগবে।”
চিন্তার ভাজ দেখা দিল হুনানপুর কপালে। “সম্ভবত সারা জীবন এর জন্য খেটে যেতে হবে। এই কাজটা করতেই হবে আমার। সারা জীবন ধরে করতে হলেও।”
কাস্টিলা হুনানপুর দিকে তাকিয়ে মুচকি একটা হাসি দিল। হুনানপু চোখ কোঁচকাল। কাস্টিলার হাসিটা তার কাছে কেমন বিচিত্র মনে হচ্ছে। হাসির কারণটাও খুঁজে পেল না।
খুব গোপনে হুনানপু তার পরীক্ষাগারে কাজ শুরু করে দিল। স্বেচ্ছাসেবীর অভাব হলো না। হুনানপুর নির্দেশে বেশ ভালো সংখ্যক খারাখোল অধিবাসীরা যন্ত্রাংশ নিয়ে মেতে উঠল। ছোট ছোট করে কাজ ভাগ করে দেয়ায় কাজগুলো সবার জন্য হয়ে উঠল সহজ।
“পবিত্র বিজ্ঞানী, আপনার অন্যান্য আবিষ্কারের মতো এটাও খুব জটিল দেখাচ্ছে। কী করা হবে এটি দিয়ে?” একজন প্রশ্ন করে হুনানপুকে। লোকটা কৃষক, তার কপালে একটা তিল আছে।
হুনানপু মৃদু হাসল। কিন্তু সরাসরি কোনও উত্তর দিল না।
“কাজ শেষ হয়ে আসলেই দেখতে পাবে। আচ্ছা, কাস্টিলাকে দেখেছ? সকাল থেকেই ওর কোনও পাত্তা পাচ্ছিনা।”
কৃষক মাথা চুলকাল। সে জানে না।
কারও কাছ থেকেই আশাজনক কোনও উত্তর পাওয়া গেল না। আপাতদৃষ্টিতে কাজ ভালোই এগোচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু হুনানপুর মাথায় খুব দুশ্চিন্তা ঘোরাফেরা করছে। কারণ এটুকু গতিতে কাজ এগোলেও হবে না। তার হাতে যে সময় অবশিষ্ট আছে তার মাঝে কাজ শেষ করতে হবে। আর সেজন্য আরও দ্রুত করতে হবে সব। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে পুরো প্রক্রিয়াটাই খুব বিশাল। এজন্য সময়ও দরকার প্রচুর। এর মাঝে কাস্টিলার অনুপস্থিতি অস্থির করে দিচ্ছে হুনানপুকে।
কাস্টিলার এরকম হুটহাট উধাও হয়ে যাওয়া নতুন কিছু নয়। কিন্তু এরকম গুরুত্বপূর্ণ একটা পরিস্থিতিতে গায়েব হওয়াটা খুব কাজের কিছু না। হুনানপু কর্মযজ্ঞের দিকে নজর দিল। ক্রমেই হতাশ বোধ করছে সে।
কাস্টিলা ফিরল পাক্কা চারদিন পর। তার মুখে চওড়া হাসি। হুনানপু মুখ চেপে কঠিনস্বরে কিছু কথা শুনিয়ে দিতে চাচ্ছিল কাস্টিলাকে। কিন্তু হাত তুলে থামাল তাকে সে।
“আমি জানি তুমি খুব রেগে আছ। কিন্তু তোমার রাগ আমি দুই মিনিটে কমিয়ে দিচ্ছি।”
বলেই সে চোখ টিপে দিল।
হুনানপু এবার দ্বিধান্বিত বোধ করল। সে ঘটনা বুঝে উঠতে পারছেনা।
কাস্টিলা মুখে আঙুল দিয়ে বিশেষ পদ্ধতিতে জোরে শিস দিয়ে ইশারা করল। হঠাৎই রাস্তা থেকে শব্দ করতে করতে একটা ঘোড়ার গাড়ি এসে উপস্থিত হল তাদের সামনে। গাড়িতে বসা কমপক্ষে এক ডজন অভিজাত শ্রেণির মানুষ। তাদের শরীরে উন্নত চামড়ার পোশাক দেখেই তা আঁচ করা যায়। হুনানপু হঠাৎ ধরতে পারল ব্যাপারটা। এরা সবাই বিজ্ঞানী।
গাড়ি থেকে প্রৌঢ় একজন নেমে আসলেন। চোখমুখ গম্ভীর। হুনানপু চিনতে পারল। খুব বিখ্যাত তিনি। পালেংখুযের শিলালিপি মন্দিরের বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ রাওয়ালুন্ডি। তিনি হুনানপুকে দেখতে পেয়েই স্বগতোক্তি করলেন, “কী হে, শুনলাম কী আবিষ্কার করে নাকি দুনিয়া উদ্ধার করে ফেলছ?”
হুনানপু দাঁত বের করে হেসে বলল, “একদম। আমি এখনও বিশ্বাস করতে পারছিনা আপনারা সবাই এসেছেন।”
জ্যোতির্বিদ স্নেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে হাসলেন।
“আমি জানতাম হুনানপু”, কাস্টিলা মাঝে এসে বলা শুরু করল, “যে রাজা তোমার সঙ্গে কাজ করবে না। তো বিকল্প খুবই প্রয়োজনীয় তখন। কিন্তু এত বিশাল কাজে মানুষও লাগবে অনেক। তাই সেদিন আটলান্টিসে যাবার সময় প্রত্যেক শহরের যত বিজ্ঞানী আছেন তাদের সঙ্গে কথা বলে গিয়েছিলাম। মজার ব্যাপার হচ্ছে তারা কেউই আমার মতোই রাজবৈজ্ঞানিক আরাকজেকে সহ্য করতে পারে না। তা পারার কথাও না। কিন্তু তুমি তোমার কাজকর্মের জন্য সবার কাছে বরণীয়। ফলে উনাদেরকে তোমার কথা বলতেই তারা রাজি হয়ে গেলেন। উনারা সবাই ব্যাপারটায় খুব উৎসাহী হয়ে গিয়েছিলেন, আমার সঙ্গে কথা হবার পর নিজেরা পরস্পর যোগাযোগও করেছেন। অবশেষে যখন দেখলাম বিপুল সাহায্যের সত্যিই প্রয়োজন আমাদের, তখন দেরি না করে বেরিয়ে পড়লাম আমি। আর সবাইকে ধরে নিয়ে আসলাম একত্রে। এবার বাকি কাজ তোমার।”
হুনানপুর চেহারায় স্পষ্ট উচ্ছাস ফুটে উঠল। সে জড়িয়ে ধরল কাস্টিলাকে। “ধন্যবাদ কাস্টিলা। লোকে তোমাকে আমার জমজ ভাই বলে। জমজ না হলেও তুমি সত্যিই আমার ভাই।”
রাতেই বৈঠক বসল বিজ্ঞানীদের। বিজ্ঞানীরা যথেষ্ট প্রতিভাবান হলেও হুনানপুর মত এতটা অগ্রগামী নন কেউই। ফলে হুনানপুর কথা তারা খুব একটা বুঝে উঠতে পারল না। শেষে হুনানপু সহজ ভাষায় কি কি করতে হবে তা বলে দিল। সেই সঙ্গে এটাও বলতে ভুলল না যে বিষয়টা হবে গোপনীয়। সকলেই চমৎকার আবিষ্কারটার সঙ্গে এক হয়ে গেল। পরিপূর্ণভাবে এবার শুরু হল পৃথিবীর সবচেয়ে গোপন আজব এক আবিষ্কারের অধ্যায়।
(৪)
খারাখোলের বড় একটা অংশ একদমই পাতালে চলে গেল যেন। হুনানপুরা খুব গোপনীয়ভাবে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। রাজা অবশ্য পিছু ছাড়ল না তার। সরাসরি ঘোষণা না দিলেও রাজার অনুচররা গুজব ছড়িয়ে দিল হুনানপুর বিরুদ্ধে। রাজা খোঁজ নিয়ে দেখলেন জন্মস্থান সম্পর্কে হুনানপুর তথ্যে গড়মিল আছে। অনুচররা বিপুল বিক্রমে হুনানপুকে জাদুকর আখ্যা দিয়ে গুজব ছড়াল। কিন্তু তারা বেশি সুবিধা করতে পারল না। হুনানপুকে লোকজন খুব বেশি সম্মানের চোখে দেখে। তার অবস্থান গুজবের উর্ধ্বে। বরং লোকজন রাজার ষড়যন্ত্র ধরে ফেলে রূপকার্থে রাজাকে খল চরিত্রে বসিয়ে লোককথা বানিয়ে ফেলল। এইসব ব্যাপারে হুনানপু অবশ্য খুব বেশি পাত্তা দিল না। সত্যি বলতে পাত্তা দেয়ার সময়ই পেল না।
পুরো পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সারাদিন উঠে পড়ে লেগে থাকতে হয় তাকে। টেলিস্কোপটা জুড়ে দিয়ে ছোটখাট একটা মহাকাশযান বানিয়েছে সে। সঙ্গে পেন্টাবাইনারী পদ্ধতির একটা কম্পিউটার যুক্ত করে দিয়েছে। মহাশূণ্যে অবস্থান ঠিক করতে সেটা সাহায্য করবে। যানটায় বিপুল পরিমাণে ক্রিস্টালের ব্যবহার করা হয়েছে। এই একই জিনিস তৈরি করতে হবে হাজারটা। নিজে কাজ করার পাশাপাশি অন্য অঞ্চলের বিজ্ঞানীদেরকে ছোট ছোট দলে বিভক্ত করে কাজ ভাগ করে দিল। বিজ্ঞানীরা তাদের অনুসারী এবং কিছু ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের সাহায্য নিয়ে মিলেমিশে এই হাজারটা মহাকাশযান তৈরিতে লেগে গেলেন। বিপুলভাবে পরিকল্পনা এগিয়ে গেল বাস্তবায়নের পথে। প্রায় প্রতিটা রাজ্যেই খুব গোপনে চলতে থাকল এই কর্মযজ্ঞ।
রাজা কোনভাবে হুনানপুকে পরাজিত করতে না পারলেও চেষ্টা অব্যাহত রাখল। হুনানপু প্রকাশ্যে কোন আবিষ্কার প্রদর্শন না করলেও রাজা তার প্রতি প্রবল ঈর্ষাম্বিত হয়ে পড়েছে। তাকে সরাসরি খুন করা সম্ভব হচ্ছেনা। প্রজাবিদ্রোহটা হচ্ছে খুব আজবভাবে। ওদের অলিখিত নেতা হুনানপু। কিন্তু সে সম্ভবত নিজেও জানেনা বিষয়টা। প্রথাবিরোধী কাজ করে সে বুঝিয়ে দিয়েছে সবাই সমান ক্ষমতাশালী। সম্মান সবারই পাওনা। সে লক্ষেই এগিয়ে যাচ্ছে বিপ্লব। বিভিন্ন অঞ্চলে কিছু ছোটখাটো ঝামেলাও হয়ে গেছে। এই মুহূর্তে হুনানপুর কিছু হলে পুরো মায়া রাজ্যে বিদ্রোহের ঢল নেমে আসবে। কাজ করতে হবে কৌশলে।
সে তার দূর্গের ছাদে দাঁড়িয়ে চারপাশটা দেখল। যতদূর চোখ যায় তার রাজ্য। কিন্তু তার মনে শান্তি নেই। মন্ত্রী তার সঙ্গেই আছে। সে তার দিকে উদ্দেশ্য করে বলল, “হুনানপুকে কোনভাবে কোন কাজে ফাঁসিয়ে দিয়ে মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে। এছাড়া আর কোন উপায় নেই, কি বল? লোকে তাকেই রাজা বানিয়ে ফেলছে। সহ্য করা যাচ্ছেনা আর।”
মন্ত্রী তেলতেলে একটা হাসি দিল। “মহামান্য, এর চেয়েও ভালো একটা পদ্ধতি আছে কিন্তু। সাপও মরবে লাঠিও ভাঙবে না।”
রাজা মন্ত্রীর দিকে চোখ কুঁচকে তাকালেন। “যেমন?”
মন্ত্রী সামনের দিকে হাত দিয়ে ইশারা করল। “কী দেখতে পাচ্ছেন, মহামান্য?”
রাজা এক নজর দেখলেন সামনে। “ভুট্টা ক্ষেত। দারুণ ফলন হয়েছে।”
মন্ত্রী মাথা নেড়ে বলল, “দৃষ্টি আরও খানিকটা প্রসারিত করুন। নদীটার দিকে তাকান।”
রাজা টেওটিহুয়া খানিক বিরক্ত হলেও তাকাল সুদূরে বয়ে যাওয়া নদীটার দিকে। কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকবার পরে হুট করেই ব্যাপারটা ধরতে পারল সে। তার মুখে অশুভ একটা হাসি ফুটে উঠল।
“মন্ত্রী, তোমাকে আমার কিছু পুরষ্কার দেয়া উচিত। নিখুঁত জিনিস হবে।”
মন্ত্রী আরেকটা তেলতেলে হাসি উপহার দিল।
খারাখোলের ফসলের পানির যোগানদাতা এর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া এই শান্ত নদীটা। নদীর পানিতে খাল কেটে পরিকল্পনামাফিক সেগুলো সরবরাহ করা হয় ফসলের মাঠে। যদি কোনওভাবে পানি আটকে ফেলা যায়, খারাখোলের অধিবাসীরা বিপুল পানি সংকটে পড়ে যাবে। এতে কেবল হুনানপুর প্রতি প্রতিশোধই নেওয়া হবে না, বরং খারাখোলের সকল অধিবাসীর উপর চড়াও হওয়া যাবে। রাজার ইতোমধ্যেই এদের উপর ক্ষোভ আছে। এই অঞ্চল জনশূন্য হলেও তার খুব একটা ক্ষতি নেই। তার রাজ্যসীমা নেহাত কম না।
চতুর রাজা টেওটিহুয়া এই সুযোগটাই নিল। সে উন্নয়নের নাম করে নদীর বিভিন্ন জায়গায় বাঁধ বসাল। কিছুদিনের মধ্যেই খারাখোল আক্রান্ত হল প্রবল খরায়।
হুনানপু ব্যস্ত তার নিজের পরিকল্পনা নিয়ে। এসব ব্যাপার সে খেয়াল করার সময়টাই পেল না। কিংবা বিকল্প পানির কোন পদ্ধতি আবিষ্কার করারও সুযোগও না। এতে তেমন লাভ হত কিনা নিশ্চিত না। রাজার বিকল্প পরিকল্পণাও খুব চাতুর্যপূর্ণ ছিল। পানির অভাবে ফসলের মাঠ সব একসময় ফেটে চৌচির হয়ে গেল। দলে দলে জনগণ খারাখোল ছেড়ে চলে যেতে শুরু করল উর্বর জমির সন্ধানে। তবে এতদিনে কাজকর্ম মোটামুটি গুছিয়ে এনেছে হুনানপুরা। সারাদিন তারা ব্যস্ত থাকে গবেষণাগারে। রাত হলেই দিনে বানানো মহাকাশযানটা নিক্ষেপ করে আকাশে। এরপর দুরনিয়ন্ত্রিত যন্ত্রের সাহায্যে পথ পরিক্রমণ ঠিক করতে হয় সেগুলোর। মাঝে মাঝেই হুনানপু তার যানটা নিয়ে কোথায় যেন নিরুদ্দেশ হয়। ফিরে আসে প্রচুর পরিমাণে লোহা নিয়ে। এ ব্যাপারে তাকে জিজ্ঞেস করলে সে হেয়ালি করে বলে, মাথায় বুদ্ধি থাকলে লোহাও খুঁজে পাওয়া যায়। একসময় পরিকল্পনার শেষ প্রান্তে উপস্থিত হলো হুনানপু। আর তখনই হঠাৎ খেয়াল করল যে খারাখোল ইতোমধ্যেই পরিণত হয়েছে বিরান ভূমিতে। হুশ ফিরল তাদের। স্পষ্ট বুঝতে পারল এখানে আর খুব বেশিদিন টিকে থাকা যাবে না। কিন্তু কাজ পুরোপুরি শেষ হয়নি এখনও। আর কাজ শেষ না করে হুনানপু এক পা-ও নড়তে রাজি না। কাস্টিলা অনেক বুঝিয়েও রাজি করাতে পারল না হুনানপুকে। অবশেষে একদিন সে-ও বিষন্ন মনে ত্যাগ করল একসময়ের প্রভাবশালী নগররাষ্ট্র খারাখোল। যা এখন শুধুই ইতিহাস। কাস্টিলা খারাখোল ত্যাগ করার পরই আমাদের জানাশোনাও আচমকা থেমে গেল। হুনানপুর ভাগ্যে কী ঘটল কিংবা তার কাজ সে শেষ করে যেতে পেরেছে কিনা, কিছুই আর জানা গেল না। যেন এক অসমাপ্ত গল্প বলা হলো। তবে কাহিনি এখানেই শেষ নয়। আমাদের জানাশোনা থেমে গেলেও সময় থেমে রইল না। গড়িয়ে গেল হাজার বছর। নক্ষত্র ক্রমাগত পরিবর্তন করল তার অবস্থান। মহাবিশ্বের বিস্তৃতি ঘটল আরও অনেকখানি। সূর্যে ঘটে গেল সহস্র বিষ্ফোরণ।
(৫)
“তাহলে তুমি বলতে চাইছ মানুষ থুম করে পৃথিবীতে এসে পড়েছে? কোন বিবর্তন ছাড়াই? শূন্য থেকে?”
ইভানের গলার বিদ্রুপ ভাবটা রায়ানের কান এড়াল না। সে মৃদু হাসল। “হ্যাঁ অনেকটা তাই।”
“অনেকটা? আচ্ছা তুমি বিবর্তনবাদ জানো তো?”
ইভানকে দেখে মনে হচ্ছে দুনিয়ার সবচেয়ে গর্দভ মানুষটার সঙ্গে কথা বলছে। বিজ্ঞানীরা আর যাই হোক, অবৈজ্ঞানিক কিছু মেনে নিতে পারে না।
রায়ান একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “আসলে ব্যাপারটা অসম্ভব কিছু না। হয়তো আমরা কিছু একটা মিস করে যাচ্ছি, যার ফলে বিষয়টা আমাদের কাছে মনে হচ্ছে ভুয়া।”
“শোন, রায়ান। পদার্থবিদ্যা হচ্ছে তোমার ডিপার্টমেন্ট। জীববিজ্ঞানে নাক গলালে কোন সমস্যা নেই। কিন্তু অযৌক্তিক কথা বলে মেজাজটা খারাপ কোরো না দয়া করে।”
“তোমার কাছে অযৌক্তিক মনে হচ্ছে?”
মুখে বিরক্তির ভাব ফুটিয়ে তুলল ইভান। “তোমার জ্ঞাতার্থে ডারউইনের বিবর্তনবাদটা বলছি তোমাকে। আমি নিশ্চিত কোথাও বুঝতে ভুল হয়েছে তোমার। একটা কথা প্রচলিত আছে, মানুষ এসেছে বানর থেকে। কথাটা ভুল। মানুষ আর বানরের বিবর্তন হয়েছে একই প্রজাতির প্রাণী হতে। আর সেই একই প্রজাতির প্রাথমিক প্রাণী বা প্রাইমেট ছিল অনেকাংশেই বর্তমান বানরের মত। এই প্রাণীকে বোঝাতেই বানর শব্দটা বলা হয়। বুঝতে পেরেছ ব্যাপারটা।”
“ইভান, তুমি জানো এইসব বিষয় জানা আছে আমার। আমি কেবল একটা তত্ত্বীয় বিষয় চিন্তা করছিলাম।”
“তত্ত্বীয় হয় কিভাবে?” চেঁচিয়ে উঠল ইভান। “শোন, মানুষ সবসময় এরকম ছিল না। হোমো নিয়ান্ডারথালেন্সিস প্রজাতির কথাই ধর। এদের গণও কিন্তু মানুষের মতই ছিল হোমো। কিন্তু এরা টিকতে পারেনি। ধরা যাক মানুষের দুই পূর্ব পুরুষ প্রজাতি হোমো ইরেক্টাস আর হোমো নিয়ান্ডারথালেন্সিসের মধ্যে প্রজনন হয়েছে। এতে কি হবে? আমরা পাব যোগ্যতম প্রজাতিকে। এরা পরিবেশের জন্য আরো যোগ্য। এজন্যই কিন্তু এরাই টিকে যাবে। যেমনটা নিয়ানডার্থালরা টিকে গিয়েছিল। বাকিরা বিলুপ্ত হবে সময়ের সঙ্গে, পরিবেশে টিকতে না পেরে। ব্যাপারটা অনেকটা লম্বা ঘাড় আর ছোট ঘাড়ের জিরাফের দুই প্রজাতির মত। এই দুই প্রজাতির মধ্যে প্রজনন হয়ে ঘাড় লম্বা জিরাফ হয়েছে। আর এরাই টিকে গেছে। ছোট ঘাড় জিরাফ প্রজাতি হয়েছে বিলুপ্ত। কারণ তারা উঁচু ডাল থেকে পাতা খেতে পারত না। তেমনি মানুষের বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে প্রজনন হতে হতে আজকের আধুনিক মানব সভ্যতার জন্ম হয়েছে। এটাই বিবর্তন, রায়ান। ফসিলগুলো এর স্বপক্ষে যুক্তি দেয়। হুট করে কিছু হয়ে যেতে পারে না।”
“এমন হতে পারে না যে, মানুষ্য প্রজাতি আগেই ছিল। এদের সঙ্গে প্রজনন হয়েছে অন্যান্য মানুষের কাছাকাছি প্রজাতির। ফলে জন্ম নিয়েছে আরো যোগ্য এক মানুষ্য প্রজাতি। তোমার যুক্তির সঙ্গে এর পুরো মিল আছে। তুমি যা বলেছ এগুলো সম্পর্কে আমি পুরোপুরি জ্ঞাত, ইভান। কিন্তু আমি আমার বক্তব্য থেকে সরছি না। অনেক কিছুই ঘটতে পারে আমাদের অন্তরালে। পৃথিবীর বহু জায়গাতেই আমাদের পা পড়েনি। আমি বিষয়টা প্রমাণ করে দিব।”
চোখ সরু করে তাকাল ইভান। হেসে ফেলল রায়ান। “এভাবে তাকিও না। ভস্ম হয়ে যাব।”
ইভান হাল ছেড়ে দেয়ার ভঙ্গি করল। “চিন্তা করছি একটা বানর পালা শুরু করে দিব। কি বল?”
“ফাটাফাটি হবে। সুন্দর একটা জুটি পাব আমরা।”
চোখ মটকে রায়ানের দিকে তাকাল ইভান। আলোচনারও সেখানেই মুলতবি হল।
রায়ান বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে পড়ল ইভানের ল্যাবটা থেকে।
রায়ানের সহকর্মী ইভান। কিছু বিষয়ে আলোচনার জন্য একটু অবসর পেয়েই এখানে এসেছিল সে। তার দৃষ্টিতে আলোচনা সফল। এবার দ্রুত নিজের ল্যাবটা ঘুরে যেতে হবে।
‘বার্ন’, পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত নিউক্লিয়ার রিসার্চ অর্গানাইজেশন। রায়ান হচ্ছে বার্নের গর্বিত একজন তরুণ পদার্থবিজ্ঞানী। ভালোভাবে বললে একজন শিক্ষানবিশ বিজ্ঞানী। ‘বার্ন’ সম্প্রতি প্রতিভাবান বিজ্ঞানীদেরকে আরো ভালোভাবে গড়ে তোলার জন্য এই ব্যাপারটা চালু করেছে। নিউক্লিয়ার রিসার্চ অর্গানাইজেশন হলেও ‘বার্ন’ অন্যান্য শাখায়ও সমান বিচরণ করে। রায়ানও এই প্রতিষ্ঠানকে অনুসরণ করে কিনা কে জানে! পদার্থবিজ্ঞানী হলেও কৌতুহল মেটানোর জন্য সব শাখা সম্পর্কেই হালকা পাতলা জ্ঞান রাখে সে। খোঁজ রাখে বিচিত্র সব বিষয়ের। তার জীবনটাও কম বিচিত্র নয়। এই যেমন ধরা যাক তার গাড়িটার কথা। উদ্ভট দেখতে এই যানটা শুধু বিচিত্রই না, অদ্ভুতও বটে। সহকর্মী বন্ধুদের কাছে এর জন্য টিটকারিও কম খেতে হয় না। তবে সেগুলো গায়ে লাগে না তার। এই ব্যাপারে কথা উঠলে কেবলমাত্র একটা হাই তুলতে দেখা যায় তাকে।
বায়োলজি ডিপার্টমেন্ট থেকে সে ছুটল ফিজিক্সের দিকে। খুব দ্রুত সবকিছু গোছগাছ করে ফেলতে হবে।
***
ল্যাবে পৌছে সব ঠিকঠাকই দেখা গেল। রায়ান খেয়াল করে দেখেছে যখন সব ঠিকঠাক দেখা যায়, গন্ডগোল সব ঠিক তখনই ঘটে। এই বিষয়ে তটস্থ থাকার পেছনে যথেষ্ট কারন আছে বৈকি। তারা এই পদার্থবিদ্যার ল্যাবে রসায়ন থেকে শুরু করে অবৈজ্ঞানিক পরীক্ষাও চালায় মাঝেমধ্যে। নিতান্তই মজার জন্য। তবে সেগুলো যে কম বিপজ্জনক হয়, সে কথা বলা যাবে না। এর উপরে আজ রিনিতা নেই, ছুটিতে গেছে।
তবে আজ আর বোধহয় তেমন কোন গন্ডগোল হবে না। ল্যাবে ঢুকেই এডিনকে তীব্র মনোযোগ দিয়ে কম্পিউটার স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকতে দেখা গেল। এসাইনমেন্ট বাদ দিয়ে সে জ্যোতির্বিদ্যা নিয়ে ডুবে আছে। এডিন হচ্ছে রায়ানের সহকারী।
রায়ান ঢুকেই বাজখাই গলায় বলল, “এডিন! এসাইনমেন্ট বাদ দিয়ে আজেবাজে কাজ করা হচ্ছে? একদম বসের কাছে বিচার দিয়ে দিব।”
এডিনের মধ্যে কোন ভাবান্তর দেখা গেল না। সচরাচর যায়ও না। সে রায়ানের দিকে তাকিয়ে উজ্জ্বল স্বরে বলল, “রায়ান, অদ্ভুত একটা ব্যাপার ঘটে গেছে। ঘন্টা দেড়েক আগে একটা সিগন্যাল পেয়েছি।”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল রায়ান। এরপর এগিয়ে গেল এডিন কি বোঝাচ্ছে দেখার চেষ্টা করল। ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করল, “সিগন্যাল আবার অদ্ভুত হয় কিভাবে?”
“অদ্ভুত কারন সেটা মানুষ্য নির্মিত কোন উৎস থেকে আসছে না। এসেছে সরাসরি মহাশূণ্য থেকে। জ্যোতির্বিদ্যা সেকশনের রেকর্ড মতে সেখানে কোন স্পেসশীপ থাকার কথা নয়।”
“তবে তুমি কি ভাবছ মহাজাগতিক কোন প্রানী তোমাকে জন্মদিনের দাওয়াত পাঠিয়েছে?”
ঠাট্টা ধরতে পারল না এডিন। সে কন্ঠে উচ্ছ্বাস নিয়ে বলল, “একদম ঠিক তাই।”
“জ্যোতির্বিদরা এই সংকেত পেয়েছে নিশ্চয়ই। তাদের কাজ তাদেরকে করতে দাও তো।”
“না পায়নি। আমরা মহাবিশ্বের বিস্তৃতি নিয়ে কাজ করছিলাম না? তখন যে প্রোগ্রামটা তৈরি করেছিলাম তার সঙ্গে এই সংকেতের কানেকশন ঘটেছে। জ্যোতির্বিদরা এই ব্যাপারটা ধরতে পারবে না। নইলে এটা নিয়ে এত উৎসাহ দেখাই নাকি?” চোখ টিপে বলল এডিন।
তবে এডিনকে হতাশ করে দিল রায়ান। গম্ভীর স্বরে বলল, “যে এসাইনমেন্টগুলা করতে হবে, সেগুলো সব প্রস্তুত? মাথা থেকে আবর্জনা ঝেড়ে ফেলে নিজের কাজটা কর। মহাজাগতিক সংকেত পাবার ঘটনা এই প্রথম না। এর মানে এই না যে, তোমার প্রিয় কোন এলিয়েন তোমাকে বন্ধুবার্তা পাঠাচ্ছে।”
এডিন বিরস মুখে সরে গেল কম্পিউটারের সামনে থেকে।
রায়ান দ্রুত সেই জায়গা দখল করে নিল। এরপর হাতের আঙুল ফুটিয়ে বলল, “কি যেন বলছিলে? সংকেতটা কোথায় পাওয়া গেছে? দ্রুত দেখাও। এরপর একই রকম দ্রুত এসাইনমেন্টের কাজে লেগে যাও বাছা।”
এডিন শুধু চোখ পাকিয়ে তাকাল।
ইভান চোখ টিপে কেবল বলল, “বিখ্যাত বিজ্ঞানীদের সঙ্গে কাজ করাটা বেশ মজার।”
কাজ শেষ করতে করতে বেশ রাত হয়ে গেল। সংকেতের ব্যাপারটায় অবশ্য ওরা বেশি সময় দেয়নি। সত্যি বলতে সুযোগ পায়নি। রিনিতা থাকলে সব কাজ আরো দ্রুতই শেষ হত। তবে যখন আজকের মত দায়িত্ব শেষ হল, স্বস্তির নিঃশ্বাস নিল রায়ান। বাসায় গিয়ে ভালো একটা ঘুম দিতে হবে। গত কয়েকদিন মাথায় এসাইনমেন্টের বোঝা ঝুলে ছিল। এখন সেটা হালকা হয়ে এসেছে। আর চাপ হ্রাস মাত্রই দেহমনে আলস্যের সৃষ্টি করে।
(৬)
প্রচন্ড শব্দে ঘুম ভাঙল রায়ানের। ঘুম ভাঙার পর কয়েক মুহুর্ত লাগল শব্দের উৎসটা বুঝতে। এরপর শান্তভাবে হাই তুলে ক্রন্দনরত ফোনটা কানে ধরল সে।
অপর পাশের কথা শুনে নিমিষে চোখ থেকে ঘুম উধাও হয়ে গেল তার। কোনমতে হাতমুখ ধুয়ে আজগুবি গাড়িটা নিয়ে ছুটল ল্যাবের দিকে।
বার্নের সিক্যুরিটি অংশ বেশ কড়া। এখানে জয়েন করেছে খুব বেশিদিন হয়নি। ফলে প্রতিদিনই খানিকটা দেরি হয়ে যায় এখানে। নিজের আইডি, অনুমতিপত্র সব দেখিয়ে চেক করে ঢোকানো হয় ভবনটায়। সিক্যুরিটি সিস্টেমের উপর মনে মনে গালি দিয়ে অবশেষে ল্যাবের দিকে ছুটল সে। দেরি সইছে না। মন খুব বেশি কৌতূহলী হয়ে পড়েছে।
ল্যাবে ঢুকতেই রিনিতা উচ্ছ্বসিত ভঙ্গিতে এগিয়ে আসল। ছুটিতে ছিল বলেই বোধহয় আজ সবার আগে ল্যাবে উপস্থিত হয়েছে সে। ল্যাবের কৃত্রিম আলোয় কেমন রহস্যময় লাগছে তাকে।
“তুমি বিশ্বাস করবে না কি ঘটে গেছে। এক ঘন্টার মধ্যে টানা এক ডজন সংকেত ধরা পড়েছে। এক ডজন! আর এগুলো কোনটাই আমাদের সৃষ্ট না”, কম্পিউটারটার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলল রিনিতা। তার গলায় উত্তেজনার পাশাপাশি বিস্ময়টাও কানে এসে লাগল। রিনিতাকে বিস্মিত করা সোজা কথা না।
রায়ান ভ্রূ তুলে বলল, “দেখা যাচ্ছে অবশেষে তোমার এলিয়েন প্রেমিক প্রবর তোমাকে নক করেছে। অভিনন্দন!”
রিনিতা এক মুহুর্তের জন্য থেমে গেল। তার চোখে মুখে ভয়ংকর ভাব ফুটে উঠেছে। চাইলে সে সত্যিই খুব ভয়ংকর হতে পারে। রায়ানের স্পষ্ট মনে আছে যেদিন সে বার্নে জয়েন করল, সেদিন এক ছোকরা বিজ্ঞানী রিনিতার পিছে ঘুরঘুর করছিল। কয়েকটা আজেবাজে কথাও বলেছিল বোধহয়। এরপরের ঘটনা খুব হৃদয় বিদারক। রিনিতা কলার ধরে তার কপাল দেয়ালে ঠুকে দিয়েছিল। সেই ছোকরার দীর্ঘদিন চোয়ালে ব্যান্ডেজ নিয়ে ঘুরতে হয়েছে। মাথায় লেগেছিল পাক্কা পাঁচটা সেলাই। সুতরাং রিনিতা যখন ভয়ংকর ভঙ্গিতে তাকাল, রায়ানের ভয় পাওয়াটা ছিল খুব স্বাভাবিক। কিন্তু সে অবাক হয়ে খেয়াল করল সে মোটেও বিন্দুমাত্র ভয় পাচ্ছে না। বরং রাগলে রিনিতার যে গাল টকটকে লাল হয়ে যায় কিংবা তার মুখে যে মায়া মায়া ভাব চলে আসে সেটা সে মুগ্ধভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। নিজের উপরেই বিরক্ত বোধ করল সে।
তবে ভাগ্য ভালো রিনিতা শেষ পর্যন্ত কিছু করল না। কেবল ভস্ম করে দেয়া একটা দৃষ্টি ছুড়ে দিল।
রায়ান দ্রুত প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে ফেলল। “সংকেতগুলো কেমন? অর্থোদ্ধার সম্ভব হয়েছে?”
রিনিতা দাঁত চেপে বলল, “নিজে পরীক্ষা করে দেখ।”
রায়ান হাসিমুখে বলল, “আহ! বিখ্যাত বিজ্ঞানীদের সঙ্গে কাজ করার মজাই অন্যরকম।”
এরপর সে বসে পড়ল বিশেষ কম্পিউটারটার সামনে। এই যন্ত্রটা অন্যান্য সাধারণ কম্পিউটারের চেয়ে বহুগুণে পারদর্শী। নিজেদের কাজ কিংবা সত্যি বলতে কৌতূহল মেটাতে বিশেষভাবে একে তৈরি করেছে তারা তিনজন মিলে। তাদের কাজ পদার্থে আটকে না থেকে যে নানা অপদার্থ ব্যাপার স্যাপারেও বিস্তৃত হয়েছে, তার পেছনে এই কম্পিউটারের বড়সড় ভূমিকা আছে বৈকি।
কয়েক মুহুর্ত স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে চোখ পিটপিট করে রায়ান রিনিতার দিকে ফিরল।
রিনিতা আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে রায়ানের প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য। ঘটনা দেখে নিশ্চিত তার মাথা ঘুরে গেছে। কিন্তু রায়ানের বলা কথাগুলো তাকে হতাশ করল। রায়ান গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, “ইয়ে রিনিতা, তোমার চশমাটা একটু দিবে? চোখে ঝাপসা দেখছি।”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল রিনিতা।
চশমা যে রায়ানের লাগেই, তা না। তারপরেও ল্যাবে আসার পর কিছু করার সময়ই সে চশমা ব্যবহার করে। চশমার উৎস হিসেবে বরাবর রিনিতাকেই এগিয়ে আসতে হয়। চশমা ভাগাভাগি করতে যে তার খারাপ লাগে তা না। কিন্তু চশমার মত বস্তু ভাগাভাগি করাটা একটু জটিলই বটে। রিনিতা নিশ্চিত রায়ান এই কাজ করে তার সঙ্গে মজা নেয়ার জন্য। তবে খারাপ ব্যাপারটা হচ্ছে রিনিতার ব্যাপারটা ভালোই লাগে। সে তার ঢাউস ব্যাগটা থেকে একটা বক্স বের করল। সেখান থেকে বেরিয়ে আসল সুদৃশ্য একটা চশমা। সেটা সে বাড়িয়ে ধরল রায়ানের দিকে।
চশমাটা হাতে নিয়ে সে ভ্রু কুচকে ফেলল। নতুন চশমা। পুরোনোটাই তো তার পছন্দের ছিল। সেটা নিয়ে অবশ্য কথা তুলল না সে আর। ফিরে গেল কম্পিউটার স্ক্রিনের দিকে।
দীর্ঘ কয়েক মুহুর্ত সব খুটে খুটে পরীক্ষা করল রায়ান। খানিকটা আঁতকে উঠল মুহুর্ত পরেই। সত্যিই ডজনখানেক সংকেত ধরা পড়েছে। আর এটা নিছক কোন ফলস এ্যালার্ম না। ভয়ংকর ব্যাপারটা হচ্ছে, সব সংকেতই উদ্ভট কোন ভাষায়। এই কম্পিউটার বাইনারি মান ধরতে পারে। সে অনুযায়ীই প্রদর্শন করে ফলাফল। কিন্তু সংকেতটা একদম ভিন্ন। গতরাতে এডিনও একটা সংকেত পেয়েছিল। কিন্তু পাত্তা দেয়ার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেনি রায়ান। এখন মনে হচ্ছে পাত্তা দেয়ার দরকার ছিল। সত্যিই একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে গেছে। এমনটা হয়নি আগে কখনো আর। রায়ান বিস্মিত দৃষ্টি নিয়ে তাকাল রিনিতার দিকে।
এইবার রায়ানের মুখভঙ্গি বোধহয় মনের মত হল রিনিতার কাছে। সে মুখে হাসি ঝুলিয়ে বিদ্রুপ মেশানো স্বরে বলল, “আমার প্রেমিকের ম্যাসেজের গুরুত্ব বুঝতে পারার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ, রায়ান।”
***
এডিন আসার পর ওকে বাকি দায়িত্ব দিয়ে সংকেতের ব্যাপারটা পরিষ্কার হবার চেষ্টা করল রায়ান। বুঝতে চেষ্টা করল সিগন্যাল আসছে ঠিক কোথা থেকে এবং সেটায় আসলে কি বোঝানো হচ্ছে। রিনিতা আর এডিন অন্যান্য বিষয় সামলে তাকে এখানে মনোযোগ দিতে সাহায্য করল। চমৎকার দুজন সহকর্মী পাওয়ায় নিজের ভাগ্যকেই ঈর্ষা করতে ইচ্ছা করল তার।
এখনো এই সংকেতের বিষয়ে কাউকে জানায় নি তারা। অর্থোদ্ধার করা হোক আগে। সারাটা দিন রায়ান পড়ে রইল অদ্ভুত কোডগুলো নিয়ে। ল্যাব থেকে বিদায় নেয়ার আগে রিনিতা হাত নেড়ে বলল, “রায়ান, এবার অন্তত একটু বিশ্রাম দাও শরীরটাকে। স্পেসশীপ পাঠিয়ে কাল আরো ভালো করে বোঝা যাবে বিষয়টা। এখন বাসায় যাও।”
কম্পিউটার স্ক্রিন থেকে বাস্তবে ফিরে আসল রায়ান। চশমা ফেরত দেয়ার কথা মনে পড়ে গেল তার। আজ সারাদিন রিনিতা একবারও এটা তার কাছ থেকে নেয়নি। চশমাটা খুলে সে রিনিতার দিকে বাড়িয়ে ধরে বলল, “তোমার চশমা খুব কার্যকর। একদম আমার চোখের সঙ্গে পারফেক্ট ম্যাচ। আগেরটা থেকে এটায় বেশি আরাম।”
“রেখে দাও। ফেরত দিতে হবে না।”
রায়ান চোখ কুচকে তাকাল। রিনিতা কি তাকে একটা উপহার দেয়ার চেষ্টা করছে নাকি? চোখে বিভ্রান্ত ভাব ফুটে উঠল তার।
ব্যাপারটা খেয়াল করে রিনিতা মৃদু হাসল। গম্ভীর গলায় বলল, “দ্রুত বাসায় যাবে। এরপর ঠিকমত খাওয়াদাওয়া করে তারপর ঘুমাবে। ঠিকাছে?”
রিনিতা চলে গেল। এক মুহুর্ত চশমা হাতে নিয়ে সেদিকে তাকিয়ে রইল রায়ান।
হঠাৎ তার মনে পড়ল রিনিতাকে এখনই যেতে দেয়া যাবেনা। জরুরী কাজ সারতে হবে। সে দৌড়ে ল্যাবের বাইরে বেরিয়ে গেল।
***
রিনিতা চোখ সরু করে প্রশ্ন করল, “তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে রায়ান?”
রায়ান মাথা চুলকে বলল, “কিন্তু মাইক্রো চিপগুলো খুব দরকারি। আমাদের কম্পউটারে এটাচ করে দিতে হবে। এই বার্নের রেস্ট্রিকশন সেকশন ছাড়া আর কোথাও পাওয়া যাবেনা এই ন্যানো প্রযুক্তির জিনিসগুলো।”
রিনিতা এতটাই বিস্মিত হয়েছে যে কথাই বলতে পারল না। “তুমি রেস্ট্রিকশন সেকশনে গিয়ে একটা গোপনীয় আবিষ্কার রীতিমত চুরি করে আনতে চাইছ?”
“আহা চুরি হবে কেন? ভুলে গেছ আমরা এখানে কাজ করি? আমাদের প্রয়োজনে যেকোন জিনিসই ব্যবহার করার অধিকার থাকা উচিৎ আমাদের।”
“কিন্তু রেস্ট্রিকশন সেকশনের ব্যাপারগুলো এখনও কাজের উপযোগী নয়।”
“আমার যে চিপ লাগবে সেটা ঠিকঠাকই কাজ করে। আমি খোঁজ নিয়েছি খুব ভালোভাবেই। আর এই চিপ ছাড়া সিগন্যালগুলোর অর্থোদ্ধার খুব কঠিন হবে। চিপগুলোতে বাইনারীর বাইরেও বেশ কিছু পদ্ধতি ব্যবহার করার উপায় আছে। একটু বুদ্ধি ব্যবহার করলে নিজের মত পরিবর্তন করে নেয়া যায়। আর আমার লাগবে সেটা।”
রিনিতা আশেপাশে তাকাল। এরপর নিচু স্বরে বলল, “দেখ রায়ান, আমার কাছে খুব এখনও খুব বিপজ্জনক মনে হচ্ছে ব্যাপারটা। প্রতিটা দরজা লক করা। পাসকার্ড ছাড়া ঢোকা যায়না। আর আমাদের পাসকার্ড ব্যবহার করলে নিশ্চয়ই সেটা খুব বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।”
রায়ান চওড়া হাসি দিয়ে বলল, “আমরা আমাদেরটা ব্যবহার করব না।”
এর ঠিক সাত মিনিট পরে রিনিতা যখন দেখল সে রায়ানের সঙ্গে চুপিচুপি কর্মচারীদের চেঞ্জিং রুমের সামনে এসে হাজির হয়েছে সে নিজেকেই বিশ্বাস করতে পারল না। তার কাছে পুরো ব্যাপারটাই স্রেফ পাগলামি মনে হচ্ছে। মোটামুটি বার্নের কাজের শিফট শেষ হয়ে গেছে সবার। তাই খুব নির্জন চারপাশ। তারপরেও রিনিতা একদমই স্বস্তি পাচ্ছেনা।
রায়ান আশেপাশে এক নজর তাকিয়ে কর্মচারীদের চেঞ্জিং রুমের দরজায় টান দিল। খুব দুঃখের সঙ্গে খেয়াল করল এই দরজাও লক করা যা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। রিনিতা তার দিকে অগ্নিচক্ষু নিয়ে তাকাল। একটা বিব্রত হাসি দিয়ে রায়ান তার পকেট থেকে উদ্ভট একটা যন্ত্র বের করল। রিনিতা প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকাতে রায়ান ফিসফিস করে বলল, “আমার অ্যান্টি লকার। এই যন্ত্রে সাহায্যে লক খোলা যাবে কিন্তু সমস্যা হচ্ছে সিক্যুরিটি খেয়াল করে ফেলবে যে অচেনা কোন কোড সংখ্যা কেউ প্রবেশ করছে ভেতরে। তাই আমার এখন কর্মচারীদের কারও পাসকার্ডের কোড নাম্বার লাগবে।”
রিনিতা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না। কেউ এতটা অগোছাল কাজ করতে পারে ভাবতে পারছেনা সে। তবে এখন এতকিছু ভাববার সময় নেই। মাথা ঠাণ্ডা করল সে। ভালোভাবে সম্পূর্ণ ব্যাপারটায় নজর দিল। দরজাটা লাগানো, তবে উপরের অংশে ফোকর থাকায় ভেতরটা দেখা যায়। রিনিতা তীক্ষ্ণ চোখে রায়ানের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমাদের ভেতরে ঢোকার দরকার নেই। এত সহজ একটা ব্যাপারকে এত পেঁচিয়ে ফেলেছ তুমি যে আমি বলার মত কিছু খুঁজে পাচ্ছিনা।”
রায়ান বিভ্রান্ত বোধ করল। “মানে বুঝলাম না।”
রিনিতা নিরস চোখে দরজার কাঁচের ফোকরের দিকে ইঙ্গিত করল। “তোমার ফোনের ক্যামেরা দিয়ে জুম করে দেখ এই ফোকর দিয়ে। ভেতরে স্যুট রাখা আছে পরিচ্ছন্নকর্মীদের। বেশিরভাগেরই পাসকার্ডটা বের হয়ে আছে।”
রায়ান দ্রুত একনজর দেখল ফোকর দিয়ে। এরপর রিনিতার দিকে তাকিয়ে বিব্রত একটা হাসি দিল।
মানুষজনের চোখ এড়িয়ে অবশেষে রেস্ট্রিকটেড সেকশনে পৌঁছাল ওরা। ইতোমধ্যেই হাজারটা দরজা খুলতে হয়েছে অ্যান্টি লকার দিয়ে। তবে পরিচ্ছন্নকর্মীর পাসকোড হওয়ায় কেউ কিছু ভাববে না। রায়ান একটা জ্যামার বের করে সিকিউরিটি ক্যামেরাগুলো অচল করে দেওয়ার প্রস্তুতি নিল। কিন্তু খুব দ্রুত করতে হবে কাজ। বেশিক্ষণ ক্যামেরা জ্যাম করে রাখলে সন্দেহ হতে পারে সিক্যুরিটির।
সমস্যা হচ্ছে রায়ান যখন অ্যান্টি লকার দিয়ে আগে দরজা খোলার চেষ্টা করল তখন লাল বাতি জ্বলে দরজা জানাল সেটা খোলা সম্ভব না।
রায়ান রিনিতার দিকে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকাল। এতদূর এসে এমনটা কল্পনাও করা যায় না।
রিনিতা চোখ কোঁচকাল। “একজন পরিচ্ছন্নকর্মীর এখানে ঢোকার অনুমতি নেই। উচ্চপদস্থ কারও পাসকোড লাগবে।”
“আমার মাথার চুল ছিড়ে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে। এতদূর এসে এমন কিছু আশা করতে পারিনা আমি।”
রিনিতার মাথায় দ্রুত চিন্তা চলছে। হাল ছেড়ে দেয়া যাবেনা।
“আচ্ছা বার্নে একটা গুজব চালু আছে না? যে পাসকোডগুলো খুব রীতি মেনে তৈরি হয়েছিল। নিম্নপদস্থ কারও পাসকোডের এনাগ্রাম হচ্ছে উচ্চপদস্থ কারও পাসকোড। এভাবে পাসকোড বিনিময় করায় নির্দিষ্টতা থাকে। হিসেব রক্ষা করতে সুবিধা হয়। কারণ সংখ্যার পরিমাণ থাকে নির্দিষ্ট কিছু। আমার মনে হয় এখন এই গুজবটা সত্যি কিনা তা আমাদের পরীক্ষা করে দেখতে হবে।”
রায়ান এক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল রিনিতার দিকে। এরপর চোখমুখ শক্ত করে বলল, “রাইট। এখনই করছি।”
“দাঁড়াও। আমার কাছে দাও। আমি চেষ্টা করি।”
রিনিতার দিকে তীব্র একটা দৃষ্টি ছুড়ে দিয়ে অ্যান্টি লকারটা সে তার দিকে বাড়িয়ে দিল। রিনিতা প্রবল মনোযোগ দিয়ে কোডের সংখ্যাগুলো উলটপালট করে সাজাল। সে কয়েকটা সংখ্যাপদ্ধতি ব্যবহার করল সে, আশা করছে এভাবে লজিক্যাল উপায়েই কোডগুলোকে সাজিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
রায়ান অ্যান্টি লকারটা দরজায় সেট করল। লাল বাতি জ্বলবে আবারও? নাকি কাজ করবে সত্যিই? কয়েকটা মুহূর্ত কাটল প্রবল উৎকণ্ঠায়। এবং হঠাৎ করেই রায়ান এবং রিনিতা বিস্মিত চোখে দেখল সবুজ বাতি জ্বলে দরজা খুলে গেছে। তারা নিজেদের চোখকে বিশ্বাস করতে পারল না। উত্তেজনায় রিনিতাকে জড়িয়ে ধরল রায়ান। পারলে গুটিকয়েক ডিগবাজিও দিয়ে দিত বোধহয়। এরপর দ্রুত জ্যামার দিয়ে জ্যাম করে দিল সিক্যুরিটি ক্যামেরা।
এবারের কাজ খুব দ্রুত করতে হবে। চিপগুলো কোথায় রাখা আছে সেটা খুঁজে বের করতে হবে। রায়ান দ্রুত নজর চালাল চারপাশে। সবগুলো আবিষ্কার খুব সাবধানে আলাদা আলাদা সেকশনে লেবেল লাগিয়ে রাখা হয়েছে। তাই দুজন মিলে আকাঙ্ক্ষিত বস্তুটা খুঁজে বের করতে খুব একটা সময় লাগল না। ওরা দ্রুত চিপটা নিয়ে বের হয়ে গেল রুম থেকে।
দু’ জনের মনেই বিজয়ানন্দ আর উৎকণ্ঠা একসঙ্গে কাজ করছে। এখন শুধুমাত্র কারও চোখে না পড়ে ল্যাব পর্যন্ত পৌঁছাতে হবে। প্রোজেক্ট এপিমিথিউসের এক্সপেরিমেন্ট সেকশনের বাঁকটা ঘুরবার পর রিনিতা চমকে উঠল। তার একদম নাকের সামনে একজন স্যুট পড়া মানুষ দাঁড়ানো। রিনিতা দ্রুত সরে আসল। তাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন বার্নের ডিরেক্টর স্বয়ং জেনারেল কর্নেলিয়াস বানিয়োত্তি।
***
বানিয়োত্তি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন দুজনের দিকে। বিশালদেহী লোক তিনি, বুকে নীলরঙা আইডি কার্ড ঝোলানো। রিনিতার নিঃশ্বাস আটকে গেল। রায়ান আস্তে করে চেষ্টা করল রিনিতার আড়ালে চলে যাবার। দীর্ঘ কয়েকটা মুহূর্ত কাটল চরম উৎকণ্ঠায়? এরপর তারা দু’ জনেই খেয়াল করল ডিরেক্টর জেনারেলের মুখে কেমন একটা কৌতুক দৃষ্টি ফুটে উঠল। তিনি পালা করে দু’ জনের দিকে তাকালেন। একটা ভ্রু তুলে জিজ্ঞেস করলেন, “কোথায় যাওয়া হয়েছিল?”
রায়ান রিনিতার আড়াল থেকে বের হয়ে ফট করে বলে উঠল, “ইয়ে স্যার টয়লেটে গিয়েছিলাম।”
রিনিতা ভস্ম করা দৃষ্টিতে তাকাল রায়ানের দিকে। সে দ্রুত বানিয়োত্তির দিকে ফিরে আমতা আমতা করে বলল, “স্যার আসলে আমরা ক্যাফেটেরিয়ায় গিয়েছিলাম। ক্ষুধা লেগেছিল তো খুব।”
বানিয়োত্তি সাহেবের ভ্রু কুঁচকে গেল এবার। হুট করে রিনিতার মনে পড়ে গেল ক্যাফেটেরিয়াএকদমবিপরীতদিকে।সে সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে মনে মনে কষে গাল দিল। তার মাথার ফাংশনে কিছু ওলটপালট হয়ে গেছে মনে হচ্ছে। আস্তে আস্তে ডিরেক্টর জেনারেলের মুখে কৌতুক ভাব প্রবল হল। তিনি ফিসফিসিয়ে বললেন, “টয়লেট খাওয়াদাওয়া করার জন্য ভালো জায়গা না একদমই!”
এরপর একবার চোখ টিপে দিলেন তিনি দুজনের দিকে তাকিয়ে।
রিনিতার গাল টকটকে লাল হয়ে গেল। কর্নেলিয়াস বানিয়োত্তি চলে যাবার পর রায়ান মাথা চুলকে বলল, “ইয়ে ল্যাবে যাওয়া দরকার।”
রিনিতা তার দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকাল।
(৭)
আজকের দিনটা খুব রৌদ্রোজ্জ্বল। ঝকঝক করছে চারপাশ। সকালে উঠেই এডিনের মন ভালো হয়ে গেল। হয়তো সেজন্যই একটু আগেভাগে ল্যাবের উদ্দেশে রওনা হয়ে গেল। বার্ন ভবনে প্রবেশের পর বুঝতে পারল আজকে তাদের দলে সে-ই আগে এসেছে।
তবে ল্যাবের দরজা ঠেলে ঢুকে সে বিস্মিত হয়ে দেখল রায়ান কম্পিউটারের সামনে বসে আছে। চোখের নিচে কালি, মুখে উত্তেজিত অভিব্যক্তি। সে এমনকি এডিনকেও খেয়াল করেনি। তবে যখন এডিনকে দেখল, উত্তেজিত কন্ঠে চিৎকার করে উঠল, “এডিন, শতাব্দীর গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারটা আমরা করে ফেলেছি!”
***
“তুমি বলতে চাইছ এগুলো সত্যিই কোন এলিয়েনের কারবার না? বরং সবই মানুষ্য নির্মিত?” ভ্রু কুচকে জানতে চাইল রিনিতা।
“একদম ঠিক। মানুষ্য সৃষ্ট মহাকাশযান থেকেই এসেছে সংকেত। শুধু তাই না। অদ্ভুত হলেও সত্য, এগুলো হাজার বছর আগে সৃষ্ট। মেক্সিকোর দক্ষিণ অঞ্চলে অর্থাৎ উত্তর মধ্য আমেরিকাতে উদ্ভূত প্রাচীন মায়াদের হাতে। চিন্তা করতে পারো? এরা জ্ঞান বিজ্ঞানে প্রচুর উন্নতি করেছিল। অথচ দুঃখজনক হলেও সত্য এদের সম্পর্কে বিস্তারিত আমরা জানি না। এদের উত্তরপুরুষরা বহাল তবিয়তে টিকে আছে। তারপরও না..”
রিনিতা রায়ানকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “আমি মায়া সভ্যতা সম্পর্কে ভালোভাবেই জানি। কিন্তু তোমার ধারণা অবান্তর। হাজার বছর আগে কোন মহাকাশযান ছিল না।”
“মজাটা সেখানেই, রিনিতা। এডিন আর তুমি যখন সংকেতগুলো পেলে তখনও বুঝিনি ঘটনা কি। কিন্তু গতকাল অদ্ভুত সংকেতগুলো পাবার পর রহস্য উদঘাটন থেকে নিজেকে থামাতে পারছিলাম না। সারা দিন আর সারা রাত পড়ে ছিলাম এর পেছনে।”
“সেটা আমি জানি। এমনকি তুমি রাতের খাবারটাও খাওনি”, গম্ভীর স্বরে বলল রিনিতা।
রায়ান হাত নাড়িয়ে উড়িয়ে দেয়ার ভঙ্গিতে বলল, “আমি যতই ব্যাপারটার গভীরে ঢুকছিলাম, ততই বিস্মিত হচ্ছিলাম। যে সংকেতটা পাওয়া গেছে সেটা ছিল পেন্টাবাইনারি পদ্ধতিতে। জান কিনা জানি না, কথিত আছে মায়ারা পাঁচভিত্তিক একটা সংখ্যা পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছিল। আমি এখন নিশ্চিত সেটা ছিল পেন্টাবাইনারি। আর সেই পদ্ধতির কার্যকারীতা ঘটিয়েছে তাদের স্ব-আবিষ্কৃত কম্পিউটারে। তুমি বিশ্বাস করবে না রিনিতা, সেসব কম্পিউটার একদম ভিন্ন আর অনেকাংশে আরো আধুনিক। আমরা পৃথিবীর প্রাচীন সভ্যতাগুলো সম্পর্কে কত কম জানি! আমি সেই মায়াকোড ডিসাইফার করতে পেরেছি। এজন্য নতুন একটা প্রোগ্রাম তৈরি করতে হয়েছে আমার। আর এই কোডে স্পষ্ট বলা আছে এই ম্যাসেজের লক্ষ্য আর উদ্দেশ্য কি।”
রিনিতা আগ্রহ বোধ করছে। রায়ান যা বলছে আদতে সম্পূর্ণটাই গাঁজাখুরে মনে হচ্ছে। কিন্তু সত্যিই তো প্রাচীন সভ্যতার একটা বড় অংশ আমাদের কাছে রহস্যময়। রিনিতা নিজের কৌতূহলে এসব নিয়ে একসময় পড়াশোনা করেছে। রায়ানের কথাবার্তা আজগুবি শোনালেও হয়তো অসম্ভব না।
রায়ান বলে চলল, “মায়া মহাশূন্যযানটার অবস্থান নির্ণয় গতকালই করতে পেরেছিলাম। আমি কাল বিকেলেই জ্যোতির্বিদ্যা ডিপার্টমেন্টের অনুমতি নিয়ে একটা স্পেসশীপ পাঠিয়ে দিয়েছি। প্রচুর তথ্য সংগ্রহ করা গেছে। মজার বিষয় হচ্ছে মায়াদের মহাশূন্যযান একটা নয়, বরং সংখ্যাটা হাজার!”
রিনিতার মুখ থেকে একটা অস্ফুট ধ্বনি বেরিয়ে আসল। “কি বলছ তুমি?”
রায়ান মাথা ঝাকাল। “আমার পাঠানো ছোট স্পেসশীপটা জ্যোতির্বিদ্যা ডিপার্টমেন্টের সাম্প্রতিক আবিষ্কার। আধুনিক ক্লোরোইঞ্জিনে চালিত এই যানটার দ্রুতগামীতা নিয়ে অন্তত কারও কোন দ্বিমত নেই। এজন্যই এটা ব্যবহার করেছি। মোটামুটি খানিকটা দূরে হলেও রাতের মধ্যেই পৃথিবীর সবচেয়ে কাছের মায়াযানটার সন্ধান পায় স্পেসশীপটা। এর মধ্যে অত্যাধুনিক মাইক্রো ক্যামেরাও সেট করে দিয়েছিলাম। সেটা মায়াযানটাকে ঘিরে কয়েকবার চক্কর দিয়েছে। অবাক হয়ে আমি এর নির্মাণশৈলী দেখেছি। অবাক হতে হয়েছে। যানটা স্টীলের পাশাপাশি এক ধরণের ক্রিস্টালের সাহায্যে তৈরি। আর অদ্ভুত ব্যাপারটা হচ্ছে, এই ক্রিস্টালগুলোই মায়াযানের শক্তির উৎস। যা হাজার বছরেও ফুরিয়ে যায়নি।”
ভ্রূ কুচকে গেল রিনিতার। “ক্রিস্টাল? তুমি বলতে চাইছ মায়াশূন্যযানের ক্রিস্টালের শক্তি হাজার বছরেও ফুরিয়ে যায়নি?”
রায়ান এক মুহুর্তের জন্য থেমে গেল। এরপর ভ্রূ তুলে বলল, “মায়াশূন্যযান! নামটা ভালো দিয়েছ।”
“ব্যাখ্যা দাও, রায়ান।”
মৃদু হাসল রায়ান। “হ্যাঁ ক্রিস্টাল। আমার ধারণা এই ক্রিস্টাল সাধারণ কিছু না। এর মধ্যে খুব সম্ভবত নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া চলে অবিরত। ফলে অসীম এক শক্তির আধারে পরিণত হয়েছে এটি। আর মায়াশূন্যযানগুলো কোনও মানুষ বহনের জন্য বানানো হয়নি। আকারে তাই খুব ছোট। আর সবচেয়ে বিস্ময়কর বস্তুটা এর একদম মাথায় সেট করা। একটা টেলিস্কোপ। আর সেটা মোটামুটি উচ্চ মানের।”
“তুমি কি নিশ্চিত, অন্য কোন দেশের কোন মহাকাশযানকে তুমি হাজার বছর আগের কোন মায়াশূন্যযান বলছ না? কারন মায়ারা স্টিলের ব্যবহার জানত না। টেলিস্কোপও সেসময় আবিষ্কৃত হয়নি।”
“আমি নিশ্চিত। কোডটায় স্পষ্ট বলা আছে। এছাড়া নির্মাণশৈলী একদম মায়াদের মত। সবচেয়ে বড় কথা মায়ারা আমাদের কাছে রহস্যের আধার। তাদের অনেক কিছুই আমরা জানি না। তারা টেলিস্কোপ আবিষ্কার করেছিল। কিন্তু অজানা কোন কারনে সেই জ্ঞান উত্তরপুরুষদেরকে দিয়ে যেতে পারেনি। আর মায়াশূন্যযানের পেছনে বাম পাশটায় প্রাচীন মায়া ভাষায় একটা শব্দ খোদাই করা ছিল। হুনানপু। হুনানপু মায়ান ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ নাম।”
নিচের ঠোঁট কামড়ে এক মুহুর্তের জন্য চিন্তায় ডুবে গেল রিনিতা। এরপর বলল, “কিন্তু মায়ারা সারা মহাকাশ জুড়ে গুপ্তচর ছড়িয়ে রাখবে কেন?”
রায়ান মৃদু হাসল। “সম্ভবত এটাই মায়াদের সবচেয়ে বৃহৎ আবিষ্কার। বহু বছরের সাধনা। আমি মায়াশূন্যযানের সঙ্গে এই কম্পিউটারটা কানেক্ট করতে পেরেছি। ব্যাপারটা কঠিন ছিল না। তারা জানত কোন একদিন কেউ এই চেষ্টা করবে। এখান থেকে হয়তো কিছু উত্তর পাওয়া যাবে। তবে আমি সবচেয়ে বেশি অভিভূত হয়েছি এই যানটার পেছনের থিওরিটার জন্য। বিস্তারিত বলার আগে তোমাকে একটা অদ্ভুত জিনিস দেখাই।”
রায়ান দ্রুত কম্পিউটারে কিছু কমান্ড দিল। রিনিতা অবাক হয়ে লক্ষ্য করল কমান্ডগুলো একটু অদ্ভুত ভাষায়। হঠাৎই স্ক্রিনটা একটু কেঁপে উঠল। এরপর সেখানে ফুটে উঠল মহাশূন্যের চিত্র। নিকষ কালো আঁধারের পটভূমিতে ছোট ছোট নক্ষত্ররাজি। স্ক্রিনের ঠিক মাঝ বরাবর নীল একটি গ্রহ। পৃথিবী।
রিনিতা স্ক্রিনের কাছাকাছি গিয়ে ভালোভাবে দেখার চেষ্টা করল ব্যাপারটা। পরমুহুর্তেই বিস্মিত হয়ে আবিষ্কার করল পৃথিবীর বর্তমান রূপ না সেটা। হাজার কিংবা কে জানে, হয়তো লক্ষ বছর আগের পৃথিবীকে দেখা যাচ্ছে পর্দায়। মহাদেশগুলোর অবস্থান বা আকার একদম ভিন্ন। রিনিতা অস্ফুট দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইল স্ক্রিনের দিকে।
রায়ান রিনিতার মুখভঙ্গি লক্ষ্য করে মৃদু হাসল। “ঠিক ধরেছ, রিনিতা। এটা বর্তমানের পৃথিবী নয়। তবে সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে এই ইমেজটা নেয়া হচ্ছে সরাসরি মায়াশূন্যযান থেকে। টেলিস্কোপটাকে এভাবেই তারা বানিয়েছিল। অনেকটা ভিডিও ক্যামেরার মত কাজ করে সেটা। এবং প্রতি সেকেন্ডেই এই কম্পিউটারে এই মুহুর্তের চলমান চিত্র পাঠিয়ে যাচ্ছে।”
“হাজার বছর আগের ভিডিও এখনও জমা রেখেছে এটা? মেমোরি কি দিয়ে বানানো?”
“না এখানে তোমার বুঝতে একটু ভুল হয়েছে। এটার কোন মেমোরি নেই। টেলস্কোপ দিয়ে যা দেখতে পাচ্ছে সঙ্গে সঙ্গে সে চিত্রটুকু পাঠায়। কোন কিছু জমা করে রাখেনা। আমার ধারণা টানা হাজার বছরের তথ্য জমা রাখার প্রযুক্তি খুব সহজ কিছু না। সেটা ওরা সৃষ্টি করতে পারেনি নিশ্চিতভাবেই।”
“তাহলে এই ভিডিওটা?”
রায়ান এবার জুম করা শুরু করল। চিত্রটা ক্রমেই মেঘ ভেদ করে এগিয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর দিকে। রিনিতা অবাক হয়ে খেয়াল করল, পৃথিবীতে কোন সভ্যতার রেশমাত্র দেখা যাচ্ছে না। বেশিরভাগ অঞ্চলই ভরপুর বন আর জঙ্গলে। আরো জুম করার পর ভ্রূ আরেকবার কুচকে গেল তার।
স্পষ্ট ভূমি দেখা যাচ্ছে এবার। কিছু বড় আকারের হাতি প্রাণপণে দৌড়ে পালাচ্ছে। পুরো জায়গাটা হয়ে উঠছে ধুলো ধুসরময়। একটু খটকা লাগল রিনিতার। সে ভালোভাবে তাকাল।
প্রাণীগুলো হাতি নয়, বাইসন। আর বাইসনগুলোকে তাড়া করছে কিছু অসীম সাহসী আদিম মানুষ। নিয়ান্ডার্থাল। কিংবা ইরেক্টাস গোত্রও হতে পারে। নিশ্চিত না রিনিতা। কিন্তু সে নিশ্চিত যে এতটা বিস্মিত সে কোনদিন হয়নি। চোয়াল ঝুলে পড়ল তার।
“রায়ান, তুমি বলেছিলে মায়াশূন্যযান এই মুহুর্তের টেলিস্কোপিক ভিডিও পাঠাচ্ছে, প্রতি সেকেন্ডে। কিন্তু..”
শব্দটা ঝুলে রইল বাতাসে।
“হ্যাঁ এটা এখনকার ছবি নয়”, ভ্রু নাচিয়ে বলল রায়ান। “কিন্তু টেলিস্কোপটা এখনকার ছবিই পাঠাচ্ছে।”
বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে রায়ানের দিকে তাকাল রিনিতা।
“আচ্ছা রিনিতা, তোমার নিশ্চয়ই ‘বাবল’ টেলিস্কোপের কথা মনে আছে?”
খানিকটা বিরক্ত বোধ করল রিনিতা। অধৈর্য কন্ঠে বলল, “মনে না থাকার মত কিছু না। ‘বাবল’ টেলিস্কোপ বর্তমান সময়ের অন্যতম শক্তিশালী টেলিস্কোপ। সম্প্রতি ১.৭ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দুরের একটা নক্ষত্র আবিষ্কার করে আলোচনায় উঠে এসেছে।”
“ঠিক তাই”, হাতে কিল দিয়ে বলল রায়ান। “আমরা জানি যে কোন বস্তু থেকে আলো এসে পড়লে তবেই সেটা দৃশ্যমান হয়। সে হিসেবে বাবল টেলিস্কোপ আবিষ্কৃত নক্ষত্রটির ১.৭ বিলিয়ন বছর পূর্বের আলো আমাদের চোখে এখন ধরা পড়ছে। অর্থাৎ আমরা নক্ষত্রটার ১.৭ বিলিয়ন বৎসর আগের আলো দেখতে পাচ্ছি। সোজা কথায় অতীত দেখছি।”
“রায়ান, আসল কথা বল। এই ব্যাপারগুলো আমি জানি সেটা তুমি ভালো করেই জান।”
“আহা ভূমিকা দিতে দাও। হুট করে উপসংহার বলে দিলে মজা থাকল কোথায়?”
রিনিতা হতাশভাবে মাথা নাড়ল।
রায়ান বলল, “বাবল টেলিস্কোপের মতই ঘটনা ঘটেছে এই মায়াশূন্যযানে।”
রিনিতা ঠিক দুয়ে দুয়ে চার মেলাতে পারল না। ফলে দ্বিতীয়বারের মত রায়ানের দিকে বিভ্রান্ত দৃষ্টি ছুড়ে দিল।
মুচকি হাসল রায়ান। “তোমাকে খুলে বলছি ব্যাপারটা, রিনিতা।”
মনোযোগ বাড়িয়ে দিল সে।
“মনে কর হাজার বছর আগে মায়াদের মধ্যে প্রতিভাধর একজন বিজ্ঞানী ছিলেন। যিনি কিনা টেলিস্কোপ আবিষ্কারের উপায় বের করে ফেলেছিলেন। টেলিস্কোপ নিয়ে ঘাটাঘাটি করার সময়ই বোধহয় তার মাথায় ব্যাপারটা এসেছিল। বাবল টেলিস্কোপের মত বিষয় আরকি। সে চিন্তা করল এই থিওরি দিয়ে মায়াদেরকে চিরস্মরণীয় করে রাখবে। সত্যি কথা বলতে তার পরিকল্পণাটা যখন আমি বুঝতে পারলাম, আমিও ভালো রকম চমকে উঠেছিলাম। রিনিতা, চিন্তা করে দেখ আমাদের পৃথিবী কিংবা মহাশূন্যের বেশিরভাগ গ্রহ নক্ষত্রই গোল। আর সেগুলো গোলাকার পথেই ক্রমে ঘুরে চলেছে। কেমন হয় যদি পুরো মহাবিশ্বটাই গোল হয়? সম্ভবত বিজ্ঞানী এমনটাই চিন্তা করেছিলেন। তিনি হিসাব নিকাশ করলেন। জান তো মায়ারা জ্যোতির্বিদ্যায় খুব অগ্রগামী ছিল। গ্রহ নক্ষত্রের নিখুঁত অবস্থান তারা নির্ণয় করেছিল। এই জ্ঞান ব্যবহার করে সে একটা মানচিত্র তৈরি করল। এরপর হাজার হাজার মায়াশূন্যযান তৈরি করে পাঠিয়ে দিল মহাবিশ্বে। মজার ব্যাপার হচ্ছে এগুলো পাঠানো হয়েছে নিখুঁত সরলরেখা বরাবর। তবে এই সরলরেখা একসময় স্বাভাবিকভাবেই গোলাকার হয়ে গেল। যেহেতু সে প্রাচীন বিজ্ঞানী ভেবেছিলেন মহাবিশ্ব গোল। হয়তো তিনি ঠিকই ছিলেন। ঘটনাটা অনেকটা পৃথিবীর এক মেরু দিয়ে ভ্রমণ শুরু করে অন্য মেরু দিয়ে ফিরে আসার মত। মায়াশূন্যযান পাঠানো হয়েছিল পৃথিবীর উত্তর মেরু বরাবর। অবধারিতভাবেই প্রথম পাঠানো যানটা একসময় পৃথিবীর দক্ষিণ মেরুর দিকে এসে পৌছে। বিস্ময়করভাবে হিসাব করে তারা কাজটা করেছিল। আমরা উত্তর মেরুর দিক থেকে সিগন্যাল পেয়েছিলাম। পরে পরীক্ষা করে দেখেছি, দক্ষিণ মেরুর দিকে সত্যিই লাইন দিয়ে মায়াযানগুলো অবস্থান করছে। যদিও তাদের মধ্যকার দুরত্ব প্রচুর।”
“কিন্তু এর সঙ্গে এই বাইসনের দৃশ্য দেখার কি কারন?”
“বলছি। প্রত্যেকটা মায়াশূন্যযানের মধ্যকার দুরত্ব হচ্ছে আলোর গতিতে প্রায় এক দিন। কিন্তু প্রত্যেকটা যানের সামনে খুব শক্তিশালী টেলিস্কোপ লাগানো হয়েছে। যেহেতু এরা সরলরেখায় অবস্থিত, তাই প্রত্যেকটা যানের টেলিস্কোপের মধ্য দিয়ে তার সামনের মায়াশূন্যযানের টেলিস্কোপ দৃশ্য দেখা যায়। ধর তুমি যদি উত্তর মেরুর মায়াশূন্যযানের টেলিস্কোপে চোখ রাখ তবে দক্ষিণ মেরুর মায়াশূন্যযানের টেলিস্কোপ, যেটা কিনা পৃথিবীর দিকে তাক করা, সেটা যে দৃশ্য দেখাচ্ছে তা দেখতে পাবে। উত্তর মেরু থেকে পুরো মহাবিশ্ব পার করে যেতে যেতে ইতোমধ্যে লাখ বছর পার করে ফেলেছে দক্ষিণ মেরুর মায়াশূন্যযানটা। সুতরাং এর টেলিস্কোপে যে আলো পড়ছে সেটা ঘটনাক্রমে হচ্ছে লাখ বছর আগের। আর এজন্যই আমরা পৃথিবীর অতীতটা দেখতে পারছি। মজার বিষয় হচ্ছে টেলিস্কোপটা লাখ বছর আগের দৃশ্য দেখছে, কিন্তু লাখ বছর আগের পৃথিবী থেকে সেটাকে দেখা যাচ্ছে না। কারন সে সত্যিকার অর্থে সেই সময়টায় নেই। সেটাকে দেখতে পাচ্ছি আমরা। কারন সেটা থেকে বিচ্ছুরিত আলোটা আমাদের চোখে ধরা পড়ছে। আইনস্টাইন এরকম কিছু প্রথম চিন্তা করেছিলেন। সময় আর স্থানের পারস্পরিক নির্ভরশীলতার একটা ব্যাপার। এজন্য আমরা এতদিন এই মায়াশূন্যযানগুলোর কোনটিকেই দেখতে পাইনি। সেটি আমাদের চেয়ে প্রত্যেকবারই কিছুটা সময় পিছিয়ে ছিল।”
রিনিতা এক মুহূর্তের জন্যও মুখ খুলেনি। সম্পূর্ণ ব্যাপারটা হজম করতে তার যথেষ্ট সময় নিতে হল। শেষ পর্যন্ত বলল, “আজব। কিন্তু মাত্র হাজার বছরে মায়াশূন্যযানগুলো মহাবিশ্বের বিশাল অংশ ঘুরে এসে পড়েছে, ব্যাপারটা খানিক অদ্ভুত না?”
রহস্যময় একটা হাসি দিল রায়ান। নিজের অদ্ভুত কোন আবিষ্কারের কার্যকারীতা অন্যকে বোঝানোর সময় যে হাসিটা দেয়।
“মায়াশূন্যযানগুলো খুবই রহস্যময়, রিনিতা। ক্রিস্টালগুলো হচ্ছে রহস্যের উৎস। অসীম জ্বালানী যোগান দেবার পাশাপাশি যানগুলোকে অসীম গতিশক্তিও দিয়েছে এটি। ইঞ্জিনগুলো আলোর চেয়েও বেশি গতিতে ছুটতে পেরেছে। আর কোন বাহ্যিক বল প্রদান না করলে গতিশীল বস্তু একই গতিতে চিরদিন চলতেই থাকে। মহাশূন্যে হয়তো সৌভাগ্যক্রমে সেটিকে বাধা দেবার মত কিছু ছিল না। আর আলোর গতিতে ছোটার সময় এদের কাছে সময় হয়ে যায় স্থির। একসময় এরা প্রবেশ করে অতীতে। অনেকটা সময় পরিভ্রমণের থিওরির মত। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে এরা মাত্র হাজার বছর ভ্রমণ করেছে। সত্যিকার অর্থে এরা হয়তো লাখখানেক বছরের বেশিই সময় একটানা ছুটেছে। মহাশূন্যে অনেক রহস্যময় ঘটনাই ঘটা সম্ভব।”
“আরেকটু গুছিয়ে বল বিষয়টা। মাথায় জট লেগে যাচ্ছে।”
“মানে মায়াশূন্যযানগুলোর গতি আলোর গতির চেয়েও বেশি। আমার ধারণা ক্রিস্টালগুলোতে বিশেষ কোন কণা আছে। এগুলোই সব রহস্যের উৎস। প্রাচীন পুরাণেও এসব ক্রিস্টালের উল্লেখ পাওয়া যায়। কথিত আছে এগুলো শক্তিকে বিবর্ধিত করতে পারত। রহস্যময় দ্বীপ আটলান্টিসে পাওয়া যেত বস্তুগুলো। আর বিভিন্ন তথ্যমতে আটলান্টিসের নানা অবস্থান পাওয়া যায়। এর মাঝে একটা হচ্ছে উত্তর মধ্য আমেরিকার আশেপাশেই। মানে মায়াদের রাজত্বের একদম সঙ্গেই। সম্ভবত এটাই সঠিক তথ্য। এই ক্রিস্টালের শক্তির মাধ্যমেই আলোর চেয়েও দ্রুত ছুটেছে এই মায়াশূন্যযান। কিন্তু আলো চলেছে তার নিজস্ব গতিতেই। দক্ষিণ মেরুর দিকে মায়াশূন্যযানটা এখন যে অবস্থানে আছে, তার কাছে পৃথিবীর লাখ বছর আগের আলো যাচ্ছে। অনেকটাই ‘বাবল’ টেলিস্কোপের থিওরিটার মতই। আর যেহেতু প্রত্যেক মায়াশূন্যযান পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত, তাই আমরা উত্তর মেরুর মায়াশূন্যযান থেকে যে দৃশ্য দেখছি সেটা মূলত দক্ষিণ মেরুর দিকের পৃথিবীমুখী সর্বশেষ মায়াশূন্যযানের চিত্র। সুতরাং টেকনিক্যালি আমরা পৃথিবীর অতীত দেখতে পাচ্ছি।”
রিনিতা দীর্ঘক্ষণ কিছু বলতে পারল না। বিহ্বল হয়ে বসে রইল। তথ্যগুলো পুরোপুরি মাথায় বসাতে খুব সময় লাগল তার।
রায়ান হেসে বলল, “মনে হচ্ছে এবারও এলিয়েন প্রেমিক তোমার হাতছাড়া হয়ে গেল।”
রিনিতা এর প্রতিউত্তরেও কোন প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারল না।
(৮)
‘বার্নে’ মোটামুটি বড় ধরণের একটা সাড়া পড়ে গেল। পুরো অর্গানাইজেশনটা এই আবিষ্কারটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল পুরোদমে। আগেই বাইরে প্রচার করা হবে না ব্যাপারটা। মানবজাতি বিষয়টা মেনে নিতে পারবে কিনা সেটা বিবেচনা করে ধীরেধীরে সব প্রকাশ করা হবে। তবে বার্নের ভেতরে একটা প্রলয় ঘটে গেছে। সবাইকে বিষয়টা খুলে বলা হচ্ছে না যদিও। বাছাই করা বিজ্ঞানীদেরকে তাদের নিজেদের সেক্টরের প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করার অনুমতি দেয়া হচ্ছে শুধু। তারপরও জ্যোতির্বিদ্যা ডিপার্টমেন্টের বিশেষ কম্পিউটারে সারাদিন ভীড় লেগেই থাকে। এডিনরা এই কম্পিউটারটা ডেভেলপ করে দিয়েছে। নিজেদের ল্যাবেও যে এমন একটা যন্ত্র আছে, দক্ষতার সঙ্গে সেটা চেপে গেছে বেমালুম। যার ফলে সবাই প্রবল আগ্রহ নিয়ে হুমরি খেয়ে পড়ছে এক জ্যোতির্বিদ্যা ডিপার্টমেন্টের এই যন্ত্রটার উপর। তাদের চাপে ছবি তুলে বিভিন্ন সময়ের পৃথিবীর ম্যাপ করে নেয়া হয়েছে। অতীত দেখার সুযোগ পেলে নিজেদের সেক্টরের অজানা বিষয়গুলো সম্পর্কে নিশ্চিত হবার সুযোগ কে-ই বা হাতছাড়া করতে চায়!
রায়ান অবশ্য আজ কাজে আসেনি। এতবড় একটা বিষয় আবিষ্কারের পর একদিন ল্যাবে না আসার অধিকার তার আছে বটে। মজার ব্যাপার হচ্ছে এসবই যে তার আবিষ্কার ব্যাপারটা বেশিরভাগ বার্ন বিজ্ঞানীরা জানে না। জানানো হয়নি তাদেরকে।
রিনিতা ল্যাবে ঢুকে এডিনকে তীব্র মনোযোগ দিয়ে বিশেষ কম্পিউটারটার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখল। অবধারিতভাবেই সে মায়াশূন্যযানের পেছনে লেগে আছে। ভাগ্য ভালো তাদের এই কম্পিউটারের কথা অন্যান্য বিজ্ঞানীরা জানে না। তাহলে জ্যোতির্বিদ্যা ডিপার্টমেন্টের মত জঘন্য অবস্থা এখানেও হত।
“রিনিতা, একটা বিষয় কি দেখেছ?” রিনিতাকে ঢুকতে দেখেই জিজ্ঞেস করল এডিন।
রিনিতা প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকাল।
এডিন গভীর মনোযোগ দিয়ে কম্পিউটারের পৃথিবীর চিত্র দেখছে। সে আনমনেই বলল, “মায়াদের এই যানগুলোরর একটার সঙ্গে কম্পিউটার সংযুক্ত থাকলেই প্রত্যেকটাকে আলাদা আলাদাভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। আর যদি দক্ষিণ মেরুর শেষ মায়াশূন্যযানটা দিয়ে না দেখে, এর আগের যে কোন একটা যানের টেলিস্কোপের অবস্থান একটু বাকিয়ে সেটা দিয়ে দেখা হয়, একদম ভিন্ন একটা সময়ের পৃথিবীকে দেখা যায়। যেহেতু আলাদা করলে সেটায় আরো অতীতের পৃথিবীর আলো এসে পড়ে।”
রিনিতা বিষয়টা বোঝার জন্য আরো প্রশ্ন করার চিন্তা করল। কিন্তু সে সময়ই দরজা খুলে প্রবেশ করল কেউ একজন।
ইভান, সেই জিনবিজ্ঞানী। তার চোখেমুখে গাঢ় চিন্তার ভাব। আশেপাশের কোন কিছুতেই খেয়াল নেই যেন। যেসব বিজ্ঞানী পৃথিবীর অতীত নিয়ে গবেষণা করার সুযোগ পেয়েছে, তাদের মধ্যে সে-ও একজন।
রিনিতা তার কাছে গিয়ে অভিবাদন জানাল। কিন্তু ইভানের মধ্যে কোন ভাবান্তর দেখা গেল না। গভীর চিন্তায় ডুবে আছে যেন।
“ইভান”, আবার বলল রিনিতা। “ঠিক আছো তুমি?”
হঠাৎ করেই যেন বাস্তবে ফিরে আসল ইভান। “হু! ওহ। হ্যাঁ। রায়ান কোথায়?”
“রায়ান আজ আসেনি। বিশ্রাম নিচ্ছে। এসাইনমেন্ট আর কিছু বিষয় নিয়ে গত দুইদিন খুব খাটনি গেছে তো ওর উপর দিয়ে। কেন কি হয়েছে?”
ইভান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। “সবকিছু পাল্টে যাচ্ছে, রিনিতা। মায়াদের টেলিস্কোপে স্পষ্ট দেখা গেল প্রাচীন মানুষদের। মানে মানুষ। আজকের মানুষের মতই। অথচ এদের সে সময় থাকবার কথা না। বিবর্তন হয়ে পূর্ণাঙ্গ মানুষ হওয়ার কথা আরো অনেক পরে। সে মানুষ সম্প্রদায় আদীম, কিন্তু প্রায় আমাদের মতই। তারা মানুষের কাছাকাছি অন্যান্য প্রজাতির জীবের সঙ্গে প্রজননের মাধ্যমে নিজেদেরকে আরো যোগ্য করে তুলেছে। কি অদ্ভুত! যেখানে তাদের থাকবারই কথা না, সেখানে তারা নিজেরাই নিজেরদেরকে উন্নত করেছে। নিজেদের বিবর্তন করেছে নিজেরাই। সব পাল্টে যাচ্ছে। সব! বিবর্তনবিদ্যা আবার লিখতে হবে নতুন করে।”
রিনিতা একটা নিঃশ্বাস ফেলল। অনেক কিছু যে পরিবর্তন হয়ে যাবে সেটা সে আগেই বোঝা গেছে। সে বলল, “কিন্তু রায়ানের সঙ্গে এর কি সম্পর্ক?”
“রায়ানের সঙ্গে এই ব্যাপারটা নিয়েই আলাপ হয়েছিল কিছুদিন আগে। সে বলেছিল এরকম কিছু সম্ভব। কিন্তু আমি পাত্তাই দেইনি। কিন্তু এখন…”
ইভানকে দেখে রিনিতার মায়াই লাগল। একজন বিজ্ঞানী সারাজীবন এই ঝুকিটা নিয়ে কাটায়। যে কোন সময় এতদিন ধরে জেনে আসা বিষয়টা এক লহমায় ভুল হয়ে যেতে পারে। প্রস্তুতি থাকা স্বত্তেও এরকম কিছু যখন সত্যিই ঘটে যায়, নিজেকে সামলে রাখাটা খুব সহজ হয় না।
“ওহ রিনিতা”, ফিরে যেতে চেয়েও থেমে বলল ইভান। “বস ডেকেছে তোমাকে। এসাইনমেন্ট দিবে বোধহয়।”
এরপর আবার ঘুরে আপনমনেই বিড়বিড় করতে করতে চলে গেল ইভান।
রিনিতা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এসাইনমেন্টের ভার পড়ে গেছে। আবার গাদাখানেক ঝামেলার মধ্য দিয়ে তাকে যেতে হবে মনে হচ্ছে।
***
পরেরদিনও যখন রায়ান ল্যাবে আসল না, রিনিতা খানিকটা দুশ্চিন্তা বোধ করল। এডিনেরও একই অনুভূতি হবার কথা ছিল। কিন্তু সে এখন আর পৃথিবীতে নাই। গতকাল সারা দিন এমনকি সারা রাত সে কম্পিউটারটার সামনে বসে ছিল। আগেরবার এভাবে যে এই যন্ত্রের সামনে বসে ছিল সে যুগান্তকারী একটা আবিষ্কার করেছিল। তাই রিনিতা ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামাল না। ইভান রীতিমত কাগজ কলম নিয়ে কি কি হিসেব করছে। বারবার মায়াশূন্যযান পরিবর্তন করে করে বিভিন্ন সময়ের পৃথিবীকে দেখছে। রিনিতা একটু উঁকি দিয়ে দেখেছে সে প্রফেসর হফম্যানের সম্প্রতি দেয়া সময় বিষয়ক একটা সূত্র নিয়ে সেটাকে বিভিন্ন ভাবে সাজাচ্ছে। হফম্যানের এই সূত্র এখন পর্যন্ত গাঁজাখুরে হিসেবেই প্রচার হয়ে আসছে। বিজ্ঞানী সমাজ এখনও মেনে নেয়নি। রিনিতা নতুন নানান ইকুয়েশনও দেখতে পেল। কিন্তু ব্যাপারটা ভালোভাবে পর্যবেক্ষণের সুযোগ পায়নি। তার উপরে কোয়ান্টাম তত্বের একটা এসাইনমেন্টের দায়িত্ব চাপানো হয়েছে। সেটা নিয়ে কাজ করেই কূল পাওয়া যাচ্ছে না।
প্রায় দুপুর পর্যন্ত টানা নিজেদের কাজ করে গেল দুজনই। এডিন এখনও একবারের জন্য চেয়ার ছেড়ে উঠেনি। রিনিতা নিশ্চিত এডিন খেয়ালও করেনি রিনিতা ল্যাবে আছে কি নেই।
লাঞ্চের সময় রায়ানের জন্য দুশ্চিন্তাটা আবার ফিরে এল। তার যোগাযোগ মডিউলটা সকাল থেকেই বন্ধ। ব্যাপারটা মাথা থেকে সরিয়ে রাখার জন্য সে আশেপাশে তাকাল। ‘বার্নে’র এই লাঞ্চ এরিয়াটা তুলনামূলকভাবে নতুন। যে সকল শিক্ষানবিশ বিজ্ঞানীরা কাজের ফাঁকে খাবারটাও এখানে সেরে ফেলতে চায় তাদের জন্য বানানো হয়েছে। প্রচুর বিজ্ঞানীদেরকে আশেপাশে দেখা যাচ্ছে। কেউ জটলা বেধে খাচ্ছে, কেউ আবার রিনিতার মত এক কোনে বসে আছে একাকী। রিনিতা কেমন একটা শিহরণ অনুভব করল। এখান থেকেই কেউ হয়তো ভবিষ্যতে যুগান্তকারী কোন কিছু ঘটিয়ে ফেলবে। পরিণত হবে কিংবদন্তীতে।
তখনই একটা ব্যাপার রিনিতার মাথায় খেলে গেল। খাওয়া থামিয়ে দিল সে। সে যা ভাবছে তা যদি সত্যি হয় তবে ব্যাপারটা খুবই অদ্ভুত হবে। সে দ্রুত মাথা চালাল। সবকিছু খাপে খাপ মিলে যাচ্ছে।
রিনিতা ধীরেসুস্থে খাবার শেষ করল। এরপর ল্যাবে ফিরে না গিয়ে বেরিয়ে পড়ল ‘বার্ন’ ভবন থেকে। এসাইনমেন্ট পরেও করা যাবে।
(৯)
রিনিতা তার যোগাযোগ যন্ত্রের স্ক্রিনে ভেসে ওঠা ঠিকানাটা মিলিয়ে নিল। রায়ানের বাসার ঠিকানায় এটাই দেয়া। রায়ানের বাসায় আগে কখনো আসা হয়নি। তার ধারণা ছিল রায়ান কোন ব্যস্ত এলাকায় বহুতল কোন ভবনের এক কোনে থাকে। কিন্তু তার ধারণা ভুল ছিল।
এই এলাকাটা শহরের বাইরে, আর বেশ নির্জন। নিম্নবিত্তদের বাস এখানে। বাসাটাও ছোটখাটো। দেখে মনে হচ্ছে পেছন দিকটায় বেশ খালি জায়গা আছে। সে কলিং বেলটায় চাপ দিল। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেও কোন সাড়া পাওয়া গেল না।
রিনিতা আলতো করে ধাক্কা দিল দরজায়। খোলা। কিছুটা অবাক হয়েই সে ঢুকে পড়ল ভেতরে।
রায়ানের বাসার ভেতরটা বেশ অদ্ভুত। এক ঝলক দেখলেই বোঝা যাবে এটা নিশ্চিত কোন পদার্থবিজ্ঞানীর আস্তানা। ল্যাবে সাধারণ কাজকর্ম করে যাওয়া রায়ানকে এই বাসাটার সঙ্গে মেলানো যাবে না। নিজের অদ্ভুত কাজকর্মের সব বৈশিষ্টই এখানে পাওয়া যাবে। রিনিতা বেশ কিছু জটিল যন্ত্রপাতি দেখল। দ্বিতীয় কক্ষে ঢোকার পর দেখতে পেলএকটা রোবট নিবিষ্টমনে কাজ করে যাচ্ছে। রিনিতাকে রুমে ঢুকতে দেখে সেটা মুখ তুলে একবার জ্বলজ্বলে চোখ নিয়ে তাকাল। এরপর আবার ডুবে গেল কাজে।
রিনিতা এই রুমটা পেরিয়ে বাসার পেছনের দিকে চলে গেল। এখানে একটা বারান্দা মত আছে। সেখান দিয়ে বাড়ির পেছনে বড়সড় খোলা অংশটা দেখা যায়। বারান্দার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে রায়ান। বিমুগ্ধ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে খোলা জায়গাটায় রাখা তার বিশেষ সেই গাড়িটার দিকে।
রিনিতার পদশব্দে পেছনে ফিরে তাকাল রায়ান। মাথা নেড়ে মৃদু হাসল সে।
“রায়ান, তুমি কি ঠিক আছো?” কোমলস্বরে জানতে চাইল রিনিতা।
রায়ান একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “হ্যাঁ রিনিতা। যতটা থাকা যায়। আমার আস্তানায় স্বাগতম।”
রিনিতা এক মুহূর্ত চুপ রইল। এরপর ধীরেধীরে বলল, “ইভান তোমাকে খুঁজছিল। তুমি আগেই জানতে মানুষ বিবর্তন নিয়ে ভুল জেনে আসছে। মায়াশূন্যযান সম্পর্কেও সব জানতে তুমি। একদিনেই যেভাবে মায়াশূন্যযানের রহস্য ভেদ করলে সেটা কোনভাবেই সম্ভব ছিল না। যদি না আগে থেকেই না জেনে থাক।”
রায়ানকে অবাক মনে হল না। সে মৃদু হাসল।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রিনিতা বলল, “আমি যে এখানে এসে এসব বলব সেটাও তুমি জানতে।”
রায়ান একটা নিঃশ্বাস ফেলল। “তোমার কেন এরকম মনে হল, রিনিতা?”
“তুমি ভবিষ্যতের মানুষ। ভবিষ্যৎ থেকে এসেছ সময়কে ঠিক করার জন্য। মানুষকে সঠিক পথটা ধরিয়ে দেবার জন্য। সবকিছুই পরিকল্পণার অংশ ছিল। তুমি আমাদের ল্যাবে কম্পিউটারটা কাস্টমাইজড করার সময় সব ইচ্ছে করেই করেছিল সেভাবে। এছাড়াও অন্যান্য প্রত্যেকটা ধাপ ছিল হিসেব করা।”
রায়ান একটা নিঃশ্বাস ফেলল। “সংশোধক। আমরাদেরকে বলা হয় সংশোধক। কিংবা সময়শোধক। তোমাদের চেয়ে বহু বছর ব্যবধানে আমাদের বাস। পৃথিবীর সময়কে আমরা সঠিক দিকে চলতে সাহায্য করি। হ্যাঁ তোমার ধারণা সঠিক।”
রিনিতার মুখে এবার কৌতুহল ফুটে উঠল। “তোমরা কি সব জান?”
হেসে ফেলল রায়ান। “নাহ। বোর্ড আমাদেরকে বেছে নির্বাচিত করে। সবাই সময় সংশোধক হতে পারেনা। এরপর বোর্ড খুটে খুটে দেখে ঠিক কোথায় কি পরিবর্তন করলে মানব সভ্যতা ঠিক পথে থাকবে। আর আমাদেরকে পাঠিয়ে দেয় বিভিন্ন সময়ে। গোপনীয়তার সঙ্গে আমরা ফিরে যাই ভিন্ন কোন জায়গায়।”
“তুমি কি সত্যিই ভবিষ্যতের মানুষ।”
“আমাদের জীবনটা খুব অদ্ভুত। প্রতিনিয়ত বন্ধু, প্রিয়জনকে ছেড়ে ছুটে যেতে হয় ভিন্ন জগতে, ভিন্ন সময়ে। আমি একজন সময়শোধকের কথা জানি। তাকে যেতে হয়েছিল প্রাচীন এক নগররাষ্ট্রে। সেখানকার সভ্যতাকে বিশেষভাবে গড়ে দিয়েছে সে। নিজের জমজ ভাইয়ের মত বন্ধু পেয়েছিল সে। বিশাল একটা প্রজেক্ট ছিল তার হাতে। সময়শোধকদের দায়িত্ব খুব গুরুত্বপূর্ণ। যখন সে অস্বাভাবিক খেটে, বন্ধুদের সাহায্য নিয়ে কাজ শেষ করল, তখনই তার মনে হল সব ছাড়তে হবে এবার। সেই নগররাষ্ট্র, তার সেই আবিষ্কৃত মহাশূন্যযান কিংবা বন্ধু, সবাইকে ছেড়ে তাকে ফিরতে হয়েছে অন্য এক সময়ে।”
“রায়ান! তুমি কি মায়াশূন্যযানের আবিষ্কারকের কথা বলছ?”
রায়ান রিনিতার দিকে তাকাল। “তোমার মাথা খুব শার্প।”
“সেই মায়ান বিজ্ঞানী আর তুমি একই মানুষ। তাই না?”
রায়ান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তার অদ্ভুত যানটার দিকে তাকিয়ে রইল। “সেই মায়ান বিজ্ঞানী, যে ছিল একজন সময়শোধক, সে জীবনে সবচেয়ে বেশি সম্মান সেখানেই পেয়েছে। হুনানপুর উপকথাটা জানো? না জানলে পড়ে নিও। হুনানপু, মানে সেই বিজ্ঞানীকে মায়ারা কি পরিমাণ শ্রদ্ধা করতে এই উপকথাতেই বোঝা যায়। রাজার সঙ্গে তার শত্রুতা ছিল। ফলে তারা পরোক্ষভাবে রাজাকে টিটকারি করে এই কাহিনী ছড়িয়েছিল। কি দিন ছিল তখন!”
রিনিতা বিষন্ন চোখে একবার তাকাল রায়ানের দিকে।
রায়ান বলে চলেছে, “সেই হুনানপু মায়া রাজ্যের কাজ শেষ করে গেল আরেক ভিন্ন সময়ে। সেখানে পেল দুজন চমৎকার বন্ধু। তার সঙ্গেই তারা কাজ করত। মেয়েটাকে সে খুবই পছন্দ করত। সেই সময়টাকেও। কিন্তু সেখানেও তার কাজ শেষ হয়ে গেল। কী নিষ্ঠুর এক জীবন!”
“রায়ান, তুমি কি চলে যাবে?”
বিষন্ন হাসি দিল রায়ান। এরপর ধীর পায়ে এগিয়ে গেল তার গাড়িসদৃশ যানটার দিকে। বিশেষ কোন এক বাটনে চাপ দিল। মুহুর্তেই অদ্ভুত গাড়ি থেকে পাল্টে আরো অদ্ভুত একটা যানে পরিণত হয়ে গেল।
রায়ান ফিরে তাকাল।
রিনিতা এক মুহুর্ত কী যেন চিন্তা করল। “আচ্ছা রায়ান, আমাদের বার্ন বিজ্ঞানীদের মধ্যে কে কিংবদন্তি বিজ্ঞানীতে পরিণত হবে?”
“রিনিতা, পৃথিবী একটা রহস্যের আধার। এখানে অনেক কিছুই ঘটে। হয়তো তোমাদের কেউ একজনই এমন কিছু আবিষ্কার করে বসবে যা না হলে আমি এখানে থাকতাম না।”
একটা দুঃখের হাসি দিল রায়ান। এরপর যোগ করল, “তোমার…তোমাদের কথা আমার মনে থাকবে, রিনিতা। আমার এই বাসাটা বোর্ডের অর্থায়নে কেনা হয়েছে। এখানকার সবকিছু তুমি দেখে রেখ।”
“রায়ান!”
রায়ান ভ্রূ তুলল।
রিনিতা ইতস্তত করে বলল, “তোমাকে একবার জড়িয়ে ধরতে পারি?”
মৃদু হাসল রায়ান। আলতো করে জড়িয়ে ধরল সে রিনিতাকে। “বিদায়, রিনিতা। তোমাদেরকে আমার মনে থাকবে চিরজীবন।”
সে তার অদ্ভুত যানটার খোলা দরজা দিয়ে উঠতে শুরু করল। রিনিতা পেছন থেকে বলে উঠল, “রায়ান, তুমি বলেছিলে গোপনীয়তা রক্ষা করে ভিন্ন কোন সময়ে তোমরা ফিরে যাও। আমাকে সব বলে দিলে কেন?”
“তুমি আমার রহস্যগুলো মনে রাখবে, রিনিতা। আমার স্মৃতি তোমাকে দিয়ে গেলাম। আমার পক্ষ থেকে ছোট উপহার। এর ভাগ কাউকে দিও না।”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল রিনিতা। “তোমার আসল নাম নিশ্চয়ই রায়ান না। এই নাম কি তুমি নিজেই রেখেছ?”
রায়ান পিছু ফিরে রিনিতার চোখের দিকে তাকাল। “‘মানুষ’ নামটাও মানুষের নিজের দেয়া।”
এরপর ঘুরে সে চলে গেল যানটার ভেতরে। রিনিতার খেয়াল হল, রায়ান চশমাটা পড়ে আছে। যে চশমাটা সে তাকে দিয়েছিল।
ধীরেধীরে উপরে উঠে গেল ভবিষ্যৎ যানটা। এরপর প্রবল গতি নিয়ে ছুটে গেল সব বায়ুবাধা পেরিয়ে। রিনিতা বুঝতে পারল সেটা একটা টাইম মেশিন।
একসময় মিলিয়ে গেল টাইম মেশিনটা। রিনিতার কেমন অদ্ভুত একটা কষ্ট হচ্ছে। বরাবরের মত নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করল সে। এই কষ্টের উৎপত্তি এই মহাবিশ্বে না। এর কোন প্রতিকারও এখানে নেই।
***
শেষকথা
রিনিতা বিজ্ঞানী আর্কিমিডিসের ‘ইউরেকা’ গল্পটা বহু শুনেছে। কিন্তু সে কখনও ভাবেনি একইরকম কোনও ঘটনা তার আশপাশেও ঘটবে। সেদিন ল্যাবে হঠাৎ ‘ইউরেকা’ বলে চিৎকার করে উঠে এডিন যখন দৌড়ে বেরিয়ে গেল, সে খানিকটা অবাকই হল। এডিনের চোখেমুখে উত্তেজনা। একেবারে কাঁপছে সে। ল্যাব থেকে বেরিয়ে কী চিৎকার! কেউ অবশ্য পাত্তা দিল না। সবাই বোধহয় ভেবে নিয়েছে যে বিজ্ঞানীরা হালকা পাগলাটেই হয়। অবশেষে এডিনের মুখ থেকে যা উদ্ধার করা গেল তা অনেকটা এরকম।
মায়াশূন্যযানে বিভিন্ন সময় পর্যবেক্ষণ করার সময় হঠাৎ তার মাথায় কিছু বিষয় আসে। সে সময় বিষয়ক সূত্রগুলো নিয়ে তাই ঘাঁটাঘাঁটি করছিল। নিজেও একটা থিওরি আবিষ্কার করে ফেলে। সেই সঙ্গে সে সম্পর্কিত একটা সূত্র। সেটার উপরই ভিত্তি করে সময় ভেদ নিয়ে ছোট একটা পরীক্ষা করছিল। এবং সেটা সফল হয়েছে। খুব দ্রুতই হয়তো বড় আকারে একটা টাইম মেশিনের মতো কিছু তৈরি করা যাবে।
এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের কথাটা আবিষ্কারকের কাছে শুনে তার কেবল রায়ানের কথাই মনে পড়ল। সত্যিই মায়াশূন্যযান থেকে যা কিছু আবিষ্কৃত হয়েছে সেগুলো খুব অপ্রত্যাশিত। রায়ানের সময়শোধকের মিশনটা সত্যিই খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। একটা চক্র সৃষ্টি করেছে ব্যাপারটা।
রিনিতা এখনও সবসময় রায়ানের কথা মনে করে। তার সঙ্গে আর কখনই দেখা হবে না। কিন্তু সে তার অনেক স্মৃতি রেখে গেছে রিনিতার কাছে। সেগুলো রিনিতা কারও সঙ্গে ভাগাভাগি করবে না। কারও সঙ্গেই না।
Tags: কল্পবিজ্ঞান উপন্যাস, তৃতীয় বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, পূজাবার্ষিকী, মায়াশূন্যযান, সালেহ আহমেদ মুবিন
অসাধারণ!