ওটা ভালোদের জায়গা নয়
লেখক: প্রতিম দাস
শিল্পী: প্রতিম দাস
ওটা ভালোদের জায়গা নয়
লেখক – প্রতিম দাস
অলংকরণ – প্রতিম দাস
অন্ধকার ঘরে একটা মোমবাতি জ্বেলে উইজা বোর্ডের সামনে একা বসেছিল অজয়। ‘হে আত্মাগণ কেউ কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছো? কিছু একটা সংকেত দেখাও যাতে আমি কাজলের সঙ্গে কথা বলতে পারি। একটা কিছু চিহ্ন দাও। প্লিজ! প্লিজ!!’
গোটা তিনেক সজোরে ধাক্কা মারার শব্দ শোনা গেল কোথাও।
টানটান হয়ে বসলো অজয়। ‘তুমি এসেছ কাজল? সত্যিই কি ফিরে এলে? যেমনটা বলেছিলে?’
আরও কিছু চাপড় মারার শব্দ হলো। একটা চিৎকার ভেসে এলো ঘরের বাইরে থেকে। জামাটা ঠিক করতে করতে উঠে গিয়ে দরজাটা খুলে দিল অজয়। বাইরে অন্ধকারে দাঁড়িয়েছিল বছর তিরিশের একটা মেয়ে। একটু এগিয়ে এসে আলতো করে অজয়ের মুখটা ছুঁয়ে ভালো করে দেখার চেষ্টা করে বললো, ‘কি ব্যাপার অজয়। আমি তো রীতিমত ভয় পেয়ে গেছি। ফোনে তোমার কণ্ঠস্বরে অদ্ভুত এক উত্তেজনার ছাপ ছিল। সব ঠিক আছে তো?’
‘আমার স্ত্রী মারা গেছে মেঘ!’
‘হ্যাঁ জানিতো। সে তো এক বছর হয়ে গেল।’
‘আমি ওকে ভালোবাসি।’
‘অজয়, তুমি কি এখনো সেই প্রেতাত্মা দেখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছো?’
‘হ্যাঁ। কিন্তু কাজলের মতো কাউকেই দেখতে পেলামনা আজও। কেন বলোতো? ওর মৃত্যুটাতো একটা সাময়িক ব্যাপার। কাজল আমায় কথা দিয়েছিল, ও ফিরে আসবে।’
‘তার জন্য তুমি ট্যারোট কার্ড, ক্রিস্টাল বল, সিঁয়াসে কত রকম চেষ্টাই তো করলে গত কয়েক মাস। পারলে নাতো তার সন্ধান পেতে।’
‘উইজা বোর্ড দিয়ে চেষ্টা কিন্তু আগে করিনি।’
মেঘ উইজা বোর্ডটার দিকে তাকালো। লালচে মোমের আলো ঠিকরাচ্ছিল ওটার গা থেকে।
মেঘের দিকে তাকিয়ে অজয় বললো, ‘কাজলের মতো ক্ষমতা কি আর আমার আছে। আমাদের পরিবারের প্রকৃত শুভাকাঙ্খী ছিল কাজল। ব্যবসায় যখন যা অলৌকিক সাহায্যের দরকার হয়েছে ও সব সাহায্যই করেছে।’
মেঘ বললো, ‘ওর যদি অতই ক্ষমতা থাকে তাহলে ওর উচিত এই মুহূর্তে তোমার সামনে এসে দাঁড়ানো। অজয় তুমি যে কাজলের প্রতি ভালোবাসা থেকে এসব করছো সেটা বুঝতে পারছি। কিন্তু এর ফলে তোমার কি অবস্থা হচ্ছে সেটা কি বুঝতে পারছো? শেষ হয়ে যাচ্ছ তুমি অজয়! এর থেকে তোমার সরে আসা দরকার। অন্তত এক রাতের জন্য হলেও।’
‘কিন্তু আমিতো তাকে অনুভব করতে পারছি মেঘ। যে কোনও মুহূর্তে সে ওপারের বন্ধন ছিড়ে এদিকে চলে আসবে।’
‘এমনওতো হতে পারে অজয়। ওর এই জগতে ফিরে আসার ইচ্ছে আর নেই। মৃত্যু এক মহান যাত্রাপথ। ও হয়তো বদলে গেছে।’
ঘোঁত করে একটা আওয়াজ করলো অজয়। কথাগুলো ওর যে ভালো লাগছেনা বোঝাই গেলো।
‘হয়তো সে আর তোমাকে ভালোবাসে না। নতুন জগতটাই ওর ভালো লেগেছে।’
‘আমি ওকে ছাড়া সুখী হতে পারব না।’
‘আমার কেন জানিনা মনে হচ্ছে ও চাইছে তুমিই ওর সঙ্গে থাকো। তুমি বললে, ও তোমাকে খুব ভালোবাসতো। সেজন্যই ও তোমাকে নিজের করে পেতে চাইছে। আসলে ও তোমাকে একেবারে শেষ করে দিতে চাইছে। কারন তাহলেই একমাত্র তোমরা একসঙ্গে থাকতে পারবে। আমার কথাটা বুঝতে পারছো অজয়?’
‘আমি জানিনা! কাজল মেটাফিজিক্স বিষয়টা খুব ভালো করে জানতো। যদি ওর মৃত্যুকেই পছন্দ ছিল তাহলে ও নিশ্চিত আমাকে বলতো সেকথা। তোমার আমার চেয়ে মৃত্যুকে ও অনেক ভাল করে জানতো।’
‘হয়তো এখন যতটা জানে ততটা আগে জানতোনা।’
অজয়ের দিক থেকে কোনও উত্তর এলো না।
‘ঠিক আছে, এখন চলো দেখি। একটু ঘুরে আসি। একেবারে ডিনার সেরে ফিরবো। চিন্তা নেই আমিই খাওয়াবো।’
অজয় মাথা নাড়লো নেতিবাচক ভাবে।
‘ওহ অজয়। আমি যদি তোমাকে সাহায্য করতে পারতাম।’
অজয় তাকালো মেঘের দিকে। ‘পারোতো সাহায্য করতে। আমি জানি। সেজন্যইতো তোমাকে ডেকে আনলাম।’ মেঘের মুখটা সহসাই চকচক করে উঠলো। ‘বলো কি করতে হবে?’
‘তুমি ছিলে কাজলের সবচেয়ে কাছের মানুষ। ও আমায় বলেছিলো তোমরা দুজন একসঙ্গে বড় হয়ে উঠেছো।’
‘হ্যাঁ আমরা একই বেডরুম শেয়ার করতাম।’
‘আসলে আমি ভাবছিলাম যদি আমরা দুজন একসঙ্গে চেষ্টা করি তাহলে সাফল্যের চান্স ডাবল হয়ে যাবে।’
মেঘ হাতের আংটিটা ঘোরাতে ঘোরাতে বললো, ‘এমন নয় যে আমি তোমাকে সাহায্য করতে চাইনা। কিন্তু সবকিছুর একটা সময় আছে অজয়। বাঁচার সময়। ভালোবাসার সময়। মরার সময়। এক একটা মহাজাগতিক ছন্দ। কাজল মরে গেছে। এটা তোমাকে মেনে নিতে হবে। তা নাহলে তুমিও শেষ হয়ে যাবে।’
‘আমি পাগল হয়ে যাব মেঘ, যদি ওর নাগাল না পাই। একবার অন্তত আমি জিজ্ঞাসা করতে চাই, যে অবস্থায় ও আছে, সেই অবস্থায় ও ভালো আছে কিনা? এটা আমাকে জানতেই হবে।’
মেঘ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। ‘ঠিক আছে, শুধু তোমার জন্যই আমি এটা করবো। তবে মাত্র একবারই। আর তোমাকে প্রমিস করতে হবে আগামী আধঘণ্টার ভেতরে তুমি যদি কাজলের দেখা না পাও তাহলে তুমি তৎক্ষণাৎ এখান থেকে আমার সঙ্গে বাইরে যাবে। এই সাহায্য করছি বলে ডিনারের খরচটাও তোমাকেই দিতে হবে।’
আলতো করে একটা চুমু খেলো অজয় মেঘের কপালে।’আমি জানতাম তোমার ওপর ভরসা করা যায়।’
‘সেটা তুমি সবসময়ই করতে পারো।’
ওরা দুজনে বসলো উইজা বোর্ডটার সামনে। আঙ্গুল দিয়ে স্পর্শ করে মেঘ জানতে চাইলো, ‘এভাবে তো?’
‘হ্যাঁ আলতো করে। যাতে ওটা নড়তে পারে। বুঝতে পেরেছো? আমার কিন্তু অবাক লাগছে, এব্যাপারে তুমি জানতে চাইছো দেখে! আমি তো জানতাম তুমিও কাজলের মতোই এসবের চর্চা করো।’
‘অনেকদিন আগে করতাম।’
অজয় তাকিয়েছিল বোর্ডের দিকে। ‘হে প্রিয়তমা কোথায় তুমি? তোমার স্বামী এবং তোমার বোন অপেক্ষা করছে তোমার প্রত্যাবর্তনের।’
মেঘ ওর দিকে তাকিয়ে বললো, ‘আমার মনে হয় ও এখন স্বর্গে আছে, আনন্দে আছে। চাইছে তুমি নতুন করে জীবন শুরু করো।’
‘সেটা ও নিজে বলুক! আমি নিজের কানে শুনতে চাই।’
‘হয়তো সেটা ওর পক্ষে সম্ভব নয়। নিয়ম বিরুদ্ধ…’
‘চুপ! ওই দ্যাখো…’ ওরা অবাক হয়ে দেখলো বোর্ডটা নড়তে শুরু করেছে।
– আমাকে সাহায্য করো।
অজয় কঁকিয়ে উঠলো, ‘কাজল বিপদে পড়েছে!’
‘হয়তো এটা কাজল নয়!’
এবার বোর্ডের লেখা নির্দেশ করল নতুন কথা।
– পুনঃনির্মাণের বই ব্যবহার করো।
মেঘ বলে উঠলো, ‘একথার কোনও মানেই হয়না। আমাদের এবার থামা দরকার।’
অজয় চিৎকার করে জানতে চাইলো, ‘কাজল এটা কি তুমি? কোথায় আছো এখন তুমি?’
উইজা বোর্ডের জবাব এলো – নরকে।
মেঘ দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললো, ‘এবার নিশ্চিত হলাম, এটা কাজল ই…’
অজয় বইয়ের পাতাগুলো উল্টাতে উল্টাতে বললো, ‘এটা ছিল কাজলের অন্যতম একটা প্রিয় বই।’
মেঘ ঘরে পায়চারি করছিল। বুকের কাছে দুহাত গোটানো। -’পুনঃনির্মাণের বই। সেতো আলকেমির বই। শয়তানকে আবাহন করে বাস্তবকে বদলানোর জন্য ব্যবহার করা হয়। এটা দিয়ে তুমি কাজলকে কোনওভাবেই নরক থেকে ফেরত আনতে পারবে না। ওই মন্ত্র নরক থেকে কাকে তুলে আনবে সেটা তোমার জানা নেই।’
‘কাজল না জেনেবুঝে এ বই ব্যবহারের কথা বলেনি বলেই আমার ধারণা।’
‘আমারতো সেটা মনে হয়না সেটা। আচ্ছা অজয় বলতে পারো ওকে কেন নরকে যেতে হলো?’
‘ভুল করে নিয়ে গেছে। মহাজাগতিক ভুল!’ বগলের তলায় বইটা চেপে ধরে অজয় ঘরের জিনিসপত্র সরাতে শুরু করলো। ঘরের মাঝখানটা ফাঁকা করার জন্য। ‘তুমি তো জানো কাজল ভালো কাজেই তার ডাইনিবিদ্যা ব্যবহার করতো। ও ছিল দয়ালু। ভালবাসায় ভরা এক স্ত্রী। আমি সবসময় মনে করি ওর মৃত্যু একটা ভুল।’
‘সে যাইহোক, এখন যে চেষ্টা তুমি করছো সেটাও ভুল পথ। এটা বলে দিলাম।’
বইয়ে দেওয়া ছবি দেখে দেখে একটা চক দিয়ে ঘরের মেঝেতে বড় করে একটা পাঁচকোনা তারা বা পেন্টাগ্রাম আঁকলো অজয়। তাকে ঘিরে আঁকলো এক বৃত্ত।
‘অজয়, এরকম কি মনে হচ্ছেনা কাজলের অধার্মিক নানা আচরণই ওকে নরকে ঠেলে নিয়ে গেছে? আমার মনে হচ্ছে আমাদের উচিত ওর জন্য প্রার্থনা করা। নিয়ম মেনে প্রার্থনা করলে নরকের শাস্তি পাওয়া আত্মাদের স্বর্গে পাঠানো যায়।’
‘কাজল শাস্তিপ্রাপ্ত কোনও আত্মা নয় মোটেই। আর আমি এটাও চাইনা ও আমাকে ছেড়ে স্বর্গে যাক! আমি ওকে আমার সঙ্গে চাই।’
‘তুমি আগুন নিয়ে খেলছো অজয়। তোমার চাহিদা যাই হোক না কেন, পুনঃ নির্মাণ বই কোনও মতেই সঠিক পথ নয়। তুমি যদি যাদু দিয়েই কিছু করতে চাও তাহলে আমি ইতিবাচক যাদু করার চেষ্টা করতে পারি।’
অজয় চকটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বললো, ‘ইতিবাচক জাদু? মনে হচ্ছে আমরা যেন কোনও টিভির টকশোয়ে আলোচনা করছি। যতসব আজে বাজে বিষয়। শোনো মেঘ তুমি খুব ভালো মেয়ে । কিন্তু বাস্তব বুদ্ধিহীন। কাজল ছিল আলাদা। একেবারে প্রফেশনাল। নিজের কেরিয়ারটা বুঝতো।’
‘ঠিকই বলেছো। কাজল আলাদাই ছিল। ও ছিল লোভী। এক সময় আমরা দুজন একসঙ্গে ওই বিদ্যাচর্চা করেছি। পরে আমি আলাদা পথ বেছে নিয়েছিলাম।’
‘মেঘ প্লিজ! এখন তোমার সাহায্য দরকার কাজলের জন্য…’
‘অজয় আমি ওই নেতিবাচক পথ ত্যাগ করেছি। অন্ধকারের জগত নিয়ে আমি আর কাজ করি না। আমি ওকে সাহায্য করতে পারবোনা, কারণ আমি জানিনা কি করতে হবে।’
‘সব এই বইটাতে লেখা আছে। আমাদের শুধু সেটা ফলো করতে হবে।’
‘নিকুচি করেছে বই এর! আমি কাজলকে কোনও সাহায্য করব না। ওর পাতালে যাওয়াটা ভুল কিছু নয়। ও নিজের আত্মাকে শয়তানের কাছে বিক্রি করে দিয়েছিল!’
অজয় কথাটা শুনে একটু থমকে গেল। তারপর মোমবাতি খুঁজতে শুরু করলো। ‘কি সব আজে-বাজে বকবক করছো মেঘ! কাজলের ছিল নির্ভেজাল, শুদ্ধ। ওইসব ক্ষমতা ও জন্ম থেকেই সঙ্গে নিয়ে এসেছিল।’
‘না! ওইসব ক্ষমতা এসেছিল নরক থেকে। অনেক অনেক দিন আগেই ও এমন কিছু চেয়েছিল যা একান্তই আমার ছিল। সেটা যখন সৎপথে ও পেলোনা তখন শয়তানের আবাহন করে সেটা …’ বলতে বলতে থেমে গিয়ে ধপ করে আরাম কেদারায় বসে পড়লো মেঘ। ‘…অন্ধকারের পথে হাঁটা অত সহজে থামেনা অজয়। কালো জাদু এক রহস্যময় অন্তহীন পথচলা। এ পথে চলতে শুরু করলে নেশা লেগে যায়। নিজেকে কিছুতেই থামানো যায় না।’
‘কাজলের উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল কিছু করে দেখানোর। থাকবে নাইবা কেন। ও ছিল স্মার্ট। ট্যালেন্টেড। দেখতেও ছিল সুন্দরী। সেরাটা পাওয়াই ওর ভবিতব্য ছিল।’
‘সেটা ও পেয়েওছিল। কিন্তু ক্ষমতা অর্জনের জন্য যে চুক্তি সেটাতো সুদ সমেত মেটাতেই হয় অজয়! ‘
‘কারো সাধ্য নেই আমার কাজলকে নরকে বন্দি করে রাখার!’
‘সাধ্য আছে অজয়। নরকের অধিপতি সেটা পারেন। কারন উনি ওর আত্মার মালিক। আর একটা কথা, মনে রেখো অজয় ওই পাতালের অধিবাসীরা কোনও ভুল করে না। তার সঙ্গেই ওদের সেই ক্ষমতাও নেই যার জোরে ওরা সৎ মানুষদের নরকে আটকে রাখতে পারে। বদ হজম হয় ওদের। ভুল করে কেউ চলে গেলে ওরা তাকে উগরে দেয় বমি করার মত।’
পেন্টাগ্রামের প্রতিটি মাথায় মোমবাতি বসাতে বসাতে অজয় বললো, ‘কাজল আমার স্ত্রী। ওর প্রতি আমার একটা দায়িত্ব আছে। দরকার পরলে আমি নরকের দরজা ভেঙে শয়তানের কবল থেকে ওকে ছাড়িয়ে আনবো!’
মেঘ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। ‘অজয় তোমার এসব বিষয়ে কোনও ধারণা নেই। তুমি জানোনা পুনঃনির্মাণের বই কি করতে পারে।’
‘আমি আমার স্ত্রীকে বিশ্বাস করি। তার দেখানো পথেই আমি কাজ করবো। অন্যদের সঙ্গে ও কি করেছে তা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। আমি জানি ও আমাকে ভালোবাসতো। আর সেজন্যেই ওর দরকারের মুহূর্তে আমি ওকে সাহায্য করতে চাই।’ একটা একটা করে সব মোমবাতিগুলো জ্বালিয়ে দূর থেকে একবার ভালো করে দেখে নিয়ে অজয় বললো, ‘এবার সব তৈরি! চলো কাজ শুরু করা যাক।’
বইটা থেকে পাঠ করা শুরু করতেই বদ্ধ ঘরে বয়ে গেল একটা মৃদু বাতাস। বাড়তে থাকলো সে বাতাসের বেগ। প্রায় ঝড়ের দমকা আসতে শুরু করলো একটু বাদেই।
‘হে মৃতদের অধিপতি! আমার আহ্বান শুনুন! হে নরকের অধিশ্বর আমার আদেশ শুনুন! আমি চাইছি আমার ইচ্ছের শক্তিতে খুলে যাক অনন্ত নরকের দরজা। মুক্ত হোক জাদুকরী কাজল! যাকে আপনি নিয়মবিরুদ্ধ ভাবে আটকে রেখেছেন!’
হাওয়ার দাপটে উড়তে থাকা চুল চোখের উপর থেকে সরিয়ে মেঘ তাকিয়েছিল বৃত্তের ভেতর দিকটায়। ওখানকার কাঠ যেন গলে গিয়েছিল নরম মোমের মতো। যদিও কোনও গর্ত সৃষ্টি হয়নি। বদলে দেখা যাচ্ছিল লালচে হলুদ আলো মাখা এক বিশাল হাঁড়ি। ওটা আসলে অন্য জগতে যাওয়ার প্রবেশপথ। সেখানেই দেখতে পাওয়া যাচ্ছিলো দুটো মেয়েলি হাত। এক অদৃশ্য দেওয়াল ঠেলে সরানোর চেষ্টা চালাচ্ছে সেই হাতের অধিকারিনী। তার শরীরের বাকি অংশ অদৃশ্য হয়ে আছে ঘন কুয়াশার আড়ালে। অজয় দেখতে পেয়েছে হাতদুটোকে।
অদ্ভুত স্বরে সে চেঁচিয়ে বলে উঠলো,’কাজল বেঁচে আছে! ও ফিরে আসছে!’
মেঘ কেঁপে উঠল হিমশীতল আতঙ্কে। ‘কি করে জানলে ওটা কাজল? ওটা কিন্তু যে কেউ হতে পারে… যা কিছু হতে পারে অজয়!’
অজয় হাতদুটোর অসহায় নড়াচড়া দেখে অবস্থাটা কি বুঝতে পেরে বললো, ‘কিছু একটা সমস্যা হচ্ছে । ও বেরিয়ে আসতে পারছে না।’
মেঘ অজয়কে চেপে ধরে ঝড়ের মত আওয়াজে বইতে থাকা বাতাসের শব্দের ভেতর চিৎকার করে বললো, ‘আমার ভয় করছে অজয়! আমি জানিনা কে বা কি ওই পাতালে আছে! আমি জানতেও চাইনা! চলো এখান থেকে আমরা চলে যাই। যতদূরে সম্ভব। ভুলে যেতে হবে এখানে কি ঘটছে!’
‘বাজে বোকো নাতো! আমি এখন কি করে যাবো? এক বছর ধরে অপেক্ষা করে আছি আমার কাজলের জন্য। ওকে জড়িয়ে ধরার জন্য… ওর চোখের দিকে তাকানোর জন্য …’অন্য জগতের সেই অদ্ভুত আলোয় অচেনা দেখাচ্ছিল অজয়ের মুখটা। ‘এখন…এই মুহূর্তে সেই কাজল আমার এত কাছে এসেছে! আমার…’ অজয় ঝুঁকে পড়লো হাঁড়িটার কাছে। চেষ্টা করলো মেয়েলি হাতদুটোকে ধরার।
‘না!’ মেঘ টেনে ধরল অজয়কে। দুজনের ভেতর শুরু হলো টানাটানি। মেঘের নখের আঁচড়ে কেটে গেল অজয়ের কব্জি। ছোট্ট ছোট্ট রক্তের ফোঁটা পড়লো হাঁড়িটার ওপরের অদৃশ্য দেওয়ালে। তাতেই কিছু পরিমাণ মুছে গেলো বোধহয় সেই অদৃশ্য বাধা। একটা আঙুল বেরিয়ে এলো ওখান থেকে।
অজয় বলে উঠলো, ‘রক্ত! রক্ত চাই! ওটাই ওই দরজা খোলার চাবিকাঠি। কাটা জায়গাটাকে আরও জোরে অন্যহাত দিয়ে আঁচড়ালো সে। আরও কিছু রক্তের ফোটা পড়তেই সেই অদৃশ্য দেওয়াল আরও খানিকটা মিলিয়ে গেল। সেখান দিয়ে বেরিয়ে এল লম্বা নখ। অজয় ঘরের এদিক-ওদিক দেখে বললো, ‘এটুকু রক্ততে কিছু হবেনা। অনেক সময় লেগে যাবে। একটা চাকু বা ছোরা দরকার!’
মেঘ মোমবাতি গুলো লক্ষ্য করে হাত চালালো। ফেলে দিতে শুরু করলো ওগুলোকে। বিকট শব্দে একটা বজ্রপাত হলো ঘরের ভেতরে। কালবৈশাখীর ঝড় যেন এসে ধাক্কা মারলো ঘরের দেওয়ালে। অন্ধকারের জাদুশক্তি গুটিয়ে পাকিয়ে গিয়ে ফিরে গেলো হাঁড়িটার ভেতরে।
কয়েক সেকেন্ডের ভেতর সব আওয়াজ থেমে গেল। অদৃশ্য হলো অন্য জগতে যাওয়ার প্রবেশ পথ।
‘কাজলকে ফিরিয়ে আনতে হলে অনেক রক্ত দরকার। অনেক! অত রক্ত দিতে হলে আমি বোধ হয় মরে যাবো। সেটা করলে তো আমার চলবে না।’ বইয়ের ভেতর কিছু একটা দেখে সহসাই হাসতে হাসতে অজয় বললো, ‘আমি যদি সব ঠিকঠাক না করতে পারি তাহলে আমারও জায়গা হবে নরকে। তখন বেচারি কাজলকেই দায়িত্ব নিতে হবে আমাকে উদ্ধার করার।’
‘তুমি কি মনে করো? ও সেটা আদতেই করবে?’ মেঘ বিড়বিড় করে, ‘তার চেয়ে ঝট করে হাতটা কেটে রক্ত দিয়ে দাও।’
‘তুমি কি ভাবছো আমি এমনি এমনিই বইয়ের পাতা উল্টে সময় কাটাচ্ছি? সামান্য হাত কেটে রক্ত দিলে যে কাজ হবে না এটা ভালোই বুঝে গিয়েছি।’
‘তাহলে ব্লাডব্যাংকে ফোন করো!’
‘ব্লাড ব্যাংকের রক্ত বাড়িতে আনা যায় না। আর যদি সেটা কোনওভাবে করাও যায় তাতে আরও একদিন সময় নষ্ট হবে। আমি আর অপেক্ষা করতে পারছিনা।’
‘তুমি চাইলেই রক্ত কিনতে পারো। অনেক মানুষ রক্ত বিক্রি করে। একটু বেশি দাম দিতে হবে হয়তো। অথবা ব্লাড ব্যাংকের কাউকে কিছু ধরে দিলেও কাজটা হয়ে যাবে বলেই মনে হয়। এরকম বেআইনি পদ্ধতিতেইতো কাজল কাজ হাসিল করতো।’
অজয় মাথা নেড়ে বললো, ‘উঁহু ব্যাপারটা নিজের হাত কাটার মতো রোমান্টিক হবে না। নিজের বউকে নিজের রক্ত দিয়ে উদ্ধার করায় বেশ একটা থ্রিল আছে। আমি চাই কাজল উদ্ধার পাক শুদ্ধ রক্তর মাধ্যমে। ব্লাড ব্যাংকে যারা রক্ত দেয় তাদের রক্তে গিজগিজ করছে রোগজীবাণু।’
‘কাজলও রক্ত বিষয়ে এই ধরনের মত পোষণ করতো। সব সময় রক্তর রহস্যময়তা, রক্ত শপথ, রক্ত দিয়ে চুক্তি সম্পাদন এই নিয়েই মেতে থাকতো,’ মেঘ ধীরে ধীরে বললো।
‘হ্যাঁ রক্ত জীবনের আসল সম্পদ। যেকোনও ম্যাজিকের আসল উপাদানই হলো রক্ত।’
‘যে কোনও ম্যাজিক নয়, কেবলমাত্র ব্ল্যাক ম্যাজিকে দরকার হয় রক্তের। ভালো জাদুতে রক্তের ব্যবহার হয় না অজয়!’
‘মেঘ! কাজলকে রক্ত ছাড়া উদ্ধার করার আর কোনও উপায় আছে কি?’
‘না। কারণ, ও সেটাই পেয়েছে যা ওর প্রাপ্য ছিল। ভালো জাদু ওকে নরক থেকে তুলে আনতে পারবেনা।’
‘সেটা যদি জানোই তাহলে এতো কথা বলছ কেন মেঘ? তুমি কি আমার অনুভূতি নিয়ে মশকরা করছো?’
ঝাঁঝিয়ে উঠলো মেঘ, ‘হ্যাঁ করছি! আমি মস্করাই করছি। চেষ্টা করছি তোমার চেপে রাখা অনুভূতিগুলোকে জাগানোর। চেষ্টা করছি, সেই সময়টাকে ফিরে পেতে যখন… যখন আমি তোমাকে ভালবাসতাম!’
অজয় ঘুরে তাকালো, ‘তুমি আমাকে ভালবাসতে?’
‘হ্যাঁ! তুমিও ভালবাসতে আমাকে। আমরা একে অপরকে দারুণভাবে ভালবাসতাম। কাজলের সঙ্গে তখন তোমার পরিচয়ই হয়নি। কাজলের সঙ্গে তোমার পরিচয় আমিই করিয়ে দিয়েছিলাম। আর তারপরেই ও তোমাকে পাওয়ার জন্য নিজের আত্মাকে শয়তানের কাছে বেচে দেয়। ভালো জাদু দিয়ে সেটা করা ওর পক্ষে সম্ভব ছিল না। একজন ভালো জাদুকরী কেবলমাত্র মানুষের ভালো করতেই পারে। অপরের ভালোবাসা অনুভব করতে পারে। কিন্তু কালো জাদু পারে নকল ভালোবাসার মায়াময় জগত সৃষ্টি করতে। আর সেটাতেই আচ্ছন্ন হয়ে আছো তুমি।’ মেঘ কেটে কেটে বললো এরপরের কথাগুলো। ‘ঠিক এই জন্যেই কাজলকে আজ নরকের আগুনে ঢুকে থাকার শাস্তি পেতে হচ্ছে!’
অজয় একটু আড়ষ্ঠভাবে বললো, ‘আমি কিন্তু শুনেছি ছোট বোনেরাই বড় দিদিদের স্বামীর প্রতি বেশি আকৃষ্ট হয়।’
মেঘ আরামকেদারায় গা এলিয়ে দিয়ে বললো, ‘কেন যে তোমার সেসব দিনের কথা মনে পড়েনা অজয়! আজ তুমি যখন আমায় আসতে বললে, আমি ভেবেছিলাম কালো জাদুর প্রভাব বোধহয় এতদিনে কেটে গেল। কাজল মারা যাওয়ার পর থেকে আমি অপেক্ষা করেছিলাম তোমার একটা ডাকের। বুঝতে পারিনি আমার বোন আসলে তোমাকেও নরকে নিজের কাছে নিয়ে যাওয়ার ফন্দি এঁটেছে।’
অজয় চাকুটাকে মোমবাতির আগুনে পোড়াতে পোড়াতে হাতের ক্ষত চিহ্নটা দেখে নিয়ে বললো,’এই জায়গাটা কাটলে বোধহয় বেশি রক্ত বের হবে।’ বলেই ধারালো চাকুর এক টান দিলো হাতের ওপর। পাশে রাখা একটা পাত্র ধরলো ক্ষতস্থানের তলায়।
মেঘ চিৎকার করে উঠলো, ‘তোমাকে পুরো উন্মাদ করে দিয়েছে ওই ডাইনী! কি করছো তার কোনও হুশজ্ঞান নেই। যা করছো তা কি তোমার স্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে অজয়? কোথায় গেলো তোমার নৈতিকতা? দশ বছর আগে এইসব শয়তানি মন্ত্রতন্ত্রকে তুমি ঘৃণার চোখে দেখতে। সেসব কথা মনে আছে কি তোমার?’
চাকু আর রক্তভরা পাত্র পাশে রেখে ক্ষতস্থানে একটা কাপড়ের টুকরো বাঁধলো অজয়। মেঘ বলতেই থাকলো, ‘আমরা, তুমি আর আমি, ভালো জাদুতে বিশ্বাস করতাম। আমরা জানতাম এটাই সঠিক পথ।’
‘ডিয়ার মেঘ, তুমি খুব ভালো মেয়ে। কিন্তু তুমি কাজলের মতো নও। সে ছিল মানসিক শক্তি ও ফুর্তির মূর্তিমতী রূপ। একমাত্র মেয়ে যাকে আমি চিরকাল ভালোবাসবো।’ পুননির্মাণ পুস্তকটাকে বগলে চেপে ধরে এক হাতে রক্তভর্তি বাটি নিয়ে এগিয়ে গেল এবার অজয় পেন্টাগ্রামের মধ্যস্থলে। মোমবাতিগুলোকে পুনরায় জ্বালালো। ‘যদি তুমি সাহায্য না করতে চাও, কোরোনা। কিন্তু দয়া করে নাক গলানো থেকেও দূরে থাকো! তোমাকে আমার আর দরকার নেই।’
‘ঠিক আছে। শুধু একটা কথার উত্তর দাও অজয়। কাজল মারা যাওয়ার পর থেকে একবারো কি আমার কথা তোমার মনে পড়েনি?’
‘পড়বে না কেন? তুমি আমার শ্যালিকা। তোমার দেখাশোনা করা আমার দায়িত্ব। কিন্তু আমার ভালোবাসা সবটাই কাজলের জন্য।
‘হুম, বুঝলাম, ‘মেঘ বিড়বিড় করে বললো,’ কাজল মরে যাওয়ার অনেক আগে থেকেই তুমি আমার খোঁজ খবর নেওয়া বন্ধ করেছিলে। এই জগত কিছু করার মতো শক্তি ওর কমে আসছিল। ও আরও বেশি করে ঝুঁকে পড়েছিল অন্ধকারের দিকে। সেজন্যই আমি ইচ্ছে করেই তোমাদের থেকে দূরে সরে গিয়ে ছিলাম।’
অজয় ততক্ষণে পুননির্মাণ পুস্তক পাঠ শুরু করে দিয়েছে। আবার শুরু হয়ে গেছে ঝড়। দেখা দিয়েছে অন্য জগতের প্রবেশদ্বার। মেঘ অসহায়ের মত তাকিয়ে ছিল লালচে হলুদ আলো আর কুয়াশার দিকে। ওখানে আবার সেই হাতের আবির্ভাব হয়েছে। বাটিটা তুলে ধরে মন্ত্র পাঠ করতে করতে অজয় যেই রক্ত ঢালতে যাবে মেঘ এক ঝটকায় উঠে গিয়ে এক আঘাতে ফেলে দিল সেটাকে। দূরে দেয়ালের গায়ে ছিটিয়ে গেল রক্তের ঝলক।
‘কি ভেবেছো মেঘ? এটা করে আমাকে আটকাতে পারবে? আমি রক্ত দেবই!’ বইটা পাশে নামিয়ে রেখে চাকুটা আবার হাতে তুলে নিলো অজয়। কাপড় জড়ানো ক্ষতস্থানটা উন্মুক্ত করলো।
সহসাই পুনঃ নির্মাণ পুস্তকটা হাতে তুলে নিলো মেঘ। দ্রুত ভেতর থেকে কয়েকটা পাতা ছিঁড়ে ফেললো। বললো, ‘শুধু শুধু নিজের রক্ত নষ্ট কোরোনা অজয়। এই পাতাগুলো ছাড়া তুমি নরকের দরজা খুলতে পারবে না!’ বলেই পাতাগুলোতে আগুন লাগিয়ে দিলো। সঙ্গে সঙ্গেই এক অমানুষিক হাড় কাঁপানো আর্ত চিৎকার ভেসে এলো হাঁড়িটার ভেতর থেকে। মেঘ ওপরে হাত তুলতেই থমকে গেল অজয়। গম্ভীর স্বরে মেঘ বললো, ‘নিভে যাক সব মোমবাতি! নিভে যাক সব নারকীয় আলো! চিরকালের জন্য বন্ধ হয়ে যাক নরকের প্রবেশদ্বার!’
পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকা অজয় বললো, ‘মেঘ তুমি যদি একটুও আমার কথা ভাবতে তাহলে…’
‘আমি সব সময় তোমার কথাই ভাবি অজয়। আমি যে তোমায় ভালোবাসি। তাই এটা করা ছাড়া আর কোনও পথ নেই আমার সামনে।’
ওদিকে হাঁড়ির কানাতে সেই আঙুলগুলো তখনও হাতড়ে বেড়াচ্ছিল। মোমবাতিগুলো নিভে যাওয়ার আগে ঘরে একটা ঘূর্ণিঝড় এর আবির্ভাব হলো। যা সোজা গিয়ে ঢুকে গেল ওই রহস্যময় প্রবেশপথে। মনে হলো সেই ঘূর্ণিপাকে হারিয়ে গেল হাতদুটোও।
সম্বিৎ ফিরে পেতেই হাতে চাকুটা নিয়ে অজয় ছুটে গেল মেঘের দিকে। দুজনের ভেতর শুরু হলো ধস্তাধস্তি। এরমধ্যেই চাকুর আঘাতে কেটে গেল মেঘের হাত। রক্ত ছিটকে পড়লো নরকের প্রবেশদ্বারে। অদৃশ্য বাধা দূর হয়ে গেল সেই পরশে। গলে গেল সবকিছু মোমের মত। কাজলকে এতো কাছে এনেও হারানোর রাগে অজয় একের পর এক চাকুর আঘাত করে চললো মেঘের শরীরে। ফিনকি দিয়ে ছিটকাতে থাকা রক্তের ছোঁয়া পেতেই নরকের আগুন জ্বলে উঠলো দাঊ দাউ করে। বেড়ে গেল তার উজ্জ্বলতা। সহ্য করতে না পেরে পিছিয়ে গেলো অজয়। টাল সামলাতে না পেরে খুলে যাওয়া নরকের গর্তে পড়ে গেল মেঘ।
প্রায় তৎক্ষণাৎ সেখান থেকে উঠে এলো কাজল। এসে দাঁড়ালো মেঝের উপর। হাওয়া থেমে গেল ঝপ করে। মিলিয়ে গেল হাঁড়িটা। চরম নিস্তব্ধতা তখন ঘরের ভেতর। কাজল দাঁড়িয়ে আছে পেন্টাগ্রামের ভেতরে। পরনে ঝলমলে রক্ত লাল পোশাক। ঘন কালো চুল চকচক করছে। দু হাত হাত বাড়ানো সামনের দিকে। চোখে মুখে আহ্বানের ভঙ্গী।
মোহময় স্বরে বললো,’ওহ! ডিয়ার! ডিয়ার! আমার অনুগত স্বামী। বিশ্বস্ত সহচর অজয়! আমি জানতাম তোমার উপর ভরসা করা যায়!’
অজয় ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো কাজলকে। ‘ওহ মাই লাভ! আবার আমরা একত্র হলাম। চিরদিনের জন্য ঠিক যেমনটা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম!’
অজয় বললো,’আমি জানতাম তুমি মৃত্যুকে হারিয়ে দেবে!’
একটু ইতস্তত করে কাজল বললো, ‘ডারলিং, আমি বলেছিলাম মৃত্যু আমাদের আলাদা করতে পারবেনা। মোটেই একথা বলিনি যে আমি মৃত্যুকে জয় করবো।’
‘সে যাই হোক তুমি ফিরে এসেছো। ব্যাস। এবার তোমার একটা সাহায্য দরকার। আর একজনের জন্য…তোমার বোন… মেঘ… আমি তাকে…’ কেঁদে ফেললো অজয়।’আমি ওকে খুন করেছি!’
‘হ্যাঁ করেছোতো। আমি জানিতো! আমি খুব খুশি হয়েছি তুমি এটা করেছো বলে। ওর রক্ত আমাদের জন্য নরকের দরজা খুলে দিয়েছে। আমরা আবার মিলিত হতে পেরেছি।’
‘কিন্তু আমার রক্ত দিয়েইতো কাজ হয়ে যেতো। ওর মরার দরকারই ছিল না!’
‘দরকার ছিল অজয়! তোমার রক্ত দিয়ে কাজ হয়তো হতো। দরজা খুলেও যেতো। কিন্তু তোমাকে নিয়ে যেতে পারতাম না। এখন ওর খুনের রক্ত লেগেছে তোমার হাতে। এরজন্য তোমার পাকাপাকি জায়গা হবে নরকে। আমরা চিরকালের মত একসঙ্গে থাকবো। তুমিতো বুঝতেই পেরেছো অন্ধকারের মালিক আমাকে ওপরের এই জগতে থাকতে দেবেন না। তাই আমি এসেছি তোমাকে নিয়ে যেতে!’
কাজল এক টান মারলো অজয় এর হাত ধরে। সঙ্গে সঙ্গে বজ্র নিনাদী আওয়াজ হলো একটা। দুজনেই পড়ে গেল নরকের গর্তে। শোনা গেল অজয়ের ক্ষীণ চিৎকার। যা মিলিয়ে গেল পাতালের অন্ধকারে। গর্তটা যেন হঠাৎ মানুষের মতো কেশে উঠলো। আর তার সঙ্গে সঙ্গেই মেঘের শরীরটা ছিটকে বেরিয়ে এলো গর্তের ভেতর থেকে। এক লহমায় মিলিয়ে গেল সবকিছু। ধড়মড় করে উঠে বসলো মেঘ। চোখেমুখে বিভ্রান্তি। অবাক হওয়ার ভাব। সারা গায়ে রক্ত লেগে আছে। কিন্তু কোনও কাটা দাগ আর দেখা যাচ্ছেনা।
ঘরের চারদিকে তাকালো মেঘ। তারপর বলে উঠলো,’অজয়! অজয়! তুমি কোথায়?’
লেখকের কথাঃ Thomas S Sipos এর The Career Witch গল্পের ভাবানুবাদ। মূল গল্প প্রকাশিত হয়েছিল ফিফটি উইচ স্টোরিজ সংকলনে।
Tags: অনুবাদ গল্প, ওটা ভালোদের জায়গা নয়, তৃতীয় বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, পূজাবার্ষিকী, প্রতিম দাস