অগ্নিপথ ৮ : অগ্নিযোগ
লেখক: সুমন দাস
শিল্পী: সুমন দাস
স্থানঃ ভবিষ্যৎ
কালঃ অজ্ঞাত
পাত্রঃ সুমন
সুমনার নোটবইতে আর কোনও গল্প লেখা ছিল না। সেইবার ওর সামনে দাঁড়িয়ে আর কোনও কথা হয়নি। সময় ফুরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমায় ফিরে আসতে হয় কথা অসমাপ্ত রেখে। ডায়রীতে এই কথাগুলো বাদেও রয়ে যায় কিছু নোটস… সেগুলো সংক্ষেপে লেখা। আর সঙ্গে কিছু ছবি… আমি সেগুলোই পড়তে শুরু করলাম…
|| ৮ক ||
প্রায় দুই হাজার খ্রীষ্টপূর্বাব্দে ইঁটের বাড়ী তৈরী করা শুরু হয়। কাদা এবং মাটি দিয়ে ছোট ছোট স্ল্যাব বানিয়ে সূর্যের উত্তাপে প্রথমে তাকে শুকিয়ে নেওয়া হত ভালো করে। তারপর মাটি দিয়েই ভালো করে আটকে আটকে দেওয়াল তৈরী হতে লাগল, এবং অবশেষে বেশ ফ্যাশানেবল বাড়ী তৈরী হওয়া শুরু হল। কিন্তু এই ধরনের বাড়ী তৈরীর সবথেকে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াল বৃষ্টি। বিশেষত বর্ষাকালে বাড়ীগুলোকে টিকিয়ে রাখা ছিল একরকম অসম্ভব। কিন্তু তবুও আগুনে পুড়িয়ে ইট তৈরী করার ফর্মুলা আবিষ্কার করতে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আরও অপেক্ষা করতে হয় মানবজাতিকে।
প্রথমে কাদা, বালি এবং জল সহযোগে মধ্য এশিয়াতে নরম এক ধরণের মন্ড বানানো শুরু হয় যার নাম ক্লট। কাঠের ছাঁচের মধ্যে সেই মন্ডটাকে ফেলে একধরণের বিশেষ আকার দেওয়া হতে শুরু করা হয়। এটাই ইঁটের আদিপুরুষ। তারপর প্রায় ২০০০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেডে পুড়িয়ে নিয়ে ঠান্ডা করা হলে পাওয়া যায় লাল রঙের শক্তপোক্ত ইঁট, যা এখনও ব্যবহার করা হয়। এরপর বহুরকমের সংশোধনের মধ্যে দিয়ে এই ইঁটকে নিয়ে যাওয়া হয়। আজ অত্যাধুনিক টেকনোলজি দিয়ে একসঙ্গে অনেক ইঁট তৈরী করা সম্ভব হলেও তার ছাঁচ বা আকার কিন্তু প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই মোটামুটি একই রকমের রয়ে গেছে।
|| ৮খ ||
Figure 2 Glass Blowing Utensils
সিরিয়ানরা সর্বপ্রথম গ্লাসের ব্যবহার শুরু করে। তারাই আবিস্কার করে কীভাবে কাচকে আগুনে গলিয়ে তারপর তাকে বিভিন্ন আকারের ব্যবহৃত এবং ঘরের সৌন্দর্যবর্ধক বস্তুতে রূপান্তরিত করা যায়। যদিও তারও বহু আগে কাচের ব্যবহার শুরু হয়ে যায়, কিন্তু তাকে প্রায় হাজার ডিগ্রী তাপমাত্রায় গলিয়ে বিভিন্ন ধরণের সূক্ষ্ম কাজের মধ্য দিয়ে একটা শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত করা — সিরিয়ানদের আগে কেউই পারেনি।
গ্লাসব্লোয়িং (Glassblowing) হল এক ধরনের বিশেষ পদ্ধতি যা, কাচকে তার ইচ্ছামত আকার ও নির্দিষ্ট আকৃতি — যা একটা সভ্যতার নিজস্ব ধারক ও বাহক হয়ে দেখা দেয়। কিন্তু এইক্ষেত্রে যে পদ্ধতি নেওয়া হয়েছিল তা একইরকম। একটা লম্বা নলের ডগায় গলিত কাচ নেওয়ার পর অন্য প্রান্তে ফুঁ দিয়ে দিয়ে আস্তে আস্তে বায়ুটাকে গলিত কাচের মন্ডের ভেতরে পাঠানো হয়। আস্তে আস্তে কাচের মন্ড ফুলে ওঠে এবং ধীরে ধীরে নির্দিষ্ট রূপ পেতে থাকে। বুদবুদ সমেত কাচটিকে আবার চুল্লীতে দেওয়া হয় গরম করার জন্য (যাতে অন্যরকম কোনও কিছু বানাতে গেলে আরও বুদবুদের প্রয়োজন হয়), অথবা একে এক জায়গায় রেখে দেওয়া হয় ঠান্ডা করার জন্য। ঠান্ডা ও শক্ত হলে খুব সুন্দর আকৃতি লাভ করে। এই ঠান্ডা করার প্রক্রিয়াটি কিন্তু খুব ধীরে ধীরে করা হয়। আসলে এই কাচের নির্দিষ্ট কোনও গলনাঙ্ক বা স্ফুটনাঙ্ক নেই। তাপমাত্রার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আস্তে আস্তে গলতে বা শক্ত হতে শুরু করে।
রোমান সভ্যতার উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে এই ধরণের কাচের ব্যবহার বহুল পরিমাণে বেড়ে যায়। এটিকে সর্বোচ্চ শিল্পের পর্যায়ে মানুষ নিয়ে আসে মূলত সেই সময় থেকেই। পরবর্তীকালে ম্যাঙ্গানীজ অক্সাইড মিশালে কাচের গ্লাস স্বচ্ছ এবং আরও সুন্দর রূপে আমরা পেতে শুরু করি। রোমানরাই প্রথম এই ধরণের গ্লাসের আবিষ্কর্তা, মোটামুটি ১০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে।
||৮ গ ||
Figure 3: Rocket
৯০৪ খ্রীষ্টাব্দ। দক্ষিণ চীনের ইউঝ্যাং প্রদেশ। আক্রমণকারী সৈন্যদের আদেশ দেওয়া হল অগ্নিবাণ নিক্ষেপ করার। প্রদেশের মূল গেট নিমেষে ধূলিসাৎ হল। অমন অগ্নিবাণের সামনে কোনও কাঠের গেট দাঁড়াতে পারবে? এবং সেইদিন মানব সভ্যতার ইতিহাসে লেখা হল সর্বপ্রথম Fire Arrows–এর কথা।
প্রকৃতপক্ষে চীনাদেরকেই আমরা অগ্নিকন্দুকের জনক বলে থাকি। বারুদের ব্যবহার এরাই সর্বপ্রথম তাদের তীরে ব্যবহার শুরু করে। এই বারুদ তীরের সামনে লাগানো থাকত। নিক্ষিপ্ত তীর যে স্থানে আঘাত করত, সেই জায়গায় বিস্ফোরণ হত।
১০৪৪ সালে ৎন কুং-লিয়ান (Tseng Kung-Liang), তার লেখা The Compendium of Important Military Techniques বইতে বিস্তারিতভাবে লিখছেন, কীভাবে বারুদসমেত একটা তীরকে বিনা ধনুকে আকাশে ছাড়তে হবে এবং তা সুনিপুণভাবে শত্রুসৈন্য নিপাত করবে। ১২৩৩ সালে, যখন চীন-মোঙ্গল যুদ্ধ হচ্ছে, তখন আমরা দেখতে পাই রীতিমতো রকেটের ব্যবহার। একটা ছোট হালকা নলের একটা মাথায় টুপি পরানো, অন্যদিকটা খোলা। এটাকে তীরের মাথায় খুব শক্ত করে বেঁধে দেওয়া হত। যখন আগুন দেওয়া হত, বারুদ জ্বলে উঠে পিছনের দিকে প্রতিক্রিয়া বলের সৃষ্টি করত। এর ফলে ক্ষয়ক্ষতি কী পরিমান হত, সেটা সুষ্পষ্ট না হলেও শত্রুশিবিরে যে বেশ আতঙ্কের সৃষ্টি করত তা বলাই বাহুল্য।
চীনাদের ব্যবহারের দেখাদেখি মোঙ্গলরা এরপর খুব তাড়াতাড়ি তাদের নিজস্ব রকমের পদ্ধতিতে এই রকেট বানাতে এবং যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহার করতে শুরু করে। এইভাবে আস্তে আস্তে মধ্য এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে এর ব্যবহার এবং সেখান থেকে ইউরোপে। দ্বাদশ শতকে ইউরোপে রকেটের ব্যবহার শুরু হয়। এরপর ১৫০০ সালে ইতালি, তারপর ক্রমান্বয়ে জার্মানি, এবং অবশেষে ইংল্যান্ড। অষ্টাদশ শতকে ভারতে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে লৌহনির্মিত রকেটের ব্যবহার দেখা যায়।
|| ৮ঘ ||
Figure 4: Compound Steam Engine
প্রাচীন স্টীম ইঞ্জিনের বৈশিষ্ট্য হল সেটার ব্যবহার মাত্র একবার করেই সম্ভব ছিল। পিস্টনটাকে পিছনের দিকে ঠেলে দিয়ে বাষ্প বায়ুতে মিশে যেত। এর কারণ একটাই, প্রাথমিক পর্যায়ে সিলিন্ডারের সংখ্যা ছিল মাত্র একটা। বাষ্পের ক্ষমতাকে আরও বাড়িয়ে তোলার জন্য সিলিন্ডারের সংখ্যা এরপর দুই, এবং ক্রমান্বয়ে আরও বাড়ানো হতে লাগল — তৈরী হল যৌগিক বাষ্পীয় ইঞ্জিন বা Compound Steam Engine, সাল ১৭৮১।
অর্থাৎ, প্রথমে হাই প্রেসার সিলিন্ডার থেকে যে বাষ্প পিস্টনটাকে ঠেলে দিল, সে বেরিয়ে না এসে দ্বিতীয় সিলিন্ডারে ঢুকে গেল, এবং তা লো প্রেসার সিলিন্ডারের মধ্যে ঢুকে গেল। সেই প্রেসার আবার পিস্টনকে ঠেলে দিয়ে আবার ক্রমান্বয়ে সিলিন্ডারের মধ্যে ঢুকে অবশেষে একটা নির্দিষ্ট চাপ বহাল রেখে পিস্টন ঠেলে দিয়ে বাইরে অবশিষ্ট স্টীম বেরিয়ে এল। দুটো পিস্টন একটা ক্র্যাঙ্কযন্ত্রের মধ্যে দিয়ে পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে। দুটো ভিন্ন পর্যায়ে কাজ করার জন্যেই এরকম ব্যবস্থা। প্রতিটা সিলিন্ডারের মধ্যে দিয়ে যে পরিমাণ শক্তি নির্গত হয় তা সমান এবং এর ফলে ইঞ্জিন সমান গতিতে সামনের দিকে এগিয়ে চলে।
Figure 5: Design
প্রকৃতপক্ষে এই ধরণের ইঞ্জিন খুব জটিল, তাই ব্যবসায়িক শিল্পঘটিত কারণ বা বাষ্পীয়পোত অর্থাৎ কি না জাহাজের জন্য এই ধরণের ইঞ্জিনের বহুল ব্যবহার দেখা যায়। রেলের ভারী ভারী ইঞ্জিনগুলোতেও (যেগুলো মালাগাড়ী বা দূরপাল্লার ট্রেন হয়) এই ধরণের ইঞ্জিনের ব্যবহার দেখা যায়। কিন্তু একে চালানো এতই শক্ত কাজ যে খুব কম ক্ষেত্রেই একে ভালভাবে মেইন্টেইন করা সম্ভবপর হয়।
জোনাথন হর্ণব্লোয়ার (১৭৫৩-১৮১৫) প্রথম এই ধরণের ইঞ্জিনের ডিজাইন তৈরী করেন ১৭৮১ সালে। দুর্ভাগ্য, প্রথম দিকের ইঞ্জিনগুলো এতই ব্যয়বহুল যে সরল ইঞ্জিনগুলোর ব্যবহার তখনো চলে। এরপর ১৮০৫ সালে আর্থার উলফ এই ডিজাইনটার ওপর কাজ করে এটাকে আরও উন্নত এবং তুলনামূলক খরচসাপেক্ষ করে তৈরী করতে সক্ষম হন।
|| ৮ঙ ||
Figure 6: Gas Light
উইলিয়াম মাড্রোক (১৭৫৪~১৮৩৯) ছিলেন একজন দুর্দান্ত ইনভেন্টার। অনেক ধরণের জিনিস আবিষ্কারের জন্য তিনি পরিচিত হলেও, তাকে আজও যে জিনিসটা আবিষ্কারের জন্য সকলে মনে রেখেছে তা হল গ্যাস লাইট। তেল এবং চর্বি সহযোগে জ্বালানী দ্বারা টিমটিমে আগুনকে হটিয়ে গ্যাস দ্বারা প্রচন্ডোজ্বল আলোকে তা ঘন্টার পর ঘন্টা পথের ধারে একটি লাইটপোস্টের মাথায় সুনিপুণভাবে জ্বালিয়ে রাখার বিরল ক্ষমতা দেখান তিনি।
তিনি দেখেন কয়লা পুড়িয়ে যে গ্যাস পাওয়া যায় তাকে জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করা যায়, শুধু তাই নয়, সেই গ্যাসকে একটি স্থায়ী জ্বালানী উৎসরূপেও ব্যবহার করা যেতে পারে। ব্যাস, যেই ব্যাপারটা মাথায় ঢুকল অমনি তার পরীক্ষা শুরু হয়ে গেল, ১৭৯২ সাল থেকে। তার মাকে বললেন, কেটলীর মধ্যে কয়লা পোড়াতে। জ্বলন্ত কয়লা থেকে যে গ্যাস উৎপন্ন হল, তা কেটলীর মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসতে লাগল। সেই মুখে আগুন সংস্পর্শ করানোর সঙ্গে সঙ্গেই দপ্ করে জ্বলে উঠল আগুন। কিন্তু কেটলীর দফারফা হয়ে গেল।
১৭৯৪ সালে কেটলীর বদলে বিশেষ ধরণের পাতনযন্ত্র বা বকযন্ত্রের ব্যবহার করে। বকযন্ত্রের গলায় লাগানো ছিল একটা লম্বা নল, যা যুক্ত ছিল একটা ফানেলের সঙ্গে। কয়লা পুড়ল, ধোঁয়া উড়ল, গ্যাস বেরোল আর ফানেলের গলা দিয়ে নির্গত হল। অতঃপর ফানেলের মুখে আগুন জ্বলে উঠল।
মাড্রোক প্রথম গ্যাস লাইটের প্রচলন করেন নিজের বাড়ীর সামনে, রেডরুথে। দিনে দিনে এর আরও উন্নতিকরণ করেন। ফলে গ্যাসের আলোর উজ্বলতা ও স্থায়ীত্ব আরও বাড়তে থাকে। ১৭৯৮ সালে বাল্টন এন্ড ওয়াট ফ্যাক্টরিতে (বাল্টন মানে ম্যাথু বাল্টন, যিনি কি না সেই সময়কার প্রখ্যাত ইঞ্জিনিয়ার এবং ওয়াট – আমাদের চিরপরিচিত জেমস ওয়াট) তার গবেষণা শুরু করেন। অচিরেই সাফল্য লাভ করে। ফলস্বরূপ ১৮০২ সালে ফ্যাক্টরির বাইরের একটা বড় অংশে গ্যাস লাইট সারি সারি দিয়ে বসানো হয়, যা জনসমাজে বেশ সাড়া ফেলে দেয়। পরের বছরেই ম্যাঞ্চেস্টারের ফিলিপ এন্ড লি নামক কটন মিলে এই গ্যাস লাইট বসানো হয়।
কিন্ত যেটা সবচেয়ে রহস্যজনক, তা হল মাড্রোক এর কোনও পেটেন্ট নেননি। মনে করা হয় বাল্টন এবং ওয়াটের নেতিবাচক মনোভাবের জন্যই না কি তিনি সরে আসেন। কারণ, ওই কোম্পানীতে আসলে তিনি ছিলেন একজন কর্মীমাত্র। আর কর্মীর এমনতর সাফল্য কোনও কোম্পানী সেই সময় বরদাস্ত করতে পেরেছে? কিন্তু ১৮০০ সালের মাঝামাঝি সময়ে ইংল্যান্ডের বেশিরভাগ বড় বড় শহরে গ্যাস লাইটের বহুল ব্যবহার শুরু হয়, যা কি না মাড্রোকের দেখান পথেই, কিন্তু মাড্রোক যা সম্মানী পান, তা অত্যন্ত নগন্যমাত্র।
|| ৮চ ||
শিল্পের নবজাগরণের (Industrial Revolution) প্রাক্কালে, খুব বড় ধাতব পাত বানানো হত ছোট ছোট পাতকে একসঙ্গে জুড়ে, ওয়েল্ডিং করে। ধাতব হাতুড়ি দিয়ে ছোটখাট পাত বানানো গেলেও বৃহৎ পাত বানাতে এই সমস্ত হাতুড়ি কোনও কাজের ছিল না। কারণ বৃহৎ পাতের ক্ষেত্রফলের তুলনায় হাতুড়ি থেকে প্রাপ্ত আঘাত ছিল অনেক দুর্বল।
SS Great Britain নামক জাহাজ বানাতে গিয়ে গ্রেট ওয়েস্টার্ন স্টীমশিপ কোম্পানি বেশ ঝামেলায় পড়ে। Paddle Wheels তৈরী করতে গিয়ে যে মাপের হাতুড়ি লাগবে তা তাদের কাছে থাকা তো দূরের কথা, ব্যাপারটার কথা ভাবাটাই বেশ অলীক টাইপের। সত্যিই তো, অমন একটা সুবিশাল জাহাজের চাকা তো বেশ বড়সড়োই হবে, আর সেটা বানাতে যে মাপের হাতুড়ি লাগবে তা দৈত্যাকৃতি হওয়াটাই বাঞ্ছনীয়। জেমস ন্যাস্মিথ (১৮০৮ ~ ১৮৯০) ছিলেন ইঞ্জিনীয়ার, যিনি সমস্যাটাকে মন দিয়ে শুনলেন এবং অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তৈরী করলেন একটা স্কেচ। এই ক্ষেত্রে উনি নিয়ে এলেন স্টীম ইঞ্জিনের কনসেপ্ট। যা কিনা জলকে আগুনে দিয়ে তার বাষ্প করে বানানো হবে। এই স্টীমের ক্ষমতা সাংঘাতিক। আর তাই এই স্টীম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র তথা হাতুড়িটা নিশ্চয় সেই রকমই বিশালবপু হবে, এবং হয়েওছিল। ন্যাস্মিথের হাতুড়ি পিস্টন দ্বারা যুক্ত ছিল। স্টিমের ধাক্কায় পিস্টনটা হাতুড়িটাকে কিছুটা উচ্চতা পর্যন্ত তুলে ধরত এবং তারপর ছেড়ে দিত। পতনটা ছিল সাংঘাতিক শক্তি নিয়ে নীচের দিকে, যার ধাক্কা ছিল বিপুল। অর্থাৎ আমরা পেলাম সেইযুগের এক অতুলনীয় যন্ত্র।
মজার ব্যাপার হল, ইতিমধ্যেই জাহাজটির ব্লু-প্রিন্টের করা হল ব্যাপক রদবদল, এবং প্যাডেল হুইলের বদলে ব্যবহার করা হল স্ক্রু-ড্রাইভ, ফলে আর এই স্টীম হ্যামারের প্রয়োজন হল না।
ন্যাস্মিথ না তো এর বাণিজ্যকরণ করেছিলেন, না নিয়েছিলেন এর পেটেন্ট। ওঁর চক্ষু ছানাবড়া হয়ে যায় যখন ফ্রান্সের এক লোহার কারখানায় পরিদর্শনে যান। তিনি দেখেন তার তৈরী যন্ত্র তারই অনুমতি ব্যতিরেকে রমরমিয়র চলছে। তিনি দ্রুত ইংল্যান্ডে ফিরে আসেন এবং পেটেন্ট নিয়ে নেন। এরপর এর প্রোডাকশনের কথা ভাবেন। তার যন্ত্র এতটাই ব্যবহারোপযোগী যে এর জনপ্রিয়তা বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে পড়তে বেশি সময় লাগেনি।
|| ৮ছ ||
Figure 7 Flamethrower
কী নাম দেব? অগ্নিক্ষেপক? মানে Flamethrower–কে? যাই হোক, ফ্লেমথ্রোয়ারই থাক আপাতত। আধুনিক ফ্লেমথ্রোয়ার আবিষ্কার করার উদ্দেশ্যই হল আগুনকে যত্রতত্র ছড়িয়ে দেওয়া – ভয়ানকভাবে। অবশ্যই এর ব্যাবহার যুদ্ধক্ষেত্রে দেখা যায়। তবে এর ধ্বংসাত্মক রূপটি কিন্তু সত্যিই ভয়াবহ। আমার মতে, সবথেকে অনৈতিক যুদ্ধাস্ত্রও বটে…
জার্মান বিজ্ঞানী রিচার্ড ফিডলার দুই ধরনের ফ্লেমথ্রোয়ার নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করেছিলেন। Flammenwerfer ছিল আকারে ছোট, যা চালালে জ্বলন্ত তেল সমেত আগুন নির্গত হত, এবং বড় যে মডেলটা ছিল তা দিয়ে প্রায় ১১৮ ফুট আগুন নির্গত হতে পারত, যার স্থায়িত্ব ছিল ৪০ সেকেন্ড! ভাবতে পার…
|| ৮জ ||
সুমনার নোটস এখানেই শেষ। আরও কিছু ছিল যা আমি জানতে পারিনি, পারবও না। আমি কেবল ডায়রিটা হাতে নিয়ে ঘোলাটে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি আর ভাবি, সে কী এই গল্পগুলো সেই ছোট্ট মেয়েটাকে বলে যেতে পেরেছিল?
[ক্রমশ]
[সব চরিত্র কাল্পনিক]
Tags: তৃতীয় বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, প্রবন্ধ, সুমন দাস