সবুজের হাতছানি
লেখক: অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়
শিল্পী: ধ্রুবজ্যোতি দাস ও দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য্য (চিত্রচোর)
আলো ঝলমল মেট্রো স্টেশনের কাঁচের দরজার ওপারে ট্রেন এসে প্রতিদিনের মতোই দাঁড়াল। ঘড়িতে তখন বাজে সকাল সাতটা দশ। ট্রেনের সিটে স্কুল ব্যাগ নামিয়ে দিয়ে অন্যদিনের মতো বাবাকে সেই পুরনো প্রশ্নটাই করে বসল গুড্ডু, “বাবা, মাটির উপরে খোলা আকাশের নিচে আমাকে কবে নিয়ে যাবে?”
অন্যমনস্ক হওয়ার ভান করতে করতে গুড্ডুর বাবা বলল, “বলেছি তো নিয়ে যাব। এখন বইতে একবার চোখ বুলিয়ে নাও। তোমার না আজ সায়েন্সের পরীক্ষা!”
সায়েন্স গুড্ডুর প্রিয় সাবজেক্ট। তাই চোখ না বুলালেও খুব সহজেই যে হায়েস্ট মার্কস পেয়ে যাবে, সেটা গুড্ডুর জানা আছে। বাবার মন রাখার জন্য গোমড়া মুখে বই খুলতেই আবার সেই পাতাটা খুলে গেল। হাতে আঁকা একটা ছবি। টবের উপর সবুজ ছোট্ট গাছ। নিচে লেখা – সালোকসংশ্লেষ।
গুড্ডুর মন খারাপ হয়ে গেল। একটা জীবন্ত গাছ, সূর্যের আলো গায়ে পড়তে যেন হেসে উঠেছে। গাছের পাতায় জলের ফোঁটা লেগে আছে। গাছটা যেন হাতছানি দিয়ে গুড্ডুকে কাছে ডাকছে। গুড্ডু জানে না গাছের পাতায় শিশিরের বিন্দু আঁকা আছে। শিশির কী সেটা নিয়ে কোনও ধারণাই নেই তার। ও তো কোনওদিন শিশির দেখেইনি। গুড্ডু বইয়ের পাতায় আঁকা গাছটার গায়ে হাত বোলায়। শুকনো বইয়ের পাতায় হাত বুলাতে খড়খড় করে শব্দ ওঠে। গুড্ডু কোনওদিন সূর্য দেখেনি। আসল সূর্য, যার কথা বিজ্ঞানের পাতায় আছে। অথচ চোখে দেখা হয়নি তার এই জীবনের চোদ্দটা বছরে।
পাই সেক্টর এসে গেল। বাবার ডাক শুনে বই বন্ধ করে উঠে পড়ল গুড্ডু। তার স্কুল এই সেক্টরেই। স্টেশনে নেমে এস্ক্যালেটরের ঠাণ্ডা হাতলে হাত রেখে উপরে মুখ তুলে বেরোবার গেটের দিকে তাকিয়েও সেই একই কথা মনে হল, কী আছে উপরে, বাইরের পৃথিবীতে, ওই ছাদ ফুঁড়ে যদি বাইরে যাওয়া যেত?
গুড্ডুদের শহরের নাম ঝিলমিল। ঝিলমিল শহরের জিটা সেক্টরে থাকে গুড্ডু। এই শহরের অবস্থান পৃথিবীর মাটি থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার নিচে। এক সময়ে ঝিলমিলের উপরে ছিল শহর কলকাতা। গুড্ডু বই পড়ে সেকথা জেনেছে। পরিবেশ দূষণে মাটির উপরের সেই শহর এখন পরিত্যক্ত। প্রায় পাঁচ ছ-শো বছরেরও আগে সেই শহর ছেড়ে মাটির নিচে ঝিলমিল তৈরি হয়। গুড্ডুর বাবা ওকে জানিয়েছে যে, সে নিজেও কোনওদিন পৃথিবীর উপরে আকাশ দেখেনি। এই মাটির নিচের শহর ঝিলমিল ছেড়ে যায়নি কোথাও।
স্কুল গেটের সামনে চওড়া হল ঘরে দশ মিনিট চুপ করে বসে থাকতে হয় সব ছাত্রছাত্রীকে। এখানে মাথার উপরে লাগানো ল্যাম্প থেকে ভিটামিন-ডি বর্ষণ করা হয় সবার মাথার উপর। সরকারি কড়া নির্দেশে বাধ্যতামূলক এই ভিটামিন গ্রহণ করতে হয় সব স্কুলে। এই সময় হালকা মিউজিক বাজে সারা ঘরে। গুড্ডুর কেমন যেন ঘুম জুড়ে আসে চোখের পাতায়।
ক্লাসের ফাইনাল পরীক্ষা চলছে এখন। বিজ্ঞান, দর্শন আর অঙ্কন নিয়ে পড়াশুনো করে গুড্ডু। সামনে খোলা কমপিউটর স্ক্রিনে বিজ্ঞান পরীক্ষার প্রশ্নপত্রেও সেই সালোকসংশ্লেষের পদ্ধতির উপর প্রশ্ন। গুড্ডুর হাত চলছে, কিন্তু মন জুড়ে একটা গাছ, গাছের সবুজ পাতা, পাতায় জমে থাকা জলের ফোঁটা।
পরীক্ষা শেষ হতেই প্রচণ্ড খিদে পাওয়ায় ব্যাগের ভিতর থেকে প্লাস্টিকের কৌটো বার করে গুড্ডু। কৌটোতে আছে প্রোটিন ট্যাবলেট। তার থেকে একটা ট্যাবলেট মুখে ফেলে কাঁধের জলের বোতল থেকে একঢোঁক জল খেয়ে পেটে চালান করে দেয়। তিন মিনিটের মধ্যে পেট ভরে যায়।
স্কুলের গেট দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসতে যেতেই বুড়ো চৌকিদার পূরণ সিং এর সঙ্গে দেখা হয়ে যায় গুড্ডুর। পূরণ সিং এর চওড়া গোঁফ। হাতে ইলেকট্রিক ব্যাটন। গোমড়া মুখে হাসি দেখা যায় না কখনও। গুড্ডু ওকে দেখে ফিক করে হেসে দেয়। তারপর ঘাড় দুলিয়ে সৌজন্য জানায়। পূরণ সিং-কে জিজ্ঞেস করলে কেমন হয়, ও কোনওদিন মাটির উপরে গেছে কিনা? কিন্তু তার হাসি বর্জিত মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করতে ভয় হয়।
গুড্ডু গেটে পৌঁছতেই চৌকিদারের টেবিলে রাখা স্ক্রিনে গুড্ডুর পরিচয় ফুটে ওঠে। ওর টাইম আউট হতেই বিপ করে একটা শব্দ হয়। গেট খুলে যায়। বাইরে আলো ঝলমল দুপুর এখন। মাটির উপরের পৃথিবীর খোলা মাঠে সূর্যের আলোর মতো আলোয় আলো চতুর্দিক। কৃত্রিম সূর্যের আলো। গুড্ডু কবজি ঘুরিয়ে ঘড়িতে সময় দেখে। মেট্রো স্টেশনের দিকে হাঁটতে থাকে।
আজ পরীক্ষা শেষ হয়ে গেল গুড্ডুদের স্কুলে। সামনে এখন এক সপ্তাহ ছুটি। বাড়ি ফিরে মোবাইলে গুড্ডুর দিম্মা ফোন করল। দিম্মা গুড্ডুদের বাড়িতে আসবে নিমতাল থেকে। দু-চারদিন থেকেও যাবে। নিমতাল, ঝিলমিল থেকে প্রায় দুশো কিলোমিটার দূরের শহর। গুড্ডুর দিম্মা জয়া ওখানে নিউক্লিয়ার রিসার্চ সেন্টারে বিজ্ঞানী। দিম্মা আসছে, ছুটিটা ভালই কাটবে মনে হচ্ছে, ভাবে গুড্ডু।
হৈ হৈ করে বাড়িতে ঢুকে পড়লেন জয়া। গুড্ডুর বাবা-মা এই সময়ে অফিসে থাকে। বাড়িতে তাই এখন শুধু দিম্মা আর গুড্ডু। ঢাউস ব্যাগটা বয়ে নিয়ে ঘরে ঢুকল দিম্মার ড্রাইভার কাম অ্যাসিস্টান্ট এন টি ২০১৪। ও একজন যন্ত্রমানব। যন্ত্র হলেও এই প্রজন্মের রোবোরা সবাই আদব কায়দায় বেজায় স্মার্ট। দিম্মা এই ক-দিন গুড্ডুর ঘরেই থাকবে জেনে ব্যাগ থেকে বার করে সব জিনিসপত্র সুন্দর করে গুছিয়ে রেখে দিল। পরবর্তী আদেশের জন্য ঘরের কোনায় দাঁড়িয়ে আছে দেখে জয়া বললেন, “তোমার বিশ্রাম প্রয়োজন। টানা তিনদিন ঘুমাওনি”।
জয়ার কথা শেষ হতে না হতেই গুড্ডুদের গেস্ট রুমে গিয়ে রোবো ২০১৪ নিজেই শাট ডাউন করে দিল তার সিস্টেমকে। জয়া হাত মুখ ধুয়ে এসে সোফায় আরাম করে বসে বললেন, “তারপর দাদুভাই, তোমার পরীক্ষা শেষ? ছুটির ক-দিন কী করবে ঠিক করেছ?”
গুড্ডুর সোজা জবাব, “মাটির উপরে যাব দিম্মা। আকাশ দেখব। গাছ দেখব, আসল গাছ…। আচ্ছা দিম্মা তুমি কোনওদিন আকাশ দেখেছ?”।
জয়া গুড্ডুর সর্বনাশা আবদার শুনে কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থেকে বললেন, “একবার, শুধু একবারের জন্য। সবাই সে সুযোগ পায় না। স্পেশাল পারমিশন না থাকলে মাটির উপর যাওয়া যায় না”।
গুড্ডু আগ্রহী হয়ে প্রশ্ন করে, “কী করে গেলে? আমায় বল, এক্ষুনি বল”।
দিম্মা গুড্ডুর চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে, “আগে যাও দেখি আমার নীল রঙের কৌটোটা টেবিলের উপর থেকে নিয়ে এসো দেখি, দেখোই না কী এনেছি তোমার জন্য!”
গুড্ডু একছুটে নীল কৌটো নিয়ে দিম্মার হাতে ধরিয়ে দিয়ে ব্যাকুল দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখতে থাকে কী বিস্ময় অপেক্ষা করে আছে তার জন্য। কৌটোর মুখের ঢাকনা খুলতেই দেখা গেল গোল বাদামি রঙের ছোট ছোট গুলি। জয়া জিজ্ঞেস করেন, “কী বলতো দাদুভাই? খাবার জিনিস কিন্তু”।
হাতে ধরা মোবাইল স্ক্রিনে চোখ বুলিয়ে গুড্ডু বলে, “নাড়ু, এর উপাদান হল, নারকোল চিনি আর ছানা। দিম্মা ছানা কী?”
জয়া বলেন, “ছানা হল একরকম জিনিস যা আজ থেকে বহু শতাব্দী আগে গরুর দুধ থেকে তৈরি হত। তুমি নিশ্চয়ই চিড়িয়াখানায় গরু দেখেছ। এক সময় গরু পালন করা হত। তার দুধ খাওয়াও হত”।
গুড্ডু মুখ বাঁকিয়ে বলে, “এঃ, আমি খাব না। মোটেই খাব না”।
জয়া হতাশ হয়ে বলেন, “তোর জন্য নিয়ে এলাম, আর তুই খাবি না বলছিস! কত কষ্ট করে ইন্টারনেট ঘেঁটে রেসিপি বার করলাম, জানিস? নারকোল জোগাড় করা আর এক সমস্যা। আচ্ছা এইটা বল, কী করে নাড়ুর উপাদান বেমালুম বলে দিলি এত সহজে, আমি তো……”।
জয়াকে কথা শেষ করতে না দিয়েই গুড্ডু বাতাসে হাত ঘুরিয়ে বলে, “মোবাইল অ্যাপ আছে না? স্ক্যান করে জেনে নিলাম। এতে আশ্চর্য হওয়ার কী আছে! আমি বরং আশ্চর্য হচ্ছি আমার মাটির উপরে বেড়াতে যাবার ব্যাপারে তুমি কোন উৎসাহ দেখাচ্ছ না বলে”।
“হবে হবে, আগে খেয়ে নাও দাদুভাই, এই নাড়ুগুলো কৃত্রিম দুধে তৈরি। আমাদের নিউক্লিয়ার রিসার্চ ল্যাবরেটরির আবিষ্কার। আর শুধু ট্যাবলেট খেয়ে বেঁচে থাকলে তোমার পাকস্থলী একদিন কুঁকড়ে ছোট হয়ে যাবে। তাই রোজ অন্তত আধ কিলো যে কোনও খাবার চিবিয়ে খাওয়া আমাদের পক্ষে খুব প্রয়োজন। রোজ এই নিয়ে সরকারি বিজ্ঞপ্তি দেওয়াও হচ্ছে আজকাল”, এই বলে জয়া কৌটো খুলে দুটো নাড়ু গুড্ডুর হাতে দিলেন।
গুড্ডু হাতে নিয়ে নাড়ু দুটো নাড়াচাড়া করে একটা মুখে তুলে চিবাতে চিবাতে বলে, “দারুণ। খুব ভালো তো খেতে! এবার বলো কী করে মাটির উপর যাওয়া যায়। আমি আকাশ দেখব। সূর্য দেখব।”
জয়ার মুখে আষাঢ়ের মেঘ খেলা করে। উঠে দাঁড়িয়ে জানলার দিকে যেতে যেতে বলেন, “কাজটা প্রায় অসম্ভব। বাইরের পৃথিবী মানুষের শরীরের পক্ষে মারাত্মক ক্ষতিকারক। ওজোন লেয়ার ধ্বংস হয়ে যাবার পর, অতিবেগুনী রশ্মি মানুষের গায়ে পড়ে ক্যান্সার হয়ে যায়। অক্সিজেন এতো কম, তাতে দশ মিনিটের অবস্থান প্রাণান্তকর হতে পারে। রোবোরা যায় অনেক কাজ নিয়ে, কিন্তু তাদের ধাতব শরীরেও বিষাক্ত গ্যাস প্রভাব ফেলছে বলে নতুন ধরণের এ্যলয় নিয়ে ভাবনা চিন্তা চলছে। এই অবস্থায়, তুমি দাদুভাই, কী করে ভাবছ উপরে ঘুরতে যাবার কথা?”
গুড্ডু জয়াকে থামিয়ে দিয়ে বলে, “তুমি যে বললে একবার গিয়েছিলে! কেমন উপরের সেই পৃথিবী?”
জয়া চোখ থেকে চশমা খুলে চেয়ারের পিছনে মাথা এলিয়ে দিয়ে বললেন, “নিউক্লিয়ার প্ল্যান্টগুলো সব মাটির উপরেই বানানো হয়। আমাদের রিসার্চ সেন্টারের নিউক্লিয়ার প্ল্যান্ট বসে অনেক বছর আগে, তখন আমি সদ্য চাকরিতে জয়েন করেছি। দু-বছর বাদে নিউক্লিয়ার প্ল্যান্টে গুরুতর গোলমাল দেখা যায়। রিমোট কন্ট্রোলে তাকে চালু করা সম্ভব হয়নি। টেকনিশিয়ান রোবোদের পাঠিয়েও কাজ হয় না। তখন আমাকে যেতে হয়েছিল। লিফটে সোজাসুজি উপরে উঠে প্ল্যান্টের গোলযোগ ঠিক করে নিচে ফিরে আসতে হয়। কিন্তু বাইরেটা দেখার সুযোগ আমাকে দেওয়া হয়নি”।
গুড্ডু বায়না ধরে, “আমি যাব। বাইরেটা দেখব। তুমি একজন বিজ্ঞানী। আমি জানি তুমি চেষ্টা করলেই হবে”।
নাছোড়বান্দা নাতির হাবভাব দেখে জয়া কিছুক্ষণ চিন্তা করে এন টি ২০১৪-র কাছে গিয়ে ওর ঘাড়ের কাছে একটা বোতাম টিপে দিতেই চোখ খুলে সে জয়াকে দেখল, তারপর চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আমার চার্জ ফুল হয়ে গেছে। পরবর্তী নির্দেশ দিন”।
জয়া জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি মাটির উপর গেছ কোনওদিন? ওই উপরে যেখানে খোলা আকাশ দেখা যায়?”
রোবো ২০১৪ ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। জয়া বুঝলেন ও নিজের ব্রেন স্ক্যান করে পুরনো রেকর্ড ঘাঁটছে। জানা গেল, জয়ার কাছে নিযুক্ত হওয়ার আগে সে বর্জ্যসামগ্রী নিষ্পত্তির কাজ করত, মানে ইংরেজিতে যাকে ওয়েস্ট ডিস্পোসাল বলে। আর সেই কাজে দিনে চারবার ঝিলমিলের বর্জ্য পদার্থ নিয়ে উপরে যেতে হত। ওর দেহে অতি বেগুনী রশ্মির প্রভাব দেখা যেতে সেই কাজ থেকে সরিয়ে ওকে ব্যক্তিগত সহায়কের কাজে নিযুক্ত করা হয়।
জয়ার কাছ থেকে যেই না রোবো জানতে পারল গুড্ডু মাটির উপর যেতে ইচ্ছা প্রকাশ করেছে, সে প্রবল আপত্তি জানাতে শুরু করল। তার ধারণা এই কাজে গুড্ডুকে সাহায্য করলে রোবো পুলিশ লেজার গান দিয়ে তাকে ধ্বংস করে দেবে। আর মরতে কার না ভয় হয়? কিন্তু গুড্ডুর পিড়াপিড়িতে ওর জেদ জয়ী হল। গুড্ডুর সরল মুখের দিকে তাকিয়ে যন্ত্রমানবের মন গলে গেল। স্থির হল আগামীকালই যাওয়া হবে। গুড্ডুর বাবা-মা অফিস চলে গেলেই ওরা বর্জ্যসামগ্রী নিষ্পত্তি বিভাগে পোশাক বদল করে কাজে যাবে। রোবো ২০১৪-র এক প্রাক্তন সহকর্মী বাচ্চা ছেলেদের খুব ভালোবাসে, আর সে এই কাজে অবশ্য সাহায্য করবে।
ট্যাবলেট দিয়ে ব্রেকফাস্ট না করে আজ ব্রেড অমলেট খেল গুড্ডু। মনটা তার বেজায় খুশি, উড়ু উড়ু। উত্তেজনায় বাবা-মা অফিস যাবার জন্য বিদায় নেওয়ার সময় তাদের একটু বেশি চিৎকার করে বাই বাই করল মনে হল। দিম্মাও বাইরে যাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে দেখে অবাক হল গুড্ডু। কী আশ্চর্য, দিম্মাও যাচ্ছে গুড্ডুর সঙ্গে! তাহলে তো ডবল মজা।
এন টি ২০১৪ গাড়ি চালাতে চালাতে বকবক শুরু করল আজ ভীষণ রকম। তার একটাই চিন্তা, জয়া আর গুড্ডুর মাটির উপরে যাওয়ার ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গেলে ওর তো বিপদ আছেই, গুড্ডুদেরও জেল হবার সম্ভাবনা। কিন্তু ওকে চুপ করানোর জন্য প্রোগ্রামিং এর অদল বদল ঘটালে যাত্রায় বিঘ্ন ঘটতে পারে। আর বর্জ্যসামগ্রী নিষ্পত্তি বিভাগের রাস্তা জয়ার জানা নেই। জিপিএসেও রাস্তা লুকানো আছে। শুধু ২০১৪-র পক্ষেই রাস্তা চিনে যাওয়া সম্ভব। তাই মুখ বুজে ২০১৪-র বকবক না শুনে উপায় থাকল না।
বিভাগের বিশাল গেটের সামনে গাড়ি পোঁছতেই নিরাপত্তা কর্মী পরিচয়পত্র দেখতে চাইল। গুড্ডুর বুক দুরদুর। উপরে যাওয়ার ছাড়পত্র না পেলেই চিত্তির। জয়া হাতব্যাগ থেকে একটা ছোট মোবাইলের মতো ট্যাবলেট বার করে কী সব খুটখাট করতেই নিরাপত্তা রক্ষীর সামনের স্ক্রিনে মেসেজ এসে গেল। সঙ্গে সঙ্গে গেটও খুলে গেল। গাড়ির ড্যাশ বোর্ডের ডিসপ্লেতে পথনির্দেশ ফুটে উঠল। ২০১৪ একটা ছোট কাঁচের দরজাওয়ালা বাড়ির সামনে গাড়ি দাঁড় করাতেই জয়া গুড্ডুকে ইশারায় নামতে বললেন। গুড্ডুর বিস্ফারিত চোখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে তার হাত ধরে জয়া বললেন, “আমি একজন আণবিক বিজ্ঞানী, জানো তো! তাই সহজেই পরিচয়পত্র পাওয়া যায়। তবে শুধু ভিতরে ঢোকার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। বাইরের পৃথিবীতে মানুষের যাওয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আগে ভিতরে যাওয়া যাক, তারপর সুযোগ বুঝে ঝুঁকি নিতে হবে”।
কাঁচের দরজা খুলে যেতে বিরাট একটা হল ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল ওরা দুজন। শক্ত পোক্ত চেহারার একজন যন্ত্রমানব এসে সামনে দাঁড়াল। হাতে তার ইলেকট্রিক ব্যাটন। জয়ার মোবাইলের মেসেজ পড়ে ঘাড় নেড়ে এগিয়ে যেতে বলল। জয়া মোবাইলে অনেকগুলো মেসেজ টাইপ করলেন খুব দ্রুত। ফিসফিস করে গুড্ডুর কানের কাছে বললেন, “আমাকে ফলো করো। অন্যদিকে হাঁ করে বেশি তাকিয়ে থেকো না। এই লোকটার প্রোগ্রামিং রিমোট কন্ট্রোলে বদলাবার চেষ্টা করছে আমার এক অ্যাসিস্ট্যান্ট। ততক্ষণ পর্যন্ত লোকটা আমাদের সঙ্গে কো-অপারেট করবে না। ও শুধু আমাদের গারবেজ ডিস্পোসাল মনিটরিং রুম পর্যন্ত নিয়ে যাবে।
এরপর কনভেয়ার বেল্টের সামনে চলে এল জয়া আর গুড্ডু। যন্ত্রমানব রক্ষীটি ইশারায় বেল্টে চড়তে বলে সরে দাঁড়াল। ওরা বেল্টে উঠতেই সে-ও বেল্টে চড়ে দুহাত দূরে দাঁড়িয়ে ওদের দেখতে লাগল। বেল্ট একটা লম্বা সুড়ঙ্গ পার হয়ে একটা বিরাট হল ঘরে চলে আসতেই কনভেয়ার বেল্ট থেমে গেল। চারিদিকে দশ বারোটা এল ই ডি মনিটর। প্রত্যেক মনিটরের সামনে বসে একেকজন যন্ত্রমানব।
ইতিমধ্যে জয়ার হাতের ট্যাবলেটে অনেকগুলো মেসেজ এল। জয়া মুখ নিচু করে সেগুলোর জবাব দিচ্ছে বলে মনে হল গুড্ডুর। দারুণ উত্তেজনায় মনিটরগুলো দেখতে লাগল গুড্ডু। কিন্তু কোনটাতে মাটির উপরে পৃথিবীর দৃশ্য দেখা যাচ্ছে, বিশেষ বোধগম্য হল না।
কব্জিতে টান পড়তে গুড্ডু দেখে তার দিম্মা মুখে আঙুল রেখে চুপ করে তাকে অনুসরণ করতে বলছে। আগে আগে চলেছে সঙ্গী সেই যন্ত্রমানবটি। এবার সে বেশ উৎসাহ নিচ্ছে বলে মনে হল। তার মানে ওর প্রোগ্রামিং বদলে দেওয়া হয়েছে।
একটা ছোট ঘরে গুড্ডুদের বসিয়ে রেখে কিছুক্ষণ পর রোবো ফিরে এল নীল পোশাক হাতে করে। মুখ ফুটল তার এতক্ষণে। গুড্ডুকে উদ্দেশ্য করে বলল, “পোশাকের উপরেই এটা চাপিয়ে নাও, আর ভালো করে মাস্কটা বেঁধে নাও। আমরা উপরে যাব”।
পোশাকটা বিশেষ ফাইবারে তৈরি মনে হল, বেশ ভারী। মাস্কের ভিতর অক্সিজেনের নল লাগানো। ভারী পোশাকের ভিতরে কোথাও অক্সিজেনের সিলিন্ডার থাকতে পারে। যন্ত্রমানব নিজেও একই রঙের পোশাক পরে নিয়েছে ততক্ষণে। দিম্মাকে নতুন পোষাকে প্রায় চেনা যাচ্ছে না আলাদা করে। কিন্তু পোশাকের ভিতর থকে কথাবার্তা চালাতে অসুবিধ হচ্ছে না।
আবার একটা কনভেয়ার বেল্টে চড়ে সুড়ঙ্গ পার হতে হল। তারপর এক বিশাল লিফটের সামনে এসে থেমে গেল কনভেয়ার বেল্ট। লিফটের সামনে অনেক বড়ো মাঠের মতো খোলা জায়গা। বড়ো বড়ো ক্রেন সিল করা স্টিলের কন্টেনার উঠিয়ে লিফটের সামনে রাখতেই দুজন যন্ত্রমানব সেগুলো লিফটে স্বয়ংক্রিয় ভাবে রাখতে সাহায্য করছে। জয়া আর গুড্ডুকে দেখেও তারা কিছু বলল না। কন্টেনারে লিফট ভরে যেতেই সঙ্গী যন্ত্রমানব দুজন সহায়কের কানে কানে কিছু বলতেই তারা গুড্ডুদের এক ঝলক দেখে নিয়ে সরে গেল। রোবো ওদের লিফটের একদিকে উঠে পড়তে বলল। ওরা তিনজন লিফটে উঠতেই লিফট চলতে শুরু করল।
দশ মিনিট একটানা চলার পর লিফট থেমে গেল। যন্ত্রমানব লিফটের প্যানেলের টাচ স্ক্রিনে খুটখাট করতেই লিফটের ক্যাপ্সুল আলাদা হয়ে গিয়ে স্বয়ংক্রিয় যানের ভিতর ঢুকে পড়ল। শব্দ শুনে গুড্ডুর মনে হল, সে যেন ট্রেনে চেপে যাচ্ছে। হঠাৎ গুড্ডুর পাশে লিফটের জানলা খুলে গেল। জানলায় কাঁচ লাগানো। গুড্ডু আর জয়া বিস্ময়ে দেখল মাটির উপর ধীর গতিতে চলেছে ক্যাপসুল। গারবেজ কন্টেনারের সঙ্গে বাহিত হয়ে ওরা চলেছে মুক্ত পৃথিবীতে। ধূসর বায়ুমণ্ডল। আকাশে ধুলোর মেঘ। গুড্ডু উঁকি দিয়েও সূর্য দেখতে পেল না।
কিছুক্ষণ পর যন্ত্রযান থেমে যেতে দরজা খুলে গেল। এক ঝলক বাতাস ছুটে এল। এই প্রথম গুড্ডু আর তার দিম্মা জয়া মাটির উপরের পৃথিবীতে পা দিল। ওরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো যন্ত্রমানবকে অনুসরণ করতে যেতেই এই প্রথম তার মুখে কথা শোনা গেল। সে বলল, “কন্টেনারগুলো খালি হতে সময় লাগবে এক ঘণ্টা। আর ঠিক এক ঘণ্টা সময় আপনাদের হাতে। যেখানে খুশি ঘুরে বেড়ান। কিন্তু ফিরে আসতেই হবে এক ঘণ্টার মধ্যে। হাতের ঘড়িতে অ্যালার্ম লাগিয়ে নিন”।
চারিদিকে তাকিয়ে দেখে গুড্ডু বুঝতে পারল এটা বিরাট মাঠের মতো জায়গা। কিছুদুরে উঁচু টিলা মতো। তার মাথায় ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে। দিম্মা বলল, এটাই ঝিলমিল শহরের আবর্জনা জমা করার জায়গা। বিরাট ক্রেন, এক এক করে কন্টেনার তুলে নিয়ে ডাম্পিং ট্রেনের উপরে তুলে দিচ্ছে। জয়া নাতির কাঁধে মৃদু চাপ দিয়ে বললেন, “ওদিকে তাকিয়ে সময় নষ্ট করনা দাদুভাই। চলো, আমরা একটু সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে দেখি। তোমার কোনও অসুবিধা হচ্ছে না তো?”
গুড্ডু ঘাড় নেড়ে জানায় ও ঠিক আছে। দেখে বোঝা যাচ্ছে, বড়োই দূষণ বাইরের পৃথিবীতে। মানুষের বসবাস যোগ্য নয় মোটেই। তাই এত বিধি নিষেধ। বাতাস বইছে, কিন্তু পোশাকের দরুন বোঝার উপায় নেই, সে বাতাস ঠাণ্ডা, নাকি গরম। আকাশে সূর্য দেখা যাচ্ছে ঘোলাটে রঙের। ধুলোর মেঘের আস্তরণে ঢাকা। গুড্ডু ইন্টারনেট ঘেঁটে যে সূর্য দেখেছিল, সে সূর্যের সঙ্গে এর প্রায় মিল নেই বললেই চলে। একটু এগোতেই দেখা গেল একটা শহরের ধ্বংসস্তুপ। দিম্মা বলে দিলো, এটাই একসময়ের কোলকাতা শহর। এর নিচেই আছে তাদের শহর ঝিলমিল। একটা অনেক প্রাচীন ভাঙাচোরা হেলে পড়া বাড়ির উপরে সাইনবোর্ড এখনও জ্বলজ্বল করছে, দ্য হোটেল গ্র্যান্ড। তার পাশে দেখে মনে হচ্ছে এককালের নামকরা বাজার ছিল। সামনে দিয়ে চলে গেছে লম্বা রাস্তা আর মুখ থুবড়ে পড়া ফ্লাইওভার।
কিন্তু চারিদিকে কোথাও গাছ দেখা যাচ্ছে না। গুড্ডু যে ভেবেছিল গাছ দেখবে, একটা আসল গাছ, সূর্যের আলোয় খিলখিলিয়ে ওঠা আস্ত গাছ। চারিদিকে যতদুর চোখ যায়, গাছের দেখা নেই। গ্র্যান্ডের দিকে গাছ দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনাই নেই দেখে জয়া নাতিকে নিয়ে উলটো দিকে হাঁটতে লাগলেন। হাঁটতে হাঁটতে ওরা অনেকটা দূর চলে এসে দেখেন দুটো কামান, মাঠের মধ্যে। এটা যে কামান সেটা গুড্ডুকে বলে দিতে হল না। মোবাইল অ্যাপে ছবি স্ক্যান করে তথ্য ঘেঁটে সে কথা জানতে পেরে গেছে।
গুড্ডু কামানের গায়ে হাত বোলায়। জড়িয়ে ধরে। প্রায় হাজার বছর আগে এই কামান কোলকাতা শহরে বসানো হয়। অথচ প্রাকৃতিক দূষণের রোষের হাত থেকে কী করে যেন বেঁচে রয়েছে এখনও। জয়ার হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে বলেই হয়তো একটু দূরে বসে জিরিয়ে নিচ্ছেন। গুড্ডু ঘুরে ঘুরে কামানটা দেখতে গিয়ে ছোট্ট কচি গাছের দেখা পেয়ে যেতেই আনন্দে লাফিয়ে উঠল। দিম্মাকে চিৎকার করে ডাকল। কিন্তু জয়া শুনতে পাচ্ছেন না এত দূর থেকে। গুড্ডু হাতের দস্তানা খুলে ফেলল। হাতটা একটু যেন জ্বালা করে উঠল। তবু, একটা আস্ত গাছ। অতটা সবুজ নয় তার পাতা যতখানি বইয়ের পাতায় দেখা যায়। কিন্তু একটাই গাছ শুধু। আর চারিপাশে তার সঙ্গী সাথী ত্রিসীমানার মধ্যেও নেই।
গুড্ডু নিচু হয়ে মাটিতে বসে পড়ে সাবধানে গাছটার গায়ে হাত বোলায়। ছোট্ট গাছের তিনটে কচি শাখা তিনদিকে প্রসারিত। ডান হাতের তর্জনী দিয়ে পাতার গায়ে বুলিয়ে দিয়ে এই প্রথম গুড্ডুরসারা শরীর গাছের স্পর্শে কাঁটা দিয়ে ওঠে। ওর মনে হয় যেন গাছটা এখনি কথা বলে উঠবে। গাছটা খুবই দুর্বল। সদ্য পৃথিবীর মাটিতে জন্মে এখনও পরিবেশটাকে বোঝার চেষ্টা করে চলেছে।
এক মুহূর্ত ভেবে নিয়ে গুড্ডু ঠিক করে এই গাছটা বাড়ি নিয়ে যেতেই হবে। তিরতির করে হাওয়ায় কাঁপতে থাকা গাছটাও যেন গুড্ডুকে মিনতি করে বলে, “আমায় সঙ্গে নিয়ে চল। এই ধুলো ধোঁয়ার পৃথিবীতে আমি আর মাথা তুলে বাঁচতে পারব না।
কখন জয়া এসে পিছনে দাঁড়িয়েছে গুড্ডু জানতেই পারেনি। জয়া গুড্ডুর একটা হাতের কনুইয়ের কাছটা চেপে ধরে বলে, “নিয়ে গেলেও বাঁচবে না দাদুভাই। সূর্যের আলো না পেলে ওরা বাঁচে না”।
“আমি নিয়ে যাব দিদুন। এখানে ও মরে যাবে। আমি রোজ জল দেব। আলোর নিচে রেখে দেব। এর থেকে আরও গাছ জন্মাবে। মাটির তলায় ঝিলমিলে অনেক গাছ, অনেক ফুল ফুটবে, তুমি দেখ!”, গুড্ডুর গলা কাতর হয়ে ওঠে।
জয়া নাতির জেদ দেখে তৎপর হয়ে চারিদিকে চোখ বুলিয়ে মাঠের মধ্যে ভাঙা ইটের টুকরো কুড়িয়ে এনে গাছটার চারিদিকে মাটি খুঁড়তে থাকেন। মাটি সুদ্ধু গাছ না নিয়ে গেলে ওটা মরেই যাবে। গুড্ডু পোশাকের পকেট থেকে জলের বোতল বার করে গাছটার চারিদিকে আর ওর শরীরে জল ছিটায়। স্নান করে গাছের সবুজ রঙ আরও গাঢ় হয়ে ওঠে। হাতের তালুর উপর সন্তর্পণে গাছটাকে বসিয়ে আর এক হাতের দুই আঙুলে গাছটাকে সোজা করে চোখের সামনে তুলে ধরে দেখতে যেতেই পকেটের মোবাইলে অ্যালার্ম বেজে ওঠে। ফিরে যাবার জন্য আর মাত্র দশ মিনিট। জয়া তাড়া দিয়ে ওঠেন। দূরে ডাম্পিং ট্রেন ছাড়ার ঘর দেখা যায়। ওরা হাঁটতে থাকে। মাথার উপর ঘোলাটে মেঘ পাতলা হয়ে এসেছে। সূর্যের তাপ তাই বেশি করে গায়ে এসে লাগছে। জয়া গুড্ডুকে নিয়ে জোর পায়ে হাঁটতে থাকেন।
কিন্তু একি! ডাম্পিং ট্রেন ছাড়ার ঘরের সামনে একদল মানুষ যেন জটলা পাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বলে মনে হচ্ছে। এরা কোথা থেকে এলো? আবার ওদেরই দিকে হেঁটে আসছে। এতটা দূর চলে এসে ভালো করেনি বলে মনে হতে লাগে জয়ার। শিরদাঁড়া দিয়ে ভয়ের ঠাণ্ডা স্রোত নামতে থাকে। গুড্ডু মুখ নিচু করে গাছ সামলাতে ব্যস্ত। ও খেয়ালই করেনি লোকগুলোকে।
গুড্ডুর মোবাইলের অ্যালার্ম জানাচ্ছে আর পাঁচ মিনিট বাকি আছে ট্রেন ছাড়ার। স্বয়ংক্রিয় ট্রেন দিনের শেষ বারের মতো ছেড়ে গেলে ঝিলমিলে পৌঁছানো অসম্ভব। সঙ্গী রোবোটা যে কোথায় কে জানে! লোকগুলোর শতছিন্ন পোশাক। সবাই পুরুষ বলে মনে হচ্ছে। তবে এদের শরীরে বল নেই, তাদের কঙ্কাল সার চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। জয়ার বুঝতে অসুবিধা হয় না, এরা সবাই ঝিলমিল শহরের ভয়ঙ্কর অপরাধী, যাদের শাস্তি, মাটির উপরে পৃথিবীতে নির্বাসন।
সামনে গুড্ডু আর জয়াকে দেখে এক সময়ের কুখ্যাত অপরাধীর দল বিস্ময়ে হতবাক হয়ে বোঝার চেষ্টা করে ওরা রোবো না মানুষ। পোশাক দেখে পার্থক্য বুঝতে পারে না জরাজীর্ণ নোংরা মানুষগুলো। ওদের মধ্যে একজন গুড্ডুর পথ আটকে ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলায় বলে ওঠে, “নিয়ে যাবি গাছ? কেন রে? আমরা কি খেয়ে থাকব? দে, এখনি দে। তোদের উচ্ছিষ্ট ডাস্টবিন থেকে কুড়িয়ে খেয়ে আমরা বেঁচে থাকব ভেবেছিস। আয়, তোরাও এখানে থেকে যা”।
গুড্ডু ভয়ানক ভয় পেয়ে জয়ার শরীরের আড়ালে দাঁড়ায়। তার দু-হাতের মধ্যে ধরা তখনও সেই ছোট্ট গাছটা। আর দু মিনিট বাকি। ট্রেন ছেড়ে দেবে। ঠিক তখনি ট্রেনে ঢোকার দরজা খুলে যায়। রোবো এসে দাঁড়ায়। ব্যাটন হাতে রোবোকে দেখে লোকগুলো ভয়ে দৌড় লাগায় আবর্জনার পাহাড়ের দিকে। জয়া স্নেহের হাত রোবোর কৃত্রিম শরীরের পিঠে রাখেন। রোবোরা হাসতে জানে না, কিন্তু গুড্ডুর মনে হল সেও যেন ফিক করে হেসে দিল। ট্রেন ছেড়ে দিল। পৃথিবীর মাটি ছেড়ে চলে যাচ্ছে বলে বুকের কোনে একটু ব্যাথা জমে উঠলো জয়ার। গুড্ডু কিন্তু দিব্যি গাছ নিয়ে মেতে আছে। আর তার পাশে দাঁড়িয়ে রোবোটাও অবাক হয়ে দেখছে গুড্ডুর মুঠোর ভিতর তিরতির করে কাঁপতে থাকা চারা গাছটা। জানলার বাইরে তাকিয়ে জয়া দেখলেন ধোঁয়াটে কুয়াশার মতো দৃশ্যপটে শাস্তি পাওয়া লোকগুলো সতৃষ্ণ নয়নে ট্রেনটার দিকে তাকিয়ে।
Tags: অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়, কল্পবিজ্ঞান গল্প, গল্প, তৃতীয় বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, সবুজের হাতছানি