রা-চীন
লেখক: পরীক্ষিৎ দাস
শিল্পী: দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য্য (চিত্রচোর)
বিস্ফোরণের প্রবল শব্দে ঘুম ভেঙে ধড়মড় করে উঠে বসে কমল। মোবাইলের ঘড়িতে দেখে রাত তখন বারোটা তেত্রিশ। টেনে টেনে কয়েকটা বড়ো শ্বাস নেওয়ার পরও বুক ধড়ফড়ানিটা কমতে চাইছে না কিছুতেই। শব্দের উৎসের সন্ধানে বিছানা ছেড়ে জানলার সামনে এসে দাঁড়াতেই নাকটা কুঁচকে ওঠে কমলের – বাতাসে মিশে আছে বারুদের গন্ধ!
দিনটা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডে-ওয়ান। কেউ জানতেও পারেনি যে চুপিচুপি হাত মিলিয়েছে রাশিয়া আর চীন। উদ্দেশ্য – সর্বশক্তিমান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া। তবে তার আগে… তবে তার আগে!
রা-চীনের ঘরের পাশেই ভারতবর্ষ। বিগত কয়েক দশক ধরে অগ্নি, শক্তি, পৃথিবীর মতো অজস্র শক্তিশালী ক্ষেপণাস্ত্র তৈরী করেছে সেই দেশ। সঙ্গে প্রভূত পরিমাণ অর্থ ঢালা হয়েছে সামরিক বাহিনীকে প্রযুক্তিগত দিক থেকে আরও জোরদার ও উন্নত করে তোলার পেছনে। কিন্তু আপাতত ভারতবর্ষের ভুল একটাই, যা কিনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কূটনৈতিক সখ্যতা, যার মাশুল ভারতবর্ষকে গুনতে হবে আগামী কয়েকদিনের ভিতর।
রা-চীন ভয় পেয়েছিল ইন্দো-আমেরিকা জোটকে। ঘরের শত্রু বিভীষণ হয়ে উঠতে পারে ভারতবর্ষ, এই আশঙ্কায় সে দেশকে শেষ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় তারা। অতএব রাতের অন্ধকারে ভারতীয় সেনাবাহিনী ও নেভির অগোচরে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের এয়ার-স্পেসে শয়ে শয়ে যুদ্ধবিমান প্রেরণ করে এই আচমকা হামলার ছক। প্রকৃত শত্রু যুক্তরাষ্ট্রের চৌকাঠে পা রাখবার আগেই যুদ্ধজয়ের নির্ভুল পরিকল্পনা।
রা-চীনের পরিকল্পনা মাফিক রাত সাড়ে বারোটায় দেশের অন্যান্য মেট্রো শহরগুলির মতো কলকাতার আকাশেও একঝাঁক যুদ্ধবিমান পরিলক্ষিত হয়। ঠিক বারোটা তেত্রিশে আকাশ থেকে নেমে আসে প্রথম মিসাইল, যার নাম ‘প্রস্তি’ (রাশিয়ান) – অর্থ ‘সরি’ বা দুঃখিত। আর তা বিখ্যাত হাওড়া ব্রিজকে ফোঁপড়া করে দেয় চোখের নিমেশে।
মাথার ওপর দিয়ে সশব্দে উড়ে যাওয়া একঝাঁক অচেনা এরোপ্লেন, চোখ ধাঁধানো অগ্নিস্ফুলিঙ্গ, বিস্ফোরণের বুক কাঁপানো শব্দ, আতঙ্কিত মানুষের চিল চিৎকার – জানলার বাইরের জগৎটা হাড়-হিম করে দেয় কমলের।
ঠিক কী ঘটছে বুঝে ওঠবার আগেই গলা বুজে শ্বাসরোধ হয়ে আসে তার। ছটফট করে ঘুমটা ভাঙতেই খেয়াল করে একটা পা বিছানার বাইরে শূন্যে ঝুলে আছে, আর ঘামে ভিজে গেছে পরনের স্যান্ডো গেঞ্জিটা। বেচারা ভুলেই গেছে ঘরের আলো নেভাতে। মাটিতে পড়ে রয়েছে জর্জ অরওয়েলের ১৯৮৪। বইটা পড়তে পড়তেই ঘুমিয়ে পড়েছিল কমল। বইটা তুলে মাথার কাছে রেখে দিতে দিতে ভাবে অরওয়েল, ব্র্যাডবারি, হাক্সলির বইগুলো পড়া এবার কমাতে হবে। ভয়ঙ্কর স্বপ্নটা যেন অরওয়েল নিজে হাতে বুনছিল, তাও আবার বাংলা ভাষায়। কমল যেন যুদ্ধরূপী ‘বিগ-ব্রাদার’-এর সম্মুখে নতজানু অসহায় উইনস্টন, সর্বনাশকারী হারিকেনের সামনে তুচ্ছ খড়কুটো যেমন।
নাহ! স্বপ্নটা নিয়ে আর ভাবতে চায় না সে। আনমনে খানিক মাথা চুলকে নিয়ে বাথরুমের দিকে চলে যায় নিঃশব্দে।
বাথরুম থেকে ফিরে ঘরের আলোটা নেভানোর পর একাকীত্বের গভীরতাটা ভালো মতোই টের পায় কমল মুখুজ্জে। বাবার মুখটা তো মনেও পড়ে না, আর মা চলে যাওয়ার পর বিয়েটা করে ফেললেই হয়তো ভালো হত। তবে এখন আর ওসব ভেবে কী লাভ? আটত্রিশের এই শীর্ণকায়, সামান্য এক নিউজপেপার কলামিস্টকে বিয়ে করবে কে?
ফের বিছানায় নিজের হতাশাগ্রস্ত অস্তিত্বটাকে মেলে দেওয়ার মুহূর্তে তার ছোট চৌকোণা ঘরের সবটুকু আলোয় ভরিয়ে দিয়ে বিদ্যুৎ চমকে ওঠে বাইরে কোথাও। আর তারপরই যেন মেঘের গর্জন। জোরালো, এবং পর পর বেশ কয়েকবার। কিন্তু বৃষ্টির গন্ধের বদলে সন্দেহজনক একটা গন্ধ নাকে এসে ঠেকতেই একরাশ ধোঁয়াশা বুকে নিয়ে জানলার সামনে এসে দাঁড়ায় সে। টের পায় বাতাসে ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে বারুদের গন্ধ।
ঝলসে উঠেছে পোস্তা নিবাসী কমলের বাড়ির থেকে কিছুটা দূরের আকাশ। শোরগোল দানা বাঁধতে শুরু করেছে ঘিঞ্জি শহরটার অলিতে গলিতে। অচেনা এক আতঙ্কে গলা শুকিয়ে আসে কমলের। শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে আসা লিকুইড নাইট্রোজেনের হাত ধরে দ্রুত ফুরোতে থাকে তার সময়। কারণ মধ্যরাতের নৈঃশব্দ চিরে ‘প্রস্তি’ সদ্য ছুঁয়েছে হাওড়া ব্রিজের লৌহ-কাঠামো! বাকিটা যেন একটা স্বপ্নের মতো। খুব করে ভুলতে চাওয়া একটা স্বপ্নের মতো!
Tags: অনুগল্প, তৃতীয় বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য্য, পরীক্ষিৎ দাস, রা-চীন