অতিমাত্রিক
লেখক: সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়
শিল্পী: দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য্য (চিত্রচোর)
“অর্ণব বাড়ি আছিস?”
“কীরে, এই অর্ণব – বাড়ি আছিস?”
ভাগ্যিস এ পাড়ায় লোকজন বিশেষ থাকে না, আর যে দু-চার ঘর ছেলেছোকরা থাকে, তারাও কাল কালীপুজোর আনন্দে কারণবারি গিলে এখন মধ্যযামে বিচরণ করছে। অনেকক্ষণ দরজা খটখট, চেঁচামেচি আর ঘণ্টি বাজানোর পর, চোখ রগড়াতে রগড়াতে দরজা খুলল অর্ণব। চোখ লাল, মুখে কাঁচা ঘুম ভেঙে যাওয়ার একরাশ বিরক্তি। তবে দরজা খুলে কিংশুকের মুখ দেখেই ওর বিরক্তি উধাও। সোল্লাসে বলল, “আরে আয় আয় – একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম রে। বুঝতেই তো পারছিস, গবেষণার বিষয়টা নিয়ে একেবারে শেষ পর্যায়ে আছি। তাই রাত-টাত জেগে যা তা অবস্থা।“ কিংশুকে নিজের ঘরে নিয়ে যায় অর্ণব, একটা হাত ভাঙা চেয়ার এগিয়ে দিতে দিতে বলে, “এই এখানে বস।“
ঘরের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নেয় কিংশুক। শেষ সপ্তাহে যা দেখে গেছিল, তার থেকেও খারাপ অবস্থা হয়েছে ঘরের। আর অর্ণবকে দেখে তো লাগছে দুদিন পরই না হসপিটালে ভরতি করতে হ্য় – চেহারা ভেঙে গেছে, চুল উসকোখুসকো, চোখের তলায় কালি পড়তে আরম্ভ করেছে। সারা ঘর জুড়ে শুধু বই, বিভিন্ন ড্রয়িং, তার, ছোটখাটো যন্ত্রপাতি, ল্যাপটপ, মোবাইলের চার্জার গড়াগড়ি দিচ্ছে এদিক থেকে সেদিক। মোবাইলটা কাত হয়ে পড়ে আছে একদিকে, দেখেই মনে হচ্ছে ব্যাটারির অভাবে মৃত- তাই অর্ণবকে মোবাইলে ধরা যায়নি সকাল থেকে। একটা অদ্ভুতদর্শন যন্ত্রও উঁকি দিচ্ছে ঘরের এক কোণ থেকে। সারা ঘরের এই হাড় হাভাতে অবস্থার সঙ্গে অর্ণবকে মেলাতে পারছিল না কিংশুক। সে যতদূর অর্ণবকে চেনে, সেই অর্ণব কিন্তু অনেক গোছালো, যতই গবেষণায় মগ্ন থাকুক, গবেষকের চারপাশকে পরিছন্ন রাখার পাঠ কিংশুক অর্ণবের থেকেই প্রথম নেয়- সেই অর্ণবের ঘরের এবং নিজের এই দশা? গত সপ্তাহের অর্ণবের সঙ্গে এ সপ্তাহের অর্ণবের যেন আকাশপাতাল তফাৎ। ওকে শুধু চেনা যাচ্ছে ওর চোখের দিকে চাইলে, কোটরের ভেতর থেকে জ্বলজ্বল করছে তার চোখ দুটি, আবিষ্কারের আনন্দে – এতদিনের পরিশ্রমের সার্থকতায়।
অর্ণব বিশ্বাস এবং কিংশুক মিত্র এই দুজনের বন্ধুত্ব শুরু হয় গ্র্যাজুয়েশনের সময় থেকে। কিংশুক ছিল মেধাবি – কিন্তু দ্বিতীয় সারির- আর অর্ণব ছিল যাকে বলে ঝকঝকে জিনিয়াস। এক অজ্ঞাত কারণে, এই দুজনের মধ্যে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে একটা অপার সখ্যতা। অর্ণব ওই সময় থেকেই নানা আবিষ্কারে মগ্ন- ক্লাসে, বা ফ্যাকাল্টির মধ্যে সেই আবিষ্কারের মূল্য কেউ দিক বা না দিক, কিংশুকের কাছে অর্ণব আলভা এডিসনের থেকে কোনও অংশে কম ছিল না। এই অপার আনুগত্যই ছিল ওদের বন্ধুত্বের প্রথম ধাপ। ধীরে ধীরে পদার্থবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করে, দুজনেই মাস্টার্স করে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। অর্ণবের বিষয় ফলিত পদার্থবিদ্যা হলেও, তার নজর ছিল এক অন্য জগতের দিকে – কিছুটা যাকে বলে প্যারানরমাল ঘেঁষা। সাধারণত পিএইচডি করার সময় ছাত্ররা তক্কে তক্কে থাকে মৌলিক গবেষণার সময় এবং পরিশ্রম বাঁচিয়ে কেমন করে অন্য গবেষণা টুকে টার্মটা শেষ করে ফেলা যায়। কিংশুক মোটামুটি সেই দিকে এগোলেও, অর্ণব ছিল উজ্জ্বল ব্যাতিক্রম। নিজের গবেষণার কাজের জন্য অর্ণব হোস্টেল ছেড়ে দেয়, থাকতে শুরু করে অপেক্ষাকৃত নির্জন শহরের একপ্রান্তে, তিন কামরার একটি ঘর ভাড়া নিয়ে। ঘরের মালিক বলতে দুই বুড়োবুড়ি, যারা মাস গেলে ভাড়া পেলেই খুশি – অন্য ব্যাপারে নাক গলানো তাঁদের স্বভাব নয়। আর অর্ণবকে মোটামুটি পর্যবেক্ষণ করলেই বোঝা যায়, তার মন সাধারণ পার্থিব সুখের জন্য লালায়িত নয়, বেশ অন্য ধরনের ছেলে সে। কিংশুকের নিজের গবেষণার চাপ একটু কমলে, সে অর্ণবের কাছে যাতায়াত শুরু করে। গবেষণার নানা জিনিসপত্র দিয়ে, ভালো ভালো খাবার দাবার এনে সাহায্য করে কিংশুক এই মা-মরা ছেলেটিকে। অর্ণবের বাবা ব্যবসায়ী, তাই পয়সা দিয়ে সাহায্য করা ছাড়া অর্ণবের জীবনে তাঁর উজ্জ্বল অনুপস্থিতি। অর্ণবের হৃদয়ের এই শূন্যস্থান কিংশুক পূর্ণ করে দিয়েছে তার মনযোগী অভিভাবকত্ব দিয়ে, তাই সুখে দুঃখে কিংশুককে ছাড়া অর্ণবের এক পাও চলে না।
কদিন আগে যখন অর্ণব কিংশুককে ডেকে পাঠায়, তখন কিংশুক বলেছিল, “কী এত ছাইপাঁশ গবেষণা করছিস ভাই? টার্মটা তাড়াতাড়ি শেষ কর, তারপর চল কলেজ সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় বসি – তোর এইসব জিনিস কেউ বুঝবে না।“ অর্ণব চুপ করে ছিল কিছুক্ষণ, তারপর বলেছিল “তুই জানিস আমি কী নিয়ে পড়ে আছি? যদি জানতিস তাহলে ব্যাপারটাকে এভাবে ছাইপাঁশ বলে উড়িয়ে দিতে পারতিস না। শোন, কেউ জানে না – আমি পিএইচডির গবেষণা করছি না- আমার ইন্টারেস্টটা অন্য।“ কিংশুক ভীষণ অবাক হয়েছিল শুনে, “তার মানে?? তুই তাহলে করছিস কী এতদিন ধরে? আর আমি এতদিন আসছি, এটুকুও আমাকে জানাসনি – কেন তুই তোর কেরিয়ারটা নিয়ে এভাবে ছেলেখেলা করছিস বলতো??” কিংশুক রেগেই গিয়েছিল, “বেকার বেকার এতটা সময় নষ্ট করলি, তোর গাইড সুনির্মল স্যার কিছু বলে না তোকে?” উত্তরে অর্ণব ঠোঁটের কোণে একটু হেসে বলেছিল, “আমার কোনও গাইড নেই কিনু, তোকে প্রথমে বললে তুই রিঅ্যাক্ট করতিস, তাই তখন বলিনি, ওই সুনির্মল স্যার বলে কেউ নেই। না বলার আর একটা কারণ, আমার গবেষণা ঠিক দিকে যাচ্ছে কিনা সেটা নিয়েও আমার যথেষ্ট সন্দেহ ছিল। এখন আর নেই, আমি জানি আমি এগিয়ে চলেছি আমার অভীষ্ট লক্ষ্যের দিকে।”
সেদিন কিংশুককে গবেষণার ব্যাপারে একটু আলোকপাত করেছিল অর্ণব, “তুই তো জানিসই, আমার বেসিক আগ্রহ পদার্থবিদ্যার সঙ্গে প্যারানরমাল বা আধিভৌতিককে মেলানো। আমার ছোট থেকেই একটা গভীর চিন্তা ছিল জানিস – যেমন ধর, এই, মানুষ মৃত্যুর পর কোথায় যায়। বিজ্ঞান বলে কোথাও যায় না, মিলিয়ে যায় পঞ্চভূতে, মানে বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলে জল, মাটি, বায়ু, আকাশ এবং অগ্নি। সে না হয় বুঝলাম যে নশ্বর দেহ মিলিয়ে যায়, কিন্তু এই যে প্রাণশক্তি, যা আমাদের মধ্যে থেকে সব কিছুকে চালনা করছে, সে যায় কোথায়? সে কি বাসা বদল করে, নাকি চলে যায় অন্য কোথাও, যেখানে আমরা সাদা চোখ দিয়েও তাকে দেখতে পাই না? এখন তো অনেক রকম জিনিস আবিষ্কার হয়েছে এবং হয়ে চলেছে, বিভিন্ন কম্পাঙ্কের আলো থেকে শুরু করে, সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর বস্তুকেও দেখার পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে, কিন্তু এই প্রাণ ব্যাপারটাই পুরো ধোঁয়াশা। আমি দেখতে চেষ্টা করছি, এর সত্যি কোনও অস্তিত্ব আছে কিনা নাকি এই আত্মা ব্যাপারটা পুরোটাই আপ্তবাক্য? না না চমকে উঠিস না, মড়া ধরে এনে পরীক্ষা আমি করব না, হা হা – তাহলে বুড়োবুড়ি আমাকে কালই পত্রপাঠ বের করে দেবে। আমার পরীক্ষা খুব সূক্ষ্ম – একটা যন্ত্র আবিষ্কারের চেষ্টায় আছি। বাকিটা তোকে পরে জানাব। তুই একবার সামনের সপ্তাহে আয়, কালীপূজোর পর।”
সেদিনের পর আজ। কদিন কিংশুক কিছুতেই ভালো করে রাতে ঘুমাতে পারেনি, কেবলই ভেবে গেছে কী সেই আবিষ্কার? কতবার বাড়ির বাইরে বেরিয়ে ভেবেছে একবার অর্নবের মেসে ঢুঁ মেরে আসে – কিন্তু সে অর্নবকে চেনে। অভিজ্ঞ গবেষকের মতো সে গবেষণার গোপনীয়তা রক্ষা করে চলবে ততদিন পর্যন্ত, যতদিন না সে একশো শতাংশ নিশ্চিত হতে পারছে তার ফলাফলের ব্যাপারে। সেদিন অর্ণবকে বেশ ঝকঝকে লাগছিল, জিনিসপত্রও বেশ গোছানো ছিল, পাকা গবেষকদের মতো, অর্ণব এক জায়গায় নোটও রাখছিল। আজ দেখে মনে হল, সব কিছু যেন এলোমেলো হয়ে গেছে। আর অর্ণবের ওপর যেন কিছু একটা ভর করেছে! দু’হাত মুঠিতে পাকিয়ে ঘরের মধ্যে পায়চারি করছে সে, এক খাঁচায় আবদ্ধ জন্তুর মতো।
“কীরে, আমাকে বসিয়ে রেখে দিলি, কিছু বলবি না?? তোর হয়েছেটা কী বলত?” অর্ণব পায়চারি বন্ধ করে বন্ধুর মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। “আমি বুঝেছি কিনু, অস্তিত্ব আছে, সবার অস্তিত্ব আছে, আমাদের চারপাশেই আছে, কিন্তু আমাদের দেখার চোখ নেই।” বন্ধুর গলার আওয়াজে কীরকম যেন একটা অস্বস্তি হতে লাগল কিংশুকের – ঘরের মধ্যে শুধু একটা ছোট আলো জ্বলছে, জানলা বন্ধ, ভেতরের বাতাসটাও গুমোট হয়ে থমকে আছে যেন । এতক্ষণ মনে হয়নি এসব, কিন্তু এখন কিংশুকের গাটা কীরকম ছমছম করে উঠল। কিংশুক ভূতপ্রেত কিছুই মানে না, বিজ্ঞানের ছাত্র সে, কিন্তু এই মুহূর্তে, ঘরের পরিবেশ এবং অর্ণবের গলার গমগমে স্বর এই দুয়ের অনুনাদেই হয়তো জন্ম নিল এক ক্ষণিক আতঙ্কের। কিংশুক লাফিয়ে উঠে বলল, “দাঁড়া, জানলাটা খুলে দিই, বড্ড গুমোট হয়ে আছে ভেতরে। থাকিস কী করে এভাবে?” অর্ণব একলাফে জানলার সামনে এসে কিংশুকের রাস্তা রোধ করে দাঁড়াল। “কিনু, ভাইটি আমার, প্লিজ জানলা খুলিস না – আমার গবেষণার কিছু কাজ এখনও বাকি আছে, আমি কৃত্রিম আলোতেই সেটা শেষ করতে চাই। আমার আর দু-চারটে ধাপ অতিক্রম করা বাকি, তারপরই আমি দিনের আলোয় আসব। তার আগে তোকে দু-একটা কথা জানিয়ে রাখি, তুই ভয় পাস না কিন্তু। দাঁড়া, একটু কফি করে আনি, ঘুম ঘুম ভাবটাকে কাটাতে হবে। তার ওপর গলাটাও শুকিয়ে গেছে।”
অর্ণব কফি বানাতে চলে গেল অন্য ঘরে। বাড়িটা বেশ বড়, তিনটে ঘর আর একটা বাথরুম। একটাকে অর্ণব ভাঁড়ার ঘর বানিয়েছে, আর একটা ওর কাজের ঘর কাম শোওয়ার ঘর – আর একটা আগের দিনও বন্ধ দেখেছে কিংশুক। ভাঁড়ার ঘর থেকে কফির পেয়ালার ঠুং ঠাং শব্দ শুনতে শুনতে, কিংশুক এগোল তালাবন্ধ তৃতীয় ঘরের দিকে। আজ অবশ্য সেখানে তালা নেই, শুধু ভেজানো রয়েছে পাল্লাটা। একটু ঠেলতেই খুলে গেল। ঘরে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার, ভালো করে নজর চলে না। চোখ অন্ধকারে একটু সইতেই নজরে পড়ল ভেতরে আসবাব বলতে একটা মাত্র চেয়ার, ঘরের মাঝখানে বসানো। সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার যেটা কিংশুকের শরীরে সেই ছমছমানিটা ফিরিয়ে নিয়ে এল, সেটা হোল চেয়ারটার অল্প অল্প দুলুনি! ওটা আরামকেদারা নয় সেটা কিংশুক হলফ করে বলতে পারে, সাধারণ কাঠের চেয়ার। কোনও হাওয়াতে ওই চেয়ার দুলবে না, যদি না সেটার ওপর কেউ বসে সেটাকে নিজের দেহের ওজনে নাড়ায়। কিংশুককে আরও অবাক করে দিয়ে, চেয়ারের দুলুনি বন্ধ হয়ে গেল – যেন চেয়ারের ওপর বসে থাকা অদৃশ্য বস্তুটি ঘরে তার অস্তিত্ব টের পেয়ে গেছে। এতক্ষণ কিংশুক খেয়াল করেনি, কিন্তু এখন তাকিয়ে দেখল, ঘরের মেঝেতে পুরু করে বালির মতো কিছু ফেলা রয়েছে – আর বালির সীমানা শেষ হয়ে গেছে, দরজার কাছে এক জায়গায় এসে। চেয়ারের চারপাশ ঘিরে বালির এক বৃত্ত তৈরি করা হয়েছে। হঠাত, কিংশুক লক্ষ্য করল, সেই বালির ওপর একটা ছোট গর্ত তৈরি হোল, যেটা একটু আগেও ছিল না। যেন শূন্য থেকে নেমে এল গর্তটা। অসীম আতঙ্কে কিংশুকের চুল খাড়া হয়ে উঠল যখন দেখল সেই গর্তের সামনে আরও একটা গর্ত তৈরী হল, তারপর আর একটা। প্রতিটা গর্ত এগিয়ে আসছে তার দিকেই অর্থাৎ দরজার দিকে লক্ষ্য করে। সারা শরীর অবশ হওয়ার আগে, কিংশুক কোনওরকমে দরজাটা টেনে বন্ধ করে দিল, আর তখনই একটা ঠান্ডা হাত এসে পড়ল ওর ঘাড়ের ওপর।
আচমকা ওরকম স্পর্শে ঝট করে ঘুরে দাঁড়াল কিংশুক, বিস্ফারিত চোখে দেখল, অর্ণব দাঁড়িয়ে আছে ঠিক পিছনে, মুখে একটা অব্যক্ত ক্রোধ, চোখগুলো ধকধক করে জ্বলছে – হিসহিস স্বরে বলল, “তোকে কে অনুমতি দিয়েছে এখানে আসতে? আমাকে জিজ্ঞেস না করে এখানে কেন এসেছিস তুই? ঘরে চল, কথা আছে।” এটা বলেই, পেছনের সেই অভিশপ্ত ঘরের দরজা খুব সাবধানে টেনে বন্ধ করে দিল অর্ণব, তারপর কিংশুকের হাত ধরে নিয়ে চলল তার স্টাডির দিকে। এত কম সময়ের মধ্যে এতগুলো ঘটনা ঘটে যাওয়াতে, কিংশুকের স্নায়ুর ওপর চাপ পড়েছিল খুব- গলাটা শুকিয়ে গেছিল। তার ওপর সারা বাড়ি বন্ধ, ভ্যাপসা একটা গরম ভাব – মনে হচ্ছিল এখুনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে ছুটে পালিয়ে যায় বাইরের খোলা হাওয়াতে, কিন্তু মনের মধ্যে কৌতূহলও সীমাহীন ভাবে মাথাচাড়া দিচ্ছে। ঘরে বসে কফির কাপ এগিয়ে দিল অর্ণব, “নে কফি খা, তার আগে একটু জল খেয়ে গলাটা ভেজা – দেখে মনে হচ্ছে খুব শক পেয়েছিস যা হোক।” টেবিলের ওপর রাখা বোতলটা থেকে এক ঢোঁক জল খেয়ে কফির কাপে চুমুক দিল কিংশুক। কফির আমেজেই আবার তার হারিয়ে যাওয়া সাহসটা ফিরে পাচ্ছিল সে। “অবু, ক্ষমা কর- এবার তো খুলে বল কী ব্যাপার? কেন ওই ঘরটা এত গোপনীয়? কী পরীক্ষা চালাছিস এখানে বসে তুই? ওই ঘরে কে আছে? আমার কিন্তু পুরো ব্যাপারটা একদম ভালো লাগছে না। তুই করছিসটা কী?” ঘড়ঘড় করে আওয়াজ বেরল কিংশুকের কণ্ঠ থেকে।
“তোকে বলব বলেই ডেকেছি কিনু, কিন্তু আমাকে বল, আমার অনুমতি ছাড়া কখনও ওই ঘরের দরজা তুই খুলবি না। তোকে সবই বলার জন্যই ডেকেছি – কিন্তু প্রতিজ্ঞা কর, বাইরের কেউ যেন এ ব্যাপারে কিছু জানতে না পারে। কারণ এটা আমার আবিষ্কার, এবং আমার সব কিছু, আমি যতক্ষণ না বলব, কোনওমতেই এসব জিনিস প্রকাশ করা যাবে না।” অর্ণবের কণ্ঠস্বর শেষ দিকে গম্ভীর হয়ে এল। এভাবে কোনওদিন কথা বলেনি অর্ণব ওর সঙ্গে, কিংশুক ভাবল – কিন্তু ব্যাপারটা জানতে ইচ্ছেও করছে খুব। “আচ্ছা ঠিক আছে, ঠিক আছে, বলব না; এখন ভনিতা রাখ আর বল কী ব্যাপার” – কিংশুক অধৈর্য হয়ে জিজ্ঞেস করল।
গলাটা একটু ঝেড়ে নিয়ে অর্ণব শুরু করল অনেকটা লেকচারি ঢঙে, “তুই নিশ্চয়ই জানিস যে আমাদের চোখ একটা বিশেষ কম্পাঙ্কের আলো ছাড়া অন্য আলো দেখতে পায় না, আমাদের কানও একটা নির্দিষ্ট কম্পাঙ্কের শব্দতরঙ্গ ছাড়া অন্য কিছু শুনতে পায় না। তাই মাছির পাখা নাড়ার আওয়াজ, পিঁপড়ের ডাক এসব আমরা কোনওদিনই সাদা কানে শুনতে পাই না। আমাদের বিশেষ বিশেষ যন্ত্রের সাহায্য নিতে হয় এসব শোনার বা দেখার জন্য। আমার অনেকদিনের ধরেই মনে হত, যে আমাদের পৃথিবীতেই এমন আর একটা অংশ আছে, যাকে বিজ্ঞানের ভাষায় ডাইমেনশন বা মাত্রা বলা যায়, যেখানে আমাদের সমকক্ষ আর একটা দুনিয়া বর্তমান। যেটা একটা নির্দিষ্ট শব্দ তরঙ্গ বা আলোক তরঙ্গের স্তরে অবস্থিত। আমরা যেমন রেডিওর নব ঘুরিয়ে একটা বিশেষ স্টেশন ধরি, সেরকমই এমন একটা যন্ত্রের পরিকল্পনা যদি করা যায় যে সেটার নব ঘুরিয়ে আমি সম্পূর্ণ একটা অন্য জগতে পৌঁছোতে পারব, যেটা আমাদের দুনিয়ার সঙ্গে সমান্তরাল ভাবে অবস্থিত, কিন্তু কোনওভাবেই দৃশ্যমান বা স্পর্শযোগ্য নয়, তাহলে একটা নতুন দিগন্ত খুলে যাবে। কিন্তু ভাবনাচিন্তা এক জিনিস, আর কাজে করে দেখানো আর এক জিনিস। যখন করতে নামলাম, তখন দেখলাম সে জিনিস বানানোর জন্য প্রচুর খরচ হওয়ার সম্ভাবনা, তাই আমাকে সস্তার যন্ত্রের দিকে নজর দিতে হল, আর সেটা করতে গিয়েই যন্ত্রে কিছু খুঁত থেকে গেছে যেটা আমি এখনও ঠিক করে উঠতে পারিনি।” শেষের কথাগুলো স্বগতোক্তির মতো শোনাল যেন। কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে অর্ণব আবার শুরু করল, “ যাইহোক, অনেকদিন কঠিন পরিশ্রম করার পর একটা দিশা খুঁজে পেয়েছিলাম যন্ত্রটা বানানোর। প্রথমে শব্দতরঙ্গকে একদম প্রায় শূন্য থেকে কয়েক লাখ তরঙ্গ দৈর্ঘ্য অবধি নিয়ে যাওয়ার পদ্ধতি আবিষ্কার করলাম, তারপর চেষ্টা করতে থাকলাম সেই নির্দিষ্ট স্টেশনকে খুঁজে বার করার। এই যাত্রাপথে কতরকম শব্দ যে শুনেছি তার ইয়ত্তা নেই, পিঁপড়ের ডাক শুনেছি, মাছির বাক্যবিন্যাস শুনেছি, আবার উচ্চতরঙ্গে অনেক নাম না জানা আওয়াজও শুনেছি। প্রতিবারই মনে হত, এবার হয়তো খুঁজে পেলাম, কিন্তু প্রতিবারই হতাশ হতে হয়েছে। শব্দের পাশাপাশি, আলোক তরঙ্গের ওপরও কাজ শুরু করেছিলাম একই রকম ভাবে, শব্দের জগতকে দৃশ্যমান করে তুলতে। শেষে সন্ধান পেলাম, গতবছর এই সময়টাতেই। আমরা জানি, যেমন বছরের একদিন সূর্য পৃথিবীর খুব কাছে চলে আসে, বা প্রতি এগারো বছর অন্তর সৌরঝড়ের একটা অংশ উড়ে আসে পৃথিবীর দিকে, সেরকমই বছরের দু-একটি দিনেই ওই সমান্তরাল জগতের সঙ্গে আমাদের নশ্বর জগতের অতিমাত্রিক ভেদাভেদ কমে আসে, দেওয়ালটা হয়ে আসে ভঙ্গুর। সেটাকেই বলা হয় হ্যালোউইন বা আমাদের এখানে ভূত চতুর্দশী। হয়তো আমাদের অনেক আগেই, পৃথিবীর প্রাচীন বিজ্ঞানীরা আধিভৌতিক গবেষণায় অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিলেন, তাই এই দিনগুলোর বিশেষ তাৎপর্য আছে। যাইহোক, যে কম্পাঙ্কে শব্দের সন্ধান পেলাম, সেটাকেই আলোর সঙ্গে তুলনা করে দেখা পেলাম সে জগতের। এই অবধি ব্যাপারটা খুব একটা শক্ত ছিল না, কারণ আমাদের চোখ দেখে দৃশ্যমান কম্পাঙ্কের আলো, আর আমাদের কান শুনতে পায় ম্যাক কম্পাঙ্কের শব্দ, তাই তাদের অনুপাত বের করে, সেটা দিয়ে ওই জগতের আলোর কম্পাঙ্ক ধরা কঠিন ছিল না মোটেই। কিন্তু গোল বাধল তার পরেই…” এত অবধি বলে চুপ করে রইল অর্ণব। মনে হল, ক্লান্ত লাগছে তাকে। এদিকে কিংশুকের বিস্ময় বেড়েই চলেছে অর্ণবের প্রতিটি কথায়, “থামলি কেন, বল।” অর্ণব একটু হাসল, “বলব, ধৈর্য হারাস না। কদিন আমার ওপর দিয়ে যা গেছে – যাক পরে আসছি সেসব কথায়। কিছু জিনিস আমি জানতে পেরেছি যা হয়তো আমরা মোটামুটি সবাই জানি, কিন্তু বিশ্বাস করি না। এই মাত্রাতে যেসব বিদেহীকে আমি চাক্ষুষ করেছি, তারা মোটেই সুবিধের নয়। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আরও অনেক কম্পাঙ্কে অনেক জগৎ আছে, বিভিন্ন স্তরে স্তরে। কিন্তু বহুকষ্টে যেটাকে খুঁজে বের করেছি, আমার সমস্ত ধ্যানজ্ঞান কেন্দ্রীভূত ছিল ওই নির্দিষ্ট জগতকে উদ্দেশ্য করেই। এই জগতের একটা নির্দিষ্ট সীমা আছে, মানে আমি গত একবছর ধরে লক্ষ করেছি যে, বিদেহীদের সংখ্যা কিন্তু নির্দিষ্ট, ওরা বোধহয় কোনও বিশেষ সাহায্য ছাড়াই এক জগৎ থেকে অন্য জগতে চলে যেতে পারে কিন্তু ফিরে আসতে পারে না এই নশ্বর দুনিয়াতে। সংখ্যা কোনওভাবে বেড়ে গেলেই, ওরা অন্য কোথাও চলে যায়। এই অদ্ভুত জগতটা কীরকম যেন ভাসা ভাসা, বেশিক্ষণ নজর রাখলে শরীরে কেমন একটা অস্বস্তি হতে থাকে। কিন্তু তবু ওদেরকে লক্ষ করে গেছি গভীরভাবে। কিন্তু বুঝতে পারিনি, ওদের থেকেও আমাকে সমান ভাবে লক্ষ করা হচ্ছে। এতদিন ওদের খেয়াল রেখে আমার মনে হয়েছে, আমার যন্ত্র সেই স্তরকেই ধরতে পেরেছে যাকে আমরা বলি এন্ট্রি লেভেল বা প্রাথমিক স্তর। সহজ ভাষায় বলতে গেলে, এটা সেই স্তর যেখানে জীব মৃত্যুর ঠিক পরেই এসে প্রবেশ করে। এরপর হয়তো চলে যায় কোনও অন্য স্তরে, কিন্তু সেটার খোঁজ আমি এখনও পাইনি। আরও খেয়াল করে মনে হয়েছে, এখানে সেই সব আত্মাই বেশি থাকে, যাদের মনের মধ্যে কামনা বাসনার দৈহিক আবিলতা এখনও মুছে যায়নি, তাদের ঘোরাফেরা অত্যন্ত হিংস্র, যেন জোর করে তাদের ধরে রাখা হয়েছে এখানে। তারা ঘোর চেষ্টায় থাকে এই নশ্বর দুনিয়াতে ফিরে আসার, তাদের অতৃপ্ত কামনার শেষ পরিণতি দেখে যাওয়ার, হয়তো সেই জন্যই মানুষ মাঝে মাঝে প্রেত প্রত্যক্ষ করে। তবে দেখে বুঝেছি, সব আত্মা এটা করতে পারে না, কামনা বাসনার টান যাদের বড় বেশি, তারাই বহু চেষ্টার পর দুই জগতের যোগসূত্রের রাস্তাটা খুঁজে পায়। এদেরই অনুসরণ করে আমি বার করতে চেষ্টা করেছি, সেই যোগসূত্র, সংক্ষেপে সেই রাস্তা, যেখান দিয়ে পাওয়া যাবে ওদের জগতে প্রবেশপথ, জীবন্ত অবস্থায় – যেন যমালয়ে জীবন্ত মানুষ।” চোখ চকচক করে উঠল অর্ণবের, “আর সেই প্রবেশপথ আমি পেয়েছি দুদিন আগে, ভূত চতুর্দশীর দিনেই।“ অর্ণবের কণ্ঠস্বর মিলিয়ে যেতেই, একটা তীব্র খটখট শোনা গেল ওই রহস্যময় ঘরের ভেতর থেকে। যেন সেই ঘরের ভেতরের বিদেহী কেউ সমর্থন করছে অর্ণবের বক্তব্য। আওয়াজটা শুনেই বিবর্ণ হয়ে গেল অর্ণবের মুখ, মুহূর্তের জন্য, আর কিংশুকের বুকের ভেতর যেন হাতুড়ি পিটতে লাগল। আয়নায় নিজের মুখের দিকে তাকালে কিংশুকও হয়তো নিজের মুখের একই অবয়ব দেখতে পেত। চিন্তাটা দ্রুত ঝেড়ে ফেলে কিংশুক প্রশ্ন করল, “তারপর, তুই কি গেছিস ওদের দুনিয়ায়?”
মাথা নেড়ে অর্ণব বলল, “নাহ্, আমার এখনও যাওয়া হয়নি। তার কারণও আছে। আমার তৈরি যন্ত্র যে প্রবেশপথ খুলে দেয়, সেই পথে প্রবেশ করা যায়, কিন্তু এই জগতের কেউ যদি সেটা অপারেট না করে, তাহলে সেখান থেকে ফিরে আসা যায় না। আমি একা সেটা করতে পারব না, তাই তোকে আমার দরকার ছিল।“ কিংশুকের বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল, “তাহলে ওই ঘরে যে আছে সে কে?” অর্ণব বলল, “ভূত চতুর্দশীর দিন, আমার যন্ত্রটা আমি চালিয়েছিলাম, একটি বিদেহীকে লক্ষ্য করে, কিন্তু যন্ত্র যেই প্রবেশপথ খুলে দেয়, সেই আত্মা আমাদের জগতে প্রবেশ করে, বেগতিক দেখে আমি যন্ত্র বন্ধ করে দিই তড়িঘড়ি, কিন্তু ততক্ষণে যা হবার তা হয়ে গেছে। এই আত্মা, যন্ত্রের কল্যাণে আমাদের জগতে প্রবেশ তো করেছে কিন্তু পুরোপুরি তার দেওয়াল ভেদ করতে পারেনি তাই তার শক্তি এখনও সীমিত। সেজন্যই সে আটকে আছে ওই ঘরে, যেখানে আমি এক্সপেরিমেন্ট করেছিলাম। ওই চেয়ারে বসেই আমি যন্ত্র চালিয়েছিলাম – এরকম কিছু হতে পারে ভেবেই মাটিতে ছড়িয়ে রেখেছিলাম বিশেষভাবে তৈরি এক মিশ্রণ, যেটার মধ্যে দিয়ে সেই বিদেহী চলাচল তো করতে পারবে কিন্তু তার দৌড় ওই মিশ্রণের সীমানা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকবে – এটা আমি শিখেছিলাম গত এক বছর ধরে ওদের চলাফেরা লক্ষ করে। কিন্তু যে পাতলা স্তরে সে আটকে আছে, তার দেওয়াল খুব পুরু নয়, সেই স্তর ক্রমশই পাতলা হয়ে আসছে, তাই তার শক্তিও বেড়ে চলেছে প্রতি মুহূর্তে। দরজায় খটখট শুনেই বুঝেছি, বেশি দেরি নেই যখন সে পুরোপুরি আমাদের দুনিয়ায় চলে আসতে সক্ষম হবে।“ অর্ণব চুপ করল। কিংশুকের হৃৎপিণ্ডটা গলার কাছে লাফিয়ে উঠল, “তাহলে, তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার কি কোনও উপায় নেই?”
বিষণ্ণ হেসে অর্ণব বলে উঠল, ‘কাল সারারাত বসে সেই গবেষণাই চালিয়েছি বন্ধু। যেটা পেয়েছি, সেটা খুব আশানুরূপ নয়। আমার যন্ত্রটার সবথেকে বড় দোষ সেটা একদম বেশি পাওয়ার ব্যাকআপ দেয় না। সেকেন্ডহ্যান্ড ব্যাটারি একটা জোগাড় করেছি বটে, কিন্তু সেটাও খুব একটা ভালো কিছু নয়। এই ধরনের টেলিপোর্টিং-এর জন্য নিরবিছিন্ন শক্তি সরবরাহ প্রয়োজন। একবার সেটা বন্ধ হয়ে গেলেই, যন্ত্রের তৈরি স্তরটা বিলুপ্ত হয়ে যাবে মুহূর্তে। তার পরে যন্ত্র চালালে, সেটা হয়তো কোন অন্য মুখ খুলে দিতে পারে, যেখান দিয়ে অন্য কোনও বিদেহী আত্মা ঢুকে পড়ার সম্ভাবনা বেশি। তাই যাওয়ার আর আসার একটাই পথ।” “তাহলে উপায়?” “উপায় একটাই”, অর্ণব ঘরের কোণ থেকে সেই অদ্ভুতদর্শন যন্ত্রটা বের করে নিয়ে এল। সেটাকে দেখতে অনেকটা চাটুর মতো। দেখে মনে হয়, চাটুটা ঘূর্ণনশীল, তার ওপর থেকে ঝুলে আছে তিনটে কমপ্লেক্স শুঁড়ের মতো বৈদ্যুতিক সার্কিট। যন্ত্রটা বেশ ভারী, সেটাকে সেই ভয়ানক দরজার কাছে নিয়ে ফিট করল অর্ণব। আমাকে বলল, “কিনু, দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গেই তুই যন্ত্রটা চালিয়ে দিবি, তাহলে আমার হিসেব অনুসারে, ঘরের ঠিক মাঝখানে একটা ত্রিমাত্রিক স্তর তৈরি হবে, যেখান দিয়ে ওই যমালয়ে ঢুকে পড়া সম্ভব। ওই যন্ত্র চালানোর সঙ্গে সঙ্গে, তোর চারপাশের জগত বদলে যাবে, তুই অনেক এরকম বিদেহীকে চলে ফিরে বেড়াতে দেখতে পাবি, কিন্তু ভয় পাস না। ওরা তোর কোনও ক্ষতি করতে পারবে না কারন দুই জগতের মধ্যে আনাগোনার ওই একটাই পথ, যেটা আমার যন্ত্র তৈরি করবে ঘরের ভেতর। যেহেতু ওই দুষ্ট আত্মা এখনও বদ্ধ আছে মাঝামাঝি স্তরে, আমি তাকে নিয়ে চলে যাব ওদের জগতে, এবং গিয়েই ফিরে আসব, নিঃশব্দে। তুই শুধু পাওয়ার সাপ্লাইটা ঠিক রাখিস, আর দেখিস যেন যন্ত্র কোনওভাবে বন্ধ না হয়ে যায়।”
কিংশুক বেশ বুঝতে পারল, তার হাত কাঁপছে। কিছুক্ষণ আগে সমস্ত ব্যাপারটা তার কাছে গল্প ছাড়া কিছুই মনে হচ্ছিল না, হয়তো, বাইরে খোলা আলো বাতাসে দাঁড়ালে, সে এটাকে গল্প বলেই উড়িয়ে দিত, কিন্তু এই পরিবেশে তার সমস্ত যুক্তিবুদ্ধি চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেছে। দরজার আড়ালে থাকা ওই বস্তুটি যে কী, সেটা ঠিক মতো ঠাওর করে উঠতে পারেনি কিংশুক, কিন্তু অর্ণবকে সে নিজের হাতের তালুর মতো চেনে। তার একটা কথাও যে বানিয়ে বলা নয়, সেটা কিংশুক খুব ভালো করে জানে। কিন্তু তার সমস্ত যুক্তিবুদ্ধি এই জিনিসটা সর্বান্তকরণে মেনে নিতে পারছে না – মনের এরকম একটা দোলাচলে সে মুখ তুলে তাকাল অর্ণবের দিকে। অর্ণব গম্ভীরভাবে বলল, “আমি জানি, তোর পক্ষে এসব মেনে নেওয়া শক্ত, কারণ তোর স্বাভাবিক বুদ্ধি দিয়ে তুই এর কুল পাবি না – তোর কাছে এটা ম্যাজিক বলে মনে হচ্ছে নিশ্চয়ই। জানিসই তো, আজকের ম্যাজিক, কালকের বিজ্ঞান।” শেষের কথাগুলো অদ্ভুত বাণীর মতো শোনাল কিংশুকের কাছে। ঠিকই তো বলেছে অর্ণব – কাল যে গ্যালিলিওকে ধরে নিয়ে যাওয়া হল, বিচারে বলতে বাধ্য করা হোল যে পৃথিবী ঘুরছে না, সে স্থির –সেই বিচারসভার ধূলিকণাও আজ খুঁজে পাওয়া যায় না। শুধু সেই বৃদ্ধ অসুস্থ মহামানবের কথা কালজয়ী হয়ে আছে। গিলোটিনে তার মাথাটা দিয়ে যেতে হয়েছিল বিজ্ঞানী অ্যাভোগাড্রোকে – তার কারণস্বরূপ সেই ফরাসি বিপ্লবের নাম ইতিহাস ঘেঁটে খুঁজে পাওয়া গেলেও, নিজেদের ভুলে যে মাথাটা আমরা হারিয়েছিলাম, তার খোঁজ আজও পাওয়া যায়নি। মন থেকে হঠাৎ ভয়টা চলে গেল কিংশুকের। বিজ্ঞানের ছাত্র সে, আর আজ তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক মহান বিজ্ঞানী, যার আবিষ্কার খুলে দিতে পারে মানুষের অনেক না জানার দরজা, এবং সে নিজে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে ইতিহাস তৈরি করতে চলেছে প্রথম মানুষকে মাত্রান্তরিত করে। কিন্তু কিছু প্রশ্ন এখনও বাকি থেকে গেছে তার মনে, “অর্ণব, তুই তো দেহধারী, তুই সেই বিদেহী আত্মাকে স্পর্শ করবি কী করে?” অর্ণবের মুখে একটু বিচিত্র হাসি ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল। চিন্তান্বিত স্বরে বলল, “দেখ কিনু, আমি এই প্রশ্নটার এখনও কোন সমাধান করতে পারিনি। এটা ঠিকই যে এক মাত্রা থেকে অন্য মাত্রায় গেলে মানুষের মরদেহে কিছু পরিবর্তন আসতে বাধ্য, কিন্তু সেটা যে ঠিক কী, সেটা আমিও জানি না। আমার পক্ষে অন্য কাউকে পাঠিয়ে সেটা পরীক্ষা করে দেখা সম্ভব হয়নি। তাই আমিই হব এ পরীক্ষার গিনিপিগ।” কিংশুক প্রবলভাবে মাথা নাড়ল, “না না সেটা হতে দেওয়া চলবে না, তোর কিছু হয়ে গেলে আমি কাকুকে কী জবাব দেব? তোর এই আবিষ্কারের কী হবে? তোর যাওয়া চলবে না অবু।” দরজায় এতক্ষণে প্রবল ঝাঁকুনি শুরু হয়েছে, কিংশুক আর অর্ণব মুখ চাওয়াচাওয়ি করল – শেষ পর্যন্ত অর্ণবের মুখে ফুটে উঠল এক চিলতে বিষণ্ণ হাসি। কিংশুকও বুঝতে পেরেছে, অর্ণবের রাস্তা ছাড়া গতি নেই – সে এদের অনেকদিন ধরে লক্ষ করছে, ওর পক্ষেই যাওয়াটা সবথেকে সমীচীন হবে।
অর্ণব এগিয়ে এল তার দিকে, পিঠ চাপড়ে বলল, “কীরে মুখ শুকনো কেন, চিন্তা করিস না। আমি এই যাব, আর এই আসব। আয় তোকে এর অপারেশানটা ভালো করে বুঝিয়ে দিই। দেখ, এই যে লাল নব, এটা ঘোরালে শব্দ, আর এই সবুজটা ঘোরালে আলো। দুটো নবের বাইরে যে কম্পাঙ্ক চিহ্নিত করা আছে, সেটা বিচার করে, আস্তে আস্তে দুটোকে সমমাত্রায় নিয়ে আসবি। সমমাত্রায় এলেই তখন এই শুঁড়গুলো তীব্রগতিতে কাঁপতে এবং ঘুরতে থাকবে। তখন এই লিভারটা টেনে দিবি- তার ফলে সামনের স্পেস টাইম ভেঙে গিয়ে পথ করে দেবে অন্য মাত্রায় যাওয়ার, আমি ওই পথেই যাব আর আসব। যদি কিছু বেগতিক দেখিস, তাহলে নীচের বাঁদিকের এই বোতামটা আস্তে করে টিপে দিস, তাহলে নিমেষে দরজাটা বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু বোতামটা বেশি চেপে দিলে, তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গের মাত্রা এবং কৃত্রিম অভিকর্ষজ বলের বেগ হয়ে যাবে অনেক বেশি, তাই তার প্রভাবে স্পেস টাইম দুমড়ে গিয়ে, খুলে যেতে পারে একের বেশি দরজা – যা দিয়ে যেকোনও মুহূর্তে ঘটে যেতে পারে দুর্ঘটনা। এইটাই আমাদের যন্ত্রের সবচেয়ে বড় ঘাটতি, যেটা আমি ঠিক করার সময় বা অর্থ কিছুই পেলাম না।“ দীর্ঘশ্বাস ফেলল অর্ণব, “না কিনু, শুরু করে দে – আর দেরি করিস না। দেখছিস তো, দরজায় আওয়াজ। ওই পলকা দরজা আর আমার দুর্বল মিশ্রণ বেশিক্ষণ ওকে ধরে রাখতে পারবে না। এবার চালু কর মেশিন।” বলে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল অর্ণব। দুরু দুরু বুকে, লাল নবটা ঘোরাল কিংশুক, হিসহিস করে ঠিক রেডিও স্টেশনের মতোই শব্দ হতে লাগল সেটা থেকে। তারপর, কাঁটা ঘুরতে ঘুরতে একটা নির্দিষ্ট কম্পাঙ্কে স্থির হল। এতক্ষণ যে আওয়াজ শুনছিল চারপাশে, সে সব এখন সম্পূর্ণ স্তব্ধ – কিংশুককে স্পর্শ করতে লাগল এক অননুভূত নিস্তব্ধতা, এক অপার্থিব শান্তি। তারপর, ধীরে ধীরে সবুজ আলোর নব ঘোরাতে থাকল সে – চারপাশের দৃশ্য বদলে যেতে লাগল ছায়াছবির মতো- শেষে যে অংশে কাঁটা স্থির হোল, সেখানে এসে সে দেখল এক অপার্থিব দৃশ্য। তার চারপাশের দেওয়াল সরে গেছে, যে ঘরে সে বসেছিল, সেখানে কিছু নেই – এক বিরাট খোলা প্রান্তরের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে সে আর অর্ণব। সেখানে দূর দূরান্ত অবধি কেউ নেই, কোনও পাহাড় নেই, নদী নেই, কোনও প্রাণের চিহ্নমাত্র নেই সেই শ্মশানসম জায়গায়। যে ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে তারা খটখট আওয়াজ শুনছিল, সেই দরজাটাও নেই সেখানে। অর্ণব ওর দিকে তাকাল, কিছু একটা বলল, মনে হল সেটা যেন বহুদূর থেকে ভেসে আসছে, বুঝতে পারল, অর্ণব ওকে লিভারটা চালাতে বলছে। কালবিলম্ব না করে, লিভারটা টেনে দিল সে, আর তখনই দেখল সেই অপূর্ব দৃশ্য। যে যায়গাটা এতক্ষণ শূন্য মনে হচ্ছিল, সেই শান্তির নীড়ে ধেয়ে এল এক প্রচণ্ড ঝড় – সেই নিবিড় পটভূমিকা নিমেষে অদৃশ্য হয়ে সেখানে মনে হল এক শক্তিপুঞ্জ তৈরি হয়েছে, যেটা যেন সব কিছুকে তার কেন্দ্রের দিকে ভয়ানক গতিতে টেনে নিয়ে চলেছে। সেই পুঞ্জ যখন সবকিছুকে তার কেন্দ্রাতিগ বলের দ্বারা আকর্ষণ করে নিল, তখন সেখানে মনে হল শূন্যটা একটু দুমড়ে মুচড়ে একাকার হয়ে গেল – আর সেখানে তৈরি ল এক উজ্জ্বল আলোকবৃত্ত। অর্ণবের দিকে ভালো করে তাকানো যাচ্ছে না, কারন সে চলে গেছে আলোকবৃত্তের অনেক কাছে। একবার পিছন ফিরে তাকাল অর্ণব, কিংশুকের মনে হল, কিছু একটা ইঙ্গিত করছে সে – আর সেই এক মুহূর্তের জন্য অর্ণবের মুখটা দেখতে পেল সে, অনির্বচনীয় আনন্দে উদ্ভাসিত সেই মুখাবয়ব। তারপরই উজ্জ্বল সেই অপার্থিব আলোকছটায় মিলিয়ে গেল অর্ণব। সেই দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে কেমন যেন ঘোর লেগে যাচ্ছিল কিংশুকের – সেই মায়াময় জগৎ, তার দিঙমণ্ডলব্যাপী সেই অপূর্ব মসৃণ মায়াবি আলো, তাকেও কেমন যেন একটা অমোঘ পরিণতির দিকে আকর্ষণ করে নিয়ে যাচ্ছিল। নিজের অজান্তেই বসা অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়াল কিংশুক, আর তখনই সংবিৎ ফিরে পেল কিছু একটার উপস্থিতিতে। কী সে জিনিস, সেটা কিংশুক কিছুতেই বুঝতে পারল না প্রথমে, কারণ তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় ছাড়া, সেই বায়বীয় অদৃশ্য পদার্থের উপস্থিতি টের পাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু এরকম অনেকে যেন ঝাঁকে ঝাঁকে এসে ভিড় করছে তার চারপাশে, চারদিকে তাকিয়েও কিছুই দেখতে পেল না কিংশুক, কিন্তু তার মনের মধ্যেকার অস্বস্তি বেড়েই চলেছে ক্রমাগত। কারা যেন আছে, তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে, ভিড় করে আসছে তার চারপাশে। কিংশুকের ঘাড়ের রোঁয়া খাড়া হয়ে উঠল কী এক অজানা আতঙ্কে। এরাই কি সেই অর্ণব বর্ণিত বিদেহী? নিশ্চয়ই তাই, হটাৎ এরকম খোলা দরজার সামনে পড়ে থমকে গেছে। কিংশুক বুঝতে পারল এক ভয়াবহ সত্য। অর্ণব বলেছিল, ভূত চতুর্দশীর দিনে এক বিদেহীকে অনুসরণ করে সে খুঁজে পেয়েছে দুই মাত্রার সবচেয়ে পাতলা স্তর, আর সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যক্রমে, সেই সবচেয়ে পাতলা স্থান হল, অর্ণবের সেই অভিশপ্ত দরজার সামনেটাই। না না, এটা সমাপতন নয়, কিংশুক চিৎকার করে উঠল, অর্ণব জেনেশুনেই এই ঘরটা ভাড়া নিয়েছিল, ভাড়া অনেক বেশি বলেও সে পিছিয়ে যায়নি। সবই জানত অর্ণব, খুব ভালো করে জানত যে ঠিক কোন জায়গায় তার যন্ত্রকে চালনা করতে হবে। এসব ভাবনার মধ্যেই কিংশুক বুঝতে পারল, ভিড় জমতে শুরু করেছে সেই আলোকজ্জল দরজার সামনে। এক ঝিঁঝিঁ পোকার মতো ডাক শুনতে পাচ্ছে সে, কিন্তু এটাকে ঠিক শোনা বলে না, না – তার কান কিছুই অনুভব করছে না – সে শুধু মনে মনে উপলব্ধি করতে পারছে সেই আওয়াজ। সে খালি দরজার দিকে তাকাচ্ছে, আর ভাবছে কখন অর্ণব এসে ঢুকবে আর কখন সে সুইচ টিপে দরজা বন্ধ করে দেবে। মনে মনে অর্ণবের ধ্যান শুরু করল সে, চোখ বুজে ফেলল, কারণ সে বুঝে গেছে, এখানে তার পঞ্চইন্দ্রিয় কোনও কাজই করবে না।
কিছু পরেই এক ক্ষীণ চিৎকার তার কানে এল, “কিনু, কিনু” – চমকে চোখ মেলে তাকাল কিংশুক, অর্ণবের ডাক, কিন্তু কোথায় সে? দরজার কাছে তো নেই, “না কিনু, আমি ওখানে নেই। আমার কথা মন দিয়ে শোন।” কিংশুক জিজ্ঞেস করল, সেই টেলিপ্যাথিক জিজ্ঞাসা, “তুই কখন আসবি? দরজা আর বেশিক্ষণ খুলে রাখলে এরা ঢুকে আসবে। তোর সঙ্গে আমি কথাই বা বলছি কী করে? আর বাকিদের কথা বুঝতে পারছি নাই বা কেন?” “কারণ তুই আমাকে ধ্যান করছিস কিনু, আর কারওর নয়। অর্ণবের ক্ষীণ বার্তা মনে এল, “এখানে কোনও ভাষা নেই, তুই বাংলায় শুনছিস তার মানে তোর মনের ওই কম্পাঙ্কে আমাকে তুই অনুভব করতে পারছিস এই যা। এটা এক অদ্ভুত জায়গা জানিস – সে যাক, ভালো করে শোন। তুই এখুনি দরজাটা বন্ধ করে দে, আর দেরি করিস না, এখুনি বন্ধ কর।” “কী বলছিস তুই, তুই তো নিজেই বলেছিস, তোর ফিরে না আসা অবধি অপেক্ষা করতে” – “না না না” গুঙিয়ে উঠল সেই স্বর, “আমি আর ফিরব না কিনু, আমি অনেকদিন আগেই এপারে চলে এসেছি।” “তার মানে?” এবার চূড়ান্ত অবাক হওয়ার পালা কিংশুকের, “কী সব বলছিস তুই” চিৎকার করে উঠল কিংশুক। আরও দূর থেকে সেই স্বর ভেসে এল, “কিনু, আমি এখানে থাকতে পারব না আর, শুধু ছিলাম তোর জন্য। আমি জানতাম তোকেও এরা এখানে নিয়ে আসার চেষ্টা করবে। যে তোকে এই দরজা খুলতে সাহায্য করেছে, সে আমি নয় কিনু, সে আমি নয়, সে অন্য কেউ।” নিঃসীম আতঙ্কে কিংশুকের রক্ত জমে এল, “তার মানে, কী বলতে চাইছিস তুই?” খুব কষ্ট করে সেই স্বর বলতে লাগল, “আমি বেশিক্ষণ এখানে থাকতে পারব না, কারণ আমার স্থান অন্য মাত্রায় সংরক্ষিত আছে, আমার ওপর এক অসীম আকর্ষণ ক্রিয়া করছে, যার টানে আমাকে এখুনি চলে যেতে হবে। কিন্তু তোকে শেষ কথা বলে যাই, এখানে কিছু দুষ্ট আত্মা আছে, যাদের নিয়ে পরীক্ষা করার সময়, তারা আমার দেহ দখল করে, আর আমাকে বন্দি করে রাখে ওই ঘরের মধ্যে। তোকে দেখামাত্র আমি তোর কাছে আসতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তুই ভয় পেলি। ওরা আমার সব কাজ নষ্ট করে ফেলেছে, আর তোকে ওখানে রেখে এই দরজা চিরকালের জন্য খুলে রাখতে চেয়েছে। তুই দরজা বন্ধ করে দে কিনু, বন্ধ ক…রে……দে………।” যেন কিংশুকের শরীরের সব রক্ত কেউ ব্লটিং পেপার দিয়ে শুষে নিয়েছে, তার হাত কাজ করছে না, কোনোমতে সমস্ত শক্তি একত্র করে সে টিপে দিল লাল সুইচটা – নিমেষে কী হয়ে গেল তার মনে নেই, সমস্ত মেশিনটা কাঁপতে আরম্ভ করে দিল থরথর করে, নিমেষের মধ্যে ঝড়ের সংখ্যা বেড়ে গেল দ্বিগুণ, কিংশুক অতিকষ্টে মাথা তুলে দেখতে পেল, আরও দরজা তৈরি হচ্ছে তার চারপাশে, গুনগুন শব্দটা এখন অনেক স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে সে। দূর থেকে এক খলখলে হাসি শুনতে পেল সে, “বলেছিলাম আস্তে টিপতে, হা হা হা – মেশিনে এই পরিবর্তনটুকু আমিই এনেছিলাম। এক লহমায় দরজার সামনে আবির্ভূত হল এক মূর্তি, হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে। “তোমার এই ভুলের জন্যই তোমাদের দুনিয়ার সঙ্গে মিশে যাবে আমাদের জগৎ…” এক গমগমে গলা শুনতে পেল কিংশুক, “তোমাদের সঙ্গেই হবে আমাদের সহাবস্থান, তোমরা……।” কথা শেষ হল না সেই বিদেহীর, কিংশুক দেখতে পেল, আগুন জ্বলে উঠেছে যন্ত্রে, পটপট শব্দে পুড়ে যাচ্ছে তার কয়েলগুলো – নিমেষে সেই জগৎ অদৃশ্য হয়ে গেল তার সামনে থেকে – শুধু দূর থেকে শুনতে পেল এক রক্তজল করা আর্তনাদ, জ্ঞান হারানোর আগের মুহূর্তে কিংশুক দেখতে পেল, অর্ণবের দেহ, সেই দরজার ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে, কিন্তু তার সারা শরীর জ্বলে যাচ্ছে এক নীল আগুনে – আর তার তর্জনী নির্দেশ করছে কিংশুকের দিকেই, চোখে তার অনন্ত জিঘাংসা। চোখের সামনে একরাশ অন্ধকার ছিটকে এল কিংশুকের, তারপর আর তার কিছু মনে নেই।
হাসপাতালে যখন জ্ঞান ফিরল, তখন তার চারপাশে বহু মানুষ। বহুকষ্টে ঘাড় তুলে তাকাতে পারল কিংশুক। সারা শরীরে তার অসহ্য যন্ত্রনা। “জল” বলতে গিয়েও তার গলা থেকে কোনো স্বর বেরোলো না। তবে তার জ্ঞান ফিরতে দেখে মুহূর্তে নার্স দৌড়ে এল, পুলিশ, সাংবাদিক, ডাক্তার সবাই ঘিরে ধরল তাকে। ভাসা ভাসা শুনতে পেল, তার শরীরের অধিকাংশ জায়গাই নাকি পুড়ে গেছে। অর্ধমৃত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করা হয়েছে। ঘরের থেকে আগুন বেরোতে দেখে পাড়ার ছেলেরাই নাকি দমকলে খবর দেয়। ভাগ্যিস সেদিন বুড়োবুড়ি ঘরে ছিল না – সমস্ত বাড়িটাই নাকি পুড়ে গেছে। এক সাংবাদিককে বলতে শুনল, “কিছুই বাকি নেই, সব পুড়ে ঝামা। ভদ্রলোক বোধহয় কিছু গবেষণা করছিলেন, কিন্তু তাঁর ঘরের তো কিছুই অবশিষ্ট নেই যে সেবিষয়ে কিছুর সন্ধান পাওয়া যাবে।“ তাঁর দিকে তাকিয়ে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করতেই, গম্ভীর মুখে ডাক্তার ধরে ঢুকলেন। গোলমাল থামিয়ে বললেন, “এনার শরীরের প্রায় ষাট শতাংশ পুড়ে গেছে। মেন্টাল শকে এনার স্বরযন্ত্রে প্যারালিসিস হয়ে যাওয়ায়, উনি আর হয়তো কোনওদিনই কথা বলতে পারবেন না। তাই ওনাকে কিছু জিজ্ঞেস করে লাভ নেই। দয়া করে ওনাকে সুস্থ হয়ে উঠতে দিন।” মুখ অন্যদিকে ফেরাল কিংশুক। কিছুই তাঁর কানে ঢুকছে না, তার শরীরের যন্ত্রনা, তার এতবড় অক্ষমতাকে ঢেকে দিয়েছে তার প্রানপ্রিয় বন্ধু বিয়োগের শোক। অর্ণব, তার স্নেহের অবু আর নেই। নেই তার সেই মহামূল্যবান গবেষণাও। তার সেই যুগান্তকারী আবিষ্কার রয়ে গেল মানবজ্ঞানের অগোচরে, শুধু সে থেকে গেল তার সাক্ষী – যে কোনওদিন কথা বলতে পারবে না, প্রকাশ করতে পারবে না এই অমূল্যনিধিকে। অসহ্য ব্যথায় জ্ঞান হারানোর আগে, অর্ণবের সেই জ্বলতে থাকা শরীরটাকে মনে করে এখন আতঙ্কের থেকেও তার কষ্ট হচ্ছে বেশি। হাসপাতালের জানলা দিয়ে অস্তাচলগামী সূর্যের দিকে তাকিয়ে কিংশুকের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল।
Tags: গল্প, দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য্য, প্রথম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়