প্রাইজ অফ পেরিল – রবার্ট শেকলে
লেখক: মর্মানুবাদঃ প্রসেনজিত দাশগুপ্ত
শিল্পী: দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য (চিত্রচোর)
বিপ্লবী পুলিন দাস স্ট্রীট ধরে ছুটতে ছুটতে এসে ডানদিকে পার্সি বাগান লেনে ঢুকে থমকে দাঁড়াল সিরাজ। উফ! শরীর আর দিচ্ছে না! কিন্তু না, থেমে গেলে চলবে না। এই রাস্তা ধরে সোজা গিয়ে এপিসি রোডে উঠলে কিছুটা সময় পাওয়া যাবেই! রাত দেড়টা বেজে গেলেও এপিসি রোড একদম নির্জন হয়ে যায় না। পাঁচ, আরো পাঁচ ঘণ্টা তার হাতে আছে। এইটুকু পার করে দিতে পারলেই…
“প্রিয় দর্শক, আপনারা এখন দেখতে পাচ্ছেন সিরাজ রাজাবাজার সায়েন্স কলেজের একটু আগে দাঁড়িয়ে পড়েছে! খুব সম্ভব ও ভীষণ হাঁপিয়ে গেছে। আর হবে নাই বা কেন, পাঁচ ঘণ্টা ধরে আট জন প্রফেশনাল কিলারের হাত থেকে পালিয়ে বেড়ানো তো চাট্টিখানি কথা নয়, তাইনা! আচ্ছা সিরাজ এতক্ষণ ওখানে দাঁড়িয়ে কি ভাবছে? ও কি কিছু প্ল্যান করছে? জানার জন্য সঙ্গে থাকুন বন্ধুরা, ফিরে আসছি ৩০ সেকেন্ডের বিজ্ঞাপনী বিরতির পড়েই!”
“সিরাজ, সিরাজ! ইউ দেয়ার?”
সিরাজ চমকে উঠল। প্রায় দেড় কিলোমিটার মত দৌড়ে এসে রাস্তার পাশেই বসে পড়েছিল সে। ইয়ারফোনটায় সঞ্চালিকা নিতা বাস্কের উত্তেজিত কণ্ঠস্বর ভেসে আসাতে সে ক্লান্তি ঝেড়ে আবার উঠে দাঁড়াল।
“হ্যাঁ বল…”
“এইমাত্র আমাদের এক দর্শক জানালেন তিনি তোমাকে পুলিন দাস স্ট্রীটে ঢুকতে দেখেছেন। এবং তার পরেই মাঝারি হাইটের টাকমাথা একটা লোক এবং তার সঙ্গী আরো দুজন ওই পথেই গেছে। আর মনে হয় মিনিট খানেকের মধ্যে ওরা…”
সিরাজের মেরুদণ্ড দিয়ে একটা ঠাণ্ডা ভয়ের স্রোত নেমে গেল। রুংটা, ওটা কিশোর রুংটার গ্যাং। টাকমাথা লোকটাই কিশোর। লোকটার নামে অন্তত গোটাদশেক খুনের মামলা আছে। ঠাণ্ডা মাথায় নৃশংস ভাবে খুন করতে লোকটার জুড়ি মেলা ভার। নাহ! হতাশায় সিরাজ কাঁধ ঝাঁকাল। তার মতো একজন তস্য সাধারণ ট্যাক্সি ড্রাইভারকে মারবার জন্য সম্পূর্ণ শক্তিই নিয়োগ করা হয়েছে দেখা যাচ্ছে।
সিরাজ একটু ভাবল। পার্সি বাগান লেন থেকে সোজা গিয়ে এপিসি রোডে উঠে পড়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। যতই রাত হোক, লোকজন থাকে ওই রাস্তায়। লুকিয়ে পড়া সোজা। তারপর কোনও একটা বাস কিম্বা ট্যাক্সি ধরে হাওড়া চলে গেলেই হল! ওখানে ভিড় আরো বেশি, চাইকি পোস্তাতেও নেমে পড়া যায়। হাতে এখনো ঘণ্টা পাঁচেক আছে। ভিড়ের মধ্যে লুকিয়ে থাকলে রুংটারা চট করে খুঁজে পাবে না।
কিন্তু অঙ্ক মিললো না।
রুংটারা নেহাত বোকা নয়। তাছাড়া কিশোর বরাবরই ঠাণ্ডা মাথার খুনি। শিকারকে ‘পড়ে‘ নেওয়ার ক্ষমতা তার জন্মসূত্রে পাওয়া। সিরাজ যে জনবহুল রাস্তার দিকেই পালাতে চাইবে সেটা তার বুঝতে অসুবিধা হল না। তাই দলের একজনকে সিরাজের পেছনে লেলিয়ে দিয়ে রুংটা নিজে আরেকজনকে নিয়ে কেশব চন্দ্র সেন স্ট্রীট দিয়ে এসে এপিসি রোডে পড়ে ঝাঁপ ফেলে দেওয়া দোকানগুলোর ছায়ায় ছায়ায় সায়েন্স কলেজের দিকে এগোল ।
সিরাজ সায়েন্স কলেজের উলটোদিকে একটা পান–বিড়ি–সিগারেটের গুমটির আড়ালে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল। সামনে দিক থেকেও যে কেউ আসতে পারে সেটা সে ভাবতেও পারেনি। বুঝতে যখন পারল ততক্ষণে বেশ দেরি হয়ে গেছে।
কিশোর শার্প শুটার। কিন্তু শেষ মুহূর্তে উলটোদিক দিক থেকে আসা একটা বেপরোয়া বাইকের আলো আর তীব্র হর্ন তাকে চমকে দিল। ওই আওয়াজেই সিরাজও চমকে ফিরে তাকিয়েছিল। গুলিটা তাই সিরাজের কাঁধ ছুঁয়ে সিগারেটের দোকানের টিনের দরজায় গিয়ে লাগল।
একটা জান্তব আর্তনাদ করে সিরাজ মাটিতে বসে পড়েছিল। কিন্তু প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে পার্সি বাগান লেনের দিকে ঢুকতে গিয়েই দেখল আলো–অন্ধকার গলিটা থেকে মোটা মতো একটা লোক হাতে একটা রড জাতীয় কিছু নিয়ে ছুটে আসছে। হতভম্ব সিরাজ কোনওরকমে সায়েন্স কলেজের পাঁচিল টপকে ক্যাম্পাসের ভেতরে নামল!
মোটা লোকটা, মানে স্বপন হাঁফাতে হাঁফাতে কিশোরের সামনে এসে দাঁড়াল। “ইডিয়ট!” চাপা স্বরে বলল কিশোর। এত সময় লাগে এইটুকু রাস্তা ছুটে আসতে? তাছাড়া চোখের মাথা খেয়েছিস নাকি গর্দভ? আমাকেও দেখতে পেলিনা কি করে? শেষ মুহূর্তে আমার আর সিরাজের মাঝখানে না এসে পড়লে চলছিল না? ব্যাটাকে পাঁচিলে ওঠার আগেই খতম করে দিতাম!”
স্বপন ধমক খেয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়াল। ঢ্যাঙা লোকটা চাপাস্বরে বলল, “বস, এই রাতে সায়েন্স কলেজে কেউ নিশ্চই নেই। চট করে চলুন ভেতরে গিয়ে কাজ শেষ করে আসি।”
কেউ যে নেই তা নয় হয়ত। কিশোর একটু ভাবল। রিসার্চ স্টুডেন্টরা থাকতেই পারে। কিন্তু তারা নিশ্চই এই কাজে বাধা দেবে না! তাছাড়া এই ষোলোই ডিসেম্বর যে খেলাটা লাইভ টেলিকাস্ট হবে সেটা অন্তত শেষ পাঁচ–ছয় মাস ধরে অ্যাড দেওয়া হচ্ছে। কলেজে কেউ থাকলেও তারা নিশ্চই ট্যাব কিম্বা ল্যাপটপেই মুখ গুঁজে বসে আছে।
হাতে আর বেশি সময় নেই। মাত্র চার–সাড়ে চার ঘণ্টা আছে। গুলিটা যে সিরাজের কাঁধ ছুঁয়ে গেছে সে ব্যাপারে কিশোর নিশ্চিত। রক্তের দাগ ধরে খুঁজে বার করতে তাহলে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। কিশোররা ধীরে সুস্থে পাঁচিল টপকে কলেজের ক্যাম্পাসে নামল।
পাঁচিল টপকে ভেতরে জমিতে পড়ে সিরাজ প্রথমে একটু হকচকিয়ে গেছিল। তারপরই অবস্থার গুরুত্ব বুঝে কোনও রকমে মেঘনাদ সাহা ভবনের পাশের টেক ক্যান্টিনের আড়ালে গিয়ে দাঁড়াল। পকেট থেকে এমারজেন্সি মেডিক্যাল কিটটা বার করে একটা পেইন–কিলার গিলে নিল। কিটটার মধ্যে একটা ব্যান্ডেডও আছে। অ্যান্টিসেপটিক গ্লু লাগানো। ক্ষতস্তানের ওপরে সেটাকে চেপে ধরতেই একটা তীব্র জ্বালা শরীরময় ছড়িয়ে পড়ল। সিরাজ জানে ওষুধটা কাজ করতে একটু সময় লাগবেই। তার মধ্যেই একটা ভাল লুকোনোর জায়গা খুঁজে বের করতেই হবে। কিশোর একবার মিস করেছে। দ্বিতীয়বার ভুল করার মত খুনি সে নয়।
ক্যান্টিনটার পাশেই বেশ বড়সড় সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো একটা চৌবাচ্চার মত জিনিস। এটা আবার কি! সিরাজ ভাবল। নাহ, এখানে সুবিধা হবে না। সে দ্রুত পায়ে পাশের চারতলা বিল্ডিংটার দিকে এগিয়ে গেল।
“বন্ধুরা, আমাদের খেলা কিন্তু জমে উঠেছে! আপনারা দেখতেই পেলেন, কিভাবে শুধুমাত্র ভাগ্যের জোরেই সিরাজ এই যাত্রা বেঁচে গেল। ও এই মুহূর্তে সায়েন্স কলেজের ভেতরের ক্যাম্পাসে শেল্টার নিয়েছে। কিন্তু ও কি আহত? আমাদের ড্রোন ক্যামেরার নাইট ভিশন মোডে দেখা যাচ্ছে …হ্যাঁ ঠিক ধরেছেন! এটা, এটা রক্তের দাগ! সায়েন্সে কলেজের পাঁচিলে রক্তের দাগ! আমি এখানে ক্যামেরা অপারেটরকে আরেকটু জুম করতে অনুরোধ করবো…কিন্তু সিরাজ কোথায়? ওই তো, ওই তো, সিরাজ কোনরকমে হাঁটতে হাঁটতে মেঘনাদ সাহা ভবনের দিকে যাচ্ছে। কিন্তু ওঁর পেছনে একটা ছায়ামূর্তি দেখা যাচ্ছে! কে এই লোকটা যে সিরাজকে ফলো করছে? তাহলে কি আবার কোন সহৃদয় দর্শক সিরাজকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে এলেন? নাকি …”
মেঘনাদ সাহা ভবনের লিফটটার সামনে সিরাজ অসহায় ভাবে দাঁড়িয়ে ছিল! লিফটটা কাজ করছে না! আজকালকার দিনেও যে কোথাও ম্যানুয়াল লিফট থাকতে পারে সেটা না দেখলে বিশ্বাসই হত না। কিন্তু এখন বুঝতে পারছে এদিকটায় আসা বোকামিই হয়ে গেল না তো? এই রাতে কোনও রুম নিশ্চই খোলা থাকবে না? কোথায় লুকাবে সে?
“এদিকে আসুন, এদিকে!”
সিরাজ ভীষণ চমকে পেছনে ফিরে তাকাল। একজন প্রৌড় ভদ্রলোক হাতে মোবাইল নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছেন। “আমি এখানকার একজন ল্যাব অ্যাটেনডেন্ট। আপনি এদিক দিয়ে কোথাও পালাতে পারবেন না। তবে আমি একটা ভাল লুকোনোর জায়গা জানি। আপনি ওই সিমেন্টের যে বড়সড় অদ্ভুত দেখতে জিনিসটা দেখতে পাচ্ছেন, ওঁর মধ্যে নেমে যান। ওটার মধ্যে নাকি এককালে রেডিও অ্যাক্টিভ এলিমেন্ট ডাম্প করা হত। তবে সেসবই শোনা কথা। আমি অনেকবার নেমেছি, ভয়ের কিছু নেই। ওটার ওপরে একটা ছোট ঢাকনা মত আছে, তালা দেওয়া। আমি সেটা খুলে দিচ্ছি। আপাতত এইটুকু রিস্ক আপনাকে নিতেই হবে!”
রেডিও অ্যাক্টিভ এলিমেন্ট যে কি সে সম্পর্কে সিরাজের কোনও ধারনাই নেই। কিন্তু আপাতত ওর মধ্যে নেমে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে বলে সে মনে করলো। সে আর কিছু ভাবতে পারছে না। ভদ্রলোক ঢাকনাটা খুলে দেওয়া মাত্রই সে ওটার ভেতরে ঢুকে পড়ল। ভদ্রলোক একটা রেসপিরেটর আর একটা স্পেস ব্ল্যাঙ্কেট ওপর থেকে ফেলে দিলেন। “ভেতরে অক্সিজেন কম থাকতে পারে, আপনি মুখোশটা পরে নিন। ওটায় যা অক্সিজেন আছে, দু তিন ঘণ্টা আরামসে চলে যাবে।” মুখোশটা পরতে পরতেই সিরাজ ভেতর থেকে ঢাকনা বন্ধ হওয়ার আওয়াজ শুনতে পেল।
মুখোশটা পরে নিয়ে আর ব্ল্যাঙ্কেটটা গায়ে জড়িয়ে সিরাজ চুপচাপ অপরিসর নোংরা এবং ঘুপচি জায়গাটায় গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়ল। তার মাথা আর কাজ করছে না। ইন্দ্রিয় গুলো যেন ভোঁতা হয়ে গেছে। তার মতো একজন সামান্য ড্রাইভার এই ডেথ গেমে নাম লিখিয়ে কি ঝকমারিই না করেছে! হ্যাঁ সে একজন সামান্য ড্রাইভারই। ওই একটা কাজই ভাল পারে। ১৩–১৪ বয়েস থেকেই গাড়ি চালাতে পারে সে। মানে প্রায় কুড়ি বছর হয়ে গেল এই পেশায়। একসময় ভাড়ার গাড়ি চালাত। বছর চারেক আগে, যখন বাবার অপারেশনের টাকার জন্য মালিকের কাছে ধার চাইতে গেছিল– তখন মালিকই তাকে বলেছিলেন রেসিং গেমে কেন সে পারটিসিপেট করছে না? সত্যি বলতে কি, তার যে একবার দুবার এটা মনে হয়নি তাও নয়। বছর আটেক ধরে এই ধরনের খেলা গুলো খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। আগে বিদেশেই বেশি চলত, কিন্তু দশ বছর আগে সুপ্রিম কোর্ট যখন স্বেচ্ছামৃত্যুকে আইনি ঘোষণা করলেন, তখন থেকেই ভারতে এই খেলাগুলোও জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে। খেলার নিয়ম কানুন খুবই সোজা। প্রতিযোগীকে একটা বন্ড সই করতে হয় শুধু। তাতে লেখা থাকে এই খেলায় প্রতিযোগীর মৃত্যু হলে সেটাকে স্বেচ্ছামৃত্যু হিসেবেই গণ্য করা হবে। ব্যাস! ঝামেলা শেষ। জিতলে অবিশ্বাস্য রকমের পুরস্কার যে থাকে বলাই বাহুল্য। খেলাগুলোর লাইভ স্ট্রিমিং হয় টিভি আর অথোরাইজড সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং চ্যানেল গুলোতে। রেসিং গেমে শেষমেশ সিরাজ দ্বিতীয় হয়েছিল। প্রাইজ মানি ছিল প্রায় আঠেরো লক্ষ টাকা! বাবার অপারেশনের পরেও যা টাকা ছিল তাই দিয়ে জনাকয়েক বান্ধবীদের নিয়ে মরিশাসে বেশ কয়েক দিন কাটিয়ে আসা গেছিল!
এরপরই সিরাজের নেশা ধরে যায়। আরো দু চারটে এইরকম খেলায় সে নাম দেয়। ঝুঁকির মুখে যে কখনো পড়েনি তা নয়। দুবার হাত ভেঙেছিল, একবার স্লিপ ডিস্ক হয়। ওসবের জন্য মেডিক্লেম করাই থাকে। প্রাইজ মানি আলাদা। গাড়ি চালিয়ে পাঁচ বছরে যা ইনকাম হয়, এইরকম একটা খেলায় প্রথম তিনের মধ্যে থাকলেই তার প্রায় ডবল ইনকাম করা যায়।
কিন্তু তবুও এই কিলিং গেমে নাম দেওয়ার কথা সে স্বপ্নেও ভাবেনি! এই খেলায় পুরস্কার মূল্য খুবই বেশি। নিয়মও সহজ। প্রতিযোগীর হাতে দশ ঘণ্টা সময়। তাকে শুধু বেঁচে থাকতে হবে, এই গোটা সময়টা! শুনতে সহজ মনে হলেও, আদপেই সহজ নয় ব্যাপারটা। কারণ একটা প্রফেশনাল খুনিদের দলকে প্রতিযোগীর পেছনে লেলিয়ে দেওয়া হয়। সাধারণত অন্ধকার জগতের লোকেরাই এই খেলায় নাম দিত। প্রথম দিকে জনপ্রিয় হলেও আসতে আসতে খেলাটা জনপ্রিয়তা হারাচ্ছিল। মার্কেট সার্ভে করে কতৃপক্ষ সিদ্ধান্তে এলেন যে এই অন্ধকার জগতের প্রতিযোগীদের সাথে দর্শকরা একাত্ম হতে পারছেন না। দর্শককুলকে নিজেদের সাথে রিলেট করানোর মত প্রতিযোগী চাই। তাই সাধারণ, ছাপোষা লোক খোঁজা শুরু হল। এই সময়েই সিরাজের সাথে যোগাযোগ করা হয়।
“সিরাজ! সিরাজ!! ইটস এনাফ! অনেক হয়েছে! বেরিয়ে এসো ওখান থেকে…!!”
চমকে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে সিরাজের মাথা ঠুকে গেল। পুরনো কথা ভাবতে ভাবতে খুব সম্ভব ঘুমিয়েই পড়েছিল। কতক্ষণ লুকিয়ে আছে সে এইখানে? দু ঘণ্টা…নাকি দু দিন?
ওপর থেকে একটা চড়া আলো এসে পড়ল সিমেন্টের চৌবাচ্চায়। “হাঁ করে তাকিয়ে কি দেখছ? বেরিয়ে এসো!”
হতভম্ব সিরাজ কোনও রকমে চৌবাচ্চা থেকে বেরিয়ে এলো। সামনে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বছর পঁচিশেক বয়েস হবে। গলায় ঝোলানো ট্যাগটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে এই ডেথ গেম প্রডাকশনের এমপ্লয়ি।
“তুমি ভেবেছটা কি? লুকিয়ে বসে থাকবে, আর তার জন্য টাকা পাবে? তোমার যে বুদ্ধি কম সেটা শুরুতেই মনে হয়েছিল, কিন্তু এতটা মূর্খ সত্যিই ভাবতে পারিনি! তুমি জান ঠিক কতজন দর্শক তোমায় এইখানে লুকোতে দেখেছে? মরতে হয় মরো, কিন্তু আত্মহত্যা করার জন্য তো তোমাকে এই গেমে নেওয়া হয়নি!”
সিরাজের কাছে সবকিছু এখনো ধাঁধার মতোই লাগছিল।
“না…মানে…আমাকে তো একজন সাহায্য করলেন এখানে লুকোতে!” সিরাজ আমতা আমতা করল। “তিনি নিশ্চই ওই তোমাদের ভাষায় গুড সামারিটান? মানে এই খেলার নিয়মেই তো আছে যে প্রতিযোগীরা দর্শকের থেকে সাহায্য পাবে। তাই উনি বললেন বলেই তো আমি ওটার মধ্যে…আর অনেক দর্শক যদি দেখেই থাকেন আমাকে ওখানে ঢুকতে তাতেই বা ভয়ের কি আছে?”
“শাট আপ! আর কোনও কথা নয়। এখুনি ওই গাড়িতে ওঠ।”
সিরাজ আর কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই মেয়েটা ওঁর হাত ধরে একরকম টানতে টানতে পাশেই রাখা একটা গাড়িতে প্রায় ধাক্কা মেরে তুলে দিয়ে গাড়ি চালিয়ে দিল!
“…বন্ধুরা, এইমাত্র আপনারা দেখলেন সিরাজ আরেকজন গুড সামারিটানের সাহায্য পেয়ে গেল। সত্যি, সিরাজের ভাগ্যকে কিন্তু হিংসা করতেই হয়! রুংটা গ্যাং আর হয়তো মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই ওকে ধরে ফেলত। তার আগেই আমরা দেখলাম একজন সহৃদয়া তরুণী সিরাজকে ওঁর গাড়িতে তুলে কোনও তুলনামূলক সেফ যায়গায় নিয়ে যাচ্ছেন। সময় কিন্তু আর বেশি বাকি নেই । আর মাত্র দেড় ঘণ্টা হাতে আছে। পারবে কি সিরাজ নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে? আমাদের বিজনেস অ্যানালিস্ট টিম জানাচ্ছেন এই ধরনের খেলায় শেষ দু ঘণ্টায় মৃত্যুর হার সবথেকে বেশি। প্রায় ৮৫ শতাংশ! সিরাজও কি এই স্ট্যাটিস্টিকস কে ঠিক প্রমাণ করবে? নাকি আর কোনও চমক অপেক্ষা করে আছে? জানতে হলে সঙ্গে থাকুন।দেখতে থাকুন…!”
গাড়িটা ততক্ষণে মানিকতলা পেরিয়ে শ্যামবাজারের দিকে যাচ্ছে। সিরাজ হতবাক হয়ে ড্যাশবোর্ডে লাগানো ছোট্ট এল ই ডি স্ক্রিনটার দিকে তাকিয়ে ছিল। স্যাটেলাইট ভিউ তে তাদের গাড়িটা দেখানো হচ্ছে। সঙ্গে সঞ্চালিকার ধারাভাষ্য।
“এটা কি হল? এসব কি হচ্ছে? আপনি তো স্টারডাস্ট প্রডাকশনেরই এমপ্লয়ি। ওরাই তো গেমটা চালায়। তাহালে আপনাকে গুড সামারিটান বলা হচ্ছে কেন?”
শ্যামবাজারের পাঁচ মাথার মোড় পেরিয়ে বিটি রোডে পড়ল গাড়িটা।
প্রশংসা মানে, স্টারডাস্ট প্রডাকশনের জুনিয়র অ্যাসোসিয়েট প্রশংসা মল্লিক হতাশ চোখে সিরাজের দিকে তাকাল। নাহ, লোকটা সত্যিই খুবই বোকা। এখনও বোঝেনি যে ডেথ গেমে ‘গুড‘ বলে কোনও ব্যাপারই হয় না! যে কয়েক কোটি লোক হত্যালীলা দেখার জন্য টিভি, ল্যাপটপ, ট্যাবে চোখ আটকে বসে আছে শেষ ঘণ্টা পাঁচেক ধরে, তারা করবে সাহায়্য! গুড সামারিটান ইন ডেথ গেম! সোনার পাথরবাটি। হ্যাঁ দর্শকরা হেল্প করছে ঠিকই, কিন্তু তারা শিকারকে নয়, শিকারিকে হেল্প করছে! শিকারের প্রত্যেকটা গতিবিধি, নড়াচড়া ধরার জন্য ১৪০ মিলিমিটারের লং শট লেন্স, ৫০–৮০ মিলিমিটারের মিড লং শট লেন্সগুলো কি এমনি এমনিই ড্রোনের মধ্যে ইন্সটল করা হয়েছে নাকি? তাছাড়া সিরাজ জানেও না, জারকিং মোমেন্টস আর পয়েন্ট অফ ভিউ শটগুলোরে জন্য ক্যামেরাম্যানরা প্রায় সবসময়ই ওকে ফলো করছিল। অর্থাৎ, দর্শকরা ঘরে বসেই জেনে যাচ্ছিলেন সিরাজ কোথায় এবং সেইমত টুইট করে, কিম্বা শেয়ার করে যাচ্ছিলেন তার রিয়েল লোকেশন! আর হ্যাঁ, টার্গেট মারা গেলে, সেই সময়ের তিরিশ সেকেন্ড আগে লোকেশন আপডেট দিয়ে যা যা পোস্ট হয়েছিল তার মধ্যে থেকে লাকি ড্র এর মাধ্যমে একজন পোস্টদাতাকে বেছে নিয়ে পুরস্কৃত করারও ব্যাবস্থা রেখেছে স্টারডাস্ট প্রোডাকশন হাউস।
কিন্তু এবারে লোকটাকে সত্যিটা বলার সময় এসেছে। সিরাজ যে দু–চারবার প্রায় মরতে মরতে বেঁচে গেছে তা প্রোডাকশন হাউসেরই সৌজন্যে। খেলা যদি শুরুর দু–তিন ঘণ্টার মধ্যেই শেষ হয়ে যায় তাহলে বিজ্ঞাপন দাতারা তো ছিঁড়ে খাবে।
“সিরাজ, দর্শকরা তোমায় সাহায্য করছে না, রুংটা গ্যাংকে সাহায্য করছে। এই ধরনের খেলায় দর্শক–খেলোয়াড়দের মধ্যে একটা পারস্পরিক আদানপ্রদান না থাকলে জনপ্রিয়তা অর্জন করা যায় না। আমরা এটা দর্শকদের ওপরেই ছেড়ে দিয়েছিলাম, কিন্তু আমাদের সিস্টেম দেখাচ্ছে ৯৩.৭৮ শতাংশ লোক খুনিদেরই সাহায্য করার অপশন বেছে নিয়েছেন! তাই বাধ্য হয়ে আমরাই তোমাকে সাহায্য করতে শুরু করি। চায়ের দোকানের যে লোকটা একটা শর্টকাট বলে দিয়েছিল, কলেজ স্ট্রীটের সামনে যে তোমাকে বাইকে লিফট দিয়েছিল আর সায়েন্স কলেজে যে তোমাকে সিমেন্টের চৌবাচ্চায় লুকিয়ে ফেলেছিল তারা আমাদেরই লোক ছিল। নাহলে অনেক আগেই তোমার খেলা শেষ হয়ে যেত। ”
“কিন্তু কেন!”
“সেটা আমরাও জানিনা। আমরা ভেবেছিলাম কোনও পেশাদার খুনির বদলে তোমার মত সাধারণ মানে ‘আম আদমি‘ নিলে দর্শকরা আরও একাত্ম হতে পারবে। সেটা হয়েছে ঠিকই, কারণ ভিউয়ার কাউন্ট এই মুহূর্তে আগের সমস্ত রেকর্ড ছাপিয়ে গেছে। কিন্তু একইসঙ্গে দর্শকরা শিকারকে সাহায্য না করে কেন শিকারিকে সাহায্য করছেন তা আমাদেরও বোধগম্য হয় নি।” প্রশংসা কিছুটা আনমনা হয়ে গেল। এই হত্যালীলা সপরিবারে বসে উপভোগ করার মধ্যেই কি কারণটা লুকিয়ে নেই? সে ভাবল।
ক্লান্তিতে আর হতাশায় সিরাজ ভেঙে পড়ল। সব মিথ্যে! সে নিজেকে ভেবে এসেছে এই দর্শকদের প্রতিনিধি। এত যে ফ্যান মেল পেয়েছে সে, এত অভিনন্দন বার্তা এই খেলায় যোগ দেওয়ার আগে, তারাই আবার তার মৃত্যুটা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করার জন্য কিশোরদের সাহায্য করছিল!
গাড়িটা বরানগর পেরিয়ে বিটি রোড ছেড়ে ভেতরের রাস্তা ধরে একদম গঙ্গার পাড়ে এসে পড়ল। প্রশংসা গাড়ি থামিয়ে বলল,”কিশোররা অনেকক্ষণ ধরেই ফলো করছে। আমার কাছেও নির্দেশ চলে এসেছে তোমায় এবার কোথাও ড্রপ করে দেওয়ার জন্য। আর চল্লিশ–পয়তাল্লিশ মিনিট মতো আছে তোমার হাতে। বেস্ট অফ লাক!” সিরাজ কিছু বলার আগে প্রশংসা গাড়ি ঘুরিয়ে বেরিয়ে গেল।
এদিকটায় সিরাজ আগেও এসেছে। সামনে আধ কিলোমিটারের মধ্যেই দক্ষিণেশ্বরের মন্দির। ওখানে হয়তো আর কিছুক্ষণ লুকিয়ে থাকার মত জায়গা পাওয়া যাবে!
বেঁচে থাকার তাগিদেই সিরাজ মন্দিরের দিকে ছুটতে শুরু করলো। গেটের কাছে একটা হালকা জমায়েত। কয়েকজন প্রাতঃভ্রমণকারী, দুয়েকজন পুজো দিতে আসা মানুষ, পুরোহিত এবং এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কিছু ভিখারি। পার্কিং প্লেসটার কাছে এসে সে একটু ইতস্তত করলো। কোনদিকে যাওয়া যায়?
হটাৎ একটা পটকা ফাটার মত আওয়াজের সাথে সাথে সিরাজের মনে হল তার কাঁধের মধ্যে কে যেন একটা আগুন গরম লোহার শিক আমূল ঢুকিয়ে দিল! আর্তনাদ করে সে মাটিতে বসে পড়ল। আশেপাশের লোকজন চমকে তাকাল।
“প্লিজ হেল্প মি!” সিরাজ যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিল। কেউ এগিয়ে এলনা। একজন পুরোহিত ছুটে এলেন। “একি মন্দিরের মধ্যে এসব কি হচ্ছে! বাইরে যান, বাইরে যান।”
“ওরা আমায় মেরে ফেলবে…দয়া করে…”
“মরার জন্যই তো এসব খেলায় নাম দিয়েছেন!” একজন পথচারী সিরাজের দিকে ঝুঁকে এলো। “কত টাকা পাচ্ছেন তা কি আর আমরা জানিনা?” ভদ্রলোক হিংস্রভাবে হাসলেন। ততক্ষণে ছোটখাটো একটা ভিড় জমে গেছে। বোঝাই যায় শেষ মুহূর্তের সাক্ষী হতে অনেকেই উৎসাহী। কেউ কেউ পকেট থেকে মোবাইল বের করে ছবিও তুলতে লাগল।
ঘুম আর জাগরণের মাঝামাঝি একটা অবস্থায় সিরাজ দেখল ভিড় ঠেলে কিশোর আর ওর দুই সঙ্গী ঢ্যাঙা আর মোটা লোকটা এগিয়ে এল। আগের গুলিটা মনে হয় অন্য কেউ চালিয়েছিল। কিশোর ওর পকেট থেকে ফিফথ জেনেরেশন গ্লক স্মার্ট গানটা বের করল।
সিরাজ চোখ বন্ধ করলো। এতগুলো লোক, কেউ একটু সাহায্য করলো না! আচ্ছা একটু পরে কি এরা ওর ডেডবডির সামনে সেলিব্রেট করবে?
কিশোর হতভম্ব হয়ে পিস্তলটার দিকে তাকাল। কি হল! ট্রিগারটা জ্যাম হয়ে গেল কিভাবে!
“…বন্ধুরা, এইমাত্র আপনারা দেখতে পেলেন সিরাজ খেলায় জিতে গেছে! ইয়েস! হি হ্যাজ ক্রিয়েটেড হিস্ট্রি! আপনারা নিশ্চই ভাবছেন কিশোর ফায়ার করা সত্ত্বেও গুলি বেরোল না কেন? এই খেলা শুরু হয়েছিল গত কাল রাত সাড়ে আটটায়। নিয়ম অনুযায়ী সকাল সাড়ে ছয়টা পর্যন্ত সিরাজকে সারভাইভ করতে হতো। মাত্র ২ সেকেন্ডের জন্য সিরাজ বেঁচে গেছে। কিশোর ছটা বেজে তিরিশ মিনিট এবং দু সেকেন্ডে গুলি চালিয়েছিল। অ্যান্ড থ্যাঙ্কস টু আওয়ার ওয়াইড এরিয়া কন্ট্রোল সিস্টেম, খুনিরা যেসব স্মার্ট গান ইউজ করেন সেগুলো প্রোগ্রামেটিক্যালি ঠিক রাত সাড়ে আটটায় রিমোটলি অ্যাকটিভেট করা হয়, এবং সাড়ে ছয়টা বাজলেই অটোমেটিক্যালি ডি–অ্যাকটিভেট হয়ে যায়। অতএব দেখতেই পাচ্ছেন সিরাজ মাত্র কয়েক মুহূর্তের জন্য বেঁচে গেছে এবং প্রায় ৫৩ কোটি টাকার পুরস্কার জিতে নিয়েছে। আমাদের ক্যামেরাম্যানরা পৌঁছে গেছেন সিরাজের কাছে, বাইটের জন্য! কিন্তু সিরাজ কোনও কথা বলছেন না কেন! উনি এখনও পালানোর চেষ্টা করছেন…!”
ধারাভাষ্যে ক্ষণিকের নিস্তব্ধতা নেমে এল।
“প্রিয় দর্শক, আমাদের মেডিক্যাল টিম সিরাজের কাছে পৌঁছে গেছে। সিরাজের খুব সম্ভব নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়েছে। ও আর নিজের মধ্যে নেই! তবে চিন্তা করবেন না বন্ধুরা, আমাদের মেডিক্যাল ইউনিট ওর সমস্ত রকম চিকিৎসার দায়িত্ব নেবে! আমরা ওকে সুস্থ করে তুলবোই। সিরাজ আবার ফিরে আসবে নতুন কোনও খেলায়, নতুন ভাবে। চোখ রাখুন আমাদের চ্যানেলে পরবর্তী রোমাঞ্চকর খেলার ব্যাপারে আপডেট পেতে! সঙ্গে থাকুন, দেখতে থাকুন…!
Tags: অনুবাদ, অনুবাদ গল্প, দ্বিতীয় বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, পূজাবার্ষিকী, প্রসেনজিত দাশগুপ্ত, প্রাইজ অফ পেরিল, রবার্ট শেকলে
এই গল্পটি বহুবার নানা বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু হয়েছে একটি বাংলা উপন্যাসের সাথে এর থীমগত মিলের জন্যে। এবার অনেকেই বাংলায় গল্পটী পড়ার সুযোগ পেলেন এই অনুবাদটির জন্যে।