পুতুলবাড়ি আরোগ্যনিকেতন
লেখক: অভীক সরকার
শিল্পী: ধ্রুবজ্যোতি দাস এবং দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য (চিত্রচোর)
তারক মণ্ডল ছেলে হিসেবে অতি চমৎকার তো ছিলই, তদুপরি তার একটা আশ্চর্য গুণ ছিল, সব জায়গায় সে ভূত দেখতে পেতো, আর সেটাই শেষ পর্যন্ত ….
ঘটনাটা গোড়া থেকেই খুলে বলি।
তারক মণ্ডল, আগেই বলেছি, অতি চমৎকার ছেলে। খড়দা‘র দিকে বাড়ি। বাপ এক্সাইজের কেউকেটা ছিলেন, মা স্কুলের মাস্টারনি। বুঝতেই পারছেন, একেবারে রূপোর চামচ কেস না হলেও তারক খুব একটা অবহেলায় মানুষ হয়নি। পড়াশোনাতে খুব সাঙ্ঘাতিক রকমের ভালো কিছু না হলেও খানচারেক মাস্টারের দৌলতে ছেলে দিব্যি টুকটাক পাশ করে যাচ্ছিল, অন্তত গ্র্যাজুয়েশন পর্যন্ত আটকাবার মতন কিছু ঘটেনি। দিব্যি হাসিখুশি বন্ধুবৎসল ছেলে, ঘাসের মতন পেলব দাড়িগোঁফ গজানোর কালে দুচারটে খুচরো বান্ধবী জুটেছিল বটে, তবে সেসব বখেড়া দ্রুতই মিটে যায়। মোটামুটি নির্ভার, নিঃশঙ্ক, হৃষ্ট হৃদয়ে তারক তার নিজের বন্ধুবান্ধব, পোষা নেড়ি গজেন্দ্রকুমার আর পাশের বাড়ির বিল্লি হরিকামিনী কে নিয়ে সুখে ছিল।
তাকে ভূতে কিলোলো ভূতেই!
তারক প্রথম ভূত দেখতে পায় যখন তার বয়েস সাত। এর আগে সে যাবতীয় রাক্ষস–খোক্কস, মামদো, ব্রহ্মদত্যি ইত্যাদির গল্প শুনে বিচিত্র শিরশিরানি জাগানো আমোদ লাভ করেছে। তা সেরকমই এক আমোদিত সন্ধ্যায় বাড়ির পেছনের বাগানে সাদা কাপড়ে চলমান এক অশরীরীকে দেখে সে বাড়ি মাথায় করে এবং তৎক্ষণাৎ হুলুস্থুলু পড়ে যায়। প্রথমে কেউই এগোতে সাহস পাচ্ছিল না এবং কাজটা দমকল, পুলিশ না হরিসংকীর্তন সমিতির বিবেচনার মধ্যে পড়ে এনিয়ে একটা ঘোর গণ্ডগোল পাকিয়ে ওঠে। অবশেষে পাড়ার ধোপা রামেশ্বরদুসাদ উচ্চৈঃস্বরে রামচরিত মানস আবৃত্তি করতে করতে আমগাছের পেছন থেকে রোরুদ্যমানা সেই চূঢ়ৈলকে উদ্ধার করে আনার পর প্রকাশ পায় যে সেই প্রেতিনী আসলে তারকের জ্যেষ্ঠ তাত কন্যা টুনটুনি, ওরফে দেবারতি। পাশের পাড়ার উঠতি মাচোম্যান ভটকু ওরফে দেবব্রতর সঙ্গে তার আজ কিঞ্চিৎ নৈশাভিসারের অভিলাষ ছিল।
এরপরেও কিন্তু তারকের ভূতদর্শন বন্ধ হয়নি। দশ বছর বয়সে একবার খেলতে গিয়ে বল হারিয়ে গেলে তার সন্ধানে সে দ্রুত মাঠের পাশের ইঁটভাটার পেছনে যায় এবং তার পরে পরেই সেই পড়ন্ত বিকেলে চিক্কুর ছেড়ে অজ্ঞান হয়ে যায়। বন্ধুবান্ধবরা দৌড়ে এসে মহাশোরগোল তুলে ফেলে। অবশেষে তারক সংজ্ঞাপ্রাপ্ত হলে হাপুস নয়নে কেঁদে জানায় যে এক লাজুক শাঁখচুন্নি খুবই অনিচ্ছার সঙ্গে তাকে দর্শন দিয়ে ফেলেছেন। প্রথমবার দেখে তারক মোটেও ভয় পায়নি, কিন্তু যখন সেই অতিশয় বিব্রত মহিলাটি এই অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্যে বারবার ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকেন, এবং ক্ষতিপূরণ বাবদ তারককে তাঁর সঙ্গে গিয়ে কিছু কেক বিস্কুট ইত্যাদি গ্রহণ করার জন্যে সস্নেহ জোরাজুরি করতে থাকেন, তখনই তারক জ্ঞান হারায়, বা বলা ভালো জ্ঞান হারাতে বাধ্য হয়।
এর পরে ভূত দেখাতে তারক বেশ পোক্ত হয়ে ওঠে। নিজের বাড়ির বাথরুমে, বন্ধুদের সঙ্গে ট্রেকিঙে গিয়ে, বইমেলাতে আনন্দর স্টলে, সিনেমা হলের অন্ধকারে, যত্রতত্র ভূতদর্শনে তারকের দক্ষতা বন্ধুদের মধ্যে তাকে ঈর্ষণীয় খ্যাতি এনে দেয়। কথিত আছে প্রথম বান্ধবীর সঙ্গে প্রথম ডেটিংএ গিয়ে শ্রীতারক মেয়েটিকে পরেরদিন হটপ্যান্ট পরে আসতে বলেন। আধুনিকা মেয়েটির তাতে আপত্তি ছিল না বিশেষ, শুধু সে একবার কৌতূহলভরে এহেন আব্দারের কারণ জিজ্ঞেস করাতে তারক জবাব দেয় যে সে দেখবে মহিলাটির হাঁটু উলটো কিনা! তার কেমন যেন সন্দেহ হচ্ছে ….
সে যাত্রা বেচারাকে বেশ কিছুদিন হাসপাতালে থাকতে হয়!
ক্রমে ক্রমে তারক দিনদুপুরে ঘরের মধ্যে ভূত দেখতে শুরু করে। এই হয়তো খেতে বসে মাছের ঝোলের বাটি থেকে একটা ভুতুড়ে চিংড়িমাছ তুলে ফেলে দিল, পরক্ষণেই হয়তো ছাদে গিয়ে হুউউশ করে কাকভূত তাড়াতে লাগলো। কি রাত্রে হয়তো খুবই আদর করে গজেন্দ্রকুমার এর সঙ্গে আরো একজনকে এঁটোকাঁটা দিয়ে ভাত মেখে দিলো, যাকে দেখা যায় না এবং তারক যার নাম দিয়েছে ভুতুয়া!
বলাবাহুল্য তারকের বাড়িতে এই নিয়ে অশান্তির শেষ ছিল না। প্রথমে ব্যাপারটাকে ছেলেবয়সের ক্ষ্যাপামি বলে বিপুল হাসিঠাট্টাসহ প্রশ্রয় দেওয়া হতো, (“তোমার মামিকে একটা ভূত দেখিয়ে দাও তো সোনাই“)। কিন্তু বয়েস বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিবার পরিজন প্রথমে বিরক্ত, পরে ক্রুদ্ধ, তারপরে বিস্মিত এবং শেষে চিন্তিত হয়ে পড়েন। না, ডাক্তার দেখাতে তারা কেউ কমতি করেন নি। বিভিন্ন বিহেভিয়ারাল থেরাপিস্ট, চাইল্ড সাইকোলজিস্ট ইত্যাদি সমুদ্র পেরিয়ে তাঁরা যখন তাবড় তাবড় মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের দুয়ারে হত্যা দেওয়া শুরু করেন তখন তারকের প্রথমযৌবন।
প্রথম বিশেষজ্ঞকেই তারক ঘাবড়ে দেয় এই বলে যে ভদ্রলোকের মৃতা প্রথমা পত্নী এখনও ওঁকে ছেড়ে যাননি, সেই মুহূর্তে ঘরেই আছেন, ইনফ্যাক্ট ডাক্তারবাবুর চেয়ারের পিছনেই আছেন এবং তিনি তারককে ইশারা করে জানতে চাইছেন যে তিনি ডাক্তারবাবুর ঘাড়ই মটকাবেন নাকি মাথায় ভারি টেবিল ল্যাম্পটা তুলে মারাটাই ঠিক হবে?
বলা বাহুল্য, ডাক্তারবাবু ব্যাপারটা খুব ভালো মনে নেননি। ফলত তারক কে বেচারিকে না হোক কিছু হেনস্থার সম্মুখীন হতে হয়।
আমরা পাড়ার ছেলেরা অবশ্য প্রথম প্রথম হেবি ইয়ার্কি নিতাম। ওর নামই হয়ে গেছিলো ভুতো তারক, সংক্ষেপে ভুতো। রাস্তায় বেরোলে আওয়াজ দিতাম বটে, তবে তারক বেশ হাসিমুখেই সেসব মেনে নিতো, এমনকি রীতিমতো উপভোগ করতো। কিন্তু আমাদের সেই পরস্মৈপদী আমোদ বেশিদিন কপালে সয়নি। ব্যাপারটা এরকম।
এক বর্ষার সন্ধ্যায় ক্লাবে বসে ক্যারাম পিটছি আর বেগুনী দিয়ে মুড়ি মাখাচ্ছি, এমন সময় হঠাৎ ক্লাবের দরজায় তারক!
রগড়ের আশায় তাকে ডেকে বসানো হলো, কাঁচালঙ্কা আর দুটো গরমা গরম বেগুনী দিয়ে একবাটি মুড়িমাখা তার হাতে দেওয়া হলো। প্রথম থাবাটা মুখে পুরে কাঁচালঙ্কায় একটা কামড় দিয়ে তারক আবেশে চোখটা বুজেছে কি বোজেনি, এমন সময় ক্লাবের বয়ঃজ্যেষ্ঠ সদস্য শিবুদা তারকের পাশে বসে পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে জিজ্ঞেস করলেন,
“হ্যাঁরে তারক, ওসব কি সত্যি?”
“কি সত্যি শিবুদা?”
“তুই নাকি ভূত দেখিস সব জায়গায়? সত্যি রে?”
খাওয়া থামিয়ে অবাক চোখে তাকায় তারক। “সে কি কথা শিবুদা? কল্যাণী থেকে কামারহাটি আদ্দেক লোক জানে, আর তুমি জানোনা?”
শিবুদা একটু অপ্রস্তুত হয়, “আহা, তা বলিনি। বলছি, তুই কি সত্যিই ওসব, মানে ওনাদের দেখতে পাস?”
এবার সামান্য বিরক্ত হয় তারক, বেগুনী চিবোতে চিবোতে শিবুদার দিকে ট্যারা চোখে তাকিয়ে গলায় সামান্য ঝাঁজ মিশিয়ে বলে, “না হলে কি আমি মিথ্যা বলি? আমি অবশ্য জানি তোমরা তাই মনে করো। যাক, অনেক মুড়িটুড়ি খাওয়ালে, থ্যাংকিউ। বিশ্বাস যখন করো না তখন…” বলে মুড়ির ঠোঙা নামিয়ে দরজার দিকে হাঁটা লাগায় সে।
সঙ্গে সঙ্গে সারা ক্লাব হাঁ হাঁ করে ওঠে, রগড় ফস্কে যায় যে! তাকে ফের প্রায় ধরে বেঁধেই বসানো হয়।
“আহাহা, তাই কি বলেছি রে পাগলা?” শিবুদা গলায় মধু ঢেলে দেন,” তোকে ছোট্ট থেকে চিনি, তোকে কি মিথ্যেবাদী বলতে পারি রে? তা নয়, আসলে আমরা, ইয়ে, মানে সে সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত কিনা, তাই আরকি … তা ভাই, বলছি যে তুই পষ্ট দেখতে পাস বলছিস? বাহ বাহ, তা ইয়ে, কেমন দেখতে রে?”
মুড়িটা খেয়ে ঠোঙাটা দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে নিঃস্পৃহ স্বরে তারক বলে “তেমন স্পেশাল কিছু না, এক কন্দকাটা ছাড়া। বাকি ওই, সবাই যেমন জীয়ন্তে থাকে, তেমনই। এক কন্ধকাটাটাই যা … আসলে একটা ইয়ে, কথা নেই, বার্তা নেই, নিজের মুন্ডুটা হাতে নিয়ে ঘুরলে কেমন কেমন লাগে না? তোমরাই বলো?” আমাদেরই সালিশ মেনে বসে তারক। আমরাও দ্রুত একমত হই, না হয়ে উপায় কি?
“তা, দুয়েক জনের উদাহরণ দে দেখি, কেমন দেখতে?” পেছন থেকে পিকাইয়ের ফোড়ন।
“কেমন আর হবে?” উদাসই শোনায় তারকের গলাটা, “এই তো সেদিন বাহাদুরকে দেখলাম, আরে দেবলোক অ্যাপার্টমেন্টের দারোয়ান ছিল যে বাহাদুর, ট্রেনে কাটা পড়ে ছিল যে। আমি কলেজ থেকে ফিরছি, স্টেশন রোড পেরিয়েই দেখি পুরোনো অশ্বত্থ গাছের নিচে বাহাদুর দাঁড়িয়ে। মুণ্ডুটা অবশ্য ওর টুপি সমেত গাছেই ঝোলানো ছিল। আমাকে দেখে ভারি খুশি হলো বাহাদুর। দুটো সুখ দুঃখের কথা হলো। তারপর চলে আসবো, আমাকে বাহাদুর কি বললো জানিস?”
“কি?” পিকাইয়ের গলার সন্ধিগ্ধ ভাবটা কারোরই নজর এড়ায় না।
“বললো পিকাইবাবুকে বারণ করবেন, পবন তিওয়ারির মেয়ে লছমীর সাথে বেশী লটঘট যেন না করে। পবন তিওয়ারির কানে কথাটা গেলে পিকাইবাবুর মুণ্ডুখানা বাবা অমরনাথের চরণে, আর বডিখানা কালীঘাটের সামনে পাওয়া যাবে, হ্যাঁ। পবন তিওয়ারি হেবি ডেঞ্জারাস মাল।“
পিকাই যে হঠাৎ কেন “মায়ের ওষুধ কেনার কথা একদম মনে ছিল না ” বিড়বিড় করতে করতে বেরিয়ে গেলো সেটা বুঝতে অবশ্য কারোরই অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
এরপর খানিকক্ষণ সবাই চুপচাপ থাকার পর মাধ্যমিকে জেলাতে ফোর্থ হওয়া সৌম্য জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা তারকদা, ওনারা কি সব জায়গাতে থাকেন? মানে তুমি কি সব জায়গাতেই ওনাদের দেখতে পাও?”
ভুবনজয়ী হাসি বিলিয়ে তারক বলে “এ নিয়ে কোনও সন্দেহ আছে নাকি রে পাগলা?”
“ধরো এই ক্লাবরুমে?”
প্রশ্নটা শুনেই অনেকে “নাহ অনেক রাত হলো“, “ইশ, পাউঁরুটি নিয়ে যেতে হবে, একদম মনে ছিল না“, “আরে, আজ ন‘টা থেকে এক্স–বাংলা চ্যানেলে গানের সেই কম্পিটিশনটা না? দেখলে, অ্যাগদম ভুলে গেস্লুম” বলে দ্রুত কেটে পড়ে। রয়ে যায় সৌম্য, শিবুদা, আমি, বাবলু আর নয়ন বা ভজা, ঠিক মনে নেই।
আর সেই হঠাৎ ফাঁকা হয়ে আসা ক্লাবঘরে বর্ষার স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়ার মধ্যে লোডশেডিং হওয়াটা যে কোনও কাজের কথা নয়, একথাটা আমি সারাজীবন মনে রাখবো।
সৌম্যই একটা মোমবাতি ধরায়। মোমবাতির আলোতে আমাদের ছায়াগুলো বিশাল হয়ে দেওয়ালে পড়ে কাঁপতে থাকে। শিবুদার কাছ থেকে চেয়ে একটা সিগারেট ধরায় তারক, বেশ আয়েশ করে একটা টান দেয়, ধোঁওয়ার রিং ছেড়ে গভীর গলায় বলে,
“বটেই তো। একজন তো এখানে আছেনই।“
উত্তরটা আমাদের কাউকেই যে বিশেষ খুশি করেনি, সেকথা না বল্লেও চলবে। সৌম্য দরজার কাছে বসে ছিল, সেখান থেকেই সে ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলায় জিজ্ঞেস করে “কে তিনি, কোথায় গেলেন?”
উত্তরে তারক বেশ একটা উচ্চাঙ্গের হাসি হেসেই হঠাৎ মাথাটা নামিয়ে ফিসফিস করে বলে, “কেন, ওপরে দরজার মাথার কাছটায় দেখতে পাচ্ছিস না? ওই যে কালো মতো, ধোঁওয়া ধোঁওয়া … দেওয়াল বেয়ে তোর দিকেই নেমে আসছে যে …..”
শুধু সৌম্য কেন, আমরা বাকিরা সব্বাই তৎক্ষণাৎ দরজার বাইরে ঝাঁপ দিই এবং তারপর চোঁচাঁ দৌড়।
এরপর থেকে তারককে অন্তত আমরা আর ঘাঁটাইনি।
ক্লাবঘরের ঘটনাটা চাউর হতে বেশি দেরি হয়নি। লোকে তারককে নিয়ে হাসিঠাট্টা করা তো বন্ধ করলোই, রাস্তাঘাটে তারককে দেখে সসম্ভ্রমে রাস্তা ছেড়ে দিতে লাগলো লোকে। পাড়ার বড়লোক সাহাবাবু দেখা হলেই “হেঁহেঁ, মা বাবা কেমন আছেন তারক” বলে খবর নেওয়া শুরু করলেন, দোকানি বাজারিরা “নমস্কার তারকবাবু” বলে একদম ন্যায্য দামে জিনিস দিতে লাগলো, এমনকি অটোওয়ালারা পাঁচটাকা ভাড়ার বদলে তারককে দুহাজার টাকার খুচরোও দেওয়া শুরু করলো। এমনকি আরও যেসব রোমহর্ষক ব্যাপারস্যাপার শুরু হলো সেগুলোকে মনে করলেও কম্প দিয়ে জ্বর আসে, আচ্ছা আচ্ছা লোকের নাড়ি ছেড়ে যায়!
আর কিছুই না, এদিক ওদিক থেকে লোকজন ভূতসিদ্ধ বাবা তারক মহারাজের দর্শনে আসা শুরু করে!
ব্যাপারটা চালু করে এলাকার গোয়ালা রামভজন, ওরফে ভজুয়া। এক সূর্যকরোজ্জ্বল পুণ্য প্রভাতে সে স্নানটান সেরে, গেরুয়া টিশার্ট ও শর্টস পরিধানান্তে কপালে তিলক কেটে, কাঁধে গামছা এবং হাতে একঘটি দুধ নিয়ে বেশ পবিত্র ভাবে রামধুন গাইতে গাইতে এসে হাজির। তারকের বাবা তখন বাগান পরিচর্যায় ব্যস্ত ছিলেন। সাতসকালে ভজুয়া ভক্তিভরে খুবই বিনীতভাবে এসে দাঁড়াতেই তিনি অত্যন্ত বিস্মিতভাবে জিজ্ঞেস করেন, “কিরে ভজুয়া, সকাল সকাল ধড়াচূড়া পরে চললি কোথায়?”
“তারকবাবা কে পাস আয়েঁ হ্যায় হুজৌর“
ভদ্রলোক যারপরনাই অবাক!
“তারক??? সে আবার বাবা হলো কবে, অ্যাঁ? এসব কি শুনছি? কি সব বকছিস ভজুয়া?”
ভজুয়া তাড়াতাড়ি লম্বা জিভ কাটে, “এ বাবা সে বাবা নয় বাবু। হামাদের তারকবাবার তো ভূত পিরেত চূঢ়ৈলদের সঙ্গে খাতিরদারি আছে, তাই…. “
অকস্মাৎ তারকের বাবার গলাটা পৌষমাসের নর্থ পোলের মতই ঠান্ডা হয়ে যায়, “আচ্ছা, তাই? তা তোর কি চাই রে ভজুয়া?”
এই প্রশ্ন শুনে ভজুয়া বড়ো লাজুক হয়ে পড়ে, “শাদির তো পাঁচ বরষ হয়ে গিলো, বাচ্চাউচ্চা কুছু হয় নাই, বাবু তো সোবই জানেন। তাই শোচলাম কি, তারকবাবা যদি কুছু জড়িবুটি দেন তো….”
হায়, কোথায় লাগে কার্ল লুইস, কোথায় লাগে উসেইন বোল্ট! ভজুয়া এরপর যে দৌড়টা দিতে বাধ্য হয় সেটা দেখে যে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা গেমটিচার ওকে সাইতে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করতে চেয়েছিলেন তার যথেষ্ট প্রমাণ আছে। আর যে ভীমনাদে চারিদিক প্রকম্পিত করে তারকের বাবা ভজুয়াকে বধ করতে উদ্যত হন তাতে তারকদের বাড়ির নারকেল গাছ থেকে দুটো ডাব খসে পড়ে, এ আমার স্বচক্ষে দেখা!
এরপর আর কোনও উপায় না দেখে তারকের মা বাবা তান্ত্রিকশ্রেষ্ঠ শ্রী মহাকালভৈরবের শরণাপন্ন হন।
তান্ত্রিকশ্রেষ্ঠ মহাকালভৈরব ঘোর অঘোরপন্থী সাধক, বামাচার থেকে শুরু করে সুলেইমানি তন্ত্র অবধি গুলে খেয়েছেন, যদিও তিব্বতি বজ্রতন্ত্রেই অবশ্য ওঁর সমধিক প্রসিদ্ধি। ভূতডামরতন্ত্র আর বজ্রযোগিনীতন্ত্র একসঙ্গে পাঞ্চ করে নাকি বিশেষ ধরনের ভূত বন্ধন যন্ত্র তৈরি করেছেন, ইচ্ছে আছে শ‘পাঁচেক ভূত জমা হলে একটা ভূতেদের মিউজিয়াম বানাবেন, এন্ট্রি ফি পঞ্চাশ টাকা, অমাবস্যায় স্পেশাল ডিসকাউন্ট।
যেদিন তারককে নিয়ে তারবাবা এঁর কাছে যান। সেদিন কালভৈরব বাবা রক্তাম্বর পরে, গলায় জবাফুলের মালা ঝুলিয়ে, মড়ার খুলি থেকে কারণ সুধারস পান করতে করতে এক মাড়োয়াড়ি বেওসাদারকে উপদেশ দিচ্ছিলেন, “আহা ভূত তো আর তেমন বিশেষ কিছু নয়, অবস্থাভেদে বস্তুর যেমন গুণগত রূপান্তর ঘটে তেমনই মৃত্যুভেদে প্রাণীর আত্মগত রূপান্তর ঘটে, ওইটাই ভূত। জলকে উত্তপ্ত করলে যেমন ধোঁওয়া, তেমনই মানুষ মরে ভূত। এইতো আপনার পাশেই লম্বোদর বসে, আহা, আপনি দেখবেন কি করে? ভূতাশন মন্ত্রে সিদ্ধি না হলে কি আর ….. তা লম্বোদর আগের জন্মে সিপাই ছিল, মিউটিনিতে কি কম ইংরেজ কচু কাটা করেছে? শেষে অবশ্য ওকে কামানের মুখে বেঁধে …. কি হে লম্বোদর, কিছু বলো, ঠিক কিনা?”
সেই মাড়োয়াড়ি কুলপতি ততক্ষণে ঘেমে নেয়ে একশা। এরপরেও ভক্তি না এলে ভক্তি জিনিসটার থাকারই দরকার নেই দুনিয়াতে। কাঁদোকাঁদো স্বরে তিনি নিবেদন করেন, “বেওসাতে বহুত নুকসান যাচ্ছে বাবা, কুছু বেওস্থা কোরেন। উদিকে ফুড ইনিসপেকটর আর্জুন সিং পচাস লাখ ঘুস চাইছে বাবা, কুছু কোরেন বাবা…”
সেই মাড়োয়াড়ি সওদাগরটিকে বেশ কিছু কাঞ্চমূল্যের বিনিময়ে হোমিওপ্যাথির শিশিতে করে আড়াইখানা ভূত ধরে দিয়ে (“একদম ঝাঁকাবেন না কিন্তু, ডিপফ্রিজে রাখবেন, আর ইয়ে, রোজ সন্ধ্যেবেলা আড়াই পেগ হুইস্কি শোধন করে বোতলের ছিপিতে ওদের সামনে রেখে দেবেন কেমন? ওপরে একটু জবাফুলের পাপড়ি ছড়িয়ে দেবেন, তাহলেই হবে। আসলে, হেঁহেঁ, আমার এখানে থেকে থেকে এদের একটু অভ্যেস খারাপ হয়ে গেছে বুঝলেন। এসে প্রায়ই কান্নাকাটি করে, আমিও ওই এক দু পাত্তর … কি করি বলুন, কেষ্টরজীব!”) বিদেয় করে তিনি এদিকে ফিরলেন, “মা মা, ব্রহ্মময়ী মা আমার, আবার কোন অজ্ঞানী অবোধকে আমার কাছে পাঠালি মা?”
তারকের বাবা সোজা উপুড় হয়ে পড়েন, “বাবা দোহাই আপনার, বড় বিপদে আছি, উদ্ধার করুন বাবা।“
“ওরে মায়াবদ্ধ জীব, উদ্ধার কি অত সহজে হয় রে পাগল? ইড়াপিঙ্গলার প্রবাহ শাসনে রেখে তারমধ্যে কুলকুণ্ডলিনীকে জাগ্রত করতে হয়। তারপর তাকে ঠেলে তুলতে হয় সহস্রারে, তবেই মুক্তি, তবেই উদ্ধার। গত দেড়শো বছর ধরে কি এমনি সাধনা করেছি রে? কম করে সাতবার অমাবস্যার রাতে শবদেহ নিয়ে বসে অঘোর সাধনায় প্রেতশুদ্ধি লাভ করেছি। সে কি আর তোদের কর্ম রে পাগলা? যা, সাধু সেবায় একশোটা টাকা ফেলে দিয়ে মুক্ত হয়ে বাড়ি চলে যা দিকিন, তোর সব পাপ আজ থেকে আমার। লম্বোদর, বলি ও হে লম্বোদর, কারণ সুধা যে শেষ হয়ে এলো বাবা, চট করে হিমালয়ে আমার সাধন পীঠ থেকে গোটা দুয়েক বোতল নিয়ে ….
“ইয়ে, লম্বোদরদা এখন নেই। একটু কাজে পাঠিয়েছি।“
বোধহয় অ্যাটম বোম পড়লেও এতখানি বিস্মিত হতেন না তান্ত্রিক মশাই, “কে রে? কে রে ওখানে?”
গলাটা একটু সাফ করে নিয়ে সাড়া দিলো তারক, “ইয়ে, আমি তারক। লম্বোদরদা দেখলুম মশা মারছে আর হাই তুলছে। ভাবলুম দাদা বেকার বেকার বসে বোর হবে কেন, তাই একটু কচুরি আর সিঙ্গারা আনতে বাজারে পাঠিয়েছি। এই এসে পড়লো বলে।“
খানিকক্ষণ স্তম্ভিত অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তারকের দিকে তাকিয়ে রইলেন পিশাচসিদ্ধ তান্ত্রিক প্রবর শ্রী মহাকালভৈরব শাস্ত্রী। তারপর হুংকার দিয়ে উঠলেন, “ডেঁপো ছোঁড়া, আমার সঙ্গে ইয়ার্কি? দেবো নাকি উচাটনে টরেটক্কা করে? নাকি স্তম্ভন করে বটগাছে ঝুলিয়ে রাখবো অ্যাঁ ?”
তারকের বাবা ডুকরে ওঠেন, “ক্ষমা প্রভু ক্ষমা, এটাই তো আমার ছেলের রোগ, সবজায়গাতেই ও ভূত দেখতে পায়। দয়া করুন প্রভু, লাইফ পুরো হেজে গেছে। বাড়িতে আত্মীয়স্বজন আসেনা, কোথাও যেতে পারি না, বাচ্চারা রাস্তায় দেখলে বলে ‘ওই দ্যাখ ভুতোর বাবা যাচ্ছে‘, বলেই পালিয়ে যায়। আর সহ্য হচ্ছে না স্যার।“
অতি উচ্চাঙ্গের হাসি হেসে তিনি বললেন, “তাই নাকি রে ছোঁড়া, তুই ভূত দেখছিস নাকি আজকাল?”
তারক অতি বিনয়ী ছেলে, আগেই বলেছি। খুবই কাঁচুমাচু হয়ে বললো, “আজকাল কেন? ছোটবেলা থেকেই দেখতে পাই যে।“
গম্ভীর হয়ে গেলেন তান্ত্রিকমশাই, “বটে, বলি এই বটগাছের ওপর বসে আছেন ক্যাওড়াতলা মহাশ্মশানের আদি বাসিন্দা, শঙ্খচূর্ণী শ্রীমতী ফুল্লকুসুম দেব্যা, দেখতে পাচ্ছিস?”
“কে? ফুলুমাসি? তাকেও তো দেখলুম লম্বোদরদার সঙ্গে যেতে। বললেন গাছে ঝুলে ঝুলে মাজাটা ধরে গেছে, একটু ছাড়িয়ে আনি গে।“
খানিকক্ষণ বাক্যস্ফূর্তি হলো না তান্ত্রিকপ্রবরের, তারপরেই চোখ পাকিয়ে হুংকার দিয়ে উঠলেন, “বটে, এত সাহস তোর, আমার সামনে ভূতদর্শন নিয়ে ছেলেখেলা? বলি আর কাকে কাকে দেখতে পাচ্ছিস শুনি?”
গর্জন শুনে একটু কুঁকড়েই গেছিলো তারক, তারপর বলে “ইয়ে, আপনার ডানপাশে সনাতনকাকুকে নিশ্চয়ই দেখতে পাচ্ছেন। বাজারের কালীমন্দিরের পুরোহিত ছিলেন, গেলবার গলায় দড়ি দিয়ে সুইসাইড করলেন না!“
তান্ত্রিকমশাই একটু অস্বস্তিতেই যেন নড়েচড়ে বসেন, বাঁদিক চেপে সরে আসেন, গলা দিয়ে একটা ভাঙা গর্জন বেরোয়, “বটে?”
“তবে উনি লোক ভালো,” তারক হাত পা নেড়ে ব্যাখ্যা করতে থাকে, “আমাদের সঙ্গেই তো এলেন। আপনার তো খুবই প্রশংসা করলেন, বললেন ‘আহা, কালু বড় ভালো ছেলে, যেমন উচ্চমার্গের সাধনা তেমনই মায়ের পায়ে অচলা ভক্তি। আমরা তো এখানে নিজেদের মধ্যে ওকে নিয়ে আলোচনা করি প্রায়ই। তারাপ্রণব অবধূত তো বলেই ফেললেন সেদিন, ওরে ছেলেটাকে বড় ভালো লেগেছে রে, এখানে আনার ব্যবস্থা কর। ভাবছি ওকে আমরা খুব তাড়াতাড়িই আমাদের কাছে টেনে নেবো“।
গলার গেরুয়া রঙের উড়নিটা দিয়ে মাথার ঘাম মোছেন তান্ত্রিক শ্রেষ্ঠ শ্রী কালভৈরবশাস্ত্রী। তারপর ক্ষীণ গলায় বলেন, “দেখোভাই, আমার কিন্তু হাইব্লাড প্রেশার। রেগে গিয়ে একটা অভিশাপ টভিশাপ দিয়ে ফেললে কি তোমাদের ভালো লাগবে, অ্যাঁ?”
তারক একথায় আধহাত লম্বা জিভ কেটে ফেলে, “আরে ছিঃ। তাই কখনও পারি? তারপর দেখুন দয়ালবাবু, আরে আপনার পিছনেই দাঁড়িয়ে যে। দয়ালবাবুকে চিনলেন না? আরে পেনশনের টাকা আনতে গিয়ে হিটস্ট্রোকে ফৌত হয়েছিলেন যে, মনে নেই? তিনি তো আমাকে বারবার জিজ্ঞাসাই করছেন কলসিটা কোথায়?”
“কলসি? কলসি?” ত্রিকালদর্শী মহাকালভৈরব শাস্ত্রী থই পান না, “কলসি কিসের ভাই?” গলাটা কাঁদো কাঁদোই শোনালো না কি?
খুবই আশ্চর্য দেখায় তারককে, “সেকি? সনাতন কাকু বলেন নি আপনাকে? উনি তো আজ এসেছেনই আপনাকে নিয়ে যাবেন বলে। বলেননি? কি আশ্চয্যি! তা আপনার তো, মানে শত্রুদের মুখে ছাই দিয়ে বেশ খাতে পিতে ঘর কে ফিগার কিনা, টানতে একটু কষ্ট করতে হবে বলে দয়ালবাবুকে রাস্তায় দেখতে পেয়ে নিয়ে এলেন। তা দয়ালবাবু জিজ্ঞেস করছেন যে, দড়ি একটা উনি নিয়েই এসেছেন, শ্মশানের একটা খাটিয়া থেকে খুলে, এখন একটা কলসি পেলেই আর চিন্তার কিছু থাকে না। আরে সরবেন না, দয়ালবাবু আপনার বাঁ কাঁধের ওপর দিয়ে দড়িটা ফেলে আপনার গলার মাপ নিচ্ছেন যে, এই দ্যাখো উঠে পড়ছেন কেন? বলি চললেন কোথায়, ও কালুবাবু। বলি দয়ালবাবু যে দড়ি নিয়ে দৌড়চ্ছেন আপনার পেছনে, আরে গলার মাপটা না দিয়ে গেলে যে সনাতন কাকু রাগ করবেন …..”
এরপর আর কি হয়েছিল জিজ্ঞেস করবেন না। মোটমাট এরপরে উপায়ান্তর না দেখে এই বিচিত্র ভূত দেখার রোগ সারাবার জন্যে অনেক আলাপ আলোচনার পর তারককে কোনও মানসিক আরোগ্য নিকেতন, বা পাগলা গারদে দেওয়াই ঠিক হয়।
তারক যথারীতি প্রতিবাদে আকাশ বাতাস বিদীর্ণ করে ফেলে, কিন্তু মা বাবা ও ভবী, কেউই ভোলার কোনও লক্ষণ দেখান না। কান্নাকাটি, অনশন, দৈববাণী কিছুতেই কিছু হলো না। শেষে তারক জেদ ধরে বসলো যে তার ইচ্ছেমতন পছন্দ করা অ্যাসাইলামেই সে যাবে, নইলে আজই সে হাফ বোতল কার্বলিক অ্যাসিড খেয়ে গলায় দড়ি দেবে, চাই কি তারপর সে গলায় কলসি বেঁধে গঙ্গায় ডুব কি দিতেও পারে, কেউ যেন না আটকায়। আরও শর্ত রইলো, যে সে একাই ভর্তি হতে যাবে, সঙ্গে কেউ গেলে চলবে না।
“তাই সই“, দাঁত চিপে এই কথাই বললেন তারকের বাবা, “ইচ্ছে মতন ইয়ে খুঁজে নে গিয়ে। আপদ বিদায় হোক“, তিনিও ধৈর্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছিলেন আর কি!
কথাটা তারকের বুকে বেজেছিল নিয্যস। নইলে সে উঠে পড়ে লেগে বন্ধুবান্ধব, ইন্টারনেট, গুগল, পুরোনো নিউজ পেপার আর্কাইভস মায় ন্যাশনাল লাইব্রেরি অবধি ঘেঁটে কালিম্পং এর এই ছোট্ট “পুতুলবাড়ি মানসিক আরোগ্যনিকেতন” এর খোঁজ আনবে কেন?
চলেই যাবে সে যতদূরে সম্ভব, এই হতচ্ছাড়া পরিবারের সঙ্গে আর কোনও সম্পর্ক সে রাখবে না। সত্যিকারের পাগলই হয়ে যাবে সে। খুবই অভিমানভরে ট্রেনে চেপে বসার সময় নিশ্চয়ই এই কথাটাই ভেবেছিল তারক।
জায়গাটা চমৎকার, বাড়ির সামনে ব্যাগ নামিয়েই সেটা স্বীকার করে তারক মণ্ডল। পাহাড়ি রাস্তা ছেড়ে অনেকটা উঠে এসে বিলকুল নির্জন জায়গায় এই কাঠের বাড়িটা। শিলিগুড়ি থেকে তো গাড়িওয়ালা আসতেই চাইছিল না জায়গাটার নামই শোনেনি বলে।
যাইহোক, অনেক কষ্টে, গুগল ম্যাপ সার্চ করে সেই কোন মোড়ে গাড়ি থামিয়ে, সুঁড়িপথ বেয়ে তারকবাবু তো সেই বিকেলে এসে হাজির, অতঃকিম?
বাড়িটার সামনে বাগান, বাগানের সামনে গেট। গেটের বাইরে একটা শ্বেতফলকে বাড়ির নাম লেখা আছে বটে, তবে কিনা শ্যাওলা আর বুনো ঝোপে ঢাকা সে নাম পড়ে কার সাধ্যি?
সাবধানে সেই বুনো ঝোপ সরায় সে, শ্যাওলা খসিয়ে বিকেলের পড়ন্ত আলোয় বাড়ির নামটা পড়ে।
“পুতুলবাড়ি“, বিড়বিড় করে আওড়াতে আওড়াতে গেটটা ঠেলে ঢোকে তারক। মোরাম বিছানো রাস্তায় তার জুতোর খচমচ আওয়াজ ওঠে। পাশে বাগান, যদিও অযত্নটা স্পষ্ট বোঝা যায়।
বারান্দায় উঠতেই এক বয়স্ক ভদ্রলোক এগিয়ে আসেন সপ্রশ্নচোখে। তারক একটু গলাটা পরিষ্কার করে নেয়, “ইয়ে, এটাই পুতুলবাড়ি মানসিক ইয়ে তো?”
ভদ্রলোক ঘাড় নাড়েন, ঘড়ঘড়ে গলায় বলেন, “ভর্তির পেপার টেপার সব আছে তো? কোন ডাক্তারের রেকমেন্ডশন? পেশেন্ট কই?”
তারক একটু লাজুক ভঙ্গিতেই বলে, “ইয়ে, আমিই পেশেন্ট।“
বৃদ্ধ লোকটি খানিকক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে থাকেন। বোধহয় ওর জিন্দেগীতে এমন পেশেন্ট দেখেন নি যে একাই পাগলা গারদে ভর্তি হতে এসেছে। তাই যদি পারবে তাহলে সে পাগল কি করে হয়? আর যদি সে পাগলই হয় তো একা একা আসে কি করে?
এসব ঝামেলাপূর্ণ ব্যাপার বুঝে ওঠার আগেই তারক কলকাতা থেকে আনা ডাক্তারবাবুর প্রেস্ক্রিপশন, রেকমেন্ডশন ইত্যাদি তুলে দেয় ভদ্রলোকের হাতে। তারপর বেশ গদগদ হয়ে বলে, “দেখুন, একটু তাড়াহুড়োর মধ্যে পাগল হতে হয়েছে তো, ঠিকমতন বুকিং অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে আসতে পারিনি, আশাকরি তাতে খুব একটা অসুবিধা হবে না। একটা বেড তো পাবই, কি বলেন কাকু?”
ভদ্রলোক কিসে ঘায়েল হলেন, কাকু ডাকে, নাকি তাড়াহুড়োতে পাগল হতে হয়েছে শুনে সেটা বলা মুশকিল। শুধু দেখা গেলো সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময় বৃদ্ধ লোকটির কাঁধে বেশ আন্তরিকভাবে হাত দিয়ে তারক জিজ্ঞেস করছে “ইয়ে, কাকু, বলছি বেডের গদিটা যেন একটু নরম হয় দেখবেন, আর ইয়ে সকালে ব্রেকফাস্টে কি আপনারা অমলেট দেন? নাকি ডিমসিদ্ধ? আমার অবশ্য পোচই পছন্দ। তা সে যাহোক করে নাহয় অ্যাডজাস্ট করে নেবো .. তবে কাকু গরম জলের ব্যবস্থাটা কিন্তু না দেখলে চলবে না, এই বলে রাখলুম হ্যাঁ……।“
কাকু নামের মহিমাতেই কিনা বোঝা দুষ্কর, ঘরটা বেশ পছন্দ হয়ে গেলো তারকের। একটাই বিছানা ঘরে, আর কিচ্ছু নেই। বেডটা ওই হাসপাতালের বেডের মতই আর কি। তবে যেটা দেখে তারক সামান্য ঘাবড়ে গেসলো সেটা হচ্ছে বিছানার চারকোণে চারটে শিকল লাগানোর আংটার উপস্থিতি। তবে ভালো ব্যাপার এই যে বেডটা রাস্তার পাশেই। দিনেরবেলা রাস্তাঘাট, সিনারি, মানুষ ইত্যাদি দেখতে দেখতে বেশ কেটে যাবে। ভীষণ খুশি হলো তাপস। চমৎকার পাহাড়ি সিনসিনারি, একলাঘর। কয়েকমাস আরামসেই কেটে যাবে।
তারপর?
তারপর যে তারকের বাবা মা এসে কান্নাকাটি করে তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাইবেন, সে কি আর তারক জানে না? ইনফ্যাক্ট সেই “বাবা, বাড়ি ফিরে চল” আর্তির উত্তরে সে কি রকম ন্যাড়া মাথায় ধ্যানী বুদ্ধ টাইপ নিরাসক্তির দৃষ্টিক্ষেপণ করবে, সেই পরমকারুণিক ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিটা অবধি সে ট্রেনে আসতে আসতে প্র্যাকটিস করেছে।
খানিকক্ষণ বাদেই ঝুপ করে সন্ধ্যে নেমে এলো এই পাহাড়ি অঞ্চলে। তারক আফশোস করলো, ইশ, জানালার বাইরেটা আজ আর দেখা হলো না। যাকগে যাক, কাল সকালেই না হয় প্রসন্ন প্রভাতে … ইত্যাদি ভেবে টেবে তারক সুইচ বোর্ড খুঁজতে লাগলো এবং ..
যাহ, ঘরে কোথাও একটা স্যুইচবোর্ড নেই, অ্যাঁ? দেওয়ালে নেই, খাটের পাশে নেই, কোনও কোণে নেই …
আস্তে আস্তে ‘নেই‘ ব্যাপারটা আরও হৃদয়ঙ্গম হতে লাগলো তারকের, বাল্বের হোল্ডার নেই, সিলিং ফ্যান নেই, ইনফ্যাক্ট ইলেক্ট্রিকতারের লাইনই নেই!
খানিকক্ষণ ভুতুম হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো তারক, ইকি ব্যবহার অ্যাঁ? সারারাত্তির কি এই বন্ধ ঘরে অন্ধ হয়েই থাকতে হবে না কি?
নাহ, কাল সকালেই এই নিয়ে একটা বিহিত করতেই হবে। ভেবে টেবে তারক নিজের ব্যাগ খোলা শুরু করে। শেভিংকিট নামিয়েই মনে পড়ে যাচ্চলে, একটা অ্যাটাচড্ টয়লেট অবধি নেই যে!
যাক গে যাক, মাসখানেকের তো মামলা। ঝামেলা হুজ্জোত কম বলেই না এমন নির্জন ছোটখাটো ‘মানসিক আরোগ্যালয়‘ চেয়েছিলোও? টক করে আসবে, ফট করে চলে যাবে, মাঝখানে বাপ মা ও টাইট, এটাই তো উদ্দেশ্য ছিল নাকি? এও এক ধরণের স্বেচ্ছা নির্বাসনই তো প্রায়। সেই কোন জমানার কোন মেডিক্যাল জার্নাল খুলেই না সে এই আরোগ্যালয়ের খোঁজ পেয়েছে। ঝুটঝামেলা কম, লোকালয় থেকে দূরে এমন জায়গাই তো সে চেয়েছিলো, নয় কি?
এমন সময়ে পেছনে কিছু আওয়াজ শুনেই ঘুরে দাঁড়ালো তারক, আর ভারি প্রসন্ন হলো। দরজায় দাঁড়িয়ে সেই বৃদ্ধ ভদ্রলোক, নাম নবকৃষ্ণ দাঁ, শর্টে নবদা, হাতে একটি বিশাল সাইজের মোমবাতি। আর তার পিছনে পিছনে জনাচারেক লোক।
অতিথিদের আগমনে প্রথমে ভারি খুশিই হয়েছিল তারক, এখানকারই বাসিন্দা হবে, আলাপ করতে এসেছে নিশ্চয়ই। বাহ, বাহ সন্ধ্যেটা তাহলে আর একলা কাটাতে হবেনা নিশ্চয়ই।
তারপরেই কথাটা মাথায় খেলে যেতে সঙ্গে সঙ্গে সতর্ক হয়ে গেলো সে।
তারক কোনও হোটেল, গেস্টহাউস, হোস্টেল বা ডর্মিটরিতে আসেনি, এসেছে একটি মানসিক আরোগ্যাগারে, সংক্ষেপে বলতে গেলে একটি ক্ষুদ্র সাইজের পাগলাগারদে! এখানে দলবেঁধে নতুন অতিথিকে দেখতে আসাটা শুধু অস্বাভাবিকই নয়, তারকের পক্ষে বিপজ্জনকও বটে!
তারক খুবই সন্তর্পণে যাবতীয় দ্রব্যাদি স্যুটকেসে ঢুকিয়ে দেয়, তারপর স্যুটকেসের ডালা বন্ধ করে। বিশ্বাস কি এদের? হয়তো তারকের টুথপেস্ট নিয়ে তারকেরই বডিতে যামিনী রায়ের পেইন্টিং প্র্যাক্টিস করতে বসলো, চিরুনি আর রেজর নিয়ে পলাশীর যুদ্ধ যুদ্ধ খেললেই বা আটকাচ্ছে কে? আর টুথব্রাশ নিয়ে যদি কমোড পরিষ্কার করতে শুরু করে, সেটাই কি তারক খুব খুশি মনে মেনে নেবে?
স্যুটকেসটা বিছানার নিচে চালান করতে করতেই নবদা বাকি চারজনকে নিয়ে ঘিরে ধরেন তারককে, “এঁয়ারা এলেন আলাপ করতে আপনার সঙ্গে,” (যেন পাগলা গারদে সেটা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা), “আমি অবিশ্যি কয়েছিলুম এঁয়াদের যে মণ্ডলবাবু আজই এয়েছেন, ডিস্টাব করাটা ঠিক হবে না বোধহয়, কিন্তু ভারি জোরাজুরি করতে লাগলেন কিনা, তাই…”
“আহ্ লবদা, বেশী বাজে কথা বলো তুমি ” বলে একমুখ দাড়ি ও হাসি নিয়ে একজন এগিয়ে এলেন, “আমার লাম লকুড় লন্দী। অ্যাগদম আদ্দিকালের ইয়ে, হেঁ, হেঁ আলাপ করে ভারি খুশি হলুম।” স্তম্ভিতভাবে হাত তুলে নমস্কার করে তারক, এত গুছিয়ে যে নিজের পরিচয় দেয় সে পাগলাগারদে কি করছে?
পরেরজন ছোটখাটো সাইজের টাকমাথা ভদ্রলোক এগিয়ে আসেন, গম্ভীরস্বরে বলেন “আমি জগদিন্দ্র নারায়ণ সিংহ রায়চৌধুরী, কোতুলপুরের রাজপরিবারের ছেলে। আমাকে কুমারবাহাদুর বললেই …”, এতটা বলতেই পেছন থেকে খ্যাঁকখ্যাঁক করে হাসি ভেসে আসে, “আর লোক হাসিও না মাইরি জগুদা, তুমিও মাইরি এই কুমারবাহাদুরির বাইরে বেরোতেই পারলে না, তালপুকুরে ঘটি ডোবে না, আবার.. ” বলতে বলতে লম্বা কালো মতন এক কুর্তা পাজামা পড়া ভদ্রলোক এগিয়ে আসেন, “আসসালাম ওয়ালেকুম বললে তো আবার রাগটাগ করতে পারেন, নমস্কার করতে আবার আমার একটু আপত্তি আছে, ইয়ে, কমরেড চলবে?”
হাঁ হয়ে তাকিয়েছিল তারক, সেদিকে একঝলক দেখে ভদ্রলোক ঝটিতি যোগ করেন, “তাহলে বেরাদরটাই থাক, আমার নাম শহিদুর রহমান। বেশিদিন আসিনি এইখানে, তাও হয়ে গেলো প্রায় …..”
এইবার শেষ ব্যক্তিটি দেখা দেন, “রাধামাধব, রাধামাধব, তোরা সর দেখি বাবা, আমাকে কিছু কইতে দে। হরেকৃষ্ণ, আমার নাম গোপালচন্দ্র গোস্বামী, বাবাজীবনের নাম তো শুনলুম তারক। আহা, মহাদেবের নাম, শুনলেও পুণ্যি, হরেকৃষ্ণ” বলে কপালে হাত ঠেকান।
তারক এত অবাক, স্তম্ভিত এবং বিস্মিত জীবনে হয়নি। এত সুস্থ মাথায় যারা নিজেদের পরিচয় দেয় তারা কি সত্যিই পাগল?
নাকি এদের পাগলামি আরও অনেক উঁচু লেভেলের কিছু?
ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে অবশ্য ব্যাপারটা বেশ মাখোমাখো হয়ে আসে। কার কোথায় বাড়ি, বাড়িতে কে কে আছেন, কার কাজকম্ম কি সেসবও জানা হয়ে যায়। তারকতো রীতিমতো ফুরফুরে মেজাজে উড়তে থাকে। আহা, কি চমৎকার লোকজন সব। যেমন হাসিখুশি ব্যবহার, তেমনই জমাটি আড্ডা। এদের সঙ্গে থাকতে হবে ভেবেই বেশ প্রসন্ন হয়ে আসে তারকের মেজাজটা।
তবুও একটা প্রশ্ন তারককে কুরেকুরে খাচ্ছিলো অনেক্ষণ থেকে। আড্ডা প্রায় শেষের পথে, মুড়িমাখাও শেষ, মোমবাতির শেষ হয়ে আসা আলোয় সবাইকে বেশ মায়াবী দেখাচ্ছে, এমন সময় তারক প্রশ্নটা করেই বসলো,
“ইয়ে, বলছিলাম কি, যদি কিছু মনে না করেন, ইয়ে, মানে আপনারা সবাই কি করে, মানে এখানে এলেন যদি একটু বলেন।“
খানিকক্ষণ সবাই চুপ। মোমবাতির আলোয় তখন সবার মুখে আলোআঁধারি খেলছে।
প্রথমে মুখ খোলেন কুমারবাহাদুর, মৃদু গম্ভীর স্বরে বলতে থাকেন,
“আমাদের জমিদারি ছিল কোতুলপুরে। তখন উত্তাল সময়, চারিদিকে আন্দোলন হচ্ছে খুব। জমিদারি প্রথা প্রায় উচ্ছেদ হয় আর কি। খাজনা আদায় হয় না বললেই চলে। এমন সময় বাবা দেহ রাখলেন। আমি বড়ো ছেলে, ন্যায়ত আমারই জমিদারি পাওয়ার কথা। কিন্তু বাধ সাধলেন আমার সৎমা। তিনি ছিলেন খুবই উচ্চাকাঙ্ক্ষী মহিলা। তিনি তাঁর ছেলেকে, মানে আমার সৎভাইকে জমিদারি দেওয়ার জন্যে একদিন আমার খাবার সরবতে ধুতরোর বিষ মিশিয়ে দেন, ব্যাস…..”, দীর্ঘশ্বাস পড়ে ভদ্রলোকের।
“জগুদার মাইরি বড়ো বড়ো রাজবাড়ির ব্যাপার। আমার হেবি সিম্পল। ট্রামের ড্রাইভার ছিলাম, বুঝলেন? অনেকদিন ধরে এদিক ওদিক গোলমাল পাকানো হচ্ছিলো বটে শুনছিলাম, পাত্তা দিই নি। তা সেটা অগাস্ট মাসের মাঝামাঝি হবে, ট্রামগুমটিতে বসে আড্ডা মারছি, হঠাৎ দেখি শালা বিশাল দাঙ্গা। এ দৌড়চ্ছে, সে মারছে, ও কাটছে। কতগুলো হারামজাদাকে দেখি একটা মেয়েদের হোস্টেলের দিকে ছুটছে। মতলবতো বোঝাই যাচ্ছে। তা, আমি, মনোহর, বিশুদা, লখিয়া আর ট্রাম কোম্পানির আরও কয়েকজন হইহই করে ছুটে গেলাম। দুয়েকজন পাবলিকও আমাদের সাইড নিয়ে নিলো। ব্যস, হারামিগুলোকে শালা টাইট দিয়েই দিয়েছিলাম, দুম করে কোন্ হারামি যে মাথার পেছনে রড বসিয়ে দিলো…. “
কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর গোপাল গোঁসাই গলা ঝেড়ে বলতে শুরু করে, “বলতে লজ্জাই করে ভাইটি। নেহাত নিজেদের মধ্যে বলেই, হেঁহেঁ … একটি সেবাদাসীর সঙ্গে (সমস্বরে হুইসল ধ্বনি), ওই আর কি, সামান্য একটু… তেমন কিছু নয় … তো সে মাগী ভয়ে গলায় দড়ি দেবে কে জানতো? আরে পেট খসাবার দু দশটা উপায় কি আর জান না তুমি? আর তারপর আমাকে সবার সামনে বেঁধে কি মার। কাপড় খুলে, জলবিছুটি পাতা দিয়ে … আচ্ছা তোমরাই বলো, দেখছো তো নরমসরম শরীর আমার..” ফোঁপাতে ফোঁপাতে নাকটা ফোঁৎ করে মুছে নেন মোহন্ত, “অত কষ্ট কি সয়? সে এলোকেশী শয়তানি নিজেও ডুবলো আর আমাকেও …” প্রায় হাহাকারই করতে থাকেন তিনি।
নকুড় নন্দী বেচারি মুখ বুজেই ছিল, এবার তার পালা আসতেই খুবই লজ্জা সংকোচের সঙ্গে বলে, “তেমল কিচু লয়। পাট্টির হয়ে পেটো বাদতাম তো অ্যাগদিন পুলিশ এসে ধরে লিয়ে যাবে বলে এলো, রাতের বেলা ময়দানে ছেড়ে দিয়ে বললো ‘যা, পালা‘, তাপ্পর দুটো পেটো আমার মাতায় চার্জ করে চলে গেলো, হে হে হে“।
একটু খটকা লাগে তারকের। পিঠে খেলে পেটে সয়না শুনেছে সে। পেটো খেলেও কি মাথায় সয়?
নবদা এবারে একটু গলা খাঁকারি দেন, “এবার তোমার কথাটা যে বলতে হচ্ছে বাবাজীবন।“
ফিক্ করে হেসে ফেলে তারক, “সে তেমন কিছু নয়“, একটু লজ্জিতই দেখায় তাকে, “আমি ভূত দেখতে পাই“।
বাকিরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকে, তারপর নানা প্রশ্ন উঠে আসতে থাকে, “পরীক্ষায় ফেল নয়?”, “মেয়েছেলে ঘটিত নয় বলছো বাবা?”, “বিষ নয়? চোটও লাগেনি?”, “জড়ভরত যেন ও সে তো দেখতেই পাচ্ছি, বলি শেয়ানা পাগল নও তো বাপু?”
তারক অবাকই হয়, “যাত্তারা। বলি ভূত দেখাটা কি পাগলের লক্ষণ নয়?”
তারা আরও অবাক হন, “একদমই না। পাগলের লক্ষণ কেন হতে যাবে? তুমিও তো ভূত দেখতে পাও, তুমি কি পাগল?”
তারকের এবার সত্যিই গুলিয়ে যায়। মানে? এরাও ভূত দেখতে পায়না কি? ভাবনাটা মনেই চেপে সে হাসিমুখে বলে, “দ্যুৎ। ভূত বলে কিছু হয় নাকি? আমি কোনদিনই ভূতফুত কিছু দেখিনি, দেখতামও না। বানিয়ে বানিয়ে এমন সব গল্প বলতাম না লোকের নাড়ি ছেড়ে যেত। হে হে, কোনও ইয়ে পাঙ্গা নিতে আসতো না। ভূতেরা না থেকেই আমার যা উপকার করেছে না, একবার একপিস দেখতে পেলে পেন্নাম ঠুকতাম মশাই।“
“তা বটে। ভূত কিন্তু খুবই উপকারী, এ নিয়ে সন্দেহের কারণই নেই “, কার গলা বোঝা যায় না।
“আপনারা কি কেউ ভূত দেখেছেন?” সন্তর্পণে প্রশ্নটা হাওয়ায় ভাসিয়ে দেয় তারক।
“না দেখার কি আছে? চোখ খুলে দেখলেই হলো” খুবই আশ্চর্যের গলায় বলেন গোবিন্দ গোঁসাই, “কি হে লাটসাহেব, বলো কিছু“, বলে কনুই দিয়ে ঠেলা দেন শহিদুরকে। “আহ, মেলা খোঁচাবেন না মাইরি“, খ্যাঁক করে ওঠেন শহিদুর, তারপর তারককে বলে “আরে ভাই ভূত না দেখার কি আছে? কালিম্পং এ মেলা গিজগিজ করছে ভূত, দেখলেই হলো। বলো তো কালই দেখাতে পারি“।
গলাটা শুকিয়ে আসে তারকের। তারপরই একটা কথা বিদ্যুচ্চমকের মতন তার মনে পড়ে যায়, কথাটা শোনার পর থেকেই একটা অস্বস্তি হচ্ছিলো বটে।
“আ, আপনি কবে দাঙ্গা থামাতে গিয়ে মাথায় বাড়ি খেলেন বলুন তো? বিরানব্বইয়ের দাঙ্গা নাকি? সে তো ডিসেম্বরে শুরু হয়, অগাস্টে তো নয়!”
“বিরানব্বই?” মোমবাতির আলোয় কুঁচকোনো শহিদুরের ভ্রু অস্বাভাবিক দেখায়, “নাহে, আঠেরোশো বিরানব্বইতে তো সবে পয়দা হয়েছি। ছেচল্লিশের কথা বলছি হে, উনিশশো ছেচল্লিশ, ষোলই আগস্ট“।
কথাটা নিয্যস বাংলাই, কিন্তু প্রথমে বোধগম্য হয়নি তারকের। খানিকক্ষণ পরে ব্যপারটা মাথায় ঢোকে।
ও হরি, তাই বলো, এই তাহলে এদের রোগ!!!
তাই এদের কথা শুনে প্রথমে পাগল বলে বোঝাই যায় না! এইবার বেশ সহজ হয়ে আসে সে এবং স্বাভাবিক ফিচেল স্বভাব তারক গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে, “হেঁ হেঁ, তা কুমারবাহাদুরও নিশ্চয়ই আন্দোলন বলতে কমিউনিস্ট পার্টির আন্দোলনের কথাই বলছিলেন। বলি, লিডারদের সঙ্গে একটু সেটিং করতে পারলেন না?”
“কমিউনিস্ট পার্টি?” ভ্রু কুঁচকে চিন্তা করতে থাকেন তিনি, “কই নাতো, কৃষক–প্রজাপার্টি বলেই তো জানতুম, তারা আবার কমিউনিস্ট হলো কবে থেকে?” ভাবিতই দেখায় কুমারবাহাদুরকে।
নাহ, এতক্ষণে গন্ডগোলটা বুঝেছেসে। যাকগে যাক। লোকগুলোর জন্যে মায়াই হতে থাকে তার। নকুড় নন্দী বোধহয় সত্তরের দশকেই আটকে আছে এখনও। আর মোহন্ত গোঁসাইয়ের এই এলোকেশী নামের সেবাদাসী নিয়েও এরকম একটা কেচ্ছা সে কোথায় পড়েছিল না?
খুব গভীরভাবেই ভাবার চেষ্টা করছিলো তারক, এমন সময় নবদা‘র খুকখুক কাশির শব্দে ফিরে আসে সে, “ইয়ে, একটা কিন্তু আলাদা কথা ছিল মণ্ডলবাবু, বলতে লজ্জা করছে খুবই। কিন্তু আপনি পাশটাশ দেবেন, বুদ্ধিমান লোক, তার ওপর ইয়াং ব্লাড, আশা করি কিছু মনে করবেন না। তাই সাহস করে বলেই ফেলছি, অপরাধ নেবেন না, কথাটা এই যে, দেয়ালে কিন্তু আপনার ছায়া পড়ছে।“
এই অত্যন্ত বোকাবোকা কথায় খুবই বিরক্ত হয় তারক। মোমবাতির আলোয় দেওয়ালে ছায়া পড়বে না তো কি ইলেকশনের পোস্টার পড়বে?
খুবই বিরক্ত হয়ে মাথা ঘুরিয়ে সে নিজের ছায়াটা দেখে নেয় একবার। তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে সবার দিকে তাকিয়ে স্থির হয়ে যায় সে।
উল্টোদিকের দেওয়ালে কারোরই ছায়া পড়ছে না!
হঠাৎ তারকের চারিদিক আরও অন্ধকার ও শীতল হয়ে আসে। প্রাচীন আরোগ্যনিকেতনের সেই প্রাচীন ঘরটির মধ্যে যেন উড়তে থাকে কিছু চাপা কান্না, হাওয়ার ঘূর্ণির মতন পাক খেয়ে ওঠে চাবুকের শব্দও আর্তনাদের আওয়াজ। সিলিং থেকে কালোছায়ার মতন নেমে আসতে থাকে সমবেত মরণান্তিক হাহাকার আর পাগলের মতন শিকল ঝনঝনানোর আওয়াজ।
স্তম্ভিত ও আতঙ্কিত তারকের দিকে তাকিয়ে কুমারবাহাদুর ফিসফিস করে বলেন, “তুমি জানতে না, তাইনা? পুতুলবাড়ি ক্লাবে স্বাগত বন্ধু“, বলে একটা প্রাচীন খবরের কাগজ ছুঁড়ে দেন তার দিকে।
থপ করে কাগজটা তারকের সামনে পড়ে, যন্ত্রচালিতের মতন তারকের ঘাড়টা নিচু হয়ে যায়।
কাগজের নামটা তারকের অবশ চৈতন্যের মধ্যেও গ্রথিত হয়ে গেলো, ‘অমৃতবাজার‘, আর খবরের প্রত্যেকটা অক্ষর যেন আগুন আখর হয়ে তারকের চোখ জ্বালিয়ে দিতে থাকে, “কালিম্পং শহরের প্রাচীনতম মানসিক আরোগ্যনিকেতন “পুতুলবাড়ি” ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে সম্পূর্ণভাবে ভস্মীকৃত। সমস্ত অসহায় হতভাগ্য আবাসিকবৃন্দ শিকল দ্বারা বদ্ধ থাকিবার নিমিত্ত করাল মৃত্যুগ্রাসে পতিত।“
তারিখটাও চোখ এড়ালো না তারকের “১৪ই এপ্রিল, ১৯৫০“!
তারপর মোমবাতিটা হঠাৎ নিভে গিয়ে গাঢ় অন্ধকার নেমে আসে চারিদিকে।
কিছুক্ষণ পরেই সেই হিমশীতল অন্ধকার সমুদ্র মন্থন করে যেন অনেকদূর থেকে পাতালের যাবতীয় গাঢ় অমানিশা ভেদ করে তারকের ঠাণ্ডা গলা ভেসে আসে,
“ধন্যবাদ।“
দারুন লাগলো!
Besh bhalo laglo
অনবদ্য। দারুন হয়েছে। বিশেষ করে শেষ লাইনটা সত্যজিৎ রায়ের ক্যম্পু মনে পড়িয়ে দিল – “মৃত্যুর পরের অবস্থা আমি জানি”.
দারুণ লেখা।